মুসলিম নারীদের নিয়ে বেগম রোকেয়ার জীবনপণ নারী শিক্ষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল হচ্ছে বর্তমানের বিশাল ‘শিক্ষিত’ নারী সমাজ, যাদের মধ্যকার ইসলামী আন্দোলনের কাজ নিয়ে আমরা কথা বলছি। বেগম রোকেয়া এ জন্যই মহিয়সী যে, তিনি নারী জাগরণের সূচনা-নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে কী বলেছেন তা আমি জানি না। যদিও তিনি নিতান্তই প্রাসঙ্গিক কারণে লোক-ইসলামের অনেক কিছুরই বিরোধিতা করেছেন। লোক-ইসলাম তথা ‘ইসলাম ধর্মকে’ ডিফেন্ড করতে আমি আগ্রহী নই।

আমি সমঝদার একজনের সাথে বসে সুফিয়া কামালের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ভালো করে শুনেছিলাম ইটিভিতে। তখন ইটিভির টেরিস্ট্রিয়াল সুবিধা ছিল। পরদিন বিকেলে আবার যখন প্রোগ্রামটা পুনঃপ্রচার করা হয় তখনও উক্ত বিদগ্ধজনকে সাথে নিয়ে পুরো সাক্ষাৎকারটা শুনেছি। সেখানে আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো বক্তব্য পাই নাই।

যারা ‘আমাদের’ কথায় তালি বাজায় না, তাদেরকে খরচের খাতায় ফেলে দেয়াটাকে আমি সমর্থন করি না। কোনো জনপদে কাজ করতে হলে সেখানকার সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা ও জননেতৃত্বকে যথাসম্ভব আপন ভাবতে হবে। ইংরেজিতে যাকে own করা বলে। আমার যে টার্গেট পিপল, তাদের নেতৃত্বকে ইসলাম সম্পর্কে বুঝাতে না পারলে তাদেরকে (গণ্যমান্য বা নেতৃস্থানীয়দেরকে) যথাসম্ভব না ঘাটিয়ে চলাই দাওয়াতী কাজের সুন্নাহভিত্তিক তরিকা। যেমন, রাসূল (সা) মুনাফিক সর্দারকে চেনা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন নাই। বরং সম্মান দেখিয়েছেন।

বেগম রোকেয়া বা সুফিয়া কামালরা এমন কোনো ইসলামবিরোধী কাজ করেন নাই যে, তাঁদেরকে খারিজ করে দেয়া বা ধরে নেয়াটা ইসলাম রক্ষার জন্য জরুরি। সুফিয়া কামাল হিন্দুর কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন– এই অভিযোগকে আমলে নিলে কাজী নজরুল ইসলামকেও খরচের খাতায় ফেলতে হবে। এই ধারায় যাচাই-বাছাই শুরু করলে ফররুখ আর মল্লিক ছাড়া কাউকে পাবেন না। বাদ দেয়াটা ইসলামের নিয়ম নয়। গ্রহণ করার মানসিকতাই সুন্নাহর দাবি।

সাহিত্যকে সাহিত্য হিসাবেই দেখতে হবে। কাব্য-উপন্যাসের পাতায় পাতায় শিরক-বেদআত খোঁজাটা এক ধরনের বাতিক। কোনো সাহিত্যিক যদি সাহিত্য দিয়ে বাতিল-দ্বীনের প্রচার করে সেটি ভিন্ন কথা। যারা লেখেন তারা জানেন, লেখাটা একটা অন্তর্গত প্রেরণার ব্যাপার। সত্যিকারের সাহিত্য আর লিফলেট ভিন্ন জিনিস। সাহিত্যিক উপমা, উৎপ্রেক্ষা বা রূপকল্পকে আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করা সাহিত্য ও সাহিত্যিকের প্রতি জুলুমমাত্র। আকীদাগত বিষয়ে সিরিয়াস থাকারও একটা সীমা বা প্রেক্ষাপট থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে, আকীদাগত অতি সতর্কতাই খারেজীদেরকে ‘খারেজী’ বানিয়েছিল!

