(প্রায় আড়াই বছর আগে ফেইসবুকে শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকীর কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এই আলাপ)
Mahmud Siddiquee: আমার মনে হয়, ইসলাম বলতে আমরা কী বুঝি বা ইসলামকে আমরা কীভাবে দেখি এর ভিত্তিতে ইসলামের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থির হয়ে যায়। তাই প্রথম যে প্রশ্নটি আমরা সিরিয়াসলি করবো- আপনার দীর্ঘ পড়াশোনা, নানা অভিজ্ঞতা কী বলে, ইসলাম আসলে কী?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলাম একটি জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা। এককথায় একে পবিত্র কোরআনে দ্বীন বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা এমনভাবে দ্বীনের কাজ করো যাতে করে তা অপরাপর দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়।
ইসলাম কী, এটা বোঝার দুইটি পদ্ধতি। একটা হলো ইসলাম যা বলে। অপরটা হলো ইসলাম যা কিছুর বিরোধিতা করে।
ইতিবাচক দিক থেকে ইসলাম হলো, উপরে যা শুরুতে বললাম, একটি জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা। এবং নেতিবাচক দিক থেকে ইসলাম হলো প্রতিদ্বন্দ্বী বা অল্টারনেটিভ যেকোনো জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার বিরোধী বিশেষ এক জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা। ঈমান বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো ইসলামী জীবন দর্শন। শরিয়া বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো ইসলামী জীবন ব্যবস্থা।
Mahmud Siddiquee: আমরা তাড়াহুড়ো করবো না। কোনো সম্পূরক প্রশ্ন থাকলে সময়মতো সেদিকে আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। এখন আমাদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রশ্ন হলো- মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে দুনিয়াতে পাঠানো কিংবা রিসালাতেরই উদ্দেশ্য আসলে কী? উম্মাহর মধ্যে এই উদ্দেশ্য নিয়ে বিভেদ বা মতপার্থক্যের বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক পটভূমি আছে কি না? যেমন- কেউ বলেন তিনি শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কেউ বলেন রহমত। কেউ বলেন বিপ্লবী। আপনি কি মনে করেন, এগুলোর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য আছে? বৈপরীত্য না থাকলে সেগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে এতো গভীর বিভক্তি তৈরি হলো কেন?
আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো- কুরআন হাদীসে রাসূলকে নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। আমরা কি যেকোনো একটি চিত্রকে অবলম্বন করে বিভক্ত হয়ে যাবো, নাকি তাঁকে সামগ্রিকভাবে বোঝার কোনো ইসলামিক বাধ্যবাধকতা আছে? তাঁকে সামগ্রিকভাবে না বুঝে আমরা রিসালাতের কিংবা রাসূলুল্লাহকে প্রেরণের উদ্দেশ্য বুঝতে পারি কিনা? এক্ষেত্রে কুরআনের অবস্থান কি? উম্মাহ কি রাসূলুল্লাহ, কুরআন এবং রিসালাতের বা ইসলামের বা মানবজাতির ইতিহাসকে সমন্বয় করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছে? যেখান থেকে বলা যেতে পারে আমাদের উদ্দেশ্য এই, করণীয় এই…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিবেকের মধ্যে ভাল-মন্দের জ্ঞান দিয়ে দিছেন। যেভাবে আমাদের মধ্যে দেয়া আছে সুর ও সৌন্দর্য সম্বন্ধে ধারণা। সুর ও সৌন্দর্য সম্পর্কে পূর্ব-জ্ঞান থাকার কারণে আমরা বলতে পারি, এটা সুন্দর হয়েছে, ওটা সুন্দর হয় নাই। মনে মনে আমরা সবাই ভাল গায়ক। কিন্তু গাইতে পারি না। ছবি আমরা আঁকতে পারি না। কিন্তু ঠিকই বলতে পারি, কোনটি সুন্দর হয়েছে।
একইভাবে, নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও খোদাতায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত। ফিলসফির দৃষ্টিতে অবজেক্টিভ। জ্ঞানতত্ত্বের দৃষ্টিতে এটি নরমেটিভ। অর্থাৎ সাবজেক্টিভিটি ও অবজেক্টিভিটির সমন্বয়। নৈতিকতা সম্পর্কে আমরা মোটাদাগে আন্দাজ করতে পারলেও কোনো ব্যাপারে ঠিক কীভাবে কী করলে তা নৈতিকতার দাবীকে সঠিকভাবে পূর্ণ করবে, অনেক সময়ে তা আমরা ঠিক ঠাহর করতে পারি না। মনের গানটা যেভাবে আমরা কণ্ঠে আনতে পারি না। শিল্পীরা সেটা পারে। তাই তারা শিল্পী। নবী-রাসূলগণ সেভাবে নৈতিকতার শিল্পী। তাঁরা ঠিক করে মিলিয়ে দেন, যা আমরা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে ভাবি।
তাছাড়া, আমাদের কাছে গায়েবি কিছু বিষয় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সুবিধার জন্য আমাদের কাছে প্রকাশ করে দিতে চান। কমপক্ষে আমরা যতটুকু বুঝবো ততটুকু দিয়ে। আমাদের ভাষায়। এই কাজের মাধ্যম হিসাবে ভূমিকাপালন করেন নবী-রাসূলগণ।
এককথায় বললে, নবুয়ত হলো তাওহীদের আউটকাম বা অব্যবহিত পরিণতি।
এবার আসেন নবী মুহাম্মদের (স) প্রসঙ্গে। তিনি একাধারে প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা, আধাত্মিক গুরু ও সেনাপতি। একেকটা দিক থেকে তিনি একেক রকম। এর কোনোটা অপরটাকে নাকচ করে না। এই ধরনের বহুমুখী বা বিপরীতমুখী ইমেজের কারণ হলো তিনি মানুষের জীবনের পূর্ণাঙ্গ উদাহরণ। এই দিকগুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে মানুষের জীবন পূর্ণতা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা পায় না।
ইসলাম মানুষকে দেখে সামগ্রিকভাবে। সমগ্র জগতের প্রেক্ষাপটে। জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতিনিধি হিসাবে। তাই রাসূলকেও (স) দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে। মানতে হবে নিজের অবস্থা অনুসারে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আমাকে ভয় করে যতটুকু তোমার পক্ষে সম্ভব।’ তিনি আরো বলেছেন, আমি কারো ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেই না।’
রাসূলকে (স) নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির কারণ অন্ধের হাতি দেখার মতো। চক্ষুষ্মান ব্যক্তি এমন ভুল করবে না। তাই রাসূলকে বুঝতে হলে রেসালত কেন এবং রাসূল কাদের জন্য কী কারণে রাসূল, তা বুঝতে হবে। কোরআন-হাদীসের নির্মোহ ও সামগ্রিক অধ্যয়ন; এবং সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হতে এটি আমরা জানতে পারি। চোখ বন্ধ করে যেমন দৃশ্যমান বাস্তবতাকে অনুমান করা যায় না, তেমন করে অন্ধত্ব ও বায়সনেস নিয়ে বিদ্যমান বাস্তবতাকে অনুধাবন করা যায় না।
আপনার ৩য় প্রশ্ন: “উম্মাহ কি রাসূলুল্লাহ, কুরআন এবং রিসালাতের বা ইসলামের বা মানবজাতির ইতিহাসকে সমন্বয় করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছে? যেখান থেকে বলা যেতে পারে আমাদের উদ্দেশ্য এই, করণীয় এই…”
হ্যাঁ, তাতো শুরুতেই পেরেছে। মানবজাতির ইতিহাসের সাথে তাওহীদ, রেসালত ও আখিরাতের ধারণাকে সমন্বিত করে ইসলাম একটা সমন্বিত বিশ্বদৃষ্টি বা প্যারাডাইম দিয়েছে। বিশেষ এই জীবনদর্শন ও জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে একই কথাকে বিভিন্ন শব্দবন্ধ ও বাক্যবিন্যাসে কোরআনে বার বার বলা হয়েছে। তার একটি হল, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।…” সুরা আল আলে ইমরান ১১০ নং আয়াত।
এই আয়াতে যা বলা হয়েছে তাতো রাসুলুল্লাহ (স) নিজেই বাস্তবায়ন করে গেছেন। তিনি মক্কা হতে শুরু করে মদীনার জিন্দেগীতে তথা নবুয়তী জীবনভর মানুষকে কল্যাণের পথে ডেকেছেন। মক্কাতে না পারলেও মদীনাতে হিজরত করার পর থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে ন্যায়ের আদেশ দেয়া ও অন্যায়ের নিষেধ করার নির্দেশ পালন করেছেন। সর্বোপরি, আল্লাহর ওপর ঈমান রেখে চলেছেন। তাঁর সাহাবীগণও তাই করেছেন। পরবর্তীগণও ঠিক তাই করেছেন।
ইকামতে দ্বীনের এই দায়িত্বপালন সেই থেকে এ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। কিয়ামত পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে বলেই প্রতীয়মান হয়। এই দায়িত্ব পালনের মাত্রা তথা কোয়ালিটিকে যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে দেখি, মুসলিম উম্মাহর অন্তর্গত প্রত্যেক ব্যক্তি এই দায়িত্ব সমভাবে পালন করেনি বা করতে সক্ষম হয়নি বা হবে না। আল কোরআনের ৫৬ নং সুরা আল ওয়াকিয়া’র ৭ থেকে ১৪ আয়াত দ্রষ্টব্য। এই দায়িত্বপালনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মাত্রাগত তারতম্য হলেও সামষ্টিকভাবে এই ধারাটি অব্যাহত রয়েছে।
ইসলামে ব্যক্তি ও সমষ্টির এক অভাবিত সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। মানুষকে পাঠানো হয়েছে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। সে জন্য মানুষের পরিশুদ্ধি বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। অন্যদিকে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা হলো ব্যক্তিগত। জবাবদিহিতার ব্যবস্থাটাও একান্ত ব্যক্তিগত। এ বিষয়ে আমার এই লেখাটা পড়তে পারেন, “ব্যক্তি ও সমাজের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ইসলাম ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার পার্থক্য”। এই ভিডিও বক্তব্যটিও এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক হতে পারে: “ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও ইকামতে দ্বীন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে”।
Mahmud Siddiquee: শুকরিয়া। ইসলাম প্রসঙ্গে আমাদের শেষ প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তা’লার উলুহিয়াত নিয়ে। আমরা ঈমানে প্রবেশের ক্ষেত্রে কালিমাই তায়্যিবায় যার স্বীকৃতি দিতে হয় আবশ্যিকভাবে। প্রশ্ন হলো, কেন উলুহিয়াত?
সূরা আরাফে দেখা যায়, সমস্ত নবী তাঁর কওমকে একটা কথাই অনিবার্যভাবে বলছেন- ইয়া কওমি বুদুল্লাহ মা-লাকুম মিন ইলাহি গাইরুন- হে আমার জাতি, আল্লাহ তা’লার ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই। আবার আল্লাহ মানে ব্যাকরণগতভাবে আল+ইলাহ। অর্থাৎ, আল্লাহ=আল+ইলাহ। আল্লাহ তা’লার ইলাহ হওয়া বা তাঁর উলুহিয়াতকে কুরআন হাদীসে আরো নানাভাবে সিগনিফাই এবং ডিগনিফাই করা হয়েছে।
এই ইলাহ মানে কি শুধু মা’বুদ? উপাস্য? (যদিও ইসলামে ইবাদাতের ধারণাও অত্যন্ত ব্যাপক, রীতিমতো সর্বগ্রাসী বলা যায়। সে যা’ই হোক।) আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন, চবি কেন্দ্রীয় মসজিদে ইলাহ এর অনুবাদ লিখা হয়েছে, ‘উপাস্য ও হুকুমকর্তা’।
এই উলুহিয়াতের সাথে কি হুকুম বা সার্বভৌমত্বের কোনো অপরিহার্য সম্পর্ক আছে? প্রত্যেক মতাদর্শিক গোষ্ঠী ইসলাম সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ ব্যাখ্যার সাথে সাযুজ্য রেখে ‘ইলাহ’ এর অনুবাদ করে, এবং ইবাদাতের সংজ্ঞায়নও করে সেভাবে। আপনার বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা কী বলে? এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ কি নেই? [একটা উম্মাহ তাদের আবশ্যিক স্বীকার্যের প্রথম বাক্যটির স্রেফ অনুবাদ নিয়ে সাংঘাতিক বিভ্রান্তিতে নিপতিত। কীভাবে দেখেন বিষয়টি? উম্মাহর অধঃপতনের সাথে এরও কি কোনো সম্পর্ক আছে?]
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অধঃপতন ও উর্দ্ধপাতন, এগুলো হওয়াই স্বাভাবিক। প্রত্যেক আদর্শেই এটি ঘটেছে। এমনকি ঈমানেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ‘যা দাত হুম ঈমানা’ দ্রষ্টব্য। মানুষের কোনোকিছু লিনিয়ার বা স্থির থাকা অসম্ভব।
আর এসব শাব্দিক অর্থগত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আমি অপারগ ও অনাগ্রহী। এ ব্যাপারে আমার একটা কথা আছে। এটাকে তত্ত্বও বলতে পারেন। সেটি হলো, multiplicity of interpretation does not prove that there is no correct interpretation. তারমানে হলো, বহুবিধ ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের মধ্যে কমপক্ষে একটা সঠিক হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা বাউন্ডারির মধ্যে সবগুলোই সঠিক। যেমন করে রাস্তার ডানদিক হলো বামদিকের বিপরীত। কিন্তু দু’টোই বৃহত্তর অর্থে রাস্তারই অংশ। সে জন্য আপনার এই প্রশ্নটিতে আমি এনগেইজ হচ্ছি না।
এর অন্যতম কারণ হলো, ইসলামের মূল বিষয়গুলো সাদামাটাভাবে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের কাছেই পরিষ্কার। তিনি শিক্ষিত হোন বা অশিক্ষিত হোন। তিনি আলোকিত মনের মানুষ হলেই হলো। আমাদের বিবেক দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, what is what, অথবা, কোন পরিস্থিতিতে আমাদের কী করণীয়।
আর, এই প্রশ্নটি কি ৪র্থ প্রশ্ন? প্রশ্নের মধ্যে এটি উল্লেখ করলে ভাল হয়। আর, আপনি কি প্রশ্নগুলো ঠিক করেছেন? যদি করে থাকেন, তাহলে মোট প্রশ্ন কয়টা? এসব জানতে চাইছি, কথার পিঠে কথা দিয়ে আড্ডা চলে, আলোচনা হতে হয় সুনির্দিষ্ট। একটা বিষয়ের মধ্যে সবগুলো বিষয়কে নিয়ে আসলে তা আর সুনির্দিষ্ট থাকে না। জগতের কোনা কিছুই একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়।
আপনি যদি প্রশ্নমালা ঠিক না করে থাকেন তাহলে এই সাক্ষাতকারটির এখানেই ইতি টানা উচিত। আর যদি ঠিক করে থাকেন তাহলে তা আমার কাছে পাঠাতে পারেন। বা পাঠানোই উচিত। সাক্ষাৎকার গ্রহণের এটাই নিয়ম।
আপনাকে আমি এতটুকু ফেভার করতে পারি, আপনি প্রশ্নগুলো আমার কাছে না পাঠালেও বলবেন, কোন বিষয়ে ঠিক কতোটি প্রশ্ন আপনি করবেন। এই সংখ্যাটি খানিকটা বাড়তে পারে। খুব বেশি নয়।
ব্রড কোনো বিষয়ে অনির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশ্ন নিয়ে অগ্রসর হওয়া মুশকিল। আপনার প্রশ্নগুলো জানতে পারলে সেগুলোর একটা সমন্বিত উত্তর দেয়া সহজতর।
শুরুতে যেমনটা আপনি বলেছেন, “ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামী রাজনীতি নিয়ে একটু গুছিয়ে আলোচনা” করতে চান, সে প্রসঙ্গে আমি তো শুরুতেই বলতে পারতাম, ‘আমার সাইটগুলোতে আমি ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী রাজনীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সব কথা বলেছি। সেগুলো পড়েন। এবং পড়ার পরে ঠিক কোন জায়গায় আপনার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তা বলেন।’ আমি কিন্তু আপনাকে তা বলিনি।
কিন্তু আপনি যদি এ সব বিষয়ে আমার দশ বছরের লেখালেখি ও বক্তব্যকে রিপিট করতে চান, তা ডিফিকাল্ট, আননেসেসারি এন্ড ইনডিসেন্ট। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন।
Mahmud Siddiquee: যেহেতু শুরুতেই এটাকে সাক্ষাৎকার বলেছি, তাই আমি এখানে কোনো বিতর্কে যাবো না। আমার প্রশ্ন খুব বেশি না। যেমন ইসলাম নিয়ে চারটা প্রশ্ন করলাম, ১. ইসলাম, ২. রিসালাত ও নবী মুহাম্মদ (স), ০৩. কুরআন ও সিরাত, ৪. কালিমা-ই-তায়্যিবা বা আল্লাহর উলুহিয়াত প্রসঙ্গে।
ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে হয়তো ৪টা প্রশ্ন হবে। ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে হয়তো আরো ৪টা। এই…
আমি আপনার কষ্টের বা মনঃকষ্টের কারণ হতে চাই না। আসলে একটা বিষয়কে সহজ-সরল করে বোঝার জন্য অনেক বইপত্র প্রবন্ধ নিবন্ধের পরও সাক্ষাৎকার গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্বল্প পরিসরে সামগ্রিকতাকে ধরার একটা প্রয়াস থাকে।
যাহোক, আপনি যদি এই উলুহিয়াতের প্রশ্নে আপনার অবস্থান বা মতামত ব্যক্ত করেন, তাহলে আমরা পরবর্তী প্রসঙ্গে চলে যাবো। না দিতে চাইলেও আপনার ইচ্ছে। সাক্ষাৎকারের নিয়ম অনুসারে আগে থেকেই প্রশ্ন সরবরাহ না করায় দুঃখ প্রকাশ করছি। শুরু থেকেই সে ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। সেজন্যই আপনি উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে যতটুকু প্রয়োজন সময় নিতে পারেন। আমরা তাড়াহুড়ো করবো না, সে কথা বলেছি। সাক্ষাৎকারটি শেষ করার ক্ষেত্রে আপনার স্বভাবসুলভ সহৃদয় ও সপ্রাণ উপস্থিতি কামনা করছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: উলুহিয়াত প্রশ্নে উত্তর তো উপরেই দিলাম। তাছাড়া “আপনার কষ্টের বা মনঃকষ্টের কারণ হতে চাই না” কথাটা ঠিক বুঝলাম না। কেউ আমার সাথে একমত হবেন না, তা যদি আমার মনোকষ্টের কারণ হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে বলবো, এই আশাঙ্কা অমূলক। ফিলসফির লোক হিসেবে আমরা দ্বিমত চর্চায় অভ্যস্ত। আমি মনে করি, মত ও দ্বিমতমাত্রকেই যু্ক্তি দিয়ে সাপোর্ট করতে হয়। হ্যাঁ, যুক্তির মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। তা আমরা কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বুঝতে পারি। ক্ষুদ্র দ্বিমত সত্বেও বৃহত্তর মতৈক্যে আমি বিশ্বাস করি। কথাটাকে আরবিতে বলে, আল ইত্তিহাদ মায়াল ইখতিলাফ।
Mahmud Siddiquee: পর্ব-০২, প্রশ্ন-০১. ইসলামী আন্দোলনকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন? একজন মানুষের ইসলামে প্রবেশ এবং ইসলামী আন্দোলনে প্রবেশের মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে? অর্থাৎ, ইসলামী আন্দোলন এড়িয়ে আমরা ইসলামে প্রবেশ করতে পারি কিনা?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ওয়ানস এগেইন, ইসলাম হলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় মৌলিক প্রশ্নসমূহের এক ধরনের উত্তর। দু’টি বিষয়কে সামনে রেখে ‘কোন ইসলামকে’ আমরা অনুসরণ করবো তা নির্ধারণ করতে হবে। (১) ইসলামের উৎসগ্রন্থসমূহে ইসলামকে কীভাবে বর্ণনা করা হয়েছে; এবং (২) অধিকাংশ ইসলাম অনুসারীরা ইসলামের যে ধরনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে সঠিক মনে করে।
পূর্বেই বলেছি, ইসলামে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা তথা মানবজীবনের সবদিককে ক্রমসোপানমূলকভাবে সমন্বয় করা হয়েছে। এই দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন হলো ইসলামের অপরিহার্য পরিণতি বা necessary engagement।
তাহলে, ইসলামী আন্দোলন বলতে আমি কী বুঝাচ্ছি? এটি পরিষ্কার না হলে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা ক্লিয়ার হবে না।
সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিএসসিএস) কর্তৃক প্রকাশিত “ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন” শীর্ষক রচনায় ইসলাম কীভাবে ইসলামী আন্দোলন হয়ে উঠে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে আমি কিছু গ্রাফিকেল ইমেজ ব্যবহার করেছি। সংক্ষেপে বললে, মানুষ গোড়াতে বুদ্ধিবৃত্তি, সৃজনশীলতা ও আধ্যাত্মিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়। এসবের পূর্ণতার দাবীতে সে যখন কর্মতৎপর হয় তখন সে বাধ্য হয়ে এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। একে আমি বলেছি প্রাথমিক স্তর। প্রথমটিকে বলেছি ভিত্তি স্তর।
প্রাথমিক স্তরের যে এনগেইজমেন্ট তা ব্যক্তিকে পরবর্তী স্তরে এনগেইজ করে। এটি হলো রাজনীতি। মানুষ নিজের জন্য যা ভাল মনে করে তা যদি সে সমাজের সব মানুষের জন্যও ভাল মনে করে তাহলে স্বভাবতই সে অন্যদের মধ্যেও তার এই মূল্যবোধগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। এ লক্ষ্যে সে যা কিছু করবে সংক্ষেপে তা-ই হলো সামষ্টিক নৈতিকতা (public morality) বা রাজনীতি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফল হলো শাসন ক্ষমতা, যা রাষ্ট্র ও সরকারের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিফলিত বা রূপায়িত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা সংহতকরণের পরিণতিতে উক্ত ধরনের বিশেষ মতাদর্শ এক পর্যায়ে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ লাভ করে। এভাবে একটা সভ্যতা গড়ে উঠে।
এই পুরো প্রক্রিয়াতে এক্টর হচ্ছে ব্যক্তি মানুষ। ফ্যাক্টর হলো স্বীয় মতাদর্শের প্রতি তার কমিটমেন্ট ও সিরিয়াসনেস। যে কোনো আদর্শের জন্যই এই প্রক্রিয়াটি অনিবার্য। ইসলামী জীবনদর্শন ও জীবনব্যবস্থার পক্ষে ব্যক্তিমানুষ ও ব্যক্তিসমষ্টি যখন এই প্রক্রিয়া অনুসারে অগ্রসর হবে তখন সেই অবস্থাকে আমরা সামগ্রিকভাবে বলবো ‘ইসলামী আন্দোলন’। এককথায় বললে, ইসলামী আন্দোলন হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কথাটা অন্যভাবে বললে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নাই যে ইসলামে তা আদৌ ইসলাম নয়।
কোথাও বা কারো কারো ইসলামের আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে ইসলামী আন্দোলনের প্র্যাকটিকেল এনগেইজমেন্ট তেমনভাবে হয়ে উঠে না। ব্যক্তির দুর্বলতা হতে শুরু করে বাস্তব অসুবিধা, নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি হতে পারে। তারমানে, কেউ রাজনীতি করছে না বা জিহাদ করছে না বিধায় আমরা ধরে নিবো না যে সে ইসলামী আন্দোলনে নাই। ‘কর্মের স্বরূপ ও ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভর করে’ – এই হাদিসটাকে এক্ষেত্রে আমরা গাইডিং প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে নিবো।
দ্বীনের অখণ্ড ধারণাকে বুকে লালন করে কেউ যদি তার জন্য উপযোগী কোনো কাজে ব্যাপৃত হয়, তাহলে আমরা বলবো, অবশ্যই তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে তথা ইসলামী আন্দোলনে নিয়োজিত আছেন। এই দৃষ্টিতে দেখলে আমরা বলতে পারি, কেউ যখন ইসলামে প্রবেশ করে তখন সচেতনভাবে হোক কিংবা অজান্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর আঙ্গিকে তথা ইসলামী আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।
ইসলামী আন্দোলনের যুগোপযোগী মডেলের আওতার মধ্যে থেকে যে কেউ কর্মতৎপর হলে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে বিবেচিত হবেন, যদিও হতে পারে, তিনি প্রচলিত কোনো ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। ইসলামী আন্দোলনকে ইসলামী আন্দোলন হওয়ার জন্য একটি মাত্র সংগঠন থাকা এবং সেটির নামে ইসলামী আন্দোলন ফ্রেইজটি থাকা বা ইসলামী কোনো সাইনবোর্ড থাকা জরুরি বলে মনে করি না।
Mahmud Siddiquee: পর্ব-০২, প্রশ্ন-০২, ইসলামী রাজনীতি বলতে আপনি কি একটি গিভেন এরিয়াতে সেখানকার কাঠামো অনুসরণ করে স্রেফ দলীয় বা সে ধরনের কোনো রাজনীতি করা বোঝেন? নাকি ইসলামের অভিমুখে ও অনুকূলে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি সব ধরনের ‘পাওয়ার’কে সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে ডীল করাকে বোঝেন? এ ধরনের ডীলিং কি ঐচ্ছিক? নাকি প্রত্যেকে তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে অংশগ্রহণে বাধ্য?
অর্থাৎ, বিদ্যমান যে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তাগুতি ব্যবস্থাকে নির্বিকার মেনে নিয়ে কারো নিজেকে মুসলিম দাবি করা কতটুকু যথার্থ?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কিছুদিন আগে কোথাও লিখেছিলাম, live for today as well as all days to come. এমনভাবে জীবন যাপন করো যাতে আজকের এই দিনটির সাথে তোমার অনন্ত আগামীর সবগুলো দিনের দাবিও পূরণ হয়ে যায়। এ কথাটির মতোই আমাদেরকে কর্মতৎপর হতে হবে একইসাথে স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং বৃহত্তর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে। অর্থাৎ বিবেচনাযোগ্য সবকিছুকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। এই বিবেচনা হবে ঐকান্তিকতা দিয়ে। কোনো ইস্যু বা বিষয় যখন সামনে আসবে তখন বৃহত্তর আদর্শের প্রেক্ষাপটে এবং লোকাল ফ্যাক্টরগুলোকে বিবেচনা করে একটা optimal decision নিতে হবে। এটি করতে হবে ঐকান্তিকতা দিয়ে। পণ্ডিতি দিয়ে নয়। কোনো কিছু যখন কোনো না কোনোভাবে হাজির হবে, তখন সেটাকে উপেক্ষা না করে বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে ‘ফ্যাক্টর’ বের করে সেগুলোর প্রেক্ষিতে কী করা যায় তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণে লিপ্ত হওয়ার দরকার নাই। যা করণীয় তা আমাদের বিবেকই বলে দেয়। বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর মনোভাব জারি থাকলেই হলো। বাকীটা আল্লাহ ভরসা।
হ্যাঁ, তেমন কিছু যোগ্য ব্যক্তি সুরা তাওবার ১২২নং আয়াতের দাবী অনুসারে থিংক-ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করবে। তাদের কথা আলাদা।
ব্যক্তির দিক থেকে সমাজ পুনর্গঠনের কাজে অংশগ্রহণের ফর্মূলা আমরা রাসুলুল্লাহর (স.) সেই হাদিস হতে জানতে পারি যাতে তিনি বলেছেন, তোমরা অন্যায় কাজে হাত দিয়ে বাধা দাও। না পারলে মুখে বলো। তাও না পারলে অন্তরে ঘৃণা করো।
এই নীতিনির্ধারণী হাদিস হতে আমরা বুঝতে পারি, তাগুতকে যে অন্তত ঘৃণাও করলো না, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তার ঈমান দুর্বল স্তরেরও নীচে।
উক্ত কথা হতে যাতে কেউ ভুল না বুঝে সেজন্য আরেকটা কথা বলা জরুরী মনে করছি। হক-বাতিলের দ্বান্দ্বিকতাকে বুঝতে গিয়ে কেউ কেউ এই ভুল করে। তারা মনে করে, যে লোকটা দৃশ্যত বাতিলের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে, সে আসলে বাতিল বা তাগুতের পক্ষ-শক্তি। অথচ, হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী ঈমানের কমজুরি বা বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসাবে কেউ প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পথ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করতে পারে।
এ বিষয়ে চরমপন্থীরা আরো একটা মারাত্মক ভুল করে। তারা তাগুত, মুনাফিক ও জালিম-ফাসিক শ্রেণীকে এক ক্যাটাগরির বলে মনে করে। অথচ, নিছক জালিম ও ফাসিকগণ ঈমানদারদের শ্রেণীভূক্ত, যদিও তারা অতীব নিম্নস্তরের মু’মিন।
Mahmud Siddiquee: ধন্যবাদ। কিন্তু আমার মনে হয়, এই জবাব প্রশ্নকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। আমরা এখানে অন্যের অবস্থা নয়, বরং নিজের বা নিজেদের অবস্থা বুঝতে চাচ্ছি। এবং কৌশল হিসেবে নয়, বরং নীতি হিসেবে ব্যক্তি মুসলিম, আমি বা সমষ্টি মুসলিম, আমরা বিদ্যমান তাগুতি ব্যবস্থা বা আল্লাহদ্রোহী শক্তিকেন্দ্রসমূহকে কীভাবে ডীল করতে বাধ্য? বা আদৌ বাধ্য কিনা? এখানে জালিম, মুনাফিক বা তাগুতকে এক করতে চাচ্ছি না। তাগুতকে তাগুত বিবেচনা করেই বলেছি। অর্থাৎ, সেই আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী যারা আল্লাহর বিধান বা মূলনীতির সামাজিকীকরণকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায়। [এখানে চাইলে আপনি আরো একটু করে রিপ্লাই দিতে পারেন। আমি অন্য একটি কমেন্টে তথা অন্য প্রশ্নে (০৭ নং) চলে যাচ্ছি। চেষ্টা করবো প্রশ্নের সংখ্যা ১২ থেকে ১০ কিংবা ৮-এ নিয়ে আসতে। আশাকরি আপনার এটুকু সময়দানকে সময় নষ্ট মনে করে বিরক্ত হবেন না]
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমি পুরো ব্যাপারটাকে খুব এনজয় করছি। আমার এ কথার মধ্যে সম্পূরক প্রশ্নটির উত্তর দেয়া আছে, “ব্যক্তির দিক থেকে সমাজ পুনর্গঠনের কাজে অংশগ্রহণের ফর্মূলা আমরা রাসূলুল্লাহর (স) সেই হাদিস হতে জানতে পারি যাতে তিনি বলেছেন, তোমরা অন্যায় কাজে হাত দিয়ে বাধা দাও। না পারলে মুখে বল। তাও না পারলে অন্তরে ঘৃণা করো। এই নীতিনির্ধারণী হাদিস হতে আমরা বুঝতে পারি, তাগুতকে যে অন্তত ঘৃণাও করলো না, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তার ঈমান দুর্বল স্তরেরও নীচে।… হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী ঈমানের কমজুরি বা বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসাবে কেউ প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পথ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করতে পারে।”
Mahmud Siddiquee: প্রশ্ন নং- ০৭. আপনি ইসলামী আন্দোলনকে কীভাবে, মানে কোন কোন জায়গায়, ইসলামী রাজনীতি থেকে পৃথক করবেন? ব্রড সেন্সে, রাজনীতি বলতে আমরা যদি বিশেষ কোনো চিন্তা/দর্শনের অনুকূলে/অভিমুখে ‘ডীলিং অব পাওয়ার’ বুঝি, তাহলে কি ইসলামী রাজনীতি এবং ইসলামী আন্দোলন সমার্থক বা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠে?
