Md Saifuddin, হ্যাঁ, লেখার শুরুতেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এসেছে। এটা না হলেই ভালো হতো বোধকরি। আপনি ঠিকই ধরেছেন, বাস্তবতাবাদই সবচেয়ে বড় ‘বাদ’। বাস্তব বিবেচনাবোধ ছাড়া কোনো তত্ত্ব বা কর্মপন্থা সঠিক হতে পারে না। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় বাস্তবতার সাথে সাথে আমাদের মনোজাগতিক ও জৈবিক বাস্তবতা, এগুলো বাদ রেখে বা অগ্রাহ্য করে বা এগুলোর ভুল মূল্যায়ন করে যারা একপাশ থেকে বা মাঝখান হতে কিছু একটা করার চেষ্টা করেন, তাদের সেই চেষ্টা দিনশেষে ব্যর্থ হবে। বরং ক্ষতিকর হিসেবে ব্যাকফায়ার করতে বাধ্য।

বাস্তবতাকে বোঝার জন্য সব সময়ে যে আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং বাস্তবতাকে বোঝার জন্য দরকার সুস্থ কাণ্ডজ্ঞান বা প্রপার আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ইসলামপন্থীরা নিজেদেরকে জড়িয়েছে বামপন্থীদের পাতানো ফাঁদে। বামপন্থীরা রোকেয়ার দৃশ্যত ইসলামবিরোধী বক্তব্যগুলোকে সামনে এনে, সাধারণভাবে ধর্মের সমালোচমূলক লেখাগুলোকে এর পিছনে সেট করে। টোটালি সিন-আউট করে দেয় ইসলামের পক্ষে সুস্পষ্ট ও জোরোলোভাবে লেখা তাঁর লেখাগুলোকে। এভাবে তাদের সংজ্ঞানুসারে একজন প্রগতিশীল রোকেয়ার ছবি তারা আঁকে। এটাকেই তারা মার্কেটিং করে। আমি চাচ্ছি, বেগম রোকেয়া সম্পর্কে এই মানসপটটাকে চেঞ্জ করে দিতে।

আপনি আমার লেখার এই অংশটুকু নিয়ে আপত্তি করেছেন, ‍“একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে নারীবাদ হলো পাশ্চাত্য প্যরাডাইমের প্রোডাক্ট। পুরুষতন্ত্র হলো প্রাচ্য-প্যরাডাইমের পক্ষ থেকে পাশ্চাত্য নারীবাদের ব্যাপারে বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়া।”

হ্যাঁ, আপনার এই আপত্তির সাথে আমি ওভারঅল একমত। আমার লেখাটাতে ‘পুরুষতন্ত্র’ ও ‘নারীবাদ’ এর মতো ব্যাখ্যাসাপেক্ষ কথাগুলো বার বার এসছে। এগুলো দিয়ে আমি আসলে কী বুঝাচ্ছি তার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দিতে গেলে লেখাটা বড় হয়ে যেতো। তাই পুরুষতন্ত্রের আগে ‘নিবর্তনমূলক’ আর নারীবাদের আগে ‘উগ্র’ শব্দটি বসিয়ে আমি কিছুটা ক্লারিফাই করার চেষ্টা করেছি। তাতে করে যে সবকিছু ক্লিয়ার হয়েছে, এমন নয়। যে কারণে আপনি আপত্তি করলেন।

ফেমিনিজমের থার্ড ওয়েভকে আমি ‘উগ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। আর, পুরুষতন্ত্রের সাথে পিতৃতন্ত্রের যে পার্থক্য, সেটা নিয়েও একটুখানি বলেছি। পেট্রিয়ার্কি শব্দটিকে চরম নেতিবাচক অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা হলো পাশ্চাত্য নারীবাদী ধ্যানধারণার একদেশদর্শীতার প্রমাণ।

পেট্রিয়ার্কি, মিনিং পুরুষতন্ত্র, এটাকে আমরা নেতিবাচক অর্থে নিতে পারি। কিন্তু, পেট্রিয়ার্কি, মিনিং পিতৃতন্ত্র, এটাকে বাদ দিলে তো সভ্যতা অচল হয়ে পড়ে। পিতৃতন্ত্রকে বাদ দিলে এর বিকল্প হিসেবে মাতৃতন্ত্রকে নিতে হয়। যে কারণে পিতৃতন্ত্র খারাপ, একই কারণে মাতৃতন্ত্রও তো খারাপ হওয়ার কথা। সেটা নিয়ে তাদের বক্তব্য কী?

