মেরুদণ্ডের অপারেশনের পরে গত মাসে ফিজিওথেরাপির জন্য রামপুরার একটা হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সকাল সন্ধ্যায় থেরাপি নিতে হতো। মাঝে মাঝে হাসপাতালের ১২তলা কেবিন হতে নিচে নামতাম। ফুটপাতে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি করতাম। মানুষজন দেখতাম। হিসেব মেলানোর চেষ্টা করতাম, why people do what they do। মাঝে মাঝে একটা টং দোকানে চিনিছাড়া রং চা খেতাম।
একদিন ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার সময়ে দেখলাম, আমার সামনে একটা পানির বোতলের উপরে বসে তিরিশোর্ধ বয়সের একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে। সিগারেটটা বেশ দামি মনে হলো। কিন্তু লোকটার পোষাক, ভাবভঙ্গী, চুল ইত্যাদি দেখে তাকে অতটা অভিজাত মনে হলো না।
বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকর্মী হওয়ার কারণে সব সময়ে স্বভাবতই লোকদের সাথে আমি নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলি। ছোট বেলায় wise men of the old -এ সম্ভবত ‘থ্রি কোয়েশ্চনস’ অথবা ‘ওয়াইজ মেন এন্ড দা হারমিট’ এই নামে একটা গল্প পড়েছিলাম।
এক রাজা ৩টা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কোথাও সঠিক উত্তর না পেয়ে এক বনবাসী দরবেশের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পেয়েছিলেন। তা নিয়ে সেই গল্প।
প্রশ্ন ৩টা হলো: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনটি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী?
উত্তর হলো: বর্তমান হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তোমার সামনে এ’মুহূর্তে উপস্থিত ব্যক্তিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আর, কাউকে তুমি কোনো সাহায্য করতে পারলে অনতিবিলম্বে তা করাই হলো তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সে মোতাবেক আমার পেশাগত পরিচয় প্রকাশ না করে লোকটার সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। জানলাম, সে এ’ধরনের দোকানে খাওয়ার পানি সরবারাহের কাজ করে। দিনে কমচে কম কুড়িটা সিগারেট সে খায়। বেনসন। প্রতিটার দাম ১৭ টাকা। কমদামি সিগারেট খেলে নাকি তার অসুখ করে।
সে বোঝে, সিগারেট তার জন্য ক্ষতিকর। শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত সবার ক্ষেত্রে যা, ওর জন্যও তা। অভ্যাসের কারণে সে সিগারেট খায়। অন্য যে কোনো মাদকের মতো, ছাড়তে গেলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও (?) সে সিগারেট ছাড়তে পারছে না।
এ ধরনের ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মানুষ নিছক যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে চলে না। রেশনাল সাপোর্টের পাশাপাশি তাকে কোনো না কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যেও থাকতে হয়।
বাচ্চাদের লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে যদি ছেড়ে দেয়া হয়, কোনো প্রকারের পরীক্ষা, তদারকি এবং শাসন না করা হয়, তারা কি নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ালেখা করে ‘মানুষ’ হয়ে উঠবে?
জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ সবকিছু বুঝিয়ে, সিটিজেনশীপের ওপর কোর্স করিয়ে যদি ছেড়ে দেয়া হয়, আইন মানতে প্রতিনিয়ত বাধ্য করা না হয়, তারা কি অটোমেটিকেলি প্লাটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সুনাগরিক হয়ে উঠবে?
সংসার করার বাধ্যবাধকতা, নানা ধরনের পিছুটান বা ডিপেন্ডেসি না থাকলে, ‘maternity is the most fulfilling achievement for a woman’ এই কথাটাকে সঠিক মনে করার কারণে সব নারীরা একেকজন সুগৃহিনী হয়ে উঠবে? আপনি কী মনে করেন?
‘ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটে লেখা এই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ কি ধূমপান বন্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে?
ভাবা যায়, দোকানে দোকানে পানি সাপ্লাই দেয়া এই দরিদ্র লোকটা মাসে ন্যূনতম ১০ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে শুধুমাত্র সিগারেট খাওয়ার জন্য?
সিগারেট খাওয়ার মতো আরো কত বাহুল্যকাজ, ক্ষতিকর কাজ আমরা করি, তা সব চিহ্নিত করে সেসবের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমি করি কিংবা এক সময়ে করেছি, আমার বাবা-মা করেছেন, আশপাশের সব ‘ভাল’ লোকেরা করছেন; কোনো মন্দ কাজের পক্ষে এটি কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ বা যুক্তি হতে পারে না।
ধুমপান হোক, অথবা যা-ই হোক, আপনি কবি হোন বা নবীতুল্য কেউ হোন, আপনার একটি বদভ্যাস আছে; ‘ছাড়তে পারছি না’ এ’রকম লেইম এক্সকিউজ দিয়ে আপনি কাজটি করতে থাকবেন; এমনটি হতে পারে না। আপনার সাথে আমার মোকবেলা হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার না হলেও আমার মতো প্রতিবাদী কারো না কারো তোপের মুখে আপনাকে পড়তে হবে। আমি অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না, সামাজিক প্রতিরোধে বিশ্বাস করি। আইনের কঠোর প্রয়োগে বিশ্বাস করি।
প্রতিটা সতের টাকার সিগারেটে আগুণ জ্বালানো মাত্রই সেটা সিজ করে নিয়ে তার কাছ হতে যদি ৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হতো, তাহলে বন্ধ হয়ে যেত পাবলিক প্লেসে ধূমপানের এই নির্লজ্জ প্রবণতা।
মেয়েরা কেন সিগারেট খায়, কিংবা ছেলেরা খেতে পারলে মেয়েরা কেন খেতে পারবে না, এ’নিয়ে গতকাল একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে অনেকে কথা বলেছেন। সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। সবাইকে ধন্যবাদ। একটা মন্তব্যের এই অংশটুকু প্রণিধানযোগ্য:
“সিগারেটের এই সোশ্যাল ও পাওয়ার ডাইমেনশন মূলত ব্রিটিশ কলোনিয়াল লিগ্যাসি।… তখন শুধু সাদা চামড়ার ব্রিটিশ প্রভুরাই সিগারেট খাওয়ার অধিকার রাখতো এবং এটি আভিজাত্য ও সুপিরিয়রিটির প্রতীক ছিলো।
… কালক্রমে সিগারেটের ব্যবহার সর্বজনীন হলেও এর সাথে যুক্ত ক্লাস ও ক্ষমতাকাঠামো আরো বহু কলোনিয়াল লিগ্যাসির মতো এখনো রয়ে গেছে।
সিগারেটের জেন্ডার রোলও আছে। …পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সিগারেট ফুঁকাকে খারাপ চোখে দেখা হয় এই কারণে যে এর মাধ্যমে সমাজ গৃহীত নারীর কনভেনশনাল কমনীয়-নমনীয় জেন্ডার রোল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পুরুষ সমাজের কাছে সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়।
আবার অনেক নারী যারা ফেমিনিজমকে “পুরুষের সমকক্ষ” হওয়া অর্থে বুঝে, তারা এই প্র্যাকটিসের মাধ্যমে নিজেকে ক্ষমতায়িত দেখতে প্রয়াস পায়।”
— সাঈদ আহসান খালিদ
মন্তব্য
Feroz Ahmed: জরিমানা এক হিসেবে আছেই। আবগারি শুল্ক নেওয়া হয়। সিগারেট খেয়ে স্বাস্থ্যসমস্যার কারণে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত খরচ হয়, তাই সেই খরচের টাকা আবগারি হিসেবে সিগারেটের দামের মধ্যেই কেটে রাখা হয়। একশলা সিগারেট তৈরির খরচ ১৭ টাকা হলে প্রায় ৭ টাকা আবগারি কর যুক্ত থাকে। এটা একটা প্যারাডক্স। বিশ্বজুড়ে ধূমপানের স্পষ্ট ক্ষতির কথা সবাই জানে, এত এত ক্যাম্পেইন হয়, কিন্তু প্রোডাকশন বন্ধ করা হয় না।