যেমন ধরুন, আপনার সিএসসিএসকে আমরা সিরিয়াস রাজনীতি হিসেবেই বুঝি। যেমন বুঝি ফরহাদ মজহারের লালনকে ‘পিউর ঈমানদার’ করে তোলার শয়তানি খায়েসকে। কারণ আপনি বা ফরহাদ মজহার, আপনাদের কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে আলটিমেটলি বিদ্যমান নানা পাওয়ার হাউজ বা শক্তিকেন্দ্রকে নিজেদের চিন্তা-দর্শনের অভিমুখেই ডীল করছেন/করতে চাচ্ছেন।
একইভাবে সিএসসিএসকে, সেই সাথে আপনার জামায়াত ত্যাগকেও আমরা আবার ইসলামী আন্দোলনের অংশই মনে করি। কেননা, আপনারা সূরা তাওবার ১২২ নং আয়াতের রেফারেন্স উপস্থাপন করেন। অবশ্য সবার জামায়াত ত্যাগ সেরকম না-ও হতে পারে। যেমন, জনাব মঞ্জুদের জামায়াত ত্যাগকে আমরা এখনও ইসলামী আন্দোলনের অংশ বা কৌশলগত অংশ মনে করি না। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: একটা তাত্ত্বিক বিষয়ে ক্লিয়ার ধারণা না থাকলে আমি এখন যে কথাটা বলতে যাচ্ছি তা সঠিক বুঝা যাবে না। তত্ত্বটি হলো necessity এবং identity’র পার্থক্য। কোনো কিছুর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে কোনো কিছু থাকা মানে, ঐ দুইটা জিনিস এক হওয়া নয়। যেমন কাগজের মধ্যে পানি আছে। কাগজ শুকালে তা আমরা টের পাই। তারমানে এই নয়, কাগজ হলো পানি বা পানির পাত্র। শরীরের necessary constituent হিসেবে জলীয় অংশ আছে, হাড় আছে, নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে যেগুলোর একটাও অচল হলে শরীর টিকবে না। এ থেকে আমরা বলতে পারি না যে শরীর মানে পানি বা হাড় বা হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুস বা মস্তিষ্ক।
অতএব, জীবনাদর্শ মাত্রই তাতে রাজনীতি থাকবে। আদর্শ আর রাজনীতির সম্পর্ক আবশ্যিক সম্পর্ক। তারমানে রাজনীতি আর আদর্শ একই জিনিস নয়। আদর্শকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে যা করতে হয় তা-ই রাজনীতি। ক্ষমতা হলো রাজনীতির অন্তর্বর্তীকালীন লক্ষ্য। কল্যাণ সাধন হলো ক্ষমতার লক্ষ্য। তো, কল্যাণের জন্য সাধারণত জনকল্যাণের শ্লোগান তোলা হলেও মূলত তা হয় নিজ লোকজনের কল্যাণ। আর আদর্শ হলো এমন কিছু যেটার দোহাই দিয়ে মানুষ বাস্তবে কিছু করে। সেই দিক থেকে মানুষের বাস্তব জীবন হলো আদর্শের প্রায়োগিক দিক। সচেতনে বা অবচেতনে মানুষ কোনো না কোনো আদর্শকে মেনে চলে।
এই দৃষ্টিতে দেখলে এটি পরিষ্কার, সিএসসিএস রাজনীতি করছে না। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা করছে। রাজনীতির চোখে দেখলে তা কোনো না কোনো ঘরানার রাজনীতির পক্ষে যাচ্ছে। এই দৃষ্টিতে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চামাত্রই কোনো না কোনো ধরনের মতাদর্শগত রাজনীতি। সিএসসিএস-কে কেউ কেউ রাজনীতি মনে করছে, এটা এক দৃষ্টিতে সিএসসিএস প্রদত্ত ফর্মূলা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠার লক্ষণ।
‘ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন’ শীর্ষক আমাদের লেখাটা হলো আমাদের কাজকর্মের থিওরি ও প্রায়োগিক রূপরেখা। তাতে আমরা বলেছি, প্রত্যেক ব্যক্তি আদর্শের সামগ্রিকতাকে অন্তরে লালন করলেও কর্মতৎপর হবে নিজের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ঝোঁক-প্রবণতা, পেশাগত অবস্থান, লোকেশান ও পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে। একটি মাত্র বিশাল বটবৃক্ষের অংশ না হয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি হবে একটা উন্মুক্ত বাগানের কিছু একটা। যারা বুদ্ধিবৃত্তি করবে, তারা সেটাতেই পূর্ণ মনোনিবেশ করবে। যারা রাজনীতি করবে তারা সেটাতেই পূর্ণ মনোনিবেশ করবে। যারা সমাজ সেবামূলক কাজ করবে তারা সেটাই সিরিয়াসলি করবে। যারা ধর্মীয় ক্ষেত্রে কাজ করবে তারা সেভাবেই নিজেদের যোগ্যতা ও পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করবে।
যিনি রাজনীতির ময়দানে কাজ করবেন, সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও তিনি অপরাপর সেক্টরের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর রাখবেন এবং সময়ে সময়ে অপর সেক্টরের কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করবেন। এইভাবে অন্যরাও নিজেদের কাজে ফুলটাইম এনগেইজ থাকলেও টাইম এন্ড এগেইন বা অকেশনালি অন্যদের কাজকর্মে প্রয়োজনানুসারে সহায়তা করবেন। এতে করে মানুষের যে ইনার পটেনশিয়ালিটি আছে তা ম্যাক্সিমাইজ হবে। বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন এমনকি বিপরীত মেজাজের কাজগুলোকে একক সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে সম্পাদন করতে চাওয়ার কারণে এগুলো একটা আরেকটাকে টেনে ধরছে, একটা আরেকটাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব বিষয়ে আমার প্রচুর লেখালেখি আছে। এখানে কিছু মৌলিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার বিকেন্দ্রীকৃত, গুচ্ছ পদ্ধতির সংগঠন ব্যবস্থার ফর্মূলা অনুসারে, রাজনীতির দিক থেকে দেখলে অন্যান্য সেক্টরের কাজগুলোকে মনে হবে রাজনীতির পরিপূরক বা সহায়ক কর্মকাণ্ড। ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে মনে হবে ধর্মীয় প্রয়োজনকে পূরণ করার জন্যই বাদবাকী সব ব্যবস্থাকে সাজানো হয়েছে। এভাবে কাজের প্রত্যেকটা সেক্টরই হবে স্বতন্ত্রভাবে মূল কাজ।
অনেকগুলো সমতলসম্পন্ন পেপার-ওয়েটকে আমরা এখানে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এর আসল জিনিসটা হলো ভিতরে থাকা ওয়ার্লড গ্লোবটা। কিন্তু প্রতিটি সমতলই ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
কাজের দিক থেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন দিক থেকে এনগেইজ হলেও আদর্শটা কিন্তু একই। আমার ক্ষেত্রে সেটি হলো ইসলাম।
Dealing of power সম্পর্কে একটা কথা বলা দরকার মনে করছি। পাওয়ার বা ক্ষমতা কিন্তু নিছক রাজনৈতিক না। নিছক অর্থনৈতিকও না। নিছক সামরিক না। নিছক বুদ্ধিবৃত্তিকও না। নিছক সাংস্কৃতিক না। নিছক ধর্মীয়ও না। নিছক সামাজিকও না। এই সবগুলোই বরং স্বতন্ত্রভাবে ক্ষমতার এক একটি উৎস। ইংরেজীতে deep state বলতে যা বুঝায়। তাই পাওয়ার ডিল করা মানে শুধু রাজনীতি করা না। যদিও রাজনীতির মধ্যে পাওয়ার ডিলটা প্রকট রূপে ধরা পড়ে।
Mahmud Siddiquee: প্রশ্ন নং-০৮ এবং শেষ প্রশ্ন: ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রত্যয়টিকে কীভাবে দেখেন? বিশ্বব্যাপী স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর খিলাফাত আ’লা মিনহাজিন নবুয়াত বা ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠার যে ভবিষৎবাণী রাসূলুল্লাহ করেছেন, সেটার প্রক্রিয়া হিসেবে, নাকি ইসলামী জুব্বাপরা আধুনিক টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের অন্যরূপ হিসেবে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইংরেজীতে যাকে Islamic person বা personality বলে তাকেই তো বাংলাতে আমরা এককথায় মুসলিম বলি। তার মানে, ইসলামী ব্যক্তি বা ইসলামিক ব্যক্তিত্ব, এমন কথা হতে পারে। তেমন করে ‘ইসলামী সমাজ’ এমন কথাও আমরা বলতে পারি। একইভাবে কোনো রাষ্ট্রও ইসলামী হতে পারে। হতে পারে ইসলামী রাষ্ট্রসমুহের সমন্বয়ে ইসলামী রাষ্ট্রসংঘ। তাত্ত্বিকভাবে আমি এতে কোনো সমস্যা দেখি না। সমাজ যখন বড় হয়ে উঠে, তখন সেখানে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটে। একপর্যায়ে গড়ে উঠে রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছু কিছু রূপ মানবসভ্যতার শুরু থেকেই যেমন ছিল তেমনই আছে। কিছু কিছু গাঠনিক দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা শাসন ব্যবস্থার তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা সময়ে সময়ে যুগের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। গ্রীক নগর রাষ্ট্র হতে বর্তমান জাতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের নানা রূপের মধ্যে যেসব কমন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় সেসব বৈশিষ্ট্য সম্বলিত একটা রাষ্ট্র ছিল তৎকালীন মদিনা রাষ্ট্র বা মদিনাকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা। এ ব্যাপারে ‘ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন’-এ বিস্তারিত বলা হয়েছে। মোট নয় অধ্যায়ে বিন্যস্ত প্রকাশিতব্য এই গ্রন্থের ৫, ৬ ও ৭নং অধ্যায়ের শিরোনাম হলো যথাক্রমে ‘দ্বীন ও শরীয়াহ’, ‘সমাজ ও রাষ্ট্র’ ও ‘ইসলামী রাষ্ট্র অথবা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’। সেখানে আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা স্কেল দিয়েছি। রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে আমার বক্তব্যকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ চিত্র।
সমস্যা হলো, এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি করলেও আমরা মানুষের কাছে আমাদের চিন্তাধারাগুলো পৌঁছাতে পারি নাই। যার কারণে বার বার কিছু বিষয় আলোচনাতে আসে। ইউটিউবে সামাজিক আন্দোলন চ্যানেলে “ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও ইকামতে দ্বীন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে” শীর্ষক শিরোনামে আমার যে বক্তব্য আছে সেটা এই প্রসঙ্গে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।