কোনো কোনো নারীবাদী বলার চেষ্টা করে, নারীরা যেহেতু কোমল, তাই পুরুষের পরিবর্তে নারীদেরকে লিডারশীপে দিলে পৃথিবীতে হানাহানি কমবে। এটা হলো শিশুসুলভ কথা। তাই এটা নিয়ে আপতত কথা আর না বলি। বাকী থাকলো, নারী-পুরুষের যৌথ নেতৃত্বের কথা। পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় যে সমানাধিকারের কথা বলা হয়, তা এই এসাম্পশানের ওপরে প্রতিষ্ঠিত।

বাস্তবতা হলো, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষের যৌথ নেতৃত্বের এই ধারণা অকার্যকর, অবাস্তব ও ভুল। নেতৃত্ব মাত্রই এককেন্দ্রিক, যদি তা হতে হয় শক্তিশালী নেতৃত্ব। যৌথ নেতৃত্ব আর পরামর্শ ব্যবস্থা, দুইটা ভিন্ন জিনিস। অতএব, সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো, পরিবার যদি হয় একটা (ক্ষুদ্রতম বা প্রাথমিক) প্রতিষ্ঠান, তাহলে সেটার জন্যও থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট একক নেতৃত্ব ব্যবস্থা। এতে অফেনডেড বা অপ্রেসড ফিল করার কিছু নাই। অকারণে তেমন কেউ ফিল করলে সেটি হবে তার হীনমন্যতা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নেতৃত্ব যে সব সময়ে পুরুষই হবে, এমন নয়। ক্ষেত্রবিশেষে নারীও হতে পারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান।

Ahmad Musaffa’র লেখা হতে আমি যে অংশ কোট করেছি তার প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন, “এটাতে একটা আরোপিত নারী পুরুষের পার্থক্য দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা কি লক্ষ্যণীয় নয়?” এ ব্যাপারে আমার কথা হলো, নারী-পুরুষের পার্থক্য করাকে পশ্চিমা বিশ্বে ‘জেন্ডার বাইনারি’; এবং এটাকে নেগেটিভ অর্থে বলা হয়। অর্থাৎ জেন্ডার বাইনারি মাত্রই তাদের দৃষ্টিতে ডিসক্রিমিনেশান। অথচ, নারী-পুরুষের মধ্যে যে জৈবিক পার্থক্য আছে সেটার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র জেন্ডার রোলকে অস্বীকার করা হলো বাস্তবতাকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা। নারী পুরুষের মধ্যকার সত্যিকার পার্থক্য আর ‘আরোপিত পার্থক্য’ নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা যেন তালগোল পাকিয়ে না ফেলি।

নারী পুরুষের বিশেষায়িত ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে তাদের মধ্যকার জৈবিক পার্থক্যকে যখন হাইলাইট করা হয় তখন নারীবাদীরা হা হা করে উঠে। তাদের ভাবখানা এমন, যেন ওসব নিছক লিঙ্গের গঠনগত পার্থক্য। তাদের দৃষ্টিতে এটা খুব একটা ম্যাটার করে না। এরা বিবর্তনবাদের পক্ষে জোরেশোরে বলে। অথচ, লক্ষ-হাজার বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়াতে নারী-পুরুষের যে জেন্ডার রোল, সেটাকে তারা কার্যত রি-ডিফাইন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের স্পেসিফাইড জেন্ডার রোলমাত্রই আরোপিত বা সোশ্যাল কনস্ট্রাকশান। কী আশ্চর্য …!

আপনি বলেছেন, ‍“বরং আমি দেখি, ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে এই পশ্চিমগামিতা আর পূর্বগামিতার লক্ষণ সমানভাবে বিরাজমান। বরং, বড় প্রশ্ন আসবে, পশ্চিমগামীতার অভিযোগ কেন শুধু পুরুষরাই করে থাকেন? নারীরা কেন পুরুষদের পশ্চিমগামীতাগুলোর ব্যপারে আওয়াজ তোলেন না?”

