এখানকার সামাজিক বাস্তবতায় নানা কারণে স্বাভাবিক মেয়াদকালের অতিরিক্ত একটা লম্বা সময় ধরে, কমপক্ষে দশ বছর গার্জিয়ানদেরকে নিজেদের প্রাপ্তবয়ষ্ক (এডাল্ট) ছেলে-মেয়েদেরকে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক (এডলসেন্ট) হিসেবে প্রতিপালন করতে হচ্ছে। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে জীবনের বৃহত্তর দায়-দায়িত্ব গ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয়ে গেছে, অথচ বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার অসংগতির অজুহাতে তাদের সাথে এমনভাবে আচরণ করা হচ্ছে যেন তারা এখনো ছোট। এই ধরনের এক্সটেন্ডেড গার্ডিয়ানশীপের নানাবিধ কুফল নিয়ে আমি ইতোমধ্যে লিখেছি।

সেখানে একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, “…তবে জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত সন্তানের সাথে যদি সুসম্পর্ক বজায় থাকে, তাহলে অভিভাবক হিসেবে সন্তানের সাথে শেয়ারিংয়ের স্পেসগুলো বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। শেয়ারিংয়ের জায়গায় দুর্বল হলে, অনেক সময় সন্তান সঠিক পথে না থাকলে, তখন সন্তানের সংশোধনের জন্য কিছু বলতে চাইলেও পরস্পরের মধ্যে ডায়লগ বিনিময়ের অভাবে তা সম্ভব হয়ে উঠে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তানের ভুলগুলো বাবা-মা’রা শুধু অসহায়ভাবে দেখেই যাবে।”

এই সুবাদে অভিভাবকত্ব নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরী মনে করছি। নচেৎ আমি এ বিষয়ে যা বলেছি সে ব্যাপারে ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ থেকে যায়।

আসলে অভিভাবকত্ব হলো একটা বহু স্তরের ব্যাপার। এক স্তর আরেক স্তরের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক। কিছু কিছু অভিভাবকত্বের মেয়াদ কখনো শেষ হয় না। তবে সময় ও পরিস্থিতি অনুসারে সেটার মাত্রা ও ব্যাপ্তির পরিবর্তন ঘটে। কিছু কিছু ধরনের অভিভাবকত্ব সাময়িক ও শর্ত সাপেক্ষ। উপযুক্ত শর্ত বজায় থাকা সাপেক্ষে এ ধরনের সাময়িক অভিভাবকত্ব দীর্ঘমেয়াদী, এমনকি জীবনব্যাপীও হতে পারে।

বংশধারাভিত্তিক যে অভিভাবকত্ব তা স্থায়ী। বাদবাকী সব ধরনের অভিভাবকত্ব হলো অস্থায়ী। নির্দিষ্ট শর্তের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী অভিভাবকত্বের অবসান ঘটে। এর বিপরীতে, উপরে যা বলেছি, সময় ও পরিস্থিতি অনুসারে স্থায়ী অভিভাবকত্বের মাত্রা ও ব্যাপ্তির পরিবর্তন ঘটে। কথার কথা, সন্তানের ওপর বাবা-মা’র যে অভিভাকত্ব সেটার ধরন পরিবর্তন হয় সন্তানের বয়স ও অবস্থার সাপেক্ষে।

শিশুকালে একজন সন্তানের ব্যাপারে বাবা-মা’র যে ভূমিকা, কৈশোরেও তা অব্যাহত থাকে। সন্তান বয়োঃসন্ধিতে পৌঁছার সাথে সাথে তার অভিভাবক তথা বাবা-মা’র এটি দায়িত্ব হয়ে পড়ে যে উক্ত সন্তানের বিয়ের ব্যবস্থা করা। এটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতিসম্মত। বাবা-মা’র ওপর এটি সন্তানের অধিকার। কোনো বাবা-মা এই দায়িত্বপালন না করলে নিজের জীবনের ব্যাপারে নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের শরিয়তসম্মত অধিকার সন্তানের আছে।

এ পর্যায়ে এসে কেউ বলতে পারে, আপনি বিয়েকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?

ধর্মীয় দৃষ্টিতে বলেন আর কাণ্ডজ্ঞানের দৃষ্টিতে বলেন, প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পরে ছেলে বা মেয়ে দাম্পত্যজীবনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে, যে ছেলেটা বা মেয়েটা যৌনতার প্রতি অধিকতর আগ্রহী ও সচেতন হয়ে উঠবে, তার অতিসত্বর বিয়ের ব্যবস্থা করাটা অভিভাবকের জরুরী দায়িত্ব। একটু আগে যা বললাম, অভিভাবক যদি এই দায়িত্ব পালন না করে তবে সন্তানের এই অধিকার থাকবে, নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করার।

বিশেষ করে বাবা-মা’য়ের এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে বয়োঃসন্ধি-উত্তর সময়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। এটি হলো স্বাভাবিক পন্থা। মানব সমাজ এভাবেই অগ্রসর হয়েছে। মানব সভ্যতার এটাই একমাত্র ঐতিহাসিক গতিপথ।

বর্তমানে যা হচ্ছে তা যদি এই স্বাভাবিক গতিধারার সাথে না মিলে, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের মন-মানসিকতা ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে বড় ধরনের গলদ হচ্ছে। সেটি নিয়ে অন্য সময়ে কথা বলা যাবে। বর্তমান আলোচনার মূল বিষয় হলো অভিভাবকত্বের ধরন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে খাওয়ানো, পরানো, পড়ানো, তার থাকার ব্যবস্থা করা, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাকে নিরাপত্তা দেয়া, এই সকল দায়িত্ব তার অভিভাবকদের ওপর থাকে। সন্তান প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে যাওয়ার পরে এই সব দায়িত্ব একেবারে নাকচ হয়েও যায় না, আবার তা শৈশব-কৈশোরের মতো অতটা অবলিগেটরি হিসেবেও থাকে না। সন্তানের ব্যাপারে বাবা-মা তথা বংশীয় অভিভাবকদের দায়িত্ব কখনোই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। একইসাথে সন্তানের ওপর বাবা-মা তথা বংশীয় অভিভাবকদের অধিকারও কখনো শেষ হয়ে যায় না। আমৃত্যু, এমনকি মৃত্যুর পরেও তা কোনো না কোনোভাবে অব্যাহত থাকে।

বিশেষ করে সন্তান যদি হয় নারী, তাহলে তাকে সাপোর্ট দেয়া সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের স্ট্যান্ডিং ডিউটি বা স্থায়ী দায়িত্ব; যদি তাদের তেমন সামর্থ্য থাকে, এবং সন্তানের যদি তেমন সাপোর্টের প্রয়োজন ঘটে। তবে, শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম, অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বপালনের এই গুরুভার ক্রমান্বয়ে লঘু হয়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো নারী সন্তানের প্রথম বিয়ের ব্যপারে তার অভিভাবকদের যতটুকু কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব, পরবর্তীতে তা আর ততটুকু বজায় থাকে না। হানাফি মাজহাব ছাড়া বাদবাকী মাজহাবগুলো অনুসারে কুমারী নারীর বিয়েতে অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে সেই বিয়ে আইনসম্মত হবে না। কিন্তু সব মাজহাবই এ ব্যাপারে একমত, অকুমারী নারীর বিয়েতে অভিভাবকের সম্মতি জরুরী নয়।

পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের দায়িত্ব, তারচেয়েও বড় কথা হলো, পরিবারের আওতা কতটুকু, তা বোঝা যাবে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম অনুসারে। সম্পত্তি বণ্টনে কারো প্রাপ্যতার পরিমাণ অনুসারে পরিবারে তার দায়িত্ব নির্ধারিত হয়, ব্যাপারটা ঠিক এমন না হলেও এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা পারস্পরিক দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে ধারণা লাভ করতে পারি।

দ্বিতীয় প্রকারের অভিভাবকত্ব হলো শর্তসাপেক্ষ। এই হিসেবে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে স্থাপিত পারিবারিক সম্পর্কসহ যে কোনো ধরনের মুয়ামালাত তথা সামাজিক সম্পর্ক, কোনো না কোনোভাবে অভিভাবকত্বের সাথে সম্পর্কিত। সরকারপ্রধান হলেন দেশের কার্যকরী অভিভাবক। রাষ্ট্রপ্রধান হলেন দেশের আনুষ্ঠানিক অভিভাবক। বিদ্যায়তনের প্রধান হলেন বিদ্যায়তনের অভিভাবক। শ্রেণীপ্রধান হলেন শ্রেণীর অভিভাবক। কোরআনের ভাষায় তারা হলেন ‘উলিল আমর’। রাসূল (স) এর ভাষায়, ‘প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল বা অভিভাবক। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’

এভাবে দায়িত্ব তথা অভিভাবকত্বের একটা স্তরবিন্যাসভিত্তিক জটিল দুনিয়ায় আমরা প্রতিনিয়ত বসবাস করি। সম্পর্কের ধরনের ওপর নির্ভর করে অভিভাবকত্বের পরিসর ও মাত্রা। মানব সমাজের যে কোনো ইউনিটের অধীনে বসবাসরত সকল মানুষই পরস্পরের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে দায়িত্বশীল। সেই অর্থে অর্থাৎ নৈতিকভাবে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও অভিভাবক। আরো বৃহত্তর অর্থে, ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মানুষ এবং সামগ্রিকভাবে মানবজাতি হলো অপরাপর সকল প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও বিশ্ব-ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও অভিভাবক।

যখন থেকে একজন মানুষ স্বাধীন নাগরিক, হোক সেটা ধর্মীয় দৃষ্টিতে কিংবা দেশের আইনে, তখন থেকে তার ওপর আপনার অভিভাবকত্ব আর আগের মতো বহাল নাই। তার জীবনের সকল দায়-দায়িত্ব মূলত তারই। আপনি তাকে সহযোগিতা করতে পারেন, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এর সম্পূরক কথা হলো, প্রাপ্তবয়ষ্ক কিংবা নাগরিক হয়ে যাওয়ার পরে আপনার বাবা-মা বা অভিভাবকদের ওপর এটি ফরজ-ওয়াজিব নয় যে তারা আপনাকে সাপোর্ট দিয়ে যাবে। এতে তারা মোটেও বাধ্য নন।

মানবিক সম্পর্কের এই মিথষ্ক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে এবং পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে এই আদলে গড়ে তুললেই কেবল মানুষের অন্তর্নিহিত সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। যত বছরে সে প্রাপ্তবয়ষ্ক হচ্ছে প্লাস আরো তত বছরব্যাপী সেই সন্তানকে প্রতিপালন করে যাওয়া, এর চেয়ে বড় তামাশা, এর চেয়ে বড় নিষ্ঠুর-বর্বরতা, এর চেয়ে বড় বাহুল্য-অপচয়, আর হতে পারে না; যেমনটা হচ্ছে বিদ্যামান সামাজিক বাস্তবতায়। আমাদের সামাজ কাঠামোর এই মৌলিক অসংগতিটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য এই লেখা।

মানব প্রকৃতিকে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে প্রকৃতিসংগত জীবনযাপনের উপযোগী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করাই ভালো। তাই, সমস্যার উপস্থিতিকে অকপটে স্বীকার করে নিয়ে আসুন আমরা আমাদের সমাজ অবয়বের এই ‘গভীর ক্ষতটাকে’ সারিয়ে তোলার চেষ্টা করি। ওই যে কথাটা, বার বার বলি, identification of the problem is half of the solution, সেটা আবারো স্মরণ করিয়ে দেই। বিকৃতি আর অবদমন নয়, বরং সুস্থ ব্যক্তিত্ব গঠনে আসুন আমরা মনোযোগী হই।

Similar Posts

One Comment

  1. সংক্ষিপ্ত অথচ সুন্দর ভাবে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ স্যার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *