“আল্লাহ সার্বজনীন হয়ে থাকলে দেড় হাজার বছর আগের দলিলপত্রে তা পাই না কেন?” – এমন একটা প্রশ্নের উত্তরে আমি আলোচনা করে দেখিয়েছি, ‘আল্লাহ’ শব্দটা syntactically আরবি ভাষার একটা শব্দ হলেও semantically পৃথিবীর সব ভাষাতেই এটি আছে।
উক্ত স্ট্যাটাসে আমি বলেছি, “আপনি যদি দেখেন, পৃথিবীর ইতিহাসে লিখিত যত পুরনো গ্রন্থ আছে সেগুলির মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কিত যে কোনো প্রাসঙ্গিক আলোচনাতে আল্লাহ তায়ালা আছেন। সেটা যত প্রাক-বিবর্তন রূপে বা বিকৃতভাবে হোক না কেন। হতে পারে সেটা সরাসরি ‘আল্লাহ’ নামক শব্দটি দিয়ে নেই।
কিন্তু আল্লাহ নামক শব্দটি দ্বারা যা বুঝানো হয় সেই মর্মার্থ নিয়ে সেখানকার প্রচলিত ভাষায়, তৎকালীন প্রচলিত শব্দে নিশ্চয়ই আছে। থাকবেই। না থাকার কথা নয়। আল্লাহ বলতে আমরা যে পরমসত্তাকে মিন করি, পরমেশ্বর, পরমসত্তা, সুপ্রিম গড, এবসলিউট, ব্রহ্ম এবং এ ধরনের শব্দগুলো দিয়ে ঠিক সেই পরমসত্তাকেই মিন করা হয়।
এই যে আমি syntax-semantics-এর পার্থক্য দিয়ে বিষয়টা বুঝালাম, আমাদের আলেম-উলামাগণ এ ধরনের অ্যাপ্রোচে কথা বলেন না। খেয়াল করে দেখেছি, উনারা potentiality-actuality’র পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্কটাই বুঝেন না। identical, necessary & occasional রিলেশানের ভিন্নতা সম্পর্কে উনাদের কখনো বলতে শুনি নাই। universal-particular সম্পর্কের ontology কী হতে পারে, তা উনারা আদৌ বুঝেন কিনা, আমি জানি না।
হতে পারে, আমি মাদ্রাসায় না পড়ার কারণে উনাদের পড়ালেখা সম্পর্কে জানি না। তাতে কী? উনারা তো দিনরাত মানুষকে হেদায়েত করছেন। কোনো তত্ত্ব বুঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি এ ধরনের বিষয়গুলো ভালো করে না জেনে কাউকে জীবন ও জগত সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়গুলো বুঝানোর চেষ্টা হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
হতে পারে, এগুলোকে উনারা উনাদের মধ্যে প্রচলিত টার্মে আমাদেরকে বলবেন, কিংবা মানুষ যেভাবে বুঝে সেভাবে বলে মানুষকে বুঝাবেন। তা না করে, ইসলাম সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করলে উনারা এত্তগুলো রেফারেন্স দিয়ে হিস্টোরিক্যাল অ্যাপ্রোচে লোকদেরকে বুঝানোর নামে শাটআপ করার চেষ্টা করেন।
জ্ঞানীসুলভ মাধুর্য, নমনীয়তা ও গভীরতা উনাদের মধ্যে দেখা যায় না। উনারা যেন সবজান্তা এবং সবসময় কেন যেন ক্ষেপে থাকেন। আদর্শ প্রচারের এটি ভুল পদ্ধতি। এ ধরনের ডগমেটিক অ্যাপ্রোচ ব্যাকফায়ার করতে বাধ্য।
মানুষ – যে ধরনের মানুষই হোক না কেন – যখন কোনো কিছু জানার চেষ্টা করে, কোনো কিছুকে যৌক্তিকভাবে বুঝার চেষ্টা করে, তখন তাকে অনিবার্যভাবে আদি ও অকৃত্রিম এক পথে অগ্রসর হতে হয়, যা সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ, সব মানুষের জ্ঞানগত গঠন কাঠামো এক ও অভিন্ন।
মানুষে মানুষে জ্ঞানগত পার্থক্য ও মতদ্বৈততা হওয়ার কারণ হলো সব মানুষ প্রকৃতিপ্রদত্ত (আসলে আল্লাহ প্রদত্ত) জ্ঞান-সক্ষমতাকে ও গিভেন রিসোর্সগুলোকে সমানভাবে কাজে লাগায় না।
যারা ইসলামের মতো এক কালোত্তীর্ণ জীবনাদর্শের পক্ষে প্রচারকাজ করবেন, তাদের দায়িত্ব হলো, মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির যে জায়গা, যাকে আমরা এক কথায় বিবেক বলি, সেটাকে অ্যাড্রেস করে কথা বলা। হুমকি-ধামকি দিয়ে লাভ কী? ভীতি আর লোভ দেখিয়ে আদর্শ প্রচার ও মানুষকে ভালো করার যে তরীকা উনারা ফলো করেন, তা টেকসই হওয়ার নয়। বরং মানুষকে যুক্তি দিয়ে কনভিন্স করার চেষ্টা করাই বেহেতর।
অবশ্য এর মানে এই নয় যে, মানুষকে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে পারলেই সে কোনো মতাদর্শকে গ্রহণ করে নিবে, ভালো হয়ে যাবে। এমনটা আপনি আশা করতে পারেন বটে। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। মানুষ কোনো আদর্শকে গ্রহণ করে তিনটা কারণে। যুক্তি-বুদ্ধি বা বিবেকের দাবি এর একটি। অপর দুটি হলো, ব্যক্তির একান্ত জীবনদৃষ্টি বা মনোভাব এবং বিদ্যমান ডমিন্যান্ট সাংস্কৃতিক আবহ।
এ নিয়ে “যুক্তি, সংস্কৃতি ও আবেগের যুগপৎ কার্যকারিতা” শিরোনামে আমার ৪:৩০ মিনিটের এই বক্তব্যটি শুনতে পারেন–
অনুরূপ বিষয়ে “জীবনাদর্শের দিক থেকে কেউ কেউ মানুষ। বাদবাকী সব জনগণ” – শিরোনামে প্রায় ১২মিনিটের এই আলোচনাটাও শুনতে পারেন–
এ ব্যাাপারে শেষ কথা হলো, কারো সাথে এ নিয়ে ঝগড়া করার মন-মানসিকতা আমার নাই। যারা এই লেখাটাকে বেয়াদবি হিসাবে নিবেন, তাদের কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আলেমদের হওয়ার ক্থা ছিলো, জ্ঞানী সম্প্রদায় ও দরদী সমাজকর্মী। তা না হয়ে তারা ক্রমে ক্রমে এক ধরনের ‘ইসলামিক পুরোহিত সম্প্রদায়’ হিসাবে গড়ে উঠেছেন। এই সংক্রান্ত সব সমস্যার গোড়া এখানে। অথচ, ইসলামে নাই কোনো যাজক শ্রেণী বা ধর্মীয় মধ্যস্থতাকারী কর্তৃপক্ষ। priest class system না থাকাটা বরং ইসলামের ধর্ম না হওয়ার অন্যতম বড় প্রমাণ।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
MH Monir: বাস্তবতা হলো অধিকাংশ/অনেক শাইখুল মাশায়েখগণের নিকট জানতে চাইলে, ইসলাম যে একমাত্র সত্য অবিকৃত দ্বীন– এই মৌলিক বিষয়টাই তারা অবজেক্টিভলি গুছিয়ে বুঝাতে পারেন না। আর এটা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জকভাবে স্থানীয় উলামাদের দাওয়াতী ফিকিরের দুর্বল অবস্থা প্রকাশ করে।
Abdullah Az Zubair: স্যার, আমাদের অথরিটি ক্রাইসিসের অন্যতম কারণ হইল কালেক্টিভ সাইকোলজি না বুঝা। গণমানুষের মনস্তত্ত্ব না বুইঝা ইসলামের ব্যাখ্যা ব্যক্তিগত ভার্সনে দেয়া হইতেসে। বিষয়টা এইরকম– আমি যেই লেভেলের কামেল বুযুর্গ, সাধারণ মানুষরেও সেই লেভেলেই কামালিয়াত অর্জন করতে হবে। নইলে প্রকৃত মুমিন হইতে পারবে না। এই চাপায়া দেওয়ার কারণেই কেউ কাউরে ঠিকমতো বুইঝা উঠতে পারতেসে না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। যাই হোক। আমার দৃষ্টিতে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা তথা একজন সত্যিকার ঈমানদার হওয়ার জন্য হাই লেভেলের ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ বলতে আমরা যা বুঝি সে রকম কিছুর আদৌ দরকার নাই। এ নিয়ে আমি বেশ কিছু লেখালেখি করেছি। কিছু বক্তৃতাও দিয়েছি।
যার মূল কথা হলো, আমাদের আশপাশের নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা, জীবনের সাধারণ নানা ঘটনা, আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং কিছুটা পড়াশোনা– এসবের সমন্বয়ে যে কোনো ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম। আমার মূলনীতি হলো, অযথা বেশি বেশি পড়াশোনা না করা। বরং বেশি বেশি চিন্তাভাবনা করাই জরুরী। সবাইকে সাধ্যমত পান্ডিত্য অর্জনের চেষ্টা করার যে টেনডেন্সি তা ভুল।
সারা জীবন পণ্ডিতি করার পেশায় নিয়োজিত থেকে এতটুকু বুঝেছি, সাদামাটাভাবে জীবনের সহজ সরল সত্যটাকে জানার জন্য এবং সঠিক পথে চলার জন্য এসব উচ্চমার্গীয় তত্ত্ব নিষ্প্রয়োজন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিকর। এসব কিছুর আদৌ দরকার নাই।
তবে যারা সমাজের সেইফ-গার্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন তাদেরকে অনেক বেশি জানতে হবে। এবং অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। জ্ঞানের গভীরতা এবং উপলব্ধির স্বচ্ছতা না থাকলে কারো পক্ষে কোনো মতাদর্শের কাণ্ডারী হওয়া অসম্ভব।
Abdullah Az Zubair: ঠিক বলছেন। আর আমি বলতে চাইছি, আমাদের আলেমগণ ‘মাওয়ায়েজে হাসানাহ’র মধ্যে ‘হিকমাহ’ অ্যাপ্লাই করেন না। অথচ মানুষকে ওয়াজ করার আগে কোরআনে হিকমাহ অর্জনের গুরুত্ব দেওয়া হইসে। এই হিকমাহর ভিতরে তো হিউম্যান স্টাডিজ, কন্টেক্সট, সাইকোলজি, ফিলোসফিসহ আরো যা আছে অনেক কিছুই ঢুইকা যায়। দু:খের বিষয়, উনারা এইসব এড়াইয়া টেক্সট নিয়া ঝড় তুলেন। বাইনারি কথাবার্তা বলেন। বিশাল ইসলামটারে জায়েজ-নাযায়েজ মানদণ্ডে আইনা খাটো কইরা ফেলেন। তখন দুনিয়া থাকে একদিকে, ইসলাম আরেক দিকে। ফলে তাঁদের ডিসকোর্স ম্যাসপিপল নিতে পারে না জীবনঘনিষ্ঠ না হওয়ার কারণে।
আর তাঁরা ব্যক্তিগত ইসলাম চর্চাপদ্ধতিকে গণমানুষের উপর চাপায়া দেওয়ার চেষ্টা করেন। সবাইরে নিজের মতো বানানোর চেষ্টা করেন। এইখানে আইসা কমিউনিকেশন মাইর খায়া যায়। অথচ সাহাবীদের মধ্যে নিতান্তই কম আমলকারী থেকে শুরু করে রাত-দিন আমলকারী – সবধরনের মানুষই ছিলেন।