হ্যাঁ, আমারও প্রশ্ন, “নারীরা কেন পুরুষদের পশ্চিমগামীতাগুলোর ব্যপারে আওয়াজ তোলেন না?” আমার ধারণায়, তারা যদি তা করে তাহলে তাদের নিজেদের আচরিত ‘গাছের তলারটাও খাবো, আগারটাও খাবো’ টাইপের সুবিধাবাদিতার সুযোগ আর থাকে না।

আপনি বলেছেন, আপনি “হালের ইসলামী নারীবাদীদের ব্যাপারে হতাশ। আমি তো, এই ‌‘নারীবাদী’দের মধ্যে কোনো ধরনের নারীবাদ দেখতেই ব্যর্থ হই।”

না, আমি আপনার মতো অতটা হতাশ নই। বরং তাদেরকে গাইড করতে হবে। নারী অধিকারের এত এত ডামাঢোলের আড়ালে যে প্যারাডিগমেটিক কনফ্লিক্ট, তা দেখিয়ে দিতে হবে। এই যে ‘দেখিয়ে দিতে হবে’ বললাম, এটাতেও আল্ট্রা ফেমিনিস্টরা আপত্তি করবে। বলবে, ‘দেখিয়ে দিতে হবে কেন? নারীরা কি কম বুঝে?’

(অতি নারীবাদীদের বলছি) হ্যাঁ, নারীরা কম বুঝে; অর্থাৎ তত্ত্বের গভীরে যেতে সাধারণত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। মানব সভ্যতার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস তাই বলে। দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস তাই বলে। ‘সোশ্যাল কন্স্ট্রাকশান’ নিয়ে ভুলভাল কথা বলে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না।

Sumaya Tasnim, আপনি বলেছেন, “আমার অভিজ্ঞতায় বললে দেখি যে, পুরুষ কিন্তু তার পরিবারের নারীটিকে ‍“কিছুটা সুযোগ” দিতে আগ্রহী। কিন্তু পরিবারের দায়িত্বগুলো থেকে অব্যাহতি দিয়ে নয়। যদি সেগুলো পালন করে বাড়তি কিছু করা সম্ভব হয় তবেই।”

মনে করেন, পুরুষেরা নারীদেরকে ‘পুরোটা সুযোগ’ দিলো। তাতে করে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষদের যে জেন্ডার রোল আছে তা নারীরা নিজেদের পক্ষে অকুপাই করে ফেলতে পারবে? ‘পুরোটা সুযোগ’ বলতে যা যা আমাদের মাথায় আসতে পারে, ধরে নেন, তা সবই নারীদের জন্য নিশ্চিত করা হলো। এরপরে কী হবে? আপনার ধারণায় তারা কি একসময়ে পুরুষদের হটিয়ে সার্বিকভাবে নেতৃত্বের আসনে বসে যেতে পারবে?

জানি না, আপনার উত্তর কী হবে। ধরে নিলাম, আপনার উত্তর নেতিবাচক হবে। আপনি হয়তো বলতে চাইবেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। মানুষের ইতিহাস, প্রাণীজগতে জেন্ডার রোলের যে উদাহরণ, তা কি এই ‘সমতাভিত্তিক যৌথ নেতৃত্ব’ প্রকল্পকে সমর্থন করে?

আমার অভিজ্ঞতা তো এটাই বলে, আমার সারাজীবনে আমি এই এক্সপেরিমেন্ট করেছি, আমার অধীনস্থ নারীদেরকে আমি সম্ভাব্য ‘সবটুকু সুযোগ’ দিয়েছি। এ ধরনের স্বাধীন পরিস্থিতিতে দেখেছি, নারীরা নারীর যে ঐতিহাসিক জেন্ডার রোল, সেটাতেই ব্যাক করে। ফেমিনিনিটির মধ্যে নারীরা জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পায়। Equality in the opportunity, not in the outcome – এই নীতির সাথে আপনি একমত হবেন কিনা জানি না। তবে নারীপুরুষের সমতাকে আমি দেখি নৈতিক ও মানবিক জায়গা থেকে। আমি মনে করি সুযোগের সমতা থাকাটা জরুরী। কিন্তু আউটকামের অ-সমতা দেখে তা সমান করতে চাওয়াটা মানব-প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। পাশ্চাত্য সভ্যতা তা করতে চায়। আর হ্যাঁ, সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায্যতার নীতি অবলম্বনকে আমি পুরোপুরি সমর্থন করি।

মানুষ হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে সমান হওয়া, আর মানুষ হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্র ও পরিধি সমান হওয়া, দুইটা যে দুই জিনিস, তা খেয়াল রাখা দরকার।

বাইরের জগত সম্পর্কে নারীরা যথাযথভাবে সচেতন থাকবে, প্রয়োজনে স্বীয় যোগ্যতা ও জরুরত বিবেচনায় কোনো ভূমিকাপালন করবে, এটাই হলো বাস্তবসম্মত ও যুক্তিসম্মত উইমেন রোল ইন দ্যা সোসাইটি।

নারীদের কাছে নারীত্বকে খাটো করে তুলে ধরার মাধ্যমে, পুরুষকে নারীর জন্য স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে সমকালীন পাশ্চাত্য নারীবাদ দিনশেষে একটা পুরুষতান্ত্রিক প্রকল্প হিসেবে হাজির হয়, মনে করি, এই নিগূঢ় সত্যটাকে বুঝতে হবে ভালো করে।

‌‘নারীত্ব’কে দুর্বলতা হিসেবে দেখা বা দেখানো, এটা হলো ওয়েস্টার্ন ফেমিনিজমের দৃষ্টিভঙ্গী। এটা আমাদের এমনকি শিক্ষিত নারীদের মধ্যেও এত বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে যে এটি তাদের মধ্যে গভীর হীনমন্যতাবোধের জন্ম দিয়েছে। নারী-পুরুষের প্রকৃতিগত কোনো পার্থক্যের কথা বলতে গেলেই একপর্যায়ে তারা পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘এটা কি নারীদের দোষ?’ সংশ্লিষ্ট পার্থক্যের বিষয়টিকে যুক্তির খাতিরে স্বীকার করলেও তারা এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি। স্পেসিফিক জেন্ডার রোলের কথা বললেই তারা নিজেদেরকে আক্রান্ত ও বিপন্ন বা অবমূল্যায়িতবোধ করে। যার কারণে, কথায় ও আচরণে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠে।

ডমিন্যান্ট প্যারাডাইমের শতমুখী প্রচারণা এবং এখানকার পুরুষতান্ত্রিক পুরুষদের অসঙ্গত আচরণ, নারীদের মধ্যে এই ধরনের নেগেটিভ সেন্সেটিভিটি তৈরী হওয়ার জন্য দায়ী।

আর হ্যাঁ, আপনার কথার এই অংশটুকু একেবারেই সঠিক, “এখানে নারীর রোল এক সময় যা ছিল, নারীরা তা থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। আবার একই সাথে চাচ্ছেও না। চিন্তার একটা অসামঞ্জস্যতা খোদ নারীদের মধ্যেই বর্তমান।”

মূল লেখাতে আমি একটা টার্মের কথা বেশ জোর দিয়ে বলেছি। সেটা হলো ‘এজেন্সি’। আমি অতি সংক্ষেপে দেখানোর চেষ্টা করেছি, এখানে বলেন, ওখানে বলেন, নারীদের মধ্যে সেন্স অব এজেন্সির ভীষণ ঘাটতি আছে। এর মানে এই নয় যে সব পুরুষদের প্রপার এজেন্সি আছে। ওভারঅল আমরা দেখি, নারীদের মধ্যে এজেন্সিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

সমাজ তাকে বলেছে, যত গরমই হোক, তুমি এভাবে আপাদমস্তক ঢেকে চলবে, প্রেফারেবলি কালো কাপড়ে, এখানে নারীরা দিব্যি তাই করছে। আমাদের দেশে ইদানীংকালে এন্টি-শাহবাগী হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার উত্থান হলো। অমনি দেশ যেন ‌‘ইসলামিস্তান’ হয়ে উঠলো। সেন্ট পারসেন্ট মেয়েরা বোরকা-হিজাব পরা শুরু করলো। ভেতরকার কোনো গুণগত পরিবর্তন ছাড়াই তাদের মধ্যে এই ব্যাপাক বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটলো। বোরকা-হিজাব পরিধান করে তারা তা-ই করছে, এগুলো না পরলেও অতীতে তারা যা করতো। বোরকা হিজাব পরিহিতা নারীদের সাথে ছেলেদের ‘বন্ধুত্বের পরিসর’ বরং আরো বেড়েছে।

সমাজ তাকে বলেছে, যত ঠাণ্ডাই লাগুক, তোমাকে আগা-টু-গোড়া প্রতিদিন ‘অবাঞ্চিত লোম’ দূর করে চকচকে থাকতে হবে; উপরে নিচে যথাসম্ভব খুলে বা দৃশ্যমান করে রাখতে হবে, সৈনিক হিসেবে যখন তুমি মার্চ-পাস্ট করবে, তখনো তোমাকে হাফ-স্কার্ট পরে লেগ-থ্রু করতে হবে। সেখানকার সব নারীরা সেখানকার সমাজ কর্তৃক আরোপিত বিধি-নিষেধ ও মূল্যবোধকে ঠিকঠাক মতো মেনে চলছে, নির্দ্বিধায়। যুক্তিবুদ্ধির কোনো প্রকারের তোয়াক্কা না করেই। প্রয়োজনে মাসিকের চক্রে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে হেরফের ঘটিয়ে হলেও তাকে দায়িত্বপালনে ব্রতী হতে হচ্ছে, সমান অধিকারের দাবী বাস্তবায়ন করার জন্যে।

