মিথ্যা হচ্ছে অনেকখানি সত্যের সাথে খানিকটা মিথ্যার সংমিশ্রণ। কোনো মিথ্যা আপাদমস্তক মিথ্যা হয় না। কিন্তু সত্যকে হতে হয় নিখাদ ও আপাদমস্তক সত্য। খানিকটা কিংবা অনেকখানি সত্য দিয়ে সত্যতা হয় না। সত্য মানে নির্ভেজাল সত্য। কিন্তু মিথ্যা মানে নির্ভেজাল মিথ্যে, এমন নয়।
মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে সংমিশ্রণ করো না। তোমরা সত্যকে গোপন করো না। যখন তোমরা সত্যিকারভাবে জানো।”
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে তরুণদের পাওনা:
যারা নবীন, বয়সে তরুণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের তিনটি পাওনা আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ:
(১) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে যথাশীঘ্র সম্ভব দাম্পত্য জীবনের অধিকার।
(২) জীবিকা অর্জনের কোনো একটি উপায়ের উপর নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ লাভের অধিকার।
(৩) জীবন, জগত, প্রকৃতি ও সত্তা সম্পর্কে স্বোপার্জিত ও সঠিক জ্ঞান লাভের অধিকার।
যেই পারিবারিক ব্যবস্থা, যেই সামাজিক গঠন ও যেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো তরুণদের এই মৌলিক অধিকারগুলো প্রদানে, এমনকি ন্যূনতম মানেও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সেই পারিবারিক ব্যবস্থা, সেই সামাজিক কাঠামো ও সেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আমূল সংস্কার জরুরী। টিনেজ বলতে যে বয়সকাল বোঝায়, সেই বয়সের নাগরিক আমাদের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ মাত্র। কিন্তু জাতির ভবিষ্যতের বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে দেখবো, এই ক্ষুদ্র অংশটিই হচ্ছে আমাদের সকল ভবিষ্যতের সবটুকু ও সমগ্র।
আমরা যদি একটা সুস্থ নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে চাই তাহলে তরুণদের এই তিনটি অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর একটির জন্য অপর কোনোটিকে বাদ দেওয়া কিংবা দমিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টার মতো কোনো নির্মম পরিস্থিতির সম্মুখীন তারা যাতে না হয়, তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক ও সমন্বিত যে সামাজিক আন্দোলনের স্বপ্ন আমি দেখি, সেটার অন্যতম লক্ষ্য।
হ্যাঁ, রাতারাতি এই সবকিছু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সবার আগে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, বিদ্যমান এই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অচলায়তন ভেঙ্গে, হতাশাজনক এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে একটি সুস্থ মানবিক সমাজ নির্মাণের কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি নিরূপণ করা।
এই ধরনের সোশ্যাল অ্যাপ্রোচে কাজের ক্ষেত্রে আমি, বলতে পারেন, জায়গা মতো একটি ‘স্ক্রু’ খুলে দেওয়া বা কিছুটা ঢিলে করে দেয়ার পক্ষে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুধুমাত্র খোলামেলা কথাবার্তা বলা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে ‘সাংগঠনিক বাধা’, সেটাকে খুলে দিলেই রেজিমেন্টেড ও অটোক্র্যাটিক সংগঠনসমূহে বিরাজমান স্থবিরতা অনেকখানি কেটে যাবে।
‘কোনো একজন ব্যক্তি সারা জীবন শুধুমাত্র একটি মাযহাবই অনুসরণ করবে’ – মাযহাবপন্থীদের মন-মানসিকতায় টাইট করে লাগানো এই ‘স্ক্রুটি’ খুলে দিলে কিংবা কিছুটা ঢিলে করে দিলে মাযহাব সমর্থন কিংবা বিরোধিতা করার বিষয়ে যে বাড়াবাড়ি চলছে, তা থাকবে না। তৎপরিবর্তে এই নীতিটি চালু করা যেতে পারে– ‘কোনো ব্যক্তি যে কোনো আমলের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসরণ করবে। অর্থাৎ নিজের খেয়াল খুশি অনুসারে অভিনব কোনো কিছু করবে না।’
একইভাবে, আমরা যদি রাখঢাক না করে, নানা ধরনের আরোপিত নৈতিকতা ও অবাস্তব প্রতিযোগিতাসহ যাবতীয় কৃত্রিমতাকে বাদ দিয়ে, বিদ্যমান পারিবারিক, সামাজিক ও মতাদর্শগত সমস্যাগুলোকে খোলামেলা আলাপ-আলোচনায় তুলে আনি, সমস্যাগুলোকে ওপেনলি অ্যাড্রেস করি, সমস্যা যে আছে সেটা স্বীকার করি এবং সংকটের গোড়া যে কোথায় তা যদি আন্তরিকভাবে অনুভব করি, তাহলে আজকের এই বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ যে জনগোষ্ঠী তথা আমাদের এই যে তরুণ সমাজ, তাদের সম্মুখে যে বিশাল ও বিরূপ পরিবেশগত বাধা, সেটা ধীরে ধীরে কেটে যাবে। তুলনামূলকভাবে নিষ্কলুষ এই বিপুল সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ মানে কাজে লাগানো যাবে।
আদর্শগত দিক থেকে চরম ডানপন্থী বলেন, রেডিক্যাল লেফটিস্ট বলেন, আর মডারেট অবস্থানের লোকজনের কথা বলেন, যারাই আজকের দিনে সমাজ পরিবর্তনের জন্য কোনো বিশেষ মতাদর্শ নিয়ে কাজ করছেন, তাদের কেউই সমস্যার গোড়ায় যেতে চান না। কিংবা তরুণদের সংকট ও সম্ভাবনাকে অকৃত্রিমভাবে আলাপ-আলোচনায় তুলে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। মাঝখান থেকে তারা, খেয়াল করলে দেখবেন, উপরের তিনটি বিষয়ের কোনো একটির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে সেটাকেই সব অ্যাঙ্গেল থেকে হাইলাইট করেন। এর পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে তরুণদের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অপরাপর অগ্রগণ্য বিষয়ের কোনোটিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা বা আংশিকভাবে বাদ দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ ভুল ও ব্যর্থ পথে তারা নিজেদের অনুসারীদেরকে পরিচালনা করছেন। এবং খুব সহীহ নিয়ত ও সোৎসাহে অন্যান্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করছেন।
যারা রেডিক্যাল লেফট ধারার অনুসারী তারা তরুণদের যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। অবশ্য এজন্য তাদের ফর্মুলা হলো অবাধ ‘বন্ধুত্ব’ ও লিভিং টুগেদার সিস্টেম। তারা ট্রাডিশনাল পারিবারিক কাঠামোভিত্তিক দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাসী নন। যারা রেডিক্যাল রাইট ধারার অনুসারী তারা তরুণদেরকে রিলিজিয়াস কালচার অ্যান্ড রিচুয়ালনির্ভর আরোপিত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করতে চান। যৌনতার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক। সুস্থ যৌনতার পরিবর্তে মাত্রাতিরিক্ত অবদমনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশি। অবাধ যৌনতার মতো এটিও এক ধরনের বিকৃতি বা পারভার্শন।
মধ্যপন্থীরা ‘ক্যারিয়ার বিল্ডআপের’ নামে ‘জীবিকাই জীবনের সবকিছু’ – কার্যত এমন নীতির অনুসারী। অথচ, যে আদর্শের অনুসারীই আমরা হই না কেন, আমরা জানি, জীবন ও জীবিকা দুটি ভিন্ন বিষয়। তথাকথিত ভালো সাবজেক্টগুলো আমাদেরকে উন্নত মানের জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় মাত্র। জীবনের জন্য অপরিহার্য যে জ্ঞান তথা জীবনবোধ বলে যে ব্যাপার, সেটি জীবিকা হতে স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। অনুকূল পরিবেশে ব্যক্তির মধ্যে উপযুক্ত জীবনবোধ গড়ে ওঠে। জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান তথা যথার্থ জীবনবোধ গড়ে উঠার জন্য তরুণদেরকে সুস্থ ধারার উপযোগী শিক্ষা ও পরিবেশ দেয়াটা বড়দেরই দায়িত্ব।
সংক্ষেপে বলতে গিয়েও কথা খানিকটা লম্বা হয়ে গেলো। যাহোক, মানুষের প্রকৃতি নিয়ে আমার ক্লিয়ার কাট আন্ডারস্ট্যান্ডিং সম্পর্কে জানতে পারবেন সংক্ষিপ্ত এই লেখাটিতে: “সুষম সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নৈতিকতা, স্বার্থ ও প্রবৃত্তির মধ্যে সমন্বয়ের অপরিহার্যতা”
উপরে উল্লেখিত three demands of teenage-এর পয়েন্ট তিনটা: যৌনতা, জীবিকা ও জীবন। এর প্রথম পয়েন্টের বিষয়ে আমার এই লেখাটা পড়তে পারেন: “দাম্পত্য জীবন হলো অন্যতম মৌলিক মানবিক অধিকার“
দুই ও তিন নম্বর পয়েন্ট নিয়ে খানিকটা বিস্তারিত লিখতে হবে। পরবর্তীতে, ইনশাআল্লাহ।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Abu Bakar Siddik: নীতিগত দিক থেকে এই তিনটি দিককে একত্রে নিয়ে আসা বা তিনটির যে কোনো দুইটি বা একটি পরিপূর্ণ হলে বাকিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে– এ রকমটা সম্ভব নয় কি?
Mohammad Mozammel Hoque: না। সমস্যাগুলো অভিন্ন নয়। আবার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও নয়। Those are necessarily connected to each other and must be solved separately without any first second third priority.