আন্তর্জাতিক নারী দিবস কেন ইসলামপন্থী নারীরা পালন করবে? রাসূলের (সা) যুগে জাতিসংঘ ছিল না, কোনো নারী দিবস ছিল না। তাই বলে তা ইসলামবিরোধী হলো কী করে? দুনিয়াতে এমন কোন্ আদর্শ বা তত্ত্ব আছে যার সব ভালো? হ্যাঁ, একটা আছে। তা হলো– ইসলাম। দুনিয়াতে এমন কোন্ আদর্শ ও মতবাদ আছে, যার সব খারাপ? না, সর্ব খারাপ হিসাবে কোনো কিছু নাই। অতএব, যে ‘খারাপ নিয়ে আপনি আমি কাজ করছি বা করবো তারও কিছু না কিছু ভালো দিক আছে বা থেকে থাকবে। তাই না? যতটুকু ভালো আছে তার আন্তরিক স্বীকৃতি দিতে আমাদের কার্পণ্য কেন? গ্লাসের অর্ধেক পানি থাকলে অর্ধেক খালি বলবো, নাকি অর্ধেক ভর্তি বলবো– এটি নির্ভর করছে আমরা প্রো-অ্যাক্টিভ হবো, না রি-অ্যাক্টিভ হবো তার উপর।

আমি নিজেকে ইতিবাচক অবস্থানে দেখতে চাই। নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে সমাজকর্মী হওয়া যায় না।

এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

শাজিদ: আমি মানব-মানবী ও দিবস পূজার পক্ষে নই।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: দিবস পালন আর ব্যক্তিপূজা সমার্থক নয় বলেই জানি। কাউকে স্মরণ করার এটি একটি আধুনিক রীতি। যেমন, পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রফেসর ইখলাস উদ্দীন স্মারক বক্তৃতা হতে পারে। দর্শন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান স্মরণে দিবস পালন হয় বা হতে পারে।

ঘুম ভাঙাতে চাই: না জেনে শুধুমাত্র কানকথায় তাল মেলানো আমাদের জাতিগত অভ্যাস। যেমন– কিছুদিন দেখছি কিছু আলেম অভিযোগ করছেন ডা. জাকির নায়েক ইসলামের ক্ষতি করছেন। ভুলে গেলে চলবে না বেগম রোকেয়া মুসলিম নারীদের জাগরণের জন্যই কাজ করেছেন অর্থাৎ যে মুসলিম নারী আগামী দিনে একজন মুসলিম সন্তানের মা হবেন, সন্তানকে শিক্ষা দিবেন। আমি তার মাঝে ইসলামের বিরোধিতার কিছু পাইনি, বরং তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে বলেছেন, “হায়! আজ যদি নবী মুহাম্মদ (সা) থাকতেন তবে আজ নারীদের এমন ভাগ্য নিয়ে বাঁচতে হতো না। মুসলিম পুরুষরা কি দেখেন না নবী (সা) কীভাবে নিজ জীবনকে ফাতেমাময় করে তুলেছিলেন?”

তিনি বর্তমান নারীনেত্রীদের মতো পশ্চিমাদের কথায় পর্দা প্রথাকে কটাক্ষ করে তা বর্জনের চেষ্টা করেননি, বরং শালীন পোশাক পরেই আন্দোলনে নেমেছেন। তিনি নারী জাগরণের নামে নারীদের পশ্চিমা সমাজের অনুসরণেরও বিরোধী ছিলেন। তিনি খুব সম্ভবত তাঁর ‘অবরোধ বাসিনী’তে লিখেছেন, “তুর্কিরা বিলাতিদের দেখে নারী স্বাধীনতার নামে নারীদেরকে পর্দার বাইরে টেনে এনেছে। বিলাতিদের মত চালচলনে উৎসাহিত করছে। এতে নারীরা স্বাধীনতা ভোগের বদলে আরো বেশি পুরুষের দাসীতে পরিণত হবে।”

তবে শেষ কথা হলো, মানুষ ফেরেশতা নয়। তাই তার যদি কোন ভুল হয়েও যায় তবে মুসলিম হিসেবে উদার দৃষ্টি নিয়ে তা মার্জনা করাই শ্রেয়। তবে সুফিয়া কামাল সম্পর্কে আমি সেরকমভাবে জানি না, তাই মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম মনে করি।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সুফিয়া কামালের যে ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকার আমি অনেক বছর আগে দেখেছিলাম তাতে তাঁকে ইসলামবিদ্বেষী মনে হয়নি। যদিও উনার অনেক কাজ প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। কোন জাতীয় ব্যক্তিত্বকে বাদ দেয়া বা গুরুত্বপূর্ণ কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা পছন্দ করি না। কোনো বিষয়ে নেতিবাচক কথা বলতে হলে সেই বিষয় বা প্রসঙ্গ নিয়েই কথা বলা উচিত। তাতে (খারাপ) কাজের বিরোধিতা করা হয়, ব্যক্তিকে আহত না করেই। আপনার সুনির্দিষ্ট মন্তব্য সত্যিই খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

লোকমান বিন ইউসুপ,চিটাগাং: “আমি নিজেকে ইতিবাচক অবস্থানে দেখতে চাই। নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে সমাজকর্মী হওয়া যায় না।” সহমত।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কট্টর বিরোধীদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে দাওয়াতী কাজ করা হলো নিজেকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়ক। যারা এটি করে না তাদের মাথায় সারাক্ষণ কাকে কাকে বাদ দিবে, সেই চিন্তা ঘুরপাক খায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দা-য়ী হিসাবে জীবন যাপনের তৌফিক দিন!

লাল বৃত্ত: সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো আসলেই অনেকের নেটওয়ার্কের উপর দিয়ে যায়, যার ফলে হুট করেই সাহিত্যের ভাষা না বুঝে একটা মন্তব্য করে বসে।

অনেকাংশেই একমত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ।

শামিম: “কাব্য-উপন্যাসের পাতায় পাতায় শিরক-বেদআত খোঁজাটা এক ধরনের বাতিক।”

একমত নই। যেগুলো খারাপ, সেগুলো বর্জনীয়। ভালো কাজ যেই করুক এপ্রিসিয়েশন থাকাটা জরুরি।

আর বিদাত নিয়ে মনে হয় একটা বিভ্রান্তি আছে। বিদাত আসে ইবাদত রিলেটেড ব্যাপারে। আমি এসিতে ঘুমাই, এখানে ইবাদতও নাই বিদাতও নাই।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কিছু বিষয় আছে যেগুলো আক্ষরিকভাবে অর্থাৎ হুবহু হতে হয়। যেমন (ফরজ) ইবাদত, হুদুদ বা শাস্তি আইনের প্রযোজ্যতা, শিরক হিসাবে কোনো কিছু ঘোষণা, হারাম সাব্যস্ত করা ইত্যাদি। সাহিত্যিক যখন অনাক্ষরিকভাবে অর্থাৎ রূপক হিসাবে কোনো কিছু বলেন তা কারো পছন্দ হোক বা না হোক, রূপককে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করাটা ভুল। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ।

রেহনুমা বিনত আনিস: “নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে সমাজকর্মী হওয়া যায় না।” – একমত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে ভালো মানুষও হওয়া যায় না, তার আদর্শ যা-ই হোক না কেন। দুঃখজনক হলো ইসলাম অনুসারীদের অধিকাংশই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে, জগত ও সমাজকে দেখে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সবকিছুকে তারা সাদা-কালো হিসাবে দেখে। রং পছন্দ করে না। ইসলাম যে রঙিন হতে পারে, তা তাদের অতি সংবেদনশীল দ্বীনি চেতনায় কখনো স্থান পায় না। ইসলাম হলো, তাদের দৃষ্টিতে, পরকালীন একটা ব্যাপার। অথবা, পরকালীন একটা ব্যাপার যেখানে দুনিয়াও আছে বটে!

ইসলামে দুনিয়াই সবকিছু, পরকাল হলো অতি উত্তম এক দুনিয়া, যা এই দুনিয়ার ধারাবাহিকতা মাত্র– কথাটা কি এভাবে বলা যায় না?

অতি সংক্ষিপ্ত হলেও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

আবু জারীর: “রাসূল (সা) মুনাফিক সর্দারকে চেনা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন নাই। বরং সম্মান দেখিয়েছেন।”

খুবই মূল্যবান কথা। অথচ অনুমান করে আমরা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কাফের পর্যন্ত বানিয়ে ফেলি (নাউজুবিল্লাহ)।

আশুরার রোজা কিন্তু দিবস পালনের একটা দলীল হতে পারে। ইহুদীরা আশুরার দিনে একটা রোজা রাখত, কিন্তু রাসূল (সা) একাধিক রোজা রেখে ইহুদীদের বিরোধিতা করতে বলেছেন। তেমনি মুবাহ অনুষ্ঠান নববর্ষ নিয়ে সেক্যুলাররা যেভাবে মাতামাতি করে, তা থেকে বাঁচার জন্য দরজা বন্ধ করে বসে থাকা মনে হয় সমাধান নয়। বরং সুন্দর পরিচ্ছন্ন অনুষ্ঠান করে ওদের জবাব দেয়াই মনে হয় উত্তম পন্থা।

দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ জায়গা হলো মেলা। অথচ রাসূল (সা) ওকাজের মেলায় যেতেন! উদ্দেশ্য দাওয়াত দেয়া।

তাহলে পহেলা বৈশাখের মেলায় আমরা কেন যাবো না? যদি আমদের উদ্দেশ্য থাকে ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার করা, তাহলে অবশ্যই যাবো এবং তাই করবো যেভাবে রাসূল (সা) করেছেন অর্থাৎ বিশাল জনসমাগমকে কাজে লাগিয়ে দাওয়াতি কাজ করেছেন। কোরআন শুনিয়েছেন। ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: দাওয়াতী কাজ হলো কট্টরপন্থী মনোভাব নিরাময়ের মহৌষধ। অবশ্য সে দাওয়াত হতে হবে আদর্শ অর্থাৎ পরিপূর্ণ ইসলামের। ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক ইসলামের খণ্ডিত দাওয়াহ কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষ আরো বাস্তববিমুখ ও কট্টরবাদীতে পরিণত হবে।

সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

হাসান তারিক: ‘নারীবাদীদের’ একতরফা প্রচারণার তোড়ে পরে রোকেয়াকে (ইংরেজিতে যিনি তাঁর নাম লেখতেন Roquiah বানানে, সম্ভবত আরবী উচ্চারণকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা) দূরে ঠেলে দেয়াটা কাজের কথা নয়। রোকেয়াকে পাঠ করা ইসলামপন্থীদের জন্য জরুরি। কারণ রোকেয়া থেকেই আমরা নারীবাদীদের ইসলামবিরোধী প্রচারণার বিপক্ষে দাঁড়াতে পারি। এটা খুবই সম্ভব। এমনকি রোকেয়ার রচনাকে আমরা হিজাবের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে পারি।

তাঁর একটা রচনা আছে ‘বোরকা’। সম্ভবত আমরা অনেকেই এই রচনাটার কথা জানি না। সেখান থেকে জাস্ট কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি–

১। “আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে, আমাদের জঘন্য অবরোধ-প্রথাই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?”

২। “পৃথিবীর অসভ্য জাতিরা অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য ব্রিটনেরা অর্ধনগ্ন থাকিত। ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থায় পূর্বে গায়ে রঙ মাখিত। ক্রমে সভ্য হইয়া তারা পোশাক ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে। এখন সভ্যতাভিমানিনী (civilized) ইউরোপীয়া এবং ব্রাহ্ম-সমাজের ভগ্নীগণ মুখ ব্যতীত সর্বাঙ্গ আবৃত করিয়া হাটে-মাঠে বাহির হন। আর অন্যান্য দেশের মুসলমানেরা (ঘরের বাহির হইবার সময়) মহিলাদের মুখের উপর আরও একখণ্ড বস্ত্রাবরণ (বোরকা) দিয়া ঐ অঙ্গাবরণকে সম্পূর্ণ উন্নত (perfect) করিয়াছেন। যাঁহারা বোরকা ব্যবহার করেন না, তাঁহারা অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকেন।”

৩। “পর্দা অর্থ ত আমরা বুঝি গোপন হওয়া, বা শরীর ঢাকা ইত্যাদি- কেবল অন্তঃপুরের চারি-প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে। এবং ভালমতে শরী আবৃত না করাকেই ‘বেপর্দা’ বলি। যাঁহারা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুখে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাঁহাদের অপেক্ষা যাঁহারা ভালমত পোশাক পরিয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাঁহাদের পর্দা বেশি রক্ষা পায়।”

৪। “কেহ বলিয়াছেন যে, “সুন্দর দেহকে ‘বোরকা’ জাতীয় এক কদর্য ঘোমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কিম্ভূতকিমাকার জীব সাজা যে হাস্যকর ব্যাপার যাঁহারা দেখিয়াছেন, তাঁহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন”– ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে, রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমণ্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।”

৫। “সময় সময় ইউরোপীয়া ভগ্নীগণও বলিয়া থাকেন, “আপনি কেন পর্দা ছাড়েন না (Why don’t you break off purdah)? কি জ্বালা! মানুষে নাকি পর্দা ছাড়িতে পারে? ইহাদের মতে পর্দা অর্থে কেবল অন্তঃপুরে থাকা বুঝায়। নচেৎ তাঁহারা যদি বুঝিতেন যে, তাঁহারা নিজেও পর্দার (অর্থাৎ privacy) হাত এড়াইতে পারে না, তবে ওরূপ বলিতেন না।”

৬। “মোটের উপর আমরা দেখিতে পাই সকল সভ্য জাতিদেরই কোন-না-কোন রূপ অবরোধ-প্রথা আছে। এই অবরোধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? এই পবিত্র অবরোধ-প্রথাকে যিনি “জঘন্য” বলেন, তাঁহার কথার ভাব আমরা বুঝিতে অক্ষম। সভ্যতাই (civilization) জগতে পর্দা বৃদ্ধি করিতেছে।”

৭। “তবে সকল নিয়মেরই একটা সীমা আছে। এদেশে আমাদের অবরোধ-প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। … এইভাবে সর্বদা গৃহকোণে বন্দিনী থাকায় তাহাদের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয়। দ্বিতীয়তঃ তাহাদের সুশিক্ষায় ব্যাঘাত হয়। … আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব, প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই।”

৮। “সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই- শিক্ষার অভাবে হইয়াছে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে।”

৯। “যাহা হউক, পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় নাই। এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব আছে। এই অভাবটি পূরণ হইলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ হইলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চশিক্ষা লাভ হইতে পারে।

প্রয়োজনীয় পর্দা কম করিয়া কোন মুসলমানই বোধ হয় শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হইবেন না।

আশা করি, এখন আমাদের উচ্চশিক্ষা-প্রাপ্তা ভগ্নীগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, বোরকা জিনিসটা মোটের উপর মন্দ নহে।”

সমস্যা হলো একতরফা প্রচারণার তোড়ে আমরা প্রায় সময় ভেসে যাই। রোকেয়াকে ‘নারীবাদীরা’ তাদের মতো করে ব্যবহার করেছে। আর আমরা রোকেয়াকে পাঠ না করেই তাকে বিরোধী কাতারে ফেলে রেখেছি!

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনার মূল্যবান উদ্ধৃতির সাথে যদি পৃষ্ঠা নম্বরসহ একাডেমিক স্টাইলে সাইটেশন করা হতো তাহলে খুব ভালো হতো। এতটুকুই যে কষ্ট করছেন, তাও অনেক বেশি। ধন্যবাদ জনাব হাসান তারিক।

হাসান তারিক: আসলে মূল বইটা আমার কাছে নাই। জাস্ট ‘বোরকা’ রচনাটা চটি বই আকারে ‘নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা’ কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৮ সালের একটা সংস্করণ আছে আমার কাছে।

মূল রচনা বেগম রোকেয়ার মতিচুর (প্রথম খন্ড) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। যা ১৯০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। বেগম রোকেয়ার মতিচুর (প্রথম খণ্ড) ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন–

https://arts.bdnews24.com/wp-content/uploads/2010/12/motichur.pdf

বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আরো একটা অসাধারণ পোস্ট:

http://www.sonarbangladesh.com/blog/fatimakaniz/57417

আবু নিশাত: আপনি বেগম রোকেয়ার সাথে সুফিয়া কামালের মতো নিকৃষ্ট মহিলাকে নিয়ে আসলেন! কোথায় বেগম রোকেয়া এবং কোথায় সুফিয়া কামাল? আপনি সুফিয়া কামালের ১ ঘণ্টার সাক্ষাৎকারকে গুরুত্ব দিলেন? কিন্তু ৭১-এর পূর্বে তার বক্তব্য এবং ৭১-এর পরের বক্তব্যের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন? ৭১-এর পরে ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে তার বিভিন্ন বক্তব্যগুলো কি বিবেচনা করেছেন? তিনি ইসলামী সংগঠনের প্রতি কি ধরনের আক্রোশ প্রকাশ করেছেন ৮০, ৯০ দশকের পত্রিকাগুলো সাক্ষী। আপনি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা বলেছেন, আবার এমনও আছে কাউকে কাউকে রাসূল (সা) কতলেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলো অনেক বড় আলোচনার ব্যাপার। শুধু একটি লাইন কোট করে বক্তব্য দিতে গেলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। উপরে কমেন্টে এক ভাই তো বলেই ফেললেন, পহেলা বৈশাখের মেলায় গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। তাহলে আমি বলি, হিন্দি সিনেমার আসরে গিয়ে দাওয়াত দিলে আরো ভালো হয়। এটাকে সম্ভবত ইসলামপন্থীদের ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বলা যেতে পারে। ভাই, বর্তমানে আমাদের সমস্যা হলো– আধুনিক যা আছে, তাই ইসলামের রং দিয়ে জায়েজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। আর যারা এটা করেন না, তাদেরকে কট্টরপন্থী হিসেবে গালি দেয়া হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই কট্টরপন্থী গালির স্রষ্টারা হলো আমেরিকা-ইউরোপের মুরুব্বীরা। এই মুরুব্বিরা ইসলামপন্থীদের আটকানোর জন্য একটি উদারবাদী ইসলামী গ্রুপ সৃষ্টি করেছে। এই উদারবাদীদের কাছে সবকিছুই জায়েজ, আর যেগুলো শরীয়াহ মানতে চায় ওগুলো হলো কট্টরপন্থী।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: উদারবাদ না কট্টরবাদ – এ প্রসঙ্গে আপাতত আমরা ইউসুফ কারযাভীকে সালিশ মানতে পারি (যদি আধুনিকতাকে প্রশ্রয় (?) দেয়ার জন্য উনাকে মাইনাস না করে থাকেন)। উনার কথা এ জন্য বললাম যে, এক সহকর্মী আজ উনার ‘ইসলামিক এওয়েকেনিং বিটুইন এক্সট্রিমিজম এন্ড রিজেকশন’ বইটার বাংলা অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আমি তখন সেলফ হতে খুঁজে এর ইংরেজি ভার্শনটা বের করলাম। ভাবছি, কাউকে দিয়ে এটি রি-ট্রান্সলেট করাবো। আমরা কিছু বই বের করার চিন্তা করছি। বলতে পারেন, প্রকাশনা আন্দোলন।

(মধ্য)প্রাচ্যকে আমাদের এবং পাশ্চাত্যকে আমাদের (ইসলাম) বিরোধী – এমন ধরনের সরলীকরণে আমি নাই। আমি শুধু ইসলামের পক্ষে। প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য– এসবকে খুব একটা বিশেষ ফ্যাক্টর হিসাবে বিবেচনা করি না।

বেগম রোকেয়া আর সুফিয়া কামাল এক বা সমান নন, তবে তাঁরা উভয়ই নারী জাগরণের জন্য কাজ করেছেন। দ্বিতীয় জন প্রথম জনের উত্তরসূরী। এ দৃষ্টিতে তাঁরা উভয়েই ছিলেন নারীবাদী। বুঝতেই পারছেন, নারী অধিকার বা নারী জাগরণ অর্থে আমি নিজেও নারীবাদী।

সুফিয়া কামালরা যে ইসলামের বিরোধিতা করেছেন তা দলবিশেষের রাজনৈতিক ইসলাম কিম্বা ধর্মবাদীদের লোক-ইসলাম। যে ইসলামকে অন্যতম, প্রধান ও ব্যক্তিগতভাবে আমার একমাত্র আদর্শ হিসাবে জানি, মানি, প্রচার ও বিশ্বাস করি সেই ইসলামের বিরোধিতা তাসলিমা নাসরিন ছাড়া তাদের অনেকের মধ্যেই পাই নাই।

পহেলা বৈশাখের মেলাসহ কোনো লোকজ মেলাকেই ‘ইসলামে নিষিদ্ধ’ মনে করি না। উৎসব বা উপলক্ষ ঈদ হোক আর লোকজ মেলা হোক, যেসব কাজ খারাপ এমন কোনো নিষিদ্ধ কাজ তথা আইটেমকে এড়িয়ে চলা সমীচীন মনে করি।

এসবই আমার একান্ত ব্যক্তিগত কথা। এটি একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। কোনো ফতোয়ার ব্যাপার এখানে নাই। তাছাড়া, আমাদের প্রত্যেকের ভালো-মন্দ নির্ণয় করার এখতিয়ার আছে। লেখালেখি হলো মতপ্রকাশ মাত্র। আশা করি ভুল বুঝবেন না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

আবু নিশাত: সুফিয়া কামালরা বুঝে-শুনেই ইসলামের বিরোধিতা করেছেন। এটা ঠিক কৌশলগত কারণে এই বিরোধিতা কখনো দলীয় মোড়কে করেছেন বা কখনও অন্য কোনো মোড়কে। আজ অবশ্য সুফিয়া কামালের উত্তরসূরীরা সরাসরি কোনো দলের বিরোধিতা না করে ইসলামের বিরোধিতা করছেন। আপনি যদি একুশে টিভি, চ্যানেল আই, এটিএন, আরটিভি ইত্যাদি চ্যানেল নিয়মিত দেখেন, তবে দেখবেন এই উত্তরসূরীরা এখন সরাসরি বিরোধিতা করছেন। যেমন শরীয়াহ আইনকে মধ্যযুগীয় বর্বর আইন, চোরের হাত কাটা আইন বর্বর আইন, বাবার সম্পদে ছেলে-মেয়ের সমান অংশ নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছেন। আর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন পহেলা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, জন্মদিন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের এমন অবস্থা হয়েছে যে, এখন দেশের ভিতর অসংখ্য তাসলিমা নাসরিনের উপস্থিতি তাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। বর্তমানের পহেলা বৈশাখ এবং গ্রামবাংলার পহেলা বৈশাখের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে পরিকল্পনা করছে, তা হলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি ঈদের জায়গা দখল করতে পারে। মুসলিম হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মুসলমানদের উৎসবের দিন হল দুইটি। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। মুসলমানদের কোনো ‘মা’ দিবসের প্রয়োজন নেই। আমরা প্রতিদিনই মায়ের সেবা করব, যদি ঈমানদার হই। মুসলামানদের কোনো ধরনের ‘নারী দিবস’ পালন করার প্রয়োজন নেই, ইসলাম নারীর যে অধিকার দিয়েছে, তা দেয়া হউক, যদি আমরা ঈমানদার হই। আমরা বাবার সম্পদ ভাগ করে নেই, কিন্তু বোনদের অংশ দেই না। আমরা যদি পরিপূর্ণ মুসলামান হই, তবে এসব দিবসের কোন গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই। আপনি জাতিসংঘের ‘নারী দিবস’ পালন করবেন। তাহলে আমরা ধরে নিবো আপনি নারী সংক্রান্ত জাতিসংঘের নীতিমালার সাথে একমত। অর্থাৎ সম্পদ বণ্টনে নারী-পুরুষ সমান অংশ পাবে। নারী এবং পুরুষের সমান ক্ষমতা। বলুন তো কুরআন কি সম্পদ বণ্টনে নারী-পুরুষের সমান অংশ দিয়েছে। বলুন তো কুরআন নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্য দেয় নাই?

