জ্ঞানের চর্চা, প্রচার ও প্রসারের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে জ্ঞান নিয়ে ব্যবসা করার প্রতিষ্ঠানে। জীবনমুখী জ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরিবর্তে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক একটি জ্ঞান বিপণন সংস্থা।

জানার চেয়েও উপস্থাপনের মূল্য এখানে ঢের বেশি। অর্জিত জ্ঞানের দাবিকে মেনে চলার পরিবর্তে নিছক বলার জন্য বলা, শো-অফ বা প্রেজেন্টেশনের দিকে এখানকার জ্ঞানী-গবেষকদের ঝোঁক অত্যধিক। বলা যায়, এটিই হলো এখানকার ডমিন্যান্ট ট্রেন্ড।

এখানে অনেকেই জ্ঞানী, গুণীজন বিরল।

আপনি যদি শুধুই জানতে চান, হতে চান গবেষক, গুণী; তাহলে এখানে এসে আপনি হতাশ হবেন। আর কোনোমতে কিছু একটা জানার পরে সেটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ঢোল পিটাতে যদি আপনার ক্লান্তি না আসে, একই বিষয়, বক্তব্য বা ফাইন্ডিংসকে নানাদিক থেকে প্রজেকশন করতে আপনি যদি লজ্জাবোধ না করেন, একজন জ্ঞানব্যবসায়ী হিসেবে যদি তুষ্ট থাকতে পারেন, নীতিবিরুদ্ধ স্বার্থপরতা যদি আপনাকে ক্রমাগতভাবে বীতশ্রদ্ধ করে না তোলে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি আপনার জন্য একটি অতীব উত্তম পেশা।

উপরি পাওনা হিসেবে এখানে পাবেন রাজনীতির মতো একটি শক্তিশালী ও নির্ভার আশ্রয়। যত অদক্ষতাই আপনার থাকুক, যত অপকর্মই আপনি করেন না কেন, পলিটিক্সের ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে মুছে আপনি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠবেন কিংবা থেকে যাবেন সাফ-সুতর, পরিষ্কার।

সুতরাং, নো টেনশন। ডু পলিটিক্স। ক্লাসে যাওয়ার দরকার নাই। আল্টিমেইটলি, ইউ উইল বি আ রিনাউন্ড এডুকেটর। ইটস জাস্ট আ ম্যাটার অব টাইম।

অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হওয়ার কথা ছিল, কিংবা আমার দৃষ্টিতে উচিত ছিল এমনভাবে গড়ে ওঠা, একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন গুণীজনদের একেকটি আখড়া।

সাধুদের জন্য যেমন মঠ-মন্দির লাগে, এবাদত বন্দেগী করার জন্য যেমন গির্জা-মসজিদ-প্যাগোডা লাগে, বসবাসের জন্য যেমন ঘর-নিবাস লাগে, রোগীর চিকিৎসা করার জন্য যেমন গড়ে তুলতে হয় হাসপাতাল, সৈনিকদের জন্য যেমন নির্মাণ করতে হয় সেনাছাউনি বা সেনানিবাস, তেমনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে জ্ঞান-গবেষণা পরিচালনার কাজে দেশের সেরা জ্ঞানী, গুণী ও গবেষকদের জন্য গড়ে তুলতে হয় লাইসিয়াম বা একাডেমি ধাঁচের প্রতিষ্ঠান।

যা কাঙ্ক্ষিত তা অনেকটা এরকম–

বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানতাপসদের আশ্রয় ও মিলন মেলা। যেখানে তারা নিয়োজিত থাকে অবাধ জ্ঞানচর্চায়। সুবিধাপ্রাপ্ত অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো যথেষ্ট ক্ষমতা ও সুবিধা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে না এসে সে ধরনের পেশায় যাওয়াই শ্রেয়তর। নৈতিকতার দিক থেকে সেটা বরং লেস অবজেকশানেবল।

জ্ঞানের উৎপাদন যেখানে থাকে সেখানে জ্ঞানের একটা বিপণন ব্যবস্থাও গড়ে উঠবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎপাদনের চেয়ে যেখানে বিপণনই হয়ে যায় মুখ্য, বিপদ সেখানে ঘোরতর। এই ধরনের বিপদে আছি আমরা, এখানে, এ দেশের সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার ধারণা কম। অভিজ্ঞতা নাই তেমন। সেজন্য সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু একটা বলছি না আপাতত। আর, বলেও বা কী লাভ? তারপরেও বলছি, এক ধরনের আত্ম-সান্তনা হিসেবে, হয়তোবা।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *