(আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দাম্পত্যজীবনের খণ্ডচিত্র নিয়ে মধ্যরাতে পাঠযোগ্য একটি রম্য রচনা)
একই বিছানা। পাশাপাশি বালিশ। যে যার কাঁথা গায়ে দিয়ে অনতিক্রম্য দূরত্ব বজায় রেখে রাত্রিযাপন। এর চেয়ে যে যার ঘরে আলাদা বিছানায় ইচ্ছামতো ঘুমানো, সেটাই তো ভালো। তাই না? ইদানীংকালে স্বামীদের থাকে না যখন তখন স্ত্রীর শরীরী উষ্ণতা পাওয়ার অধিকার। অনেক শক্তিমান স্বামী ভিতরে ভিতরে আসলে খুব ভীতু। তারা ভয় পায় তাদের আত্মনির্ভরশীল বউদেরকে। কিছু একটা গড়বড় হলেই তারা স্ত্রীর কাছ থেকে শোনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, নির্দয় কটু কথা। সান্নিধ্য কামনা প্রকাশ করে এমন আচরণের জন্য স্বামীকে শুনতে হয় বয়সের খোঁটা, ‘আর কতো …’। সহ্য করতে হয় বিরক্তি প্রকাশমূলক ব্যবহার। মেনে নিতে হয় নিরবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গোপন যন্ত্রণা।
আসলেই তো। স্বামীদের উচিত নয় সংসারের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে যাওয়া স্ত্রীকে রাতবিরাতে ডিস্টার্ব করা। আদর্শ স্বামীর কাজ হলো ধৈর্যের অনুশীলন করা। সবর করা। স্ত্রীর সম্মতির অপেক্ষা করা। সামলে চলা নিজেকে, যাতে করে ক্ষুণ্ন না হয় স্ত্রীর প্রাইভেসি এতটুকু। উপযুক্ত সংকেত পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্বামী নামক পুরুষটাকে হয়ে থাকতে হবে নির্জীব, নিরাপদ। স্ত্রীর সুখী ও সুন্দর ‘সামাজিক দাম্পত্যজীবনে’ ব্যাঘাত ঘটানোর স্পর্ধা দেখানোর অপরাধে কখনো কখনো স্বামী নামক অসহায় পুরুষটার কপালে জুটতে পারে ভার্বাল এন্ড বিহেভিয়ারেল এবিউজ। তা নিয়ে অভিযোগ করা যাবে না কারো কাছে, কোনোখানে।
ভেজালটা যে-ই করুক, যে কোনো ধরনের দাম্পত্য সমস্যার জন্য দিন শেষে স্বামী নামক পুরুষটাই দায়ী। পুরুষদের তাই হতে হবে অনুগত, বাধ্যগত, সোবার। এবিউজ, তা হোক ফিজিকেল বা ভার্বাল, তা শুধু স্বামীই করতে পারে স্ত্রীকে। স্ত্রী নামক নিরীহ নারীটির দ্বারা পুরুষ এবিউজড হওয়া, হোক তা ভার্বালি বা ইমোশনালি, নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষিত হওয়ার মতো এটি অসম্ভব। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় আইনে এই ধরনের অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য। আইনের সকল প্রকেটশান নারীদের জন্য শুধু। পুরুষ মাত্রই সম্ভাব্য নিপীড়ক। ‘টক্সিক মাসকিউলিনিটি’ বলে কথা …।
স্বামীর প্রয়োজনে স্ত্রীর সাড়া দেয়াটা নির্ভর করে স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর। আধুনিক স্ত্রীদের যখন তখন ইচ্ছা করে না। তারা অনেক বেশি ‘সংযত’! তবে, স্ত্রী কখনো প্রয়োজন বোধ করলে স্বামীকে সাড়া দিতে হবে যন্ত্রের মত। চাহিবামাত্র, অনতিবিলম্বে ও পর্যাপ্তভাবে। অতঃপর, স্টপ মানেই স্টপ। নো, মানেই নো। ওয়ান সিঙ্গেল মোর স্ট্রাইক, ইউ উইল বি কনসিডার্ড অ্যাজ অ্যা রেইপিস্ট। ইয়েস, ইউ কুড বি একজিকিউটেড ফর ম্যারিটাল রেইপ। স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীকে যৌনদাস হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ, এটি গ্রহণযোগ্য নয় মোটেও। নারীরা কখনো নির্যাতক হতে পারে না। তারা দয়াবতী। মায়ার সাগর। সদা প্রেমময়ী। তাদের প্রেম নানারূপে প্রকাশিত। যা কিছুই একজন নারী করে, তা সবই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
নারীদের বাঁচাতে হবে পুরুষদের অযাচিত কামনার হাত থেকে। নারীদের কামনা পরিশীলিত। তারা যা কিছু দেখায় তা সবই বিউটিফিকেশন। নারীদের নির্দোষ বিউটিফিকেশনকে লোলুপ পুরুষরা দেখে অবজেক্টিফিকেশন হিসেবে। এটি ওইসব পুরুষদের মন-মানসিকতার সমস্যা। কিছু একটা দেখলে বা দেখালেই নারীদের অত সহজে উথলে উঠে না কিছু। নারীরা ভিকটিম। পুরুষ মাত্রই পটেনশিয়াল প্রিডেটর। অসহায় স্ত্রীদের বাঁচাতে হবে উদ্ধত স্বামীদের নির্যাতন থেকে।
পুরুষকেই সইতে হবে সব কিছু। পুরুষ যেহেতু সুস্থ ও সবল। প্রকৃতি তাকে ফেভার করেছে। সে মজা করে কেটে পড়ে। তার নাই রজঃচক্রের আপদ। মাতৃত্বের বোঝা বইতে হয় নারীকেই শুধু। ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে নারীটাকেই সময় দিতে হয় পরিবার-পরিজনের জন্য। কী নির্মম বাস্তবতা ….! ভাবা যায় ….?
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পুরুষকে প্রটেকশান দেয়ার কিছু নাই। নারীরাই শুধু ভালনারেবল। নারীরা শারীরিকভাবে গড়পরতা দুর্বল। অধিকাংশ নারী মানসিকভাবে কমবেশি বৈকল্যের শিকার। নারীদের জন্য একদৃষ্টিতে এটি বরং সুবিধার ব্যাপার। সুস্থ-সবল হওয়াটা পুরুষদের লস প্রজেক্ট। ‘আমি দুর্বল’ এই কার্ড দেখিয়ে নারীরা অনায়াসে পার পেয়ে যায়। পেয়ে যায় যাচ্ছে তাই করার ব্ল্যাঙ্ক চেক। এটাই স্বাভাবিক। এখনকার সমাজ ও সভ্যতার আবিষ্কার। নারীদের ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়াটা হলো ন্যায্যতার দাবী। এতে করে রিভার্স-ডিসক্রিমিনেশনের অভিযোগ তোলার কিছু নাই। বিছানা থেকে টিকেটের লাইন, সবখানে নারীদের একচ্ছত্র অগ্রাধিকার। এটি যদি মানতে না পারো, তবে তুমি যোগ্য নও এই সভ্য সমাজের একজন হওয়ার। চিন্তা-চেতনায় তুমি পুরুষতান্ত্রিক, মধ্যযুগের বাসিন্দা। তুমি নও সভ্য দেশের নাগরিক হওয়ার উপযুক্ত।
তুমি পুরুষ, তুমি সবল, তুমি সুস্থ। তাই তোমাকে হতে হবে শুধু দেনেওয়ালা। হতে হবে আবেগ-শূন্য যোগ্য সুশীল। এই সমাজে তোমার অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য নাই কোনো কাউন্টার। তাই তো দেখো, ‘মিসোজিনি’র বিপরীত শব্দটা কি, তা তুমিও জানো না, কেউই জানে না। দরকার হয় না, তাই। ‘পুরুষদের অভিযোগ’ মানেই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। নারী নির্যাতনের উছিলা। নারী পুরুষের যে ঐতিহাসিক জেন্ডার রোল, তা নিছকই সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট। ইতিহাস মানেই নারীর নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। তাই সভ্যতার এই অগ্রগতির সময়ে এসে ট্রাডিশনাল জেন্ডার রোলকে রিডিফাইন করা হয়েছে থরোলি। তুমি খবর রাখোনি, বা মানতে পারোনি, এটি তোমার সীমাবদ্ধতা। এখনকার এই অবাধ নারী স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিতে না পারলে, লেটেস্ট মূল্যবোধের এনকাউন্টারে কখন যে তুমি নাই হয়ে যাবে, তা টেরই পাবে না।
তাই, ঘুমোতে যাও লক্ষ্মী ছেলের মতো। কখন তোমার স্ত্রী-দেবীর ঘুম ভাঙবে, তিনি প্রসন্ন হয়ে উঠবেন তোমার প্রতি, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় প্রহর গোনো। এভাবে সিলিং ফ্যানের পাখা দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেলেও আফসোস করার কিছু নাই। আধুনিক শিক্ষিত সবঘরে এভাবেই মঞ্চস্থ হয় দিনেরাতে সুখী দাম্পত্যজীবনের সফল অভিনয়। এটি তুমি বোঝনি এতদিন? আশ্চর্য …!
ক’দিন আর বাঁচবে? এবার কিছু ধর্মকর্ম করো। মৃত্যুর কথা ভাবো। টিকে থাকার চেষ্টা করো অভিনব এই নারীবাদী মানবতন্ত্রের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। চেষ্টা করো সেল্ফ-রেস্ট্রিকটেড মেইল হিসেবে পারশিয়ালি নপুংসক একজন সুনাগরিক হতে। প্রাণীজগতের উদাহরণ টেনে লাভ নাই। মানব সভ্যতা এখন এক বিশেষ পিকে আছে। একবিংশ শতাব্দীর হাওয়া-বাতাস বোঝার চেষ্টা করো। অবাঞ্চিত মেইল ইগো ঝেড়ে ফেলে হয়ে উঠো একজন নারীবাদী আদর্শ পুরুষ।
নারীদের এই বিশ্বে একজন নির্বিবাদী পুরুষ হিসেবে তোমাকে জানাই বিশ্ব নারী দিবসের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। শুভরাত্রি।