যুক্তিবুদ্ধির ব্যবহার নিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে অদ্ভুত সব স্ববিরোধিতা কাজ করে। একদিকে তারা মনে করেন ইসলাম হলো যুক্তিবুদ্ধির একমাত্র দাবি। অথচ, তারাই আবার মনে করেন, বিশ্বাস এবং যুক্তিবুদ্ধি, এই দুইটা পরস্পরবিরোধী ব্যাপার!
ঈমানের সাথে যেন, তাদের ধারণায়, যুক্তিবুদ্ধির কোনো ইতিবাচক সম্পর্ক নাই। যুক্তি দিয়ে ঈমান আনলে যেন সেটা ঈমানের দুর্বলতার পরিচয়!
এ কাজে তারা দুটি ঘটনাকে ‘যুক্তি’ বা দলিল হিসেবে পেশ করেন।
ইবলিশ আল্লাহর কাছে যুক্তি পেশ করেছিল। সেজন্য তারা আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে যুক্তি উপস্থাপনকে খুব খারাপ মনে করে। অথচ আমরা দেখি বিভিন্ন নবী-রাসূল আল্লাহর সাথে ‘তর্ক’ করেছেন, প্রশ্ন করেছেন, যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দানে আল্লাহর ক্ষমতা নিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জানতে চাওয়া, যাকে আমরা পাখি সংক্রান্ত ঘটনা হিসাবে জানি, উযাইর আলাইহিস সালামের সাথে মৃতকে জীবিত করা নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সওয়াল-জবাব ইত্যাদি ঘটনা আমরা স্বয়ং কোরআন হতেই জানতে পারি। সাহাবীদের সাথে আল্লাহ রাসূলের – যাকে আমরা বলি fare debate, সে ধরনের – ‘তর্কবিতর্ক’ ও যুক্তি উপস্থাপনের অনেক নজির আমরা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থগুলোতে পেয়ে থাকি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তো বিরোধীদের সাথে সুন্দরতর উপায়ে বিতর্ক করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “তাদের সাথে তোমরা বিতর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়।”
আল্লাহর সাথে ইবলিশের যুক্তি উপস্থাপনটা পদ্ধতিগতভাবে ভুল ছিল। অধীনস্ত হিসেবে যুক্তি উপস্থাপন এবং সমকক্ষ হিসেবে যুক্তি উপস্থাপন প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। থাকাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু সব শুদ্ধতার পরম মানদণ্ড, তাই তাঁর হুকুমকে মেনে নেয়াই যুক্তিবুদ্ধির একমাত্র দাবি। দেখুন, মানুষ সৃষ্টির সময়ে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের যুক্তিতর্ক শুনেছেন এবং কেন তাদের যুক্তি বা আশংকা ভুল তা বলেছেন। তারমানে, মানুষ সৃষ্টির আগে এমনকি ফেরেশতারাও আল্লাহর কাছে তাদের বুঝজ্ঞান মোতাবেক যুক্তি উপস্থাপন করতেন। ফেরেশতাদের যুক্তি প্রক্রিয়া ছিল সঠিক পদ্ধতির।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটা কথাকেও যুক্তি ও স্বাধীন জ্ঞানচর্চার বিপক্ষ দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তিনি বলেছেন, শরিয়ত যদি মানুষের যুক্তির উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হতো তাহলে তায়াম্মুমে পা মাসেহ করার মাসয়ালা অন্যরকম হতো। অর্থাৎ পায়ের উপরের অংশে না মুছে পায়ের তলায় মুছতে বলা হতো। যুক্তিবুদ্ধি বিরোধীদের দাবি অনুসারে, ময়লা লাগে পায়ের তলায়। তাই মুছতে হলে পায়ের তলাতেই মাসেহ করা যুক্তিসংগত।
এখানে তারা পবিত্রতাকে বা তাহারাতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। পবিত্রতা এক জিনিস আর পরিচ্ছন্নতা ভিন্ন জিনিস। পবিত্রতার মধ্যে কিছুটা পরিচ্ছন্নতা থাকলেও পবিত্রতার ধারণা হলো খোদা কর্তৃক আরোপিত। প্রত্যেক অথরিটিই নিজের মতো করে কিছু ফরমালিটি আরোপ করে থাকে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে নির্ধারিত ফরমালিটিগুলোকে আমরা রিচুয়্যাল বা এবাদত হিসাবে বলে থাকি।
খোদা তায়ালা যেভাবে করতে বলেছেন সেভাবেই আমাদের সেসব করতে হবে। এটাই যুক্তিবুদ্ধির দাবি। যে বিষয়ে আমরা জানি না সে বিষয়ে সব সময়েই আমরা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করি। ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্কের এই অনিবার্যতা নিয়েই আমাদের জগত ও জীবনের পথ চলা। ঊর্ধ্বতনের কাছে আপনি যু্ক্তি উপস্থাপন করতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাকে ঊর্ধ্বতনের হুকুমকেই মেনে চলতে হয়। নচেৎ ‘উর্দ্ধতন-অধস্তন সম্পর্ক’ আর বহাল থাকে না। দ্বিরুক্তি করে বললে, নিজেকে অধস্তন হিসাবে স্বীকার করার পরে ঊর্ধ্বতনের পক্ষ থেকে আসা নির্দেশ-নির্দেশনাকে অমান্য করা হলো নিজেরই যুক্তিবুদ্ধির বিরোধিতা করা। কী বলেন? আমি কি ভুল বললাম?
যদিও অপবিত্রতার গোসল আর গোসলের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা অর্জন এক নয়, তৎসত্ত্বেও যদি আমরা পানি দিয়ে গোসল করাকে পবিত্রতার স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে মনে করি তাহলে তো তায়াম্মুমের পুরো বিষয়টাই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে তো পায়ের উপরে মোছাও যা, নিচে মোছাও তা– দুটোই বাতিল হওয়ার কথা।
কথা হলো, যেগুলো আমাদের মানবিক বিবেচনায় চিন্তা, যুক্তি ও জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত বিষয় বলে মনে করি সে বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কি আমরা মানবিক বিবেচনা তথা চিন্তা, যুক্তি ও জ্ঞানকে পরিহার করি? নাকি, সেগুলোকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে আমরা সীমিত মানবিক বিবেচনাপ্রসূত চিন্তা, যুক্তি ও জ্ঞানের ঊর্ধ্বতন পরবর্তী স্তরে উপনীত হই?
আমাদের যুক্তি যখন আমাদেরকে বৃহত্তর বা ঊর্ধ্বতন কোনো অথরিটিকে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য বলে তখন যদি আমাদের যুক্তিবুদ্ধির দাবি অনুসারে সেই ঊর্ধ্বতন সত্তাকে আমরা authority হিসাবে মেনে নেই, তখন আসলে শেষ পর্যন্ত কি আমরা যুক্তিবুদ্ধির বিরোধিতা করি? নাকি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার বৌদ্ধিক দাবিকে মেনে নিয়ে প্রকারান্তরে যুক্তিবুদ্ধির মধ্যেই থাকি?
আসুন, চিন্তা করি।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য
MD Masudul Alam: ইসলামপন্থীদের যুক্তিতর্কের বিরোধিতার যুক্তি হিসেবে আপনি ইবলিশের ঘটনা এবং হযরত আলীর (রা) রেফারেন্স দিয়েছেন। আমার ধারণা, উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আরো একটা কারণ কাজ করে।
আমাদের একটা প্রবাদ আছে: ‘বিশ্বাসে মেলায় স্বর্গ/তর্কে বহুদূর।’ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মীয় সমাজে প্রবাদটা বেশ প্রচলিত। তবে আমার ধারণা, হিন্দু ধর্ম এখানকার আদিধর্ম হওয়ায়, আরো অন্য অনেক কিছুর মতো এই প্রবাদটাও মুসলমানরা সেখান থেকে ইনহেরিট করেছে।
সামগ্রিক বিবেচনায় নানামাত্রিক ইনকসিসটেন্সির কারণে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের ‘যৌক্তিক’ হওয়ার সুযোগ নেই। ‘অন্ধ বিশ্বাস’ই তাদের অবলম্বন। আমার ধারণা, যুক্তির পরিবর্তে অন্ধ বিশ্বাসের যে তাত্ত্বিক বিপদ, তা অনুধাবন না করেই এখানকার মুসলমানদের অনেকে অন্ধ বিশ্বাসকে বেছে নিয়েছে।