“আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন, যেটার উত্তর আমি অনেক দিন ধরে খুঁজছি। সেটা হলো, আল্লাহ যদি সার্বজনীন হয়ে থাকেন তাহলে দেড় হাজার বছর আগের এমন কোনো দলিল-পত্র পাই না কেন, যেখানে তাঁর এই সার্বজনীন নামের উল্লেখ আছে? বা এর anthropological or socio-historical কোনো evidence আছে?”
জনৈক পাঠকের উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরে সম্প্রতি আমি উনাকে যা বলেছি, মেসেঞ্জার-ইনবক্স হতে তা হুবহু উদ্ধৃত করছি:
“আল্লাহ সার্বজনীন, এটা কি ‘আল্লাহ’ নামক সৃষ্টিকর্তার এই নাম বা বিশেষ এই শব্দটার জন্য? নাকি, ‘আল্লাহ’ বলতে যা বুঝায়, সেটার জন্য?
প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দ্বিতীয় প্রশ্নের মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং, ‘আল্লাহ’ নামক এই শব্দের মধ্যে নিহিত নন। ‘আল্লাহ’ নামক আরবি ভাষার এই শব্দটি এবং আল্লাহ তায়ালার মহান সত্তা, এতদুভয়ের সম্পর্ক আইডেন্টিক্যাল বা অভিন্ন নয়। আল্লাহ বলতে যা বুঝায় সেটা বুঝানোর জন্য ‘আল্লাহ’ শব্দটিই একমাত্র শব্দ, এমন নয়।
এমন নয় যে, ‘আল্লাহ’ শব্দটিকে যদি আমরা মুছে ফেলি তাহলে ‘আল্লাহ’ শব্দ দ্বারা যা বুঝায় সেটাও অর্থহীন বা অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। এভাবে চিন্তা করলে আপনি সহজেই বুঝবেন, আল্লাহ শব্দটি আল্লাহ তায়ালার মহান সত্তাকে প্রকাশ করার দিক থেকে নেসেসারি বা আবশ্যিক নয়। বরং, আল্লাহ তায়ালার মহান সত্তা, আর ‘আল্লাহ’ নামক এই শব্দটির সম্পর্ক হচ্ছে হিস্টোরিক্যাল। এই অর্থে অকেশনাল।
একটি শব্দের মধ্যে দুটি জিনিস থাকে: (১) অর্থ এবং (২) অর্থ প্রকাশের একটা ধরন। চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভাষা বা শব্দ মাত্রই হচ্ছে কোনো না কোনো ধরনের চিহ্ন বা প্রতীক। কোনো ভাষা, বাক্য, বক্তব্য বা শব্দের মধ্যে সুনিদির্ষ্ট অর্থ নিহিত থাকে। সেটাকে বাদ দিলে সংশ্লিষ্ট ভাষা, বাক্য, বক্তব্য বা শব্দটি আর ভাষা, বাক্য, বক্তব্য বা শব্দ হিসেবে না থেকে অর্থহীন একটা সমষ্টি মাত্র হয়ে দাঁড়ায়। আবার একই অর্থ প্রকাশক শব্দ হতে পারে একাধিক। বর্ণমালার গঠনের দিক থেকে সেগুলো যতই ভিন্নরূপ হোক না কেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আমাকে আমার জন্য উপযুক্ত, সুন্দর, ভালো ও শোভনীয় যে কোনো নামেই আমাকে ডাকতে পারো। হ্যাঁ, তৎকালীন আরবের লোকেরা সুপ্রিম গড বা পরম ঈশ্বর বলতে আমরা যা বুঝি ‘আল্লাহ’ শব্দ দিয়ে তারা সেটাই বুঝতেন। যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা ব্রহ্ম বলতে আল্লাহকেই মিন করে থাকে।
আমরা যেহেতু আরব দেশ থেকে ইসলামকে পেয়েছি এবং আরবদের ভাষাতে যেহেতু কোরআন নাজিল হয়েছে, তাই আল্লাহ শব্দটিকে আমরা পরমেশ্বর, পরমসত্তা, সুপ্রিম গড, এবসলিউট বা ব্রহ্ম বলতে যা বুঝানো হয় সেই অর্থে গ্রহণ করি। যদিও আরবী ভাষায় ‘আল্লাহ’ শব্দটি অন্য কোনো ভাষা থেকে এসেছে। হতো পারে কিছুটা বিবর্তিত হয়ে এসেছে। আমরা এটাও জানি, কোনো ভাষাই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠে না। ভাষা মাত্রই হচ্ছে ধারাবাহিক বিবর্তন ও নিরবচ্ছিন্ন ভাঙ্গা গড়ার খেলা।
আপনি যদি দেখেন, পৃথিবীর ইতিহাসে লিখিত যত পুরনো গ্রন্থ আছে সেগুলির মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কিত যে কোনো প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আল্লাহ তায়ালা আছেন। সেটা যত প্রাক-বিবর্তন রূপে বা বিকৃতভাবে হোক না কেন। হতে পারে সেটা সরাসরি ‘আল্লাহ’ নামক শব্দটি দিয়ে নেই। কিন্তু আল্লাহ নামক শব্দটি দ্বারা যা বুঝানো হয় সেই মর্মার্থ নিয়ে সেখানকার প্রচলিত ভাষায়, তৎকালীন প্রচলিত শব্দে নিশ্চয়ই আছে। থাকবেই। না থাকার কথা নয়।
‘আল্লাহ’ শব্দটিকে আমরা যদি syntactically বিবেচনা করি তাহলে প্রাচীন দলিলপত্রে এটি না থাকারই কথা। কারণ, এটি নির্দিষ্ট একটা ভাষার বা কাছাকাছি কিছুর ভাষার অন্তর্গত একটি শব্দ। উপরে এটি ব্যাখ্যা করে বলেছি।
অপরদিকে ‘আল্লাহ’ শব্দটিকে যদি আমরা semantically বিবেচনা করি, তাহলে মানবসভ্যতার ইতিহাসে লিখিত যে কোনো পুরনো ডকুমেন্টে, প্রাসঙ্গিক যে কোনো আলোচনায় এটি পাওয়া যাবে। শব্দটা ভিন্ন হবে। কিন্তু মর্মার্থটা একই থাকবে।
বলাবাহুল্য, একটি বাক্যের গঠনগত যে আকার, সেটাকে বলা হয় syntax বা structure। আর বাক্যের যে মর্মার্থ, সেটাকে বলা হয় semantics।”
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
আক্কাস আলী: ধন্যবাদ। আপনার সাথে শতভাগ একমত। কিন্তু, আল্লাহ নাম জপার যে প্রথা আছে, সেটা নিয়ে আপনার মত কী? নামাজের পর ২০ বার আল্লাহ বললে এক সাওয়াব, ১০০ বার পড়লে আরেক সাওয়াব, তারপর হাজার বার পড়ে পানিতে ফু দিলে রোগ নিরাময়সহ আরো অনেক উপকার আছে বলে ইসলামে আছে। আমার কাছে এগুলো সন্দেহাতীত কুসংস্কার, কিন্তু আপনার মত জানতে চাচ্ছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বক্তব্যের সাথে একমত হবার জন্য ধন্যবাদ। তবে জিকির সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করে বিপদে ফেলার কী দরকার ছিল! যেহেতু আপনাকে আমি ভালো জানি এবং মূল্যায়ন করি, সেজন্যে, এরপরও এ বিষয়ে কিছু কথা বলছি।
হ্যাঁ, জিকির বা স্মরণ করার মাধ্যমে বরকত হতে পারে। যেহেতু সেটা স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) বলেছেন।
তবে, বরকতের বিষয়টা এই জন্য নয় যে আল্লাহ নামক শব্দটার মধ্যে একটা কিছু আছে। বরং ব্যাপারটা হতে পারে আল্লাহ শব্দটি উচ্চারণের চেয়েও এর যে অন্তর্গত তাৎপর্য বা মর্মার্থ সেটা অনুধাবন করার মাধ্যমে আমাদের যে এক ধরনের আত্মিক বা নৈতিক উন্নতি ঘটে সেটার কারণে আমাদের কিছু বস্তুগত সুবিধার উন্নয়ন হতে পারে। খোদার ওপরে বিশ্বাসের দিক থেকে এটি যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ খোদা যদি একজন থেকে থাকেন এবং তাঁকে যদি আমরা আমাদের চাওয়া পাওয়ার দিক থেকে ইতিবাচকভাবে পেতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর স্মরণের মাধ্যমে কিছু বরকতও আমরা পেতে পারি। কথাগুলো একটু কঠিন হয়ে গেল হয়তোবা।
তবে সাধারণ লোকেরা যে মনে করে, সার্বিকভাবে জীবনবোধ, নৈতিকচেতনা ও কাজকর্ম তথা আমল-আখলাক ইত্যাদির কোনো উন্নয়ন না ঘটিয়ে, হালাল-হারাম ইত্যাদির দিকে না তাকিয়ে, বৃহত্তর ও সামষ্টিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু কতগুলো নাম জপ করলেই কিছু একটা পেয়ে যাবে, সেটা আসলে ভুল। এবং এই ধরনের মনে করা নিশ্চিতই কুসংস্কার।
এ ব্যাপারে তো স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা পূর্ব দিকে মুখ ফিরাও কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরাও, তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নাই। বরং কল্যাণের কাজগুলো হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে ভালো বা কল্যাণকর কাজের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেটি একজন মানুষকে সৎ নাগরিক এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলে। ভারসাম্যপূর্ণ একটা জীবনের কথা বলে।
তো, জীবনের এসব ভারসাম্যের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু নাম যোগ করে পার পাওয়া যাবে বলে মানুষ যে মনে করে, সেটা নিশ্চিতই কুসংস্কার বটে। জিকির হলো আমলের অতিরিক্ত একটা ব্যাপার, নিছকই আধ্যাত্বিক। এটা নিয়ে বস্তুগত হিসাব-নিকাশ বা ক্যালকুলেশন করা নিতান্তই বোকামি।
আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু এটি আমাদের আওতার বাহিরে। আমাদের আওতার মধ্যে যেটা আছে সেটা হচ্ছে আমল বা কাজ। নিছক স্মরণ করা হচ্ছে দুর্বলতম কাজের ধরন। শক্তিশালী কাজের ধরন হচ্ছে কোনো কিছুকে বস্তুগতভাবে তথা বাস্তবে সম্পন্ন করা।
আক্কাস আলী: আপনার সাথে আবারো শতভাগ একমত। আশা করি আপনার এই কমেন্টটি বাকিরা পড়ে বুঝার চেষ্টা করবে। আমিও মনে করি, অর্থ না বুঝে কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর নামের জিকির ইত্যাদি করে মানুষ হয়তো আধ্যাত্বিকভাবে মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে পারে, কিন্তু এগুলো সব দুর্বলতম কাজের ধরন। এবং যারা শুধু এগুলো করে বস্তুজগতকে প্রভাবিত করার কথা ভাবে, তারা নিঃসন্দেহে কুসংস্কারে নিমজ্জিত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আল্লাহ তায়ালার সুন্নত হচ্ছে তিনি কার্যকারণ সম্পর্কে তথা একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে জগতটাকে পরিচালনা করেন। যারা কিছু রোবটিক জিকিরের মতো অতিরিক্ত আমলের মাধ্যমে শর্টকাট লাভের আশায় থাকেন তারা আসলে নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ।
তবে হ্যাঁ, নিজের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা সাধনা বা আমল করার পরে কেউ যদি নানা ধরনের জিকির আজকার করে বরকতের আশা করেন, সেটা ঠিকই আছে। আমাদের সমাজে বা আশপাশে যেটা দেখা যায় না। চারিদিকে ধর্মবাদিতার এত উৎকট প্রকোপ যে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরা ওভারঅল ধর্মের উপরে অনেক বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ। এই বিরক্তি মানুষকে এমন একটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে যেটাকে আমরা বলতে পারি সিচুয়েশন লাইক throwing the baby with the bathtub water।
আক্কাস আলী: আপনার কাছ থেকে এরকম অসংখ্য কুসংস্কার (যেমন– জীন/ভূতের আছর, ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, অলি/হুজুরদের অলৌকিক ক্ষমতা, জিকির ইত্যাদি) নিয়ে আরো লেখা চাই। সমালোচিত/বিতর্কিত হবার ঝুঁকি অবশ্যই আছে, কিন্তু যুক্তির সামনে সবকিছু পরাজিত হতে বাধ্য। নাইলে ধর্মান্ধতার প্রভাব কখনই কমবে না। নাস্তিকের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে।
Mutasim Billah Shahedy: স্যার, আপনার লেখাটি পড়ে আমার মাঝে একটা বিষয় জানার আগ্রহ জেগেছে। সেটা হচ্ছে, তাওরাত এবং ইঞ্জিলে আল্লাহর নাম কি ছিল?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা তো ডাক্তার জাকির নায়েক ভালো বলতে পারবেন। আমি ঠিক জানি না।
তবে বিশেষ কোনো ধর্মগ্রন্থ বা কোনো সভ্যতা সংক্রান্ত কোনো লেখাজোকা বা এ ধরনের কোনো ডকুমেন্টে আল্লাহর নাম থাকা না থাকা কোনো ম্যাটার করে না, এটাই আমার স্ট্যাটাসের মূল বক্তব্য।
কারণ যেখানে আল্লাহর নামটা নাই সেখানে আল্লাহর নামের যে তাৎপর্য বা মর্মার্থ, সে ধরনের কোনো সমার্থক নাম আছে বা থাকবে। সুতরাং ‘আল্লাহ’ শব্দটাই থাকতে হবে, এটা খুব বেশি জরুরি কিছু নয়। এটাই আমি বলতে চেয়েছি।