সুমাইয়া তাসনীম, আপনি তো একজন মনোবিজ্ঞানী। আপনিই বলেন, নারী ও পুরষের মন-মানসিকতা কি এক? যদি পার্থক্য থাকে, তা কি কিছুটা, নাকি ব্যাপক? তদনুযায়ী তাদের কর্মক্ষেত্র কি স্বতন্ত্র হওয়া জরুরী নয়?

Mohammad Ishrak, আপনি যে প্যারাডাইমের কথা বললেন, অর্থাৎ এর গুরুত্বের কথা, সেটা তো অবভিয়াস। সবকিছুর গোড়া হলো জীবন ও জগত সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারটা। যেমন, কোনো নারী কেন পর্দা করবে? সমাজ বলে, তাই? সুবিধা, তাই? যুক্তি আছে, তাই? আল্লাহ বলেছেন, একই সাথে যুক্তি ও সুবিধাও আছে, তাই? এর কোনোটাই তো ইসলামসম্মত না। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো কিছু তখনই এবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা একান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হবে। ওই কাজটি ওভাবে করার মাধ্যমে আমরা নানা উপকার পাই, কাজটি করার জন্য যুক্তি খুঁজে পাই, এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি খাস রহমত। কোনো কাজের দৃশ্যত যুক্তি না থাকলেও from a believer’s point of view, কাজটি নির্দ্বিধায় সম্পন্ন করাটা জরুরী।

এই অর্থে নিয়তের বিষয়টা মূলত প্যারাডিগমেটিক। মূল লেখাতে যা একটুখানি বলেছি, জীবন ও জগত যেহেতু একই, তাই জীবন ও জগত নিয়ে মানুষের যে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী, সেগুলোর মধ্যেও অনেকখানি মিল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে একসাথে বসবাস করার জন্য সেগুলোকে সামনেও আনতে হবে। কিন্তু একইসাথে মানুষ বিপরীত প্যারাডাইমে বসবাস করতে পারে না। হুইমজিকেলি কোনো কিছু সমর্থন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজের বিশেষ প্যরাডাইমগত অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছি কিনা, সে সম্পর্কে আমাদেরকে তাই সচেতন থাকতে হবে।

নারী অধিকার, উন্নয়ন, শিক্ষা ইত্যকার আলোচনার আন্ডারলাইয়িং প্যারাডাইমকে চট করে টের পাওয়া যায় না, যেভাবে বিনোদন সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তা সহজেই বোঝা যায়।

এরপরে আপনি একটিভিজমের কথা বলেছেন। সেটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমি বাক্য-বীর চাই না। চাই কর্ম-বীর। হ্যাঁ, নিছক লেখালেখির মাধ্যমেও কেউ অ্যাক্টিভিজম করতে পারে, অগত্যা পরিস্থিতিতে অথবা নিজস্ব চয়েস হিসেবে। কিন্তু সেটাকেও হতে হবে অর্গানাইজড, কনস্ট্রাকটিভ ও প্রো-অ্যাক্টিভ।

যেমন করে আমি নিজের জন্য ঠিক করেছি, নারী অধিকারের ব্যাপারে নির্যাতনমূলক বা নারীবিদ্বেষী পুরুষতন্ত্র, হালনাগাদের পাশ্চাত্য উগ্র নারীবাদ ও নারী-পুরুষ উভয়ের সুবিধাবাদি মনোভাব, এই তিনটাকে যুগপৎভাবে বিরোধিতা করবো। তদস্থলে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে মেনে চলবো, যুক্তিবুদ্ধির দাবীকে পূরণ করার চেষ্টা করবো এবং মানবিকতাকে সর্বোপরি নীতি হিসেবে মেনে চলবো।

আমার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে এই বিষয়গুলো ফুটে উঠে। ‘ধরো তক্তা, মারো পেরেক’ টাইপের উগ্রবাদিতা দিয়ে, অসহিষ্ণু ও প্রতিক্রিয়াশীল অ্যাক্টিভিজম দিয়ে সমাজের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ও টেকসই পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয় বলে মনে করি।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *