নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং প্র্যাকটিসিং মুসলিম, এমন কেউ যখন বলে, “আমরা সমান অধিকার চাই না; ন্যায্য অধিকার চাই” তখন আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। আমি বুঝতে পারি, তারা সমতা ও ন্যায্যতার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ভুল বুঝছেন। নারী-পুরুষের সম্পর্কের দিক থেকে সমতা হলো মৌলিক নীতি। ন্যায্যতা হলো এই মৌলিক নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য উপযোগী পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। তাই, ন্যায্যতা কোনোভাবেই সমতার বিকল্প হতে পারে না।
নারী-পুরুষের সমতার ব্যাপারে কোরআনের কয়েকটা আয়াত নমুনা হিসেবে এখানে উল্লেখ করছি:
“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।” (সূরা হুজরাত, ১৩নং আয়াত)
“আমি পৃথিবীর বুকে আমার খলিফা প্রেরণকারী।” (সূরা বাকারা, ৩০নং আয়াত)
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তওবা, ৭১নং আয়াত)
“যে লোক পুরুষ হোক কিংবা নারী, কোনো সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণ ও নষ্ট হবে না।” (সূরা নিসা, ১২৪নং আয়াত)
“আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা পরস্পর এক।” (সূরা আল ইমরান, ১৯৬নং আয়াত)
“নিশ্চয়ই মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, ইবাদতকারী পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও নারী, খোদাভীরুপুরুষ ও নারী, ছদকা দানকারী পুরুষ ও নারী, রোযাদার পুরুষ ও নারীগণ এবং যে সকল পুরুষ ও নারী তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং যে সকল পুরুষ ও নারী আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের সকলের জন্যেই আল্লাহ তা’য়ালার কাছে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” (সূরা আহযাব, ৩৫নং আয়াত)
আর নারীদের জব করা না করার যে প্রসঙ্গটা এখন বারবার আলোচনাতে আসে, সে ব্যাপারে একটা কথা পক্ষ-বিপক্ষের কোনো আলোচনাতে আসে না। তা হলো, আমার দৃষ্টিতে, এটি নিছকই একটি শহুরে সমাজের সমস্যা। মোর স্পেসিফিক্যালি, an urban solvent family problem. নিম্নবিত্তের শহুরে সমাজ কিংবা গ্রামীণ সমাজে কোনো নারী পারিবারিক ইনকাম তথা কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বা বিরত আছে বা থাকবে, এটি অকল্পনীয়। আর হ্যাঁ, নারীদের কাজের ধরন কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক।
সমতা ও ন্যায্যতার প্রসঙ্গে আমার আরো লেখা পাবেন এখানে।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ: আপনি যে আয়াতসমূহ কোট করেছেন তা অধিকার সম্পর্কিত নয়; কিছু ইবাদত সংক্রান্ত আর দু-একটা আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা কেমন সে সম্পর্কিত।
হেভিং সেইড দ্যাট, আমি কোনো পক্ষে যাইনি। জাস্ট বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আমার জানাশোনা কম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অধিকার পরস্পর সমান। কিন্তু পরস্পর সমান অধিকার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটা বস্তুগতভাবে সমান নয়। সেজন্যই ন্যায্য বন্টনের প্রসঙ্গটা আসে। যেমন, উদরপূর্তি করে খাওয়ার অধিকার সবার সমান হলেও সবাই সমপরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে না। আশা করি বুঝতে পেরেছো।
Munira Rahman Tashfi: নারী-পুরুষ উভয়ই মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই সমান। বিশেষত মানবীয় জায়গায়।
আপনার প্রদত্ত আয়াতগুলো ইবাদত সংক্রান্ত। পৃথিবীতে নারী-পুরুষ আল্লাহর বন্দেগি ও দাসত্ব করার ক্ষেত্রে এক সমান। মানুষের মর্যাদা আল্লাহর কাছে নারী-পুরুষ অভেদে সমান। নারীবাদীরা তো সেটা নিয়ে কথা বলছে না। বরং তারা ঐসব বিষয়গুলো নিয়ে বলে, যেসব বিষয়গুলোতে বৈষয়িক অধিকার জড়িত।
নারী অধিকারের প্রশ্নে সমানাধিকারের ইস্যু আসা তো জরুরি না। ন্যায্যতাই অধিকারের জন্ম দেয়। ন্যায্যতা ছাড়া তো অধিকার জন্মায় না। ফলে নারী অধিকারের প্রশ্নে সমতামুখী স্লোগানের ডামাঢোলে ন্যায্যতার প্রপঞ্চ চাপা পড়ে যায়।
সাপোজ, উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে যদি সমানাধিকার বা সমতাকে মানদণ্ড ধরা হয়, তাহলে কি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা হবে, না ক্ষুণ্ন হবে?
ফলে, এক্ষেত্রে গড়পড়তা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের চেয়েও যার যার ন্যায্য অধিকার নিয়েই কথা বলা উচিত৷ সমানাধিকারের বুলি অকার্যকর ও অবাস্তবিক।
আর, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে একাট্টা বিশেষ কিছু নাই। যখন ইনসাফ কায়েম থাকবে না, তখন দুর্বল নারী বা দুর্বল পুরুষ সবলের হাতেই নির্যাতিত হয়— এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ম্যাটার করে না। আদল কায়েম করার জন্য ইসলামী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, নাহয় দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন বন্ধ হবে না৷
চিরায়ত সত্য হলো, কর্তৃত্ব পুরুষের, আর মাতৃত্ব নারীর। মাতৃত্ব যেমন শুধু সন্তান জন্মদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি কর্তৃত্ব শুধু খবরদারির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ কর্তৃত্ব মানে লিডারশিপ, আর মাতৃত্ব মানে পাওয়ার অফ লাভ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তুমি আসলে কিছু জিনিসের মধ্যে কনফিউজ করছো। প্রাপ্যতা এবং ন্যায্যতা দুটো কিন্তু এক নয়। প্রাপ্যতা সমান হওয়া সত্ত্বেও, প্রাপ্তি সমান নাও হতে পারে। ইবাদতের বিষয়গুলোতেও নারী পুরুষ যে সমান, ব্যাপারটা তো তেমন নয়। সেসব তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো।
মেটাফিজিকেলি, এপিসটেমোলজিক্যালি, মোরালি, এথিক্যালি, লজিক্যালি এন্ড লিগ্যালি মানুষ মাত্রই সমান। এটিই নীতিগত বিষয়। বলা যায়, আইনের ফাউন্ডেশন। আইনের সমপ্রযোজ্যতা এবং আইন প্রয়োগের সমতা, দুটো যে এক নয়, এটা যদি বুঝতে পারো তাহলে আশা করি ভুল বুঝাবুঝি আর থাকবে না। আইনের সমপ্রযোজ্যতা হচ্ছে নীতি। আর আইন প্রয়োগের সমতা হচ্ছে, শুধুমাত্র সমক্যাটাগরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
মানুষের এই মানবিক সমতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য যে কর্মপন্থা বা পরিধি নির্ধারণ করতে হয়, বাস্তব কারণেই সেটি সমান হয় না। এমনকি পুরুষদের মধ্যেও বাস্তবে আদায়যোগ্য অধিকারসমূহ সমান হয় না। প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট ও বিশেষায়িত।
এসব বিষয় এত অকাট্য যে এগুলো নিয়ে আর বিস্তারিত কথা বলা দরকার বলে মনে করছি না। ন্যায্যতাকে সমতার বিকল্প হিসেবে মনে করা, এটা একটা কমন মিসটেক। দুইটা দুই লেভেল এর বিষয়।