ভাই, ইসলাম হলো ইসলাম। সব নাবী-রাসূল ইসলামের দিকে মানুষকে ডাক দিয়েছেন। কোনো কোনো নাবী-রাসুল দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ হতে সফল হয়েছেন। আবার কেউ সফল হতে পারেননি। ভাই, আমরা মূল ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকলে আমাদেরকে প্রগতিবিরোধী, মধ্যযুগীয় ইত্যাদি বলা হবে এবং জনগণের অধিকাংশ আমাদেরকে গ্রহণ নাও করতে পারে, আবার গ্রহণও করতে পারে। যদি গ্রহণ করে ইসলামী বিপ্লব হবে। আর যদি গ্রহণ না করে, তবে বিপ্লব হবে না, কিন্তু আমরা ব্যর্থ হবো না, আমাদের পাওনা আমরা আল্লাহর কাছে পাবো। ব্যর্থ হবে বা ধ্বংস হবে তারাই, যারা গ্রহণ করবে না।

ইউসুফ আল কারযাভীর বাংলা অনুবাদকৃত বইগুলো পড়েছি। নিঃসন্দেহে খুবই উচু মানের জ্ঞানী ব্যক্তি বা আলেম। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের চার ইমামের মতামত ঠিক। আমার কাছে যেন মনে হয়, চার ইমামের সমপর্যায়ের মনিষী এখনো সৃষ্টি হয়নি। তাদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু আমার মনে হয় চার জনের বক্তব্য সমন্বয় করলে সহীহ পথ পাওয়াটা খুবই সহজ হয়।

ভাই, দীর্ঘ মন্তব্য করে ফেললাম। খুশি হলাম কারযাভীর বইগুলো অনুবাদ করছেন শুনে। এখন এগুলোর প্রয়োজন খুব বেশি। আপনাকে আল্লাহ ভালো রাখুন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধারণা করেছিলাম, আপনি মন্তব্য করবেন না। যাহোক, কষ্ট করে লিখেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ। ভাবছি, সর্বশেষ কিছু কথা বলি। শুধুমাত্র আমার আন্ডারস্ট্যন্ডিংকে তুলে ধরার জন্য। আপনাকে বা কাউকে কনভিন্স করার জন্য নয়।

শুধু লোকজ মেলা-অনুষ্ঠানগুলোকে নয়, দুই ঈদ অনুষ্ঠানকেও ওরা ইতোমধ্যে হজম করে ফেলেছে। লক্ষ্য করবেন, যত খারাপ কাজ আমাদের দেশে হয়, সেগুলি সবচেয়ে বেশি হয় দুই ঈদের দিনে। শালীনতার পর্যায় অতিক্রম করবে বলে উদাহরণ/প্রমাণ দেয়া হতে বিরত থাকলাম। তাই বলে কি আমরা ঈদ অনুষ্ঠানকে বাদ দিবো? আসলে, উপলক্ষ্য কেবলই উপলক্ষ্য। লক্ষ্য হলো নির্দোষ আনন্দ ও সামাজিকতা। কোনো ইবাদতের মধ্যেও পাপ-অনাচার ভর করতে পারে। মাথায় ব্যথা হলে চিকিৎসা করাতে হবে। আরোগ্যই কাম্য, অঙ্গহানী নয়।

আদর্শমাত্রকেই আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্য হতে বাঁচানো দরকার। অথচ, আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো আদর্শ কেবলমাত্র বিচার-বুদ্ধি সর্বস্ব হয়েই টিকে থাকতে বা প্রসার লাভ করতে পারে না। আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবণতা। তৎকালীন আরবে প্রচলিত অনেক ধর্মীয় রিচুয়্যাল ইসলামী শরিয়াহতে বাতিল করা হয়েছে। অথচ ইসলামের সব ইবাদতই রিচুয়্যালনির্ভর এবং এর সবগুলোই হচ্ছে কালেকটিভ অর্থে সোশ্যাল রিচুয়্যাল। এই ভারসাম্যকে স্মরণ রাখতে হবে, মেনে চলতে হবে। দেশীয় সামাজিক অনুষ্ঠান-উৎসব, ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয় দিবস-অনুষ্ঠানের সাথে ইসলামের কোনো বিরোধ নাই। যেহেতু, এর কোনোটিকেই সওয়াবের নিয়তে করা হয় না। এগুলো হলো উরুফ বা সামাজিক প্রথা মাত্র।

তথাকথিত প্রগতিবাদী নারীবাদীদের ইসলামের ব্যাপারে কোনো আপত্তি ও ক্ষোভ নাই, আমি একথা বলছি না। আসলে ব্যাপারগুলো তালগোল পাকিয়ে আছে। আমার পর্যবেক্ষণে মনে হয়, ওদের আপত্তির একটা বিরাট অংশ, দৃশ্যমান ইসলামপন্থীদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের ভুল বা সীমাবদ্ধতার ফলশ্রুতি।

বলুন তো, নারীরা কেন মসজিদে যেতে পারে না? যেখানে তাদের প্রবেশাধিকার আছে, সেখানে আলাদা কক্ষ কেন? সুন্নাহ বলতে আপনি-আমি যা বুঝি, সেখানে এর সমর্থন কোথায়? এটি একটা উদাহরণ বললাম মাত্র। খেয়াল করলে দেখবেন, বিরোধী মহলের বাড়াবাড়ির সুযোগ, স্বপক্ষীয় মহলের ধারাবাহিক ও পূর্বকৃত বাড়াবাড়িরই প্রতিক্রিয়া মাত্র। পেশাজীবী নারীদের চাকরিচ্যুত করা হতে শুরু করে মেয়েদের স্কুলে বোমা মারার মতো নৃশংসতার জন্য আমরা আফগান-পাকিস্তানের তালিবানদেরকে জানি। আমাদের দেশেও তালেবান সংখ্যা কম নয়। সৌদীদের কথা নাইবা বললাম।

বুঝতেই পারছেন, প্রধান ইসলামী দলের গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার লক্ষ্য ও অজুহাতে একের পর এক করে যাওয়া গ্রস মিসটেক, হালনাগাদের খিলাফতপন্থীদের ধোঁয়াটে কথাবার্তা ও সনাতনীদের সংখ্যা-শক্তির অহমিকাসহ কোনো ধরনের বাড়াবাড়িকে ইসলামের নামে ডিফেন্ড করার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নাই। আদর্শ ও পতাকাবাহীর মধ্যে কোনো একটাকে বাঁচানোর বিকল্প পরিস্থিতিতে আমি আদর্শকেই নিরাপদ, অম্লান ও অক্ষুণ্ন রাখা তথা বাঁচানোর পক্ষপাতি।

চার ইমাম বলে কোনো কথা নাই। ইমাম অনেকেই ছিলেন। এখনো আছেন। ভবিষ্যতেও হতে পারেন, হবেন বা আসবেন। তবে, ‘আস সাবিক্বুনাস সা-বিক্বুন…’-এর মূলনীতির আলোকে অগ্রজদেরকে কোনোভাবেই উত্তরসূরীরা অতিক্রম করে যেতে পারবেন না। এটি বিশ্বাস করি।

ইউসুফ কারযাভীকে পছন্দ করেন জেনে খুশি হলাম। তথাকথিত রক্ষণশীলদের অনেকে উনার নাম শুনতে পারে না। আমার কাছে উনার কথাগুলোকে দারুণ মনে হয়। কোনো শিক্ষিত মুসলমানের জন্য কোনো স্কলারের সব কথাকে গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা বোধ করি না। কারো সাথে একমত হতে না পারাকে তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা ও আস্থাহীনতার প্রকাশ বলে মনে করি না।

তাই, কোনো ব্র্যান্ড অনুসারে না চলে, কনশ্যান্স অর্থে মাইন্ড অনুসরণে চলাটাকেই সঠিক মনে করি। ভালো থাকুন। দোয়া করবেন।

মূল পোস্টের ব্যাকআপ লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *