আয়নাতে আমরা তাই দেখি যা থাকে আয়নার সামনে। এমন একটা জাদুর আয়নার কথা কি আমরা ভাবতে পারি, যার ভিতরে ভেসে উঠে সেই চিত্র যা আপনি সর্বোত্তম রূপে কল্পনা করেন? সম্পর্কযোগ্য প্রতিটি নারী এবং পুরুষ পরস্পরের জন্য তেমনই এক একটা আয়নার মতো।
এ’কথাটি আমি বহুবার অনেক জায়গাতে প্রসঙ্গক্রমে বলেছি,
কোনো নারী যখন কোনো পুরুষকে ভালবাসে তখন সে আসলে ওই ব্যক্তিমানুষটাকে ভালবাসে না। বরং নাগালের মধ্যে আসা সেই পুরুষটা তার মনের মানুষ, কাঙ্ক্ষিত পুরুষ, মিস্টার হানড্রেড পারসেন্ট-এর বাস্তব প্রতিনিধি হয়ে উঠে। হতে পারে বাস্তবের সেই পুরুষটা ওই নারীর কল্পিত আদর্শ পুরুষের তুলনায় মাত্র ফিফটি পার্সেন্ট।
তৎসত্ত্বেও এরচেয়ে বেশি পারসেন্টেইজের কোনো পুরুষ তার সম্পর্কযোগ্য আওতার মধ্যে না আসায়, সংশ্লিষ্ট ওই নারী সেই পুরুষটাকে দেখে তার রাজা, তার সেনাপতি, তার মিস্টার হানড্রেড পারসেন্ট হিসেবে।
তখন নারীটির কাছে এই পুরুষটা হয়ে ওঠে এক জাদুর আয়না। সেই আয়নার মধ্যে নারীটি তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ মানুষটাকে খুঁজে পায়। বাস্তবের পুরুষমানুষটি হয়ে উঠে নারী-অনুভূতির কল্পনায় আঁকা এক প্রিয়তম আরাধ্য পুরুষের প্রতিনিধি। একইকথা অনুরূপভাবে পুরুষদের জন্যও প্রযোজ্য।
আবেগ হলো আমাদের মনের মধ্যে থাকা সেই জাদুর আয়না যার মধ্যে ইনপুট যা-ই দেয়া হোক না কেন, আউটপুট হয় ফুল কম্প্লায়েন্ট উইথ আওয়ার এক্সপেক্টেশানস। অলওয়েজ।
এ’জন্য দেখবেন, এখনকার ভাষায় লংটার্ম রিলেশনে থাকা সুখী দম্পতিদের অনেকেরই স্বামী বা স্ত্রীটা তার স্পাউজের তুলনায় সামাজিক মানদণ্ডে যথেষ্ট ইনফেরিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রী বা স্বামীর চোখে সে হয় দুনিয়ার সেরা সুদর্শন পুরুষ বা সবচেয়ে সুন্দরী নারী।
যে আবেগের কারণে আদম আর হাওয়া স্বর্গে থেকেও আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছিল, সেই আবেগের কারণেই তারা শয়তানের মতো ভুল যুক্তি দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে খালেস দিলে তাওবা করতে পেরেছিলেন। সেই একই আবেগের কারণে মানুষ বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতি রপ্ত করেছে। চর্চা করেছে মূল্যবোধ। গড়ে তুলেছে সভ্যতা। হয়েছে আস্তিক কিংবা নাস্তিক। আবিষ্কার করেছে নৈতিকতা নামক ইউনিকলি হিউম্যান এন্টারপ্রাইজ, সেই নৈতিকতার ধরন, মানদণ্ড আর কাঠামো যা-ই হোক না কেন।
অনেক বার বলেছি এই কথা, emotion is the spawning ground of knowledge। এনি নলেজ। আবেগ আছে বলেই নানা ধরনের দোষ-ত্রুটিসম্পন্ন কোনো মানুষের সাথে আমরা মোটেরওপরে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। মনের আয়নায় আমরা নিজের কাছের মানুষকে দেখি একজন অলমোস্ট নিখুঁত মানুষ হিসেবে।
যে সন্তানকে নারী গর্ভধারণ করে তাকে সে দেখে সুন্দরতম হিসেবে। নিছক সন্তান হিসেবে। আবেগের দৃষ্টিতে দেখে বলে সে সন্তানকে তার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর বলে মনে হয়। যত যা-ই হোক, গর্ভ বা ঔরসজাত সন্তানের চেয়ে প্রিয় মুখ হয় না কখনো মা-বাবার কাছে।
আরেকটা কথা বলে নেই। কোনো নারীর জীবনে যখন মি. সিক্সটি পারসেন্ট কোনো কারণে এসে যায়, অথচ তার জীবনে আগে থেকে থাকা পুরুষটি লেস দেন সিক্সটি পারসেন্ট, তখন ওই নারীটি অতিঅবশ্যই কোনো না কোনোভাবে বিশ্বস্ততার সীমা অতিক্রম করবে। পুরুষটার সাথে ‘বেইমানী’ করবে। এর ব্যতিক্রম হওয়াটা অসম্ভব।
নৈতিকতা কিংবা অগ্রাহ্য করা যায় না এমন কোনো বাস্তবতার কারণে সে যদি ইনট্রুডার মেইল মিস্টার সিক্সটি পার্সেন্ট হতে আত্মরক্ষা করতে চায়, তাহলে তারজন্য একমাত্র পন্থা হলো আগ্রাসী পুরুষটার জীবন হতে নিজেকে সর্বোতভাবে উইথড্র করে নেয়া।
পর্দার গুরুত্ব ঠিক এখানে। এক্ষেত্রে দেহের পর্দা চেয়েও মনের পর্দার গুরুত্ব বেশি। Unprotected emotion makes impossible anything possible.
মানুষের মন হলো জীবন্ত হাড়ের মতো। জীবন্ত হাড় সংস্পর্শে আসলে জোড়া লাগবেই। এটি অপ্রতিরোধ্য। অনিবার্য।
এই অসুবিধার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ বা কৃত্রিম গর্ভধারণ প্রক্রিয়ার মতো, চাইলে যে কোনো নারী বা পুরুষ যে কোনো নারী বা পুরুষের সাথে ন্যূনতম প্রাপ্তির ভিত্তিতে অকৃত্রিম সম্পর্ক গড়তে পারে। সুখী হতে পারে।
সম্পর্কের আওতায় না আসলে পছন্দনীয় মিস্টারের প্রতি সংশ্লিষ্ট নারীর ভালবাসা নিছক ফ্যান্টাসি হিসেবে থেকে যায়। এ’ধরনের মিয়ার চয়েস বা প্যাসিভ রিলেশন থাকাটা স্বাভাবিক। ধর্ম ও আইন একে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে।
সত্যি কথা হলো, চয়েস মেকিংয়ের দৃষ্টিতে নারী পুরুষ উভয় ক্যাটাগরির পিপলই বহুগামী বা পলিগেমাস। ফিজিকেল কারণে নারীরা প্র্যাকটিকেলি কিছু করার ব্যাপারে অধিকতর সতর্ক থাকে। পার্থক্য এতটুকু।
এই দৃষ্টিতে, প্রত্যেকেই আমরা সুযোগের অভাবে সৎ।
নারীকে নিয়ে পুরুষ যখন কবিতা লেখে তখন কবিতার নারীটির কোনো ত্রুটি তার নজরে পড়ে না। অথবা, জেনুইন সেই ত্রুটিকে সে পজিটিভ কিছুর সাথে মিলিয়ে বরং গুণ হিসেবে ইন্টারপ্রিট করে। সেই নারী তখন তার কাছে হয়ে ওঠে একজন লাইলি, আফ্রোদিতি, খাদিজা কিংবা আয়িশা।
আরাধ্য পুরুষকে নিয়ে যখন কোনো নারী ভাবে, কিংবা কোনো কবিতা লিখে তখন সেই পুরুষটা হয়ে ওঠে এক পাহাড় পুরুষ যেখানে সে এক পাহাড় কন্যা। অথবা, সেই পুরুষটা হয়ে ওঠে তার সূর্য পুরুষ, যেখানে সে নিজেকে কল্পনা করে ধরিত্রী হিসেবে।
আবেগের এই জাদুর আয়না দিয়ে দেখার কারণে বাস্তবে কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক না করেও কেউ লিখতে পারে শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। আমার জীবনে প্রেমের কাহিনী বিবাহপরবর্তী কালের। অথচ আমার দৃষ্টিতে অন্যতম প্রিয় এই প্রেমের কবিতাটা আমি লিখেছি ছাত্রজীবনে; ‘মহুয়া’ (৩৫২ নং কক্ষ), শাহ আমানত হল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে।
কবিতাটা যে ডায়েরীতে হাতে লেখা ছিল উঁই পোকায় সেই ডায়েরিটা সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলেছে। কোথাও টাইপ করাও নাই। এতটুকু শুধু স্মরণে আছে—
চাঁদ নও, জানি তুমি এক মানবী, তবুও
পূর্ণিমার চাঁদের মতো অনিমেষ মুগ্ধতা নিয়ে জ্বলে
তোমার রূপের শিখা।
মনের খাতায় তুমি অলখে লেখা
জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা…!
…
তোমাকে দেখার প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত
মনে হয় যেন সমস্ত পৃথিবীর চেয়েও দামী।
…
আমার সমস্ত অস্তিত্বে, স্বপনে, স্মরণে
মিশে আছো তুমি। শুধু তুমি, শুধু তুমি।
আমার পৃথিবীতে তুমি একমাত্র নারী।