যে এলাকায় যারা সংখ্যাগুরু তারা সংখ্যালঘুদের ওপর নানাভাবে কমবেশি নির্যাতন করে এটি সত্য। সব দেশ এলাকা ও সমাজের জন্য এটি সত্য। কোনো এলাকায় যেমন ইউরোপ আমেরিকায় এন্টিরেইসিজম ল থাকাটাই প্রমাণ দেয় সেখানে সংখ্যালঘুরা সামাজিকভাবে মার্জিনালাইজড। উল্লেখ্য, সামাজিক মূল্যবোধের দুর্বলতাজনিত ঘাটতি পূরণ করার জন্য আইন তৈরী করতে হয়।
এর বিপরীত সামাজিক বাস্তবতা হলো সংখ্যালঘুরা ইন জেনারেল সংখ্যাগুরুদেরকে কখনোই আপন মনে করে না। সংখ্যালঘুরা মারাত্মক রকমের হীনমন্যতায় ভোগে। কথায় বলে, ‘নিজের ছেলে, মারো ধরো। তবুও বলে, মা। পরের ছেলে, যতই করো, ততই বলে, না’।
লক্ষ করেছি, চট্টগ্রামে এসছেন, গত কয়েক দশক থেকে আছেন। এখানেই সবকিছু। তবুও চট্টগ্রামকে চট্টগ্রামের লোকদেরকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে ননচিটাগোনিয়ানরা আপন ভাবতে পারেন না; নিতান্ত ব্যতিক্রম বাদে।
জ্বরের সময়ে যেমন নিজের হাতটাকেও ভীষণ ভারী মনে হয়, তেমন করে লোকালদেরকে অপর (other) মনে করার অবচেতন অবসেশনের কারণে সংখ্যালঘুদের কাছে ‘ওদের’ কারো কোনো তুচ্ছ অসংগত আচরণকেও অসম্ভব ভারী বলে মনে হয়।
অপরাপর প্রাণীদের মতো মানুষও স্বভাবতই টেরিটোরিয়াল। টানা সাতদিন তুষার ঝড়ে আটকা পরে ঘরে বসে থাকাটাকেও কাবুলীওয়ালার কাছে খুব রোমান্টিক বলে মনে হয়েছে। মনে আছে, ইনহাস্ত ওয়াতানাম (এই তো আমার জন্মভূমি)?
আলাপ শুরু করেছিলাম সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ নিয়ে। স্থানীয়-বহিরাগত প্রসঙ্গটি এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক, ভাবছেন?
দেখুন, কোনো এলাকা বা দেশে বহিরাগতরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, দেখা যায় অল্প সংখ্যক ‘ভূমিপুত্র’ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। নেতৃত্ব থাকে লোকালদের হাতে। বহিরাগতরা সংখ্যায় দৃশ্যত সংখ্যাগুরু হলেও ক্ষমতাকাঠামো এবং সামাজিক মর্যদাসোপানে তারা থাকে নিচে। সংখ্যালঘু স্ট্যাটাসে। শহর এলাকায় নির্বাচন আসলে বুঝা যায়, প্রকৃত সংখ্যাগুরু হলো সেখানকার অত্যল্প স্থানীয় লোকজন।
মদিনায় হিজরত করার পরে সকল সুযোগসুবিধা পাওয়া সত্বেও মক্কার অনুর্বর পাহাড়-উপত্যকার জন্য মুহাজিরদের কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। জ্বরের ঘোরে তাঁরা মক্কায় অবস্থিত বিভিন্ন পাহাড়ের নাম ধরে ধরে প্রলাপ বকছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর নবী তাদের জন্য দোয়া করলেন ইয়াসরিব যেন তাদের ভাল লাগে।
অথচ, মক্কার তুলনায় বসবাসের জন্য তৎকালীন ইয়াসরিব ছিল অনেক বেশি উপযোগি। সমৃদ্ধ। সুফলা। আরামদায়ক।
অতএব, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য থাকবেই। জরুরী কাজ হলো জাতিগত বিদ্বেষকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকাবেলা করে যাওয়া। এই টক্সিসিটিকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।
একটা হেলদি সোসাইটি এন্ড স্টেইট তখনই হবে যখন সে তার মাইনরিটি পিপলকে প্রপারলি একোমোডেইট করবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতা বিধান করবে। প্রটেকশান দেয়ার পরিবর্তে যে সমাজ ও রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা করা হয় তা বর্বর সমাজ ও রাষ্ট্র, হোক সেটা অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত।
এর একটা বিপরীত চিত্রও আছে।
দেখা গেল অতীব ক্ষুদ্র একটা জনগোষ্ঠীর জন্য বাদবাকী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সাফার করতে হচ্ছে।
কোনো এলাকায় দেখা গেল, কথার কথা, কিছু লোকেরা বাকপ্রতিবন্ধী। তাদের আবদার, সুস্থ লোকেরা ঠাস ঠাস করে যখন কথা বলে তখন তারা অফেনডেড ফিল করে, গিলটি ফিল করে, ডিপ্রাইভড এন্ড এটাকড ফিল করে। অতএব, আইন করা হলো, মূকদের সম্মুখে মূকাভিনয় করতে হবে। কথা বলা যাবে না। ইশারা ভাষা শিক্ষণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক।
কোনো বাকপ্রতিবন্ধীকে কেউ যদি বোবা বলে, এমনকি তার সামনে ‘উদ্ধতভঙ্গীতে’ কথা বলে তাহলে নির্ঘাত শাস্তি। সে কেনসেলড হবে। কনডেমড হবে।
এটি হলো ‘লেজে বিড়াল নাড়ানো’র উদাহরণ। এমন ধরনের পাগলামি ক্ষেত্রবিশেষে আমরা পাশ্চাত্যেও দেখতে পাই, আমাদের এখানেও দেখতে পাই।
শেষ কথা হলো, সংখ্যাগুরুর অহমিকা যেমন বাস্তব; সংখ্যালঘুর হীনমন্যতাও তেমন বাস্তব। সুযোগ পেলে সংখ্যালঘুরা সিস্টেম মেনেইজমেন্টের (একচুয়েলি, মেনুপুলেশনের) মাধ্যমে সংখ্যাগুরুর ওপর ছড়ি ঘুরায়। সুযোগের অভাবে তারা নিরীহ (কনফরমিস্ট অর্থে) সাজে। কথায় বলে, সুযোগের অভাবে প্রত্যেকেই সৎ।
মানুষ ক্ষমতাপ্রিয়। ক্ষমতাকে সে যেমন কাজে লাগায় তেমন করে অনুকূল পরিস্থিতিতে মানুষ খুব স্বভাবতই ক্ষমতার অপব্যবহারও করে। তাই মূল্যবোধ ও আইন দিয়ে অত্যাচারী হয়ে উঠা হতে মানুষকে রক্ষা করতে হয়।
একটা সুস্থ সমাজ মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়, যাকে আমরা সামাজিক আইন বলি। একটা সুস্থ রাষ্ট্র আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রীয় আইন সামাজিক মূল্যবোধকে সুরক্ষা দেয়। সামাজিক মূল্যবোধব্যবস্থা পিরামিডের গোড়ার মতো করে রাষ্ট্রে আইনের শাসনকে নিশ্চিত করে। এর একটি ছাড়া অপরটি অচল। অকার্যকর।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
মোশারেফ ভূইয়াঁ: কেমনে চিটাগাংয়া ভাববে? ননচিটাগোনিয়নকে এখানের লোকজন বইঙ্গা বলে, তাই তারাও চিটাগাংয়াদের রোহিঙ্গা বলে। সম্পর্ক আপেক্ষিক। আমরা এক হাত এগোলে আপনাকেও এক হাত এগিয়ে আসতে হবে। সরি, বেয়াই সাহেব পারসোনালি নিবেননা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ভাই, আপনার বক্তব্য আমার লেখাকেই বরং সাপোর্ট করেছে। এটি সত্য যে এক হাতে তালি বাজে না। সমস্যা হচ্ছে, আদর্শ এবং নৈতিকতার কথা যখন আমরা বলি তখন আমরা বলতে পারি না যে আমার অপরপক্ষ তার নৈতিক মান বজায় রাখে নাই বা তার আদর্শ মোতাবেক চলছে না তাই আমার পক্ষে নৈতিক মান বজায় রাখা কিংবা আদর্শের উপর টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা, নৈতিকতা হচ্ছে একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়। যদিও নৈতিকতা হতে পারে সামাজিক বা সামষ্টিক কোনো বিষয় still, responsibility goes to the person, even he is the leader of the country. there is no moral holiday।
রোজ পিংক: সেই মূল্যবোধের ক্রাইটেরিয়া কী হবে? কোথায় পাব এখন আমরা সে মূল্যবোধ? যেখানে পাওয়া যেত সেটাকে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। আধুনিকতার নামে নৈতিকতা, মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষা গেলানো হচ্ছে আর একটা দানব প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, এরা কিভাবে মানুষের মত আচরণ করবে, মানবতা এরা কোথায় শিখবে? যে সংখ্যালঘুর তথাকথিত নির্যাতনে বিব্রত আপনি, তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে জাতির মেরুদণ্ড গঠনের হাতিয়ার, যে মেরুদণ্ডের স্পাইনাল কর্ড তারা অলরেডি কেটে দিয়েছে। এখন এ জাতি নিজে কিভাবে চলবে, আর অন্য কে কিভাবে সম্মান দেখাবে, হায় এ জাতির ভবিষ্যৎ কী হবে! আপনার সুরে বলতে চাই, আম গাছে তো আর কাঁঠাল ধরবে না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপরে তাদের কোয়ালিটিটিভ ডমিনেন্স কায়েম করে তাহলে সেটাকে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আলোকে না দেখে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও sufficient কোয়ালিটির অভাব হিসেবে দেখা উচিত। ডরমেন্ট ম্যাজরিটি পিপলের উচিত আত্মসমালোচনা করে নিজেদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করা এবং অন্যদের দোষারোপ করে সময় নষ্ট না করে সেই ঘাটতিগুলো পূরণের জন্য যথাযথভাবে কর্মনিষ্ঠ হওয়া। ব্যাপারটাকে আমি এই দৃষ্টিতেই দেখি।
কামাল হোসেন: সমতা প্রদর্শন আমাদেরকে জন্য ইদানিং বিরল কিছু হয়ে গেছে। সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যা-ই থাকুক, সবাই কেন যেন অপরকে সুযোগ মতো দেখিয়ে দেওয়ার চর্চা করা শুরু করছে। কিছু ব্যতিক্রম যা আছে তা খুবই নগন্য!