শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না। মাঝে মাঝে দূরেও ঠেলে দেয়।’ কাছাকাছি হওয়া অথবা দূরে সরে যাওয়া, এই বাইনারির বাইরেও কারো কারো জীবন অসহ্য ভালোলাগার যন্ত্রনায় অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।

একইসাথে মিলন ও বিরহের এই অপার্থিবতা এসেছিল গারডা ফিলিপসব্রন আর জাকির হোসেনের জীবনে।

গারডা ছিলেন দিল্লির ‘জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া’তে ২৭ বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকারী ও পরবর্তীকালে ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালনকারী ড. জাকির হোসেনের প্লাটোনিক প্রেমিকা। ড. জাকির ১৯২০-এর দিকে জার্মানীতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য গমন করেন। সেখানে তরুণী গারডা প্রেমে পড়েন ড. জাকির হোসেনের। পিএইচডি শেষ করে ড. জাকির ভারতে ফিরে আসেন।

কাহিনীর পরবর্তী অংশ শ্রদ্ধেয় ড. তোফায়েল আহমেদ স্যারের লেখা ‘এক কিংবদন্তির গল্প’ হতে উদ্ধৃত করছি:

‍“বার্লিনের ভারতীয় মহলে খুব অল্প সময়ে জাকির হোসেনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে জার্মান পণ্ডিতদেরও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। অনেক জার্মান তরুণী জাকিরের অনুরাগী হয়ে পড়েন।

কিন্তু জাকির হোসেন ছিলেন বিবাহিত, মাত্র ১৮ বছর বয়সে শাহজাহান বেগমকে তিনি বিয়ে করেন। তিনি অবাধে সবার সঙ্গে মেলামেশা করতেন, একই সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন সম্পর্কেও ছিলেন সজাগ ও বিশ্বস্ত। … জার্মান তরুণী গারডা ফিলিপসব্রনসহ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে জাকির হোসেন তিনটি বছর তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন বলে তার জীবনীকার মুজিব মনে করেন।

ডিগ্রির শেষ পর্যায়ে ১৯২৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ফিলিপসব্রনও সঙ্গে যেতে চান। তিনিও নাছোড়বান্দা। এ কুমারী দু-এক বছর পর জামেয়ায় এসে উপস্থিত হন এবং ১৯৪৩ সালে জামেয়াতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে জামেয়ার স্কুল সেকশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. জাকির হোসেন তার স্ত্রী শাহজাহান বেগমকে গারডার বিষয়ে সবকিছু অবহিত করেন এবং তিনিও তার স্বামীর কথা মেনে নেন। ড. জাকিরের ওপর গারডার অনেক বেশি দাবি থাকত। ড. জাকিরও তার আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দিতেন।

জামেয়ায় এ নিয়ে কানাঘুষা হতো না তা নয়, কিন্তু শাহজাহান বেগমের কোনো ক্ষোভ ছিল না। ড. জাকিরের ঘনিষ্ঠজন যারা একসঙ্গে বার্লিনে ছিলেন, তারা জানতেন এ এক শারীরিক সম্পর্ক রহিত অত্যাশ্চর্য প্লেটোনিক প্রেম।

সর্বশেষ তিনটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটি এ পর্যায়ে শেষ করে দেব। … তৃতীয় বিরল ঘটনাটি ফিলিপসব্রনকে নিয়ে।

তাকে বারণ করা সত্ত্বেও … ১৯৩২ সালে তিনি দিল্লিতে জামেয়ায় চলে আসেন। তিনি ছিলেন বার্লিনের ধনাঢ্য এক ইহুদিকন্যা। জামেয়ায় দীর্ঘ ১১ বছর থাকার পর তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

অসুস্থ অবস্থায় তিনি জাকির হোসেনকে অনুরোধ করেন যখন সময় হয় তখন যেন তার শিয়রে বসে কোরআন তেলাওয়াত করেন এবং অনুরোধ করেন তাকে যেন ইসলাম ধর্মের রীতি অনুসারে দাফন করা হয়। ড. জাকির নিয়মিতভাবে ফিলিপসব্রনের শয্যাপাশে কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং তা শুনতে শুনতে একসময় ফিলিপসব্রন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকেও জামেয়া প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়।”

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *