ভালোবাসার আছে কিছু অদ্ভুত রসায়ন। অধিকাংশ লোক হলো এমন, যখন তাদেরকে বাধা দেয়া হয় অন্য দিকে যেতে, কিংবা বিশেষ কাউকে ভালোবাসতে, ভালোবাসার মানুষের সাথে যখন রূদ্ধ হয়ে যায় তাদের সকল যোগাযোগ; তখন তারা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলে অনায়াসে তার বা তাদের সাথেই যে বা যারা আছে তাদের আশেপাশে, যাকে বা যাদেরকে ভালোবাসার জন্য তাদেরকে করা হচ্ছে প্ররোচিত। মানুষ অনায়াসে গড়ে তোলে ভালোবাসার সম্পর্ক এমন লোকের সাথে যার সাথে সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও অনুমোদিত।
জীবন্ত হাড় যখন একটি অপরটির সংস্পর্শে আসে তখন তারা জোড়া লেগে যায়। এভাবেই অপরিচিত নারী ও পুরুষ গড়ে তুলে মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক।
ভালোবাসাটাই মানুষের চরিত্র। যখন যার সাথে থাকে তার সাথে সে সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়, গড়ে তুলে এক মানবিক সম্পর্ক।
কিছু কিছু মানুষ অন্যরকম। ইচ্ছামতো ভালোবাসতে না পারলে, ভালোবাসার মানুষটিকে না পেলে, ভালোবাসার পথে তাকে বাধাগ্রস্ত করলে, নিজেকে সে গুটিয়ে ফেলে। তেমন করে ভালোবাসাবাসি করা তার আর হয়ে উঠে না। জোর করে যদি তাকে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়, তখন সে হয়ে পড়ে কঠোর অথবা কর্তব্যনিষ্ঠ।
আশেপাশের লোকেরা ভাবে, এই লোকের নেই তেমন কোনো আবেগ-অনুভূতি। সে যেন আবেগশূন্য। তার এই কর্তব্যনিষ্ঠা আর দায়িত্বপরায়ণতা তাকে এনে দেয় সামাজিক সম্মান আর এক ধরনের ভালোবাসা। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে যে এই লোকটির হৃদয়ে আছে এক বিরাট শূন্যতা সেটা কেউ অনুভব করে না।
খুব সম্ভবত আমি দ্বিতীয় ক্যাটাগরির মানুষ।
অন্যায্য হওয়ার অপরাধে, সামাজিক বৈধতা বা অবৈধতার ধোঁয়া তুলে কারো স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসাকে যদি অস্বীকার করা হয়, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয় যদি কারো সুকুমারবৃত্তি আর একান্ত ব্যক্তিজীবনকে, তাহলে মাঝে মাঝে কারো কারো ক্ষেত্রে তার ফলাফল হয় উল্টো। যারা তাদের আপন মানুষদেরকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তারা মনে করে, সচরাচর যা হয়, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঠিক তেমনটিই হবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। প্রেমিক মানুষটি ভুলে যাবে তার প্রেম। হয়ে উঠবে সে একজন সাধারণ সুখী মানুষ।
কাছের লোকেরা ভাবে, আমাদের এই বন্ধু, প্রিয় বা পরিবারের সদস্য যে মানুষটি সে যখন ভালোবাসাপ্রবণ তখন যাকেই সে কাছে পাবে তাকেই সে ভালোবাসতে থাকবে। ভুলে যাবে আর যা কিছু সব।
এভাবে জোর করে ভালোবাসা ভুলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ে থাকে। আসলে সেগুলো ছিল না সত্যিকারের ভালোবাসা। ছিল নিছক ভালোলাগা অথবা জৈবিক আকর্ষণ। বাহ্যত যেটা মনে হয়েছে, আসলেই বুঝি ভালোবাসা।
কারো কারো ক্ষেত্রে এমন সাদামাটাভাবে আপন মানুষের একান্ত ব্যক্তিজীবনকে মূল্যায়ন করে কাছের লোকেরা আসলে ভুল করে। লোকটি যে ব্যতিক্রমীদেরই একজন, সেটি তারা বুঝতে পারে অনেক দেরিতে। অভিমানী লোকটির সৌজন্যতা, নীতিবোধ আর সদ্ব্যবহারকে তারা মনে করেছে ভালোবাসাবাসি।
কিছু কিছু লোক এতটাই বোকা, তারা ভালোলাগাকে মনে করে ভালোবাসা, সৌজন্যবোধকে মনে করে প্রেম। ইচ্ছে করলেই ভালোবাসা যায় না, পরিকল্পনা করে প্রেমে পড়া যায় না। প্রেম-ভালোবাসা— এগুলো মানুষের ভিতর থেকে গড়ে ওঠে। একতরফাভাবে।
ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ততা যখন বাধাগ্রস্ত হয় নিতান্ত অন্যায়ভাবে, ভালোবাসার যে মন ভিতরে ভিতরে তা মরে যায়। চলে যায় দীর্ঘ শীতনিদ্রায়।
আবার যখন সে ভালোবাসার ছোঁয়া পায়, তেমন হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা, তখন সে জেগে উঠে আবার। ভালোবাসার অবারিত অধিকার নিয়ে সে হয়ে ওঠে ভালোবাসাময়। ভালোবাসে সবাইকে, প্রত্যেককে দেয় ভালোবাসা অকৃপণ।
এতদিন যারা দমিয়ে রেখেছে তাকে, করেছে অপমান সামাজিক বৈধতার সুযোগ নিয়ে, বিস্ময়ে তারা দেখতে পায়, ভালোবাসার পরশ পাথরের ছোঁয়ায় লোকটার মধ্যে জেগে উঠেছে প্রেম। হয়ে উঠেছে সে প্রেমিক পুরুষ।
যদি প্রেম চাও তোমার মানুষের, তাকে প্রেমিক হতে দাও তার মতো করে। দেখবে সে তোমাকেও ভালোবাসছে, দিতে পারছে প্রেম, হয়ে উঠেছে সে আনন্দময়।
জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না। ভালোবাসার দামেই তবে পাওয়া যায় সত্যিকারের ভালোবাসা। সামাজিক সম্পর্ক সূত্রের দাবি তোলে ভালোবাসা আদায় করা যায় না। হৃদয়ের দামেই শুধু পাওয়া যায় হৃদয়।
যারা হৃদয়হীন তাদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। এসব ফালতু কথা। বৈষয়িক প্রাপ্তিটাই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় কিছু অথবা একমাত্র প্রাপ্তি। হৃদয় দেয়া-নেয়া তাদের কাছে মূল্যহীন। ব্যক্তিজীবনে তারা চায় স্বামী-সন্তান-সংসার। অথবা স্ত্রী পুত্র-কন্যা পরিবার।
মনুষ্য ছুরতের এসব মানুষ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। তাদেরকে নিয়ে ভাবি না। কিন্তু যারা প্রেমিক পুরুষ কিংবা নারী, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালোবাসাটাই যাদের কাছে মুখ্য, বাকি সব গৌণ, সেইসব ভালোবাসাময় মানুষদের জন্য আমার এই কথাগুলো বলা।
তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো না। সে যেভাবে ভালোবাসে যদি পারো সেই পথে তাকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করো। দাও হৃদয়ের উষ্ণতা। তোমার অকপটতা, আন্তরিকতা, আস্থা আর বিশ্বাস দিয়ে তাকে জয় করার চেষ্টা করো। দেখবে, ভালোবাসার টানে একসময় সে হয়েছে তোমার। শুধু তোমার।
তুমি হও ভালোবাসার একটা নদী কিংবা সাগর। দেখবে, তোমাকে ছাড়িয়ে সে যেতে পারছে না অন্য কোথাও। অন্য কারো কাছে। কিংবা গেলেও সেটা কিছুমাত্র খারাপ লাগছে না তোমার কাছে। তোমার মানুষটিকে খানিকটা সাপোর্ট করে যে মানুষ, করে তার কষ্ট লাঘব, চেষ্টা করে তাকে দিতে সুখ, দেখবে তোমার মানুষের সেই মানুষটিকে তোমার আর খারাপ লাগছে না তেমন।
তা না করে, আরোপিত সামাজিক সংস্কৃতির বিষবাষ্পের প্রভাবে তুমি যদি হও ভালোবাসার একটি সঙ্কীর্ণ পাত্র, বিপুল ভালোবাসার অধিকারী তোমার মানুষটিকে তাহলে কখন জানি তুমি হারিয়ে ফেলবে, টের পাবে না। যখন বুঝবে, হয়তোবা তখন সময় অনেক গড়িয়ে গেছে কিংবা ফেরানোর সুযোগ হয়েছে বিগত।
সম্পর্ক সবাই করে। কিন্তু সম্পর্কের পুষ্টতা যে একটা পরিচর্যার বিষয়, সেটি অনেকেই জানে না কিংবা মানতে চায় না। সম্পর্কের উনুনে সব সময় জ্বাল দিতে হয়, এটি জানে না অধিকাংশ মানুষ। তারা মনে করে, যৌবনঋদ্ধ দুজন নারী-পুরুষকে একসাথে করে দিলেই তারা ভালোবাসাবাসি শুরু করে দেবে। ভালোলাগা, সহজাত প্রবৃত্তি আর সত্যিকারের ভালোবাসা— এগুলোর মধ্যে তারা কোনো প্রভেদ করতে পারে না। কিংবা চায় না।
মানবিক সম্পর্কসূত্র নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা, চিন্তাভাবনা করা, আম কথাবার্তা বলা, সেগুলোকে বোঝার চেষ্টা করা— এগুলো যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা ভাবা আমাদের সমাজে চরমভাবে উপেক্ষিত। এমন ধরনের স্থূলবুদ্ধিতার বলি হয় সব সংবেদনশীল রোমান্টিক মনের মানুষেরা। হয়েছে অতীতে। হচ্ছে। এবং হতে থাকবে যুগে যুগে।
ভালোবাসা চাও? সত্যিকারের? হৃদয়সিক্ত?
তাহলে দাও ভালোবাসা অকৃপণ। করো না হিসেব। দিয়ে দাও বেশুমার। নিছক সামাজিকতার বাধনে বাধতে চেয়োও না ভালোবাসার মানুষকে। আইনের শিকলে বেধে ভালোবাসা আদায় করা যায় না। ভালোবাসা পাওয়ার একমাত্র পথ হলো ভালোবাসা দেয়া।
মনে মনে কিংবা আনমনে তুমি যে কাউকেই ভালোবাসতে পারো। কিন্তু যদি চাও ভালোবাসার সম্পর্ক হোক প্রিয় মানুষের সাথে, তাহলে তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে একটা দেয়া-নেয়ার সম্পর্কে। সম্ভাব্য যে কোনো উপায়ে। ভালোবাসার হাটে বেচাকেনার পণ্য একটাই— ভালোবাসা। কথাটা রেখো মনে।