প্রিয়জনের সান্নিধ্য, আলিঙ্গন, ইংরেজীতে ডিপ হাগ বলতে যা বোঝায়, এটি মানুষকে সারিয়ে তোলে। আমার যদি ছেলে সন্তান থাকতো আমি তাকে মাঝে-মধ্যে জড়িয়ে ধরতাম। বেশ খানিকক্ষণ। যেমনটি করতেন আমার বাবা। চট্টগ্রামের লোকেরা যেমন, বাবা ছিলেন সারকাজম-প্রিয়। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘এ’দিকে আয়। তোকে শাস্তি দিবো’। শাস্তি হলো, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পিঠের উপর ঘুপুস ঘুপুস কিল। তিনটা কিল। আমার মনে পড়ে, যখন আমি অনেক বড় হয়েছি তখনও আমি মাঝে মধ্যে এই ‘শাস্তি’ পেতাম।
অনেক তারছেঁড়া ছেলেমেয়ের সাথে আমার মাঝে মধ্যে কথা হয়। তারছেঁড়া বলতে, জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ হতে অনেকখানি ছিটকে পড়া। এ’রকম ছেলেময়েদের মধ্যে বিশেষ করে মেয়েদেরকে আমি বলি, তুমি তোমার মায়ের সাথে এক বিছানাতে থাকো। মায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসো। তার সাথে সাথে থাকো। কোনো কেনো মা’কেও বলেছি, আপনার মেয়ের যত মানসিক সমস্যা তার অনেকখানি কেটে যাবে, আপনি যদি তাকে আরো সময় দেন। মাঝে মাঝে ওকে গভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরবেন। তাকে লোনলিনেস ফিল করতে দিবেন না।
কে শোনে কার কথা…! এ’ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। দেখেছি, মায়েরা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ততটা ফেভার করতে চান না। তারা দূর থেকে শুধু পরামর্শ আর শাসনের মাধ্যমে মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আমি পাইনি।
আমার বিভিন্ন লেখায় লিখেছি, সঙ্গসুখ পৃথিবীর বুকে মানুষের পাওয়া সবচেয়ে বড় সুখ। কুকুর-বিড়ালজাতীয় পশুপাখির প্যাট-টাচ মানুষের নিঃসঙ্গতা কিছুটা দূর করতে পারে বটে। এটি খুব সামান্য। মানুষকে ভালোবাসাই শুধু তৃপ্ত করতে পারে। মীর তকী মীরের ভাষায়, ‘প্রেমের ব্যথায় প্রেমই নিবারক’।
এতটুকু পড়ে ইয়াং ছেলেমেয়েরা ট্রিগারড হয়ে উঠবে। তারা মনে করে, ভালোবাসা সেক্স-পূর্ববর্তী ফ্লার্টিং জাতীয় কিছু। তাদের এই ভুল ধারণার কারণ তাদের ব্যক্তিগত যৌনজীবনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা। নারীবাদ তো আর এমনি এমনি আসেনি। এটি ফ্রয়েডীয় প্যারাডাইমের আউটকাম। নারীবাদ নারীর শারীরিক যৌনতৃপ্তিকে ওভার ফোকাস করে। প্যারাডক্সিকেলি, যৌনস্বাধীনতার এই জোয়ারে হারিয়ে গেছে নারীদের স্থিত-সুখ। বেড়েছে মানসিক সমস্যা। কমেছে যৌনতৃপ্তি। এমনকি যৌনসম্পর্কের হার।
পুরুষরা ব্যায়াম, খেলাধূলা, ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতি, মারামারি, কাটাকাটি, সমলিঙ্গের সমবয়সীদের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধুত্ব, নানা কিছুর মাধ্যমে তাদের মানসিক সমস্যাকে সহজেই কমাতে পারে। নারীরা যা পারে না। একজন নারীর মানসিক স্বাস্হ্যের জন্য কাছের মানুষজনের সাথে তার আবেগের সম্পর্ক থাকাটা অতীব জরুরী। সে কারো প্রতি সমর্পিত হয়ে থাকাতে সুখ খুঁজে পায়। সেজন্য তাদের এথিক্সে রিজন আর আর্গুমেন্টের চেয়েও এমপেথি আর কেয়ারের গুরুত্ব বেশি।
কথাটা বিশ্রী। আমি মাঝে মাঝে বলি। এমনকি বামপন্থী নারীবাদী প্রগতিশীলদের কাছেও এটি অন্যতম সোশ্যাল ট্যাবু। মাস্টারবেশন। এটি পুরুষের কাছে যতটা রিলিভিং, নারীর কাছে ততটা নয়। পুরুষের সঙ্গহীন যৌনতৃপ্তি তাদের জন্য শুধুই যৌনাঙ্গের তৃপ্তি। ইমিডিয়েট আফটার মাস্টারবেশন একজন নারীর মধ্যে তৈরী হয় অবসাদগ্রস্ততা, শূন্যতা ও অনির্দিষ্ট হাতাশাবোধ। সেজন্য দেখা যায়, যে নারী যত বেশি নারীবাদী; সেই নারীর তত বেশি বয়ফ্রেন্ড। পছন্দমত সেক্স-টয় থাকা সত্ত্বেও পুরুষের সাথে সে ফ্রিকোয়েন্টলি ইমোশনাল এফেয়ারে জড়ায়।
এই এফেয়ার জাতীয় সম্পর্কগুলো মানুষকে, বিশেষ করে নারীদেরকে, দিনশেষে প্রতারিত হওয়ার অনুভব ছাড়া কিছু দেয় না। কমিটমেন্টলেস কোনো রিলেশনে কমচে কম একপক্ষ একপর্যায়ে চিটেড ফিল করবেই করবে। অনুরূপ পরিণতি ক্যাজুয়াল সেক্স জাতীয় রিলেশনগুলোর। ইমোশনালি কানেকটেড না হয়ে একজন পুরুষ সেক্স করতে পারে, যা একজন নারীর জন্য অসম্ভব-প্রায়। ইমোশনালি এরাউজড না হয়ে পরিবেশগত কোনো প্রভাবকের কারণে সেক্স করার পরে একজন নারীর মধ্যে সহজেই ধর্ষিত হওয়ার অনুভূতি জাগে। এজন্য দেখবেন, ধর্ষণের ঘটনা যত বেশি, ধর্ষণের বানোয়াট অভিযোগ তার চেয়ে বেশি। ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এর অন্যতম উদাহরণ।
হাইপার-সেক্সুয়ালাইজড এই পরিবেশে অবদমিত যৌনক্ষুধা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেমেয়েরা ডিপ হাগকে ভুল অর্থে ইন্টারপ্রিট করতে পারে, তাই এই ব্রিফ বাট এক্সক্লুসিভ ক্লারিফিকেশন। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, পাহাড়ের চিপায়, ছেলেবন্ধুর মেস বা বাসায়, হোটেল কক্ষ বা টুরিস্ট-স্পটে তুমি যা পাও, তাতে সেক্স পরবর্তী রেজুলেশন-পর্বের যে অনির্বচনীয় সুখ, তা থাকে না। কারণটা সহজেই অনুমেয়।
নিজের নারীত্বকে যথাসম্ভব অস্বীকার করে শিক্ষার অজুহাতে ক্যরিয়ার-দৌড়ে প্রাণপণ ছুটতে থাকা আধুনিক নারী, শোন, তোমার সকল সমস্যার একটাই সলিউশান, একটা ছোট্ট প্যাকেজ ফর্মূলা। এর নাম বিয়ে। বাংলা কথায় সংসার। দুনিয়ার ইতিহাসে শত-সহস্র-লক্ষ বছরে ক্রসকালচারালি নারীরা এভাবেই সুখী হয়েছে। নারীবাদের প্রতিশ্রুতি বানোয়াট। প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তোমার জন্য ইন দ্যা লং রান হার্মফুল। তোমার পাশে যখন একজন মানুষ থাকবে, তোমার কোলজুড়ে যখন সন্তান থাকবে, দেখবে তোমার জীবন সুখে স্থিত হয়ে আছে। তোমার মানুষটা কেমন হবে আমি জানি না। তবে তোমার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড হতে যে ভাল হবে তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।
আমার এই আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ হলো, বিয়ের পরে বয়ফ্রেন্ডরা সব বদলে যায়। যাবেই তো। বন্ধুত্ব হয় মিউচুয়েলি এনজয় করার জন্য। সুখের সময় কাটানোর জন্য। সংসার হয় বৃহত্তর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে যৌথভাবে মোকাবেলার জন্য। যে সম্পর্কে তিক্ততা আসে না, চ্যালেঞ্জ নাই; যে সম্পর্ক শুধু সুখ বিনিময়ের, সেটি মিয়ার ফ্যান্টাসি। বাস্তবতার প্রথম আঘাতেই এ’ধরনের মেকী সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।
শুনুন, প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত মেয়ের মায়েরা, মেয়েদেরকে আপনাদের স্বপ্নপূরণে বলির-পাঁঠা না বানিয়ে তাদেরকে রিয়েল লাইফে আরো বেশি করে আপনার সান্নিধ্য দিন। তাদেরকে কাছে টেনে নিন। আপনার ইনভেলুয়েবল হিউম্যান টাচ তাদেরকে দিন। এটি শিশুকালে তাদেরকে দেয়া আপনার মাতৃদুগ্ধের মতো উপকারী। প্রাণের ছোঁয়া প্রাণকে জাগিয়ে তোলে।
আর, মেয়েরা। ‘আগে ক্যারিয়ার, পরে বিয়ে’ ছোটবেলা হতে শেখানো এই ভুয়া মন্ত্রের আসর হতে নিজেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত করবে ততই মঙ্গল। ‘নারীত্বই একজন নারীর সত্যিকারের পূর্ণতা’ এটি ধর্মজীবীদের বানানো কথা নয়। এটি পরীক্ষিত সত্য। তাই এখন থেকে তাই ক্যরিয়ার বিল্ডআপের পাশাপাশি বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথাও ভাবো। মেইট-প্রেফারেন্স প্রক্রিয়াতে সব সময় ব্যয় না করে সত্যিকারের অর্থবহ মেইট-পার্টনারের কথা এখন থেকেই সিরিয়াসলি ভাবো।
কথাটা কেউ বলছে না, তাই বলছি। তোমার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি, ক্যরিয়ার-জার্নি মেয়েদের জন্য এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে লটারী জেতার মতো ব্যাপার। কেউ কেউ জেতে, বেশিরভাগ হারে। ক্যারিয়ার পারসুইংয়ের মতো জিরো-সাম গেইমের চেয়ে ফ্যামিলি ফর্মিংয়ের মতো উইন-উইন সিচুয়েশন তোমার জন্য বেটার স্ট্র্যাটেজি। ক্যারিয়ার অথবা বিয়ে – মেয়েদের ওপর আারোপিত এই ব্রুটাল সোশ্যাল অল্টারনেটিভকে ফোকাস করে লিখেছিলাম, ‘কেন চাই সহজ বিয়ে’। ব্যক্তিস্বাধীনতার এই যুগে নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে বড় সমস্যা। ট্রাডিশনাল ফ্যামিলি লাইফ হলো এর টেকসই সমাধান।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Khandaker Ariful Haque: বেশ প্রশান্তিমূলক একটা ভাবনা, স্যার। আমি এখনো মাকে জড়িয়ে ধরি, গত সপ্তাহে বাড়ি থেকে আসার সময় বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
Mohammad Mozammel Hoque: এই মানবিক বন্ধনকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক জরুরী।
Jahid Hasan Riyad: আমার বাবা-মা’কে আমি জড়িয়ে ধরি, স্যার। আমি কখনোই কাউকে বুঝাতে পারবো না, সেই কয়েক মুহূর্তে নিজের ভেতরে কী খেলে যায়! কতটা প্রশান্তি লাগে! ডিপ হাগ অনেকক্ষেত্রেই মানুষকে বিষণ্ণতা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে।
Md Sakilur Rahman: আপনি প্রায় প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সমাজে নৈতিক মানদণ্ডে উর্ত্তীণ সমাধান দেন। কিন্তু যে পুঁজিবাদ অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে, সুযোগ করে দেয় এবং লিগ্যাল ভ্যালিডিটি দেয় তার খণ্ডন বা ভাঙনের ব্যাপারে জোড়ালোভাবে কিছু বলেন না। আপনি কি মনে করেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত আদর্শের বিপরীতে আপনার দেখানো নৈতিকতা জায়গা করে নিতে পারবে?
Mohammad Mozammel Hoque: দু’ভাবে কাজ হয়: উপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে উপরে। প্রথমটা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয়টা সমাজ নিয়ন্ত্রিত। টপ-ডাউন এবং বটম-আপ, এই দুই এপ্রোচের কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। পরস্পর নির্ভরশীল। একটা আরেকটাকে ইনফ্লুয়েন্স করে।
এর একটা মানে হলো, কোনো একটা পদ্ধতি কারো জন্য যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, সেরকম পরিস্থিতিতে কেউ চাইলে অন্য পদ্ধতিতে কাজ করতে পারে। একটা ইন্টার-কানেক্টেড সিস্টেমে সবকিছুকে চাইলে একসাথে পরিবর্তন করা যায় না। এসব হল তাত্ত্বিক কথা।
এ ব্যাপারে আমার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, একেক জন, একেক সেক্টরে, একেক দিক থেকে কাজ করবে। অন্য সেক্টরে যারা কাজ করছে তাদের ব্যাপারে সে শ্রদ্ধাশীল থাকবে। অর্থাৎ সবাই সব বিষয়ে একই সাথে সবকিছু করতে চাইবে না। যার যার একটা ফোকাল পয়েন্ট থাকবে।
মুহাম্মাদ আল আমিন: আত্মা বা সৌল সম্পর্কে সূক্ষ্ম ধারণা থাকার কারণে আমরা বলতে পারি কিনা যে বেহেশতের বর্ণনাগুলো রূপক, যেগুলো সাধারণদের বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে। দেহ না থাকলে ভোগ বা পঞ্চইন্দ্রিয়ের ব্যাপার আসে না। অন্যদিকে লান তারানি—তোমরা কখনোই দেখবে না—এর দ্বারা বর্তমান বা ভবিষ্যৎ উভয়কালেই খোদাকে স্বচক্ষে দেখার দাবি নাকচ হয়ে যায়। তবে আশারিয়াদের উপলব্ধির ধরণ কী হবে তাও জটিল বিষয়।
Mohammad Mozammel Hoque: একটা হলো বাহ্যিক দর্শন, আরেকটা হলো অন্তর্দর্শন। অন্তর্দর্শনকে ফিলসফিতে ইন্ট্রোস্পেকশন হিসেবে বলে। আমাদের জ্ঞানতত্ত্বে আমরা এটাকে inner-perception হিসেবে বলি। সেজন্য কোনো কিছু দেখার জন্য সেটার বস্তুগত অবয়ব থাকাটা জরুরী কিছু না।
এই বিষয়গুলো বোঝার জন্য ফিলসফির প্রাথমিক কিছু ধারণা থাকা জরুরি। যেমন ফিজিক্যাল এবং মেটাফিজিক্যাল এর পার্থক্য। এটি অনেকে বোঝে না। না বুঝেও বোঝার ভান করা কিংবা এই পার্থক্য বুঝতে পারাটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে না করা, এই গোয়ার্তুমির পক্ষে দেখা যায় নাস্তিক্যবাদী বস্তুবাদীদেরকে এবং গোঁড়া ধার্মিকদেরকে। এই জায়গাতে উভয় পক্ষের দারুণ মিল। উভয়পক্ষ এখানে এসে লিটারালিস্ট হয়ে পড়ে।