কনসেপ্ট অব গ্রাজুয়্যলিটি হলো একটি সহজ কিন্তু গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক বিষয়। আমি এই প্রশ্নের এক ধরনের জবাব দিয়েছি এবং যে কেউ এর কোনো সম্ভাব্য ও যুক্তিসংগত উত্তর দিতে পারে।
‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করেছি, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিয়েছি।’ [সূরা মায়েদা: ৩]
বিদায় হজ্বের সময়ে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে দ্বীন বা জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলাম কি কমপ্লিট ছিল না? ‘… আজ পরিপূর্ণ করা হলো …’ এর মানে এই নয় কি যে বিষয়টি ইতোপূর্বে কমপ্লিট ছিল না?
যদি তাই হয়, অর্থাৎ তৎপূর্বে তা পূর্ণ বা কমপ্লিট না হয়ে থাকে তাহলে এর প্রাথমিক পর্যায়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা কি ‘অ-পূর্ণ ইসলামের’ উপর মৃত্যুবরণ করেছেন? যদি বলা হয়, তাঁদের ঈমান-ইসলাম সবই পরিপূর্ণ ছিল তাহলে today it has been completed বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আর যদি বলা হয়, তাঁদের ইসলাম পূর্ণ ছিল অথচ তখনও ইসলামী বিধি-বিধান প্রবর্তন সমাপ্ত বা সুসম্পন্ন হয় নাই! তাঁরা তাঁদের সময়কালে যতটুকু পেয়েছিলেন তা তৎপরবর্তীর তুলনায় ইনকমপ্লিট ছিল। বিধি-বিধানের দিক থেকে তাঁদের সময়ে যতটুকু ইসলাম ছিল সেটা কি তাঁদের জন্যে বিশেষভাবে কমপ্লিট ছিল? নাকি সব সময়ের জন্যেও কমপ্লিট ছিল?
ধরা যাক, কোনো একজন আমল করার সুযোগ পেয়েছেন শতকরা ৫০ ভাগ বিধি-বিধানের। বাদবাকি ৫০ ভাগের উপর আমল করার সুযোগ পাননি। এখন ঐ ৫০ ভাগকে তাঁর জন্য ১০০ ভাগ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে? নাকি ঐ ৫০ ভাগ এবং পরবর্তী ১০০ ভাগ এই দুইটারই সমান মর্যাদা? হতে পারে তাঁরা যতটুকু পেয়েছেন, ধরুন তা শতকরা ৫০ ভাগ, তার বাইরের অপর অংশটুকু তাঁদের জন্যে একটা বিশেষ ফেভার হিসেবে exemption করা হয়েছে। যদি তা exemption না হয় তাহলে বলতে হবে যে আসলে দুটোই মূলত একই। শুধু প্রায়োগিক বিধি-বিধানের দিক থেকে কোনোটাকে কম expand করা হয়েছে, আর কোনোটাকে more expand হয়েছে। কোনো ইলাস্টিককে যেমন আমরা ৫ সেন্টিমিটার লম্বা করতে পারি, আবার সেটিকে সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটারও লম্বা করতে পারি। উভয় অবস্থাতেই সেটি একই রাবার হিসেবে থাকছে। তাই না?
তাহলে which Islam is the complete Islam?
আমরা দেখি ইসলামের তিনটা মেজর পর্যায় রয়েছে:
(১) প্রথম ১৩ বছরে মক্কার যে ইসলাম তা ছিল মূলত কনসেপচুয়্যল এবং বিধিবিধানের দিক থেকে almost the same।
(২) মদিনার প্রথম পিরিয়ডে বিস্তারিত বিধিবিধানের প্রবর্তন মোটামুটি শুরু হয়েছে এবং
(৩) মাদানী যুগের শেষের দিকে তা কমপ্লিট হয়েছে।
বিধিবিধানের দিক থেকে এই তিনটা পর্যায় স্পষ্টতই তিন প্রকারের। যারা মক্কী বা প্রাথমিক মাদানী যুগে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা তো পরবর্তী সময়ে প্রবর্তিত অনেকগুলো বিধি-বিধানের উপর আমল করার সুযোগই পাননি। তৎসত্ত্বেও তাঁদের ঈমান ও ইসলাম যদি কমপ্লিটই থাকে তাহলে তাঁরা কি কোনো বিশেষ ছাড় বা exemption পেয়েছেন? অবশ্য এমন কোনো কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নাই যে ঈমান, ইসলাম বা ইসলামের কোনো দিক থেকে উনাদের জন্য কোনো বিশেষ ছাড় ছিল।
তাহলে, ইসলাম জিনিসটা কী? রেফারেন্সের দিক থেকে দেখলে এটাকে একটা কনসেপ্ট দিয়েই সমন্বয় করতে হবে। ‘…আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বী-নাকুম …’ – এই আয়াতসহ কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে বলা হয়েছে দ্বীন হলো ইসলাম। হাদীসে জিবরাইলে বলা হয়েছে ইসলাম হলো কালেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব – এই পাঁচটা বিষয়ের সমষ্টি। সূরা আশ শূরার ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে,
‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যার হুকুম তিনি নূহকে দিয়েছিলেন। আর যা এখন তোমার প্রতি আমরা অহীর সাহায্যে পাঠিয়েছি। আর যার হিদায়াত আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম – এই তাকীদ সহকারে যে, কায়েম কর এই দ্বীনকে এবং ইহাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেও না।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা বরাবর একই ছিল। তাই বলা যায়, history of Islam is the history of mankind। দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষ পাঠানোর সাথে সাথে একটা জীবনবিধানও পাঠিয়েছেন। ইসলাম এই নামটা হযরত ইব্রাহীম (আ) দিয়েছেন – এই যা।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাথমিক পর্যায়ের সাহাবীদের ক্ষেত্রে exemption-এর তত্ত্বটা খাটে না। কোরআন-হাদীসে এমন কোনো রেফারেন্স নেই। বরঞ্চ সবগুলো রেফারেন্স হচ্ছে এই মর্মে যে সবার একই মানদণ্ডে বিচার করা হবে। কাউকে বিশেষ কোনো সুবিধা বা রেয়াত দেয়া হবে না। রাসূল (সা) তাঁর ফুফু সাফিয়াকে (রা), তাঁর কন্যা ফাতিমাকে (রা) নাজাতের জন্য বেশি বেশি আমল করার কথা বলেছেন।
ইসলামের দুইটা দিক। একটা হলো এর কনসেপ্চুয়্যাল দিক, আর একটা হলো এর বাস্তবায়নের দিক। কনসেপ্টটা হলো all the same এবং total। এর মধ্যে কোনো বেশ-কম করা যাবে না। কনসেপ্টে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজের প্রস্তাবে রাসূল (সা) দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন ‘আমার এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি তোমাদের (সমঝোতার) প্রস্তাব মেনে নিবো না।’ তাই, সূরা কাফেরুনে যে সিঙ্গুলারিটির কথা বলা হয়েছে সেটি নিতান্তই কনসেপ্চুয়্যাল ইসলাম সম্পর্কিত।
অতএব, দ্বীন হিসেবে ইসলাম সর্বদাই সিঙ্গুলার। আর শরীয়াহ হিসেবে ইসলাম প্লুরাল ও ডাইভারসিফাইড। যদিও এই ডাইভারসিফিকেশনের মধ্যে একটা ইউনিফিকেশান আছে, বাউন্ডারি আছে। মদীনা সনদ স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে তৎকালীন ইয়াসরিব শহরে যে শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সেটা কি ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না? অথচ, ফতেহ মক্কার পরে যে ইসলামী রাষ্ট্র, সেটার চরিত্র আর রূপের সাথে প্রথম হিজরীর তৎকালীন ইয়াসরিব নগরীর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পার্থক্য অনেক। মনে করা হয়, Islamic state is a single entity, either it is established or it is not। আমার বিবেচনায়, ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো single entity নয়। এর বিভিন্ন পর্যায় আছে। রাসূল (সা) বিদায় হজ্বে বলেছেন, আমি কী আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? সাহাবীরা বলেছেন, হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন।
পলিটিক্যাল সায়েন্সে যেটাকে ইউটোপিয়া বলা হয়, ইসলামী রাষ্ট্র কি বাস্তবায়ন-অনুপযোগী ও কল্পনাপ্রসূত এমন এক ঐশ্বরিক আদর্শ রাষ্ট্র? এক কথায়, ইসলামী রাষ্ট্র কি একটা ইউটোপিয়া? বিষয়টা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। ইসলামিক ইউটোপিয়া মানে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির সর্বোচ্চ ধাপ, যেটিতে আমরা পৌঁছার ও থাকার চেষ্টা করবো। আমরা যদি এ ধরনের কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে একে টেকসই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি তবুও মৌলিক গুণগত দিক থেকে সেটি তৎকালীন মদীনায় গড়ে উঠা রাষ্ট্রের মতো হবে না। কারণ, সেই রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন একজন নবী, মোহাম্মদ (সা), সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেটসম্যান। এই অর্থে কখনোই যেহেতু আমরা সেই মানের একটা আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে পারব না, তাই বর্তমান প্রেক্ষিতে একে এক ধরনের ইউটোপিয়া বলা যায়, যদিও সেটিকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে আমাদের এগুতে হবে।
বাস্তবায়নের ক্রমধারাকে (gradual implementation) আমরা যদি special sanction হিসেবে না ধরি, তাহলে আল্লাহর রাসূল (সা) যেভাবে তৎকালীন আরবে ইসলাম কায়েম করেছেন আমরাও আমাদের স্ব স্ব সমাজ ও দেশে সেভাবে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করব। এই সহজ কথাটার একটা ব্যাপক তাৎপর্য আছে। বিধি-বিধানের দিক থেকে মদীনার আদর্শ রাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হয়েছে। যখনই নতুন কোনো বিধান দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী বিধানটা রহিত হয়ে গেছে। উপরের সর্বোচ্চ লেভেলে যেতে হলে আমাদেরকে মাঝখানের পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হবে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, ইন্টারমিডিয়েট ও ফাইনাল – যতগুলো পর্যায় আছে বা ছিল, এই সবগুলোকে একই ধারাবাহিকতায় পাড়ি দিয়ে উপরের লেভেলে পৌঁছতে হবে। সরাসরি জাম্প করা যাবে না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলাম কায়েমের একটা হলো ডিডাক্টিভ মেথড আর একটা হলো ইনডাক্টিভ মেথড। রাসূল (সা) যেখানে রেখে গেছেন সেখান থেকে কোরআন-হাদীস পুরোপুরি তথা অখণ্ডভাবে আমরা পেয়েছি। আমরা কি প্রথমেই সর্বশেষটি দিয়ে শুরু করব? আমরা যদি শুরুতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিধানকে আমল করার কথা বলি তাহলে ক্যাপাসিটির বাইরে হওয়ার কারণে আমাদেরকে কিছু জিনিস ফেলে দিতে হবে। ফেলে দেওয়ার সময় হতে পারে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা ফেলে দেয়া হয়েছে আর কম গুরুত্বপূর্ণগুলোকে তুলে নেয়া হয়েছে। আর যদি মনে করা হয়, আমরা সাধ্য মোতাবেক বহন করব। তখন যত কমই পারি না কেন যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাকেই আমরা প্রথমে কাঁধে তুলে নেব এবং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরো বোঝাটাই একদিন আপহোল্ড করে নিতে পারবো। একটা পাকা দালানের কাঠামো যেভাবে গড়ে ওঠে সেভাবেই যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হয়, হোক তা অ-ইসলামী বা ইসলামী। আল্লাহ রাসূলও (সা) তা-ই করেছেন। নয় কি?
ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্রমধারা (gradual implementation of Islam) অবলম্বন করা যদি রাসূলের (সা) জন্য কোনো special sanction না হয়ে থাকে, তাহলে এখন কেন আমরা সেটা বাদ দিব? আর যদি রাসূলের (সা) জন্য গ্রাজুয়ালিটির বিষয়টি কোনো special sanction বা privilege হওয়ার দাবি করা হয় তাহলে নিচের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে:
নবীদেরকে আমরা যদি শিক্ষক মনে করি এবং আমাদেরকে যদি ছাত্র হিসেবে মনে করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে ভালো শিক্ষককে [মুহাম্মদ(সা)] তাঁর সেরা ছাত্রদের [সাহাবীগণ] বোঝানো ও শেখানোর জন্য ক্রমধারা অবলম্বন করতে হয়েছে। আমরা তথা পরবর্তীদের কোনো শিক্ষক নাই অথচ ছাত্র হিসেবে আমরা অতি নিম্নমানের! এমতাবস্থায় ক্রমধারার এই সুবিধা আমাদের জন্য কেন প্রযোজ্য হবে না? আমরা এখন যে সমাজে বাস করছি এই সমাজটা যদি আন্দোলনের একটা উচ্চতর স্তরে না থেকে একটা নিম্নতর ধাপে থাকে, তাহলে উচ্চতর ধাপের জন্য যা প্রযোজ্য সেসব বিধি-বিধানকে যদি আমরা সরাসরি বাধ্যতামূলক মনে করে প্রয়োগের চেষ্টা করি তাহলে একটা category mistake সংঘটিত হবে, যাতে সমাজে বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। যা ফিতনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
গ্রাজুয়ালিটিকেও আমরা মেকানিক্যালি গ্রহণ বা implement করতে পারবো না। সেটাকে যথাসম্ভব র্যাশনালাইজ করতে হবে। সাহাবীরা এমনকি জানতেনও না যে পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে! তাঁরা মানসিকভাবে ক্রমাগতভাবে তৈরি হচ্ছিলেন বটে। এক পর্যায়ে ওহীর সূত্রে রাসূল (সা) যা কিছু বলেছেন, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। বিদ্যমান পরিবেশ ও জনমানসকে যথাসম্ভব প্রস্তুুত করেই কোনো নতুন বিধান দেয়া হয়েছে। আমরা পুরো জিনিসটাকে একসাথে পেয়ে গেছি। এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে, আমরা জানি যে আল্টিমেটলি ব্যাপারটা কী বা চূড়ান্ত বিধিটা কী? অসুবিধাটা হয়েছে এই, মনে করা হচ্ছে এ সবগুলো একইসাথে বা এর চূড়ান্ত স্তরটিই শুধুমাত্র আমাদের জন্য সর্বাবস্থায় অবলিগ্যাটরি।
আমরা একটা মিশ্র সমাজে (mixed society) বাস করছি। দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আমরা বসবাস করছি। এখানে হায়ার লেভেলের কোনো কোনো বিষয় আমরা সহজেই করতে পারছি। যেমন আমরা জুমার নামাজ পড়তে পারছি। কিন্তু ঐ লেভেলের জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য কোনো কোনো বিধি আমরা মানতে পারছি না। যেমন আমরা ‘হদ’ [দণ্ডবিধি] কায়েম করতে পারছি না। যদি সাব্যস্ত করা হয়, আমরা মক্কী যুগে আছি তাহলে আমরা কি জুমা বাদ দিব? যাকাত বাদ দিব? হিজাব বাদ দিব? আমরা কি সুদ গ্রহণ করব?
বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, মিশ্র সমাজের ধারণাকে যদি আমরা গ্রহণ করে নেই তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, রুখসত [সর্বনিম্ন অনুমোদিত সীমা] এবং আজীমত [সর্বোচ্চ মান]-এর ধারণাকে সামনে রেখে যেখানে আমাদের পক্ষে সম্ভব, যে বিষয়ে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত ক্ষমতা আছে যেখানে আমরা শরীয়াহর সেই হুকুমটাকেই আমল করবো যা উচ্চতর ধাপের। আমাদের লক্ষ্য হলো যথাসম্ভব উচ্চতর ধাপে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে উন্নীত করা। শর্ত হলো সম্ভাব্য সকল উপায়ে উক্ত উন্নততর আইনকে মেনে নেয়ার জন্য সমাজকে তৈরি করা। এতে সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা থাকে না। সামাজিক কর্তৃপক্ষ যেসব উন্নততর বিধানকে অনুমোদন করে না, সেগুলোর প্রযোজ্যতাকে আমরা নীতিগতভাবে স্বীকার করব, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নকে স্থগিত রাখবো। ব্যক্তিগতভাবে মক্কীযুগে এবং প্রাথমিক মাদানী যুগে যেসব ইসলামী বিধি-বিধান বলবৎ ছিল যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সর্বদা মেনে চলব। ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে ও আওতার মধ্যে আমরা আজিমতকে অনুসরণ করব। কিন্তু অন্যদের জন্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা রুখসাতকে অনুমোদন করব। এ ক্ষেত্রে আমরা সর্বনিম্ন সীমাকে অনুমোদন করলেও মূল স্ট্রাকচারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিয়মগুলোকে যুক্তিসংগত হিসেবে উপস্থাপন করা ও ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকবো। এই লক্ষ্যে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে আমরা যথাসম্ভব তৈরি বা buildup করার চেষ্টা করবো। এক কথায় যাকে ইসলামী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন আমরা কোন পর্যায়ে আছি? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয়ের আগে ধর্ম ও ইসলাম নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি। ব্যক্তিজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ধর্মীয় বিষয় ও বৈশিষ্ট্য অন্তর্গত ও অপরিহার্যভাবে ইসলামের মধ্যে আছে বটে, যাকে আমরা ইবাদত বলি। তৎসত্ত্বেও ইসলামের অপর বৃহৎ অংশ, যাকে ফিকাহর ভাষায় বলা হয় মুয়ামালাত, তা ধর্মীয় চরিত্রের নয়; পুরোপুরিই বৈষয়িক। বিশেষ করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিতে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহের সাথে ধর্ম বলতে যা বুঝানো হয় তার মিল নাই। আল্লাহ তায়ালা ইবাদতের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেননি। এজন্য ফেরেশতারা যথেষ্ট ছিল। শুধু এ পৃথিবীকে নয়, পুরো বিশ্ব পরিচালনায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামকে এই দৃষ্টিকোণ হতে দেখে না।
তারা মনে করে, ইসলাম অন্যতম একটা ধর্ম মাত্র। হতে পারে তা উন্নততর বা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামকে বুঝা বা সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো জানা দরকার, তার ন্যুনতম জ্ঞানও আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে নাই। তারা ইলাহ পরিভাষাটির অর্থ বোঝে না, রব শব্দের অর্থ বোঝে না। তারা কালেমা উচ্চারণ করে ঠিক মতো, কিন্তু এর মর্মার্থ বা কনসিকোয়েন্স সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। মক্কার কাফের-মুশরিকেরা কালেমার যে implication পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল, আমাদের এখানে শিক্ষিত লোকেরাও সেগুলো বুঝে না। কালেমাকে তারা পবিত্র একটা মন্ত্র মনে করে। এর প্রায়োগিক জিনিসগুলো বোঝে না। তারা উলীল আমর সম্পর্কে শুনে নাই, বোঝে না। ইবাদত সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখলেও সমগুরুত্বপূর্ণ ‘তাগুত’ শব্দটি আদৌ শোনেনি!? নরম মাটির উপরে যদি একটা স্ট্রাকচার করতে হয় তাহলে প্রথমে ভালোভাবে পাইলিং করতে হবে। সুফী-দরবেশ দ্বারা ইসলাম প্রচার হলেও এদেশে কখনো ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। তাই এদেশের মানুষকে ভালো করে একটা তত্ত্ব হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে, বোঝাতে হবে। কনসেপ্ট হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হওয়ার পর তাঁদের সামনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে আসতে হবে।
ইসলাম নিয়ে যারা কাজ করেন, ইসলামিক মুভমেন্ট হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন, তাদের মধ্যেও অনেক সমস্যা আছে। এরা মনে করেন, তারা নিজেরা সবকিছু ভালো করেই বোঝেন। তাদের দৃষ্টিতে একমাত্র সমস্যা হলো অন্যদেরকে বোঝানো, অধিকাংশ (?) মানুষকে কনভিন্স করে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা! অথচ, ইসলামী অনেক কনসেপ্ট ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই গভীর মতানৈক্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিকের বুলি কপচানোর বাইরে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় না বিধায় বাহ্যত মনে হয়, কোনো সমস্যা নাই! কোনো কোনো সেক্টরে তারা কোনো কাজই করেনি। ইসলাম তাদের কাছে এক সর্বরোগহরি বড়ি (panacea), কোনোমতে খেতে ও খাওয়াতে পারলেই কেল্লা ফতে! এরই ফলশ্রুতিতে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে শাখা-প্রশাখা নিয়ে ইনভলভ হয়েছেন ও হচ্ছেন। প্রায়োগিক বিষয়ে যে ধরনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা দরকার, তা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় না। ইসলামিক সংগঠনগুলোতে intellectual bankruptcy বা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা বলতে যা বোঝায় সেই জিনিসটা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বিদ্যমান! প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধর্মীয় ভাবধারার মতো ইসলামী আন্দোলনের সংগঠনসমূহেও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়! ভাবখানা এমন, ক্ষমতা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! এই হলো রাজনৈতিক ইসলাপন্থীদের স্বনির্মিত গোলক-ধাঁধাঁ!
এ বিষয়ে আর একটা পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ইসলামিস্টরা সাধারণত এ দেশকে, দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে, দেশের মানুষকে আপন মনে করে না, own করে না। জনবিচ্ছিন্নতাকেও তারা খারাপ বা ক্ষতিকর মনে করে না। বরং এই স্বাতন্ত্র্যকে তারা উপভোগ করেন! ইসলামপন্থীদের মনোভাব হলো, তারা সাধারণ (পাপী!) মানুষের (পরকালীন) মুক্তি বা নাজাতের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এ ধরনের মানস গঠনের কারণে তাঁরা সবসময়ে সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সিটিতে ভোগেন ও এক ধরনের আত্মতুষ্টি অনুভব করেন। ফলে তারা মানুষের কাছে যখন যান তখন নিজেদেরকে বিশেষ মর্যাদাবান মনে করেন এবং মানুষও তাদেরকে (পারলৌকিক বিবেচনায়) এক ধরনের বিশেষ ধর্মীয় মর্যাদা দিয়ে থাকে। মিউচুয়্যাল এক্সক্লুশানের ভিত্তিতে এ ধরনের একটা সেক্যুলার ফরমেট এখানে কম-বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সঠিকভাবে ইসলামকে বুঝতে চাইলে deductive approach of understanding Islam-এর ভুল পন্থা হতে সরে আসতে হবে। মনে করা হচ্ছে, ইসলামের কোনো একটি বিধান কৌশলে বা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারলে কিছু না কিছু ইসলাম তো কায়েম করা গেল! ইসলামকে একটা জীবনদৃষ্টি বা আদর্শ হিসেবে না দেখে বিধি-বিধানের একটা আঁটি বা সমষ্টি হিসেবে দেখাই হচ্ছে এই ভ্রান্ত ও প্রান্তিক মানসিকতার কারণ।
ইসলামের দুটি দিক, একটা হলো Islam in its core of beliefs and personal practices। যেমন কালেমা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি ন্যূনতম বিষয়গুলো। অন্যটা হচ্ছে এর implementary aspects that are socio-cultural-economic-politically concerned। এগুলোর বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ও প্রেক্ষিত ক্রমধারায় অগ্রসরমান। এসব বিষয়ে স্থানিক ও কালিক পরিক্রমায় উদ্ভূত সমস্যা ও উপযোগী সমাধান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কোনো কালবিশেষের নিরিখে কনক্লুসিভলি বলা সম্ভব নয়। সুন্নাহভিত্তিক মূলনীতির আলোকে এসব বিষয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
প্লাটোর আদর্শ রাষ্ট্র সত্যিকারের আদর্শ রাষ্ট্র নয় এবং কখনো কোনো দেশে দার্শনিক-রাজা ছিল না। এই দৃষ্টিতে মদীনার সমাজ-রাষ্ট্র একটি বাস্তব সমাজ-রাষ্ট্র, প্লাটোনিক ইউটোপিয়া মাত্র নয়। একজন রাসূলের নেতৃত্বে একটা রাষ্ট্র সংগত কারণেই আমরা কখনো কায়েমে করতে পারবো না। এ দৃষ্টিতে মদীনার তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন আমাদের জন্য একটা কল্পরূপ বা ইউটোপিয়া বটে! ইসলামী রাষ্ট্রের শেষ বলে কোনো কিছু নেই। এমনও দেখা গেছে যে, কোনো সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করার পর মারা গেছেন। কোনো আমল করার সুযোগ পাননি। তাহলে ওনাকে কি বিশেষ রেয়াত দেয়া হবে, না তাঁর জন্য যা প্রযোজ্য বা সম্ভাব্য ছিল কেবলমাত্র তার ভিত্তিতেই তাঁর বিচার করা হবে? ইসলামকে যেহেতু আমরা মূলত একটা কনসেপ্ট হিসেবে মনে করছি, যেহেতু তিনি কনসেপ্টটাকে পুরোপুরিই গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ ঈমান এনেছেন তাহলে তাঁর ইসলাম পরিপূর্ণ ছিল বলে ধরে নেয়া হবে। আমরা কাফেরের যে সংজ্ঞাটা দিই সেটি হলো– ব্যক্তি জেনে-বুঝে ইসলামকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে।
মিশ্র সমাজের কনসেপ্ট অনুসারে আমরা যে সমাজে আছি, দেখা গেল কোনো দিক থেকে তা প্রাথমিক পর্যায়ের, আবার অন্য কোনো দিক থেকে তা মাধ্যমিক পর্যায়ের, অথবা অগ্রসর পর্যায়ের। তাহলে আমরা কোন course of action-কে ওভারঅল ফলো করব? আমাদের পক্ষে যেসব বিধিবিধান মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে সেসব আমরা মেনে চলবো। বিদ্যমান সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে যেখানে আমাদের যেটা করা সম্ভব সেটি করবো, আপাতত ততটুকুই প্রযোজ্য মনে করব। যেটি করতে পারছি না সেটি করার অনুমোদন দেয়ার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত, পরিচালিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে (গণতান্ত্রিক অথবা অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায়ে) বাধ্য করবো। এ কাজে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতাকে সর্বদা মেনে চলতে হবে। বুঝতে হবে, সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততাই হলো জিহাদ ও ফিতনার মাপকাঠি।
সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততা থাকা বা না থাকাই নির্ধারণ করবে গৃহীত কোনো বিশেষ কর্মধারা জিহাদ নাকি ফিতনা? জিহাদ ফরজ, ফিতনা হারাম। ব্যক্তিবিশেষ, একা একা জিহাদ করতে পারে না। দলবিশেষও জিহাদ করতে পারে না। এমনকি তা ইক্বামতে দ্বীনের কোনো সংগঠন হলেও! বৈধ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জিহাদ ঘোষণা ও পরিচালনা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেকের আত্মরক্ষার অধিকার সর্বদাই বলবৎ থাকে। এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধে কেউ মারা গেলে প্রতিরোধকারী শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন। যদিও এই সংঘর্ষ জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে না। যেভাবে কোনো দুর্ঘটনায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে বা সন্তান প্রসবের সময় কেউ মৃত্যুবরণ করলে শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন।
নেকাব সংক্রান্ত বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য হলো পর্দার চূড়ান্ত স্তরে নারীদের মুখ ঢাকা ফরজ করা হয়েছে কি না। প্রথম মুসলিম হযরত খাদিজাসহ (রা) প্রাথমিক যুগের মুসলিম নারীদের সম্পর্কে আমরা যদি ভাবি, চিন্তা করি তাহলে আমরা তাঁদেরকে সেভাবে পাবো না, যেভাবে মাদানী জিন্দেগীর মধ্যবর্তী সময়ের পর থেকে মুসলিম মহিলাদের দেখা গেছে। খাদিজা (রা) আর আয়িশা (রা) এক নন। এটি বুঝতে হবে। আমাদেরকে আগে খাদিজা (রা) হতে হবে। প্রথমেই আয়িশা (রা) হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রচলিত আরবীয় সংস্কৃতির কারণে তাঁরা কখনো মুখ ঢেকেছেন কিনা সেটি নিয়ে সীরাতগ্রন্থসমূহে কোনো আলোচনা নাই। তাই মুখ ঢেকে হোক বা না ঢেকে হোক অর্থাৎ হিজাবের কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই তাঁদের ঈমান, ইসলাম ও ইসলামী জিন্দেগী পূর্ণ ছিল। নয় কি? তাহলে কি তাঁদেরকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে? অথচ, কোরআন ও হাদীসের প্রচুর বর্ণনা হতে আমরা জানি, প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী নারী-পুরুষরা ছিলেন তৎপরবর্তীদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নতমানের।
রাসূল (সা) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন তা হলো আমাদের জন্য উন্নততর আদর্শ ও মান – এটি হলো একটা ধারণা। আর রাসূল (সা) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন আমাদের জন্য সেটি একমাত্র করণীয় – এটি হলো সম্পূর্ণ পৃথক আরেকটি ধারণা। এ দুটো কথার ইমপ্লিকেশনের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
সাহাবীরা মনে করতেন, ঘুমিয়ে গেলে রোজা কায়েম হয়ে যায়। তৎসত্ত্বেও মানবীয় প্রবৃত্তির কারণে তাঁরা স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক করতেন। এরপর তাঁরা অপরাধ প্রবণতায় ভুগতেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাযিল করে জানালেন, ফজর পর্যন্ত তাঁদের জন্য অবকাশ আছে। এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি এখনও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। কোনো বিষয়ে মনে করা হচ্ছে, ফাইনালি যা করতে বলা হয়েছে সেটিই আমাদের একমাত্র করণীয়। কিন্তু সেটি বাস্তবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে কী করা যায়? আমাদের এখন কী হবে? এহেন জটিল পরিস্থিতিতে সব অদ্ভূত সমন্বয়, সোজা কথায় গোঁজামিলগুলো দেয়া হয়, বিভিন্ন রকমের প্রান্তিকতা গড়ে উঠে। নমনীয়তার প্রান্তিকতা ও কঠোরতার প্রান্তিকতা। কোনো কোনো বুনিয়াদী বিষয়ে (যেমন– শাসন-কর্তৃত্ব সম্পর্কিত) নমনীয়তা ও আপসকামিতার নীতি অবলম্বন করা হয়। অথচ কোনো কোনো অ-বুনিয়াদী বিষয়ে (যেমন– পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি) পূর্ণতার দাবি ও কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। এসবই অনাকাঙ্খিত প্রান্তিকতার লক্ষণ।
এই তালগোলে ব্যাপারের পুরোটাই ঘটছে conceptual ambiguity and inconsistency-র কারণে। যদি মনে করা হয়, আজকের দিনের মধ্যে আমাদেরকে ১০০ মাইল হেঁটে যেতে হবে যা আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন আমরা কী করব? হতাশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তবা ৫/১০ মাইল হেঁটে বসে পড়বো, নতুবা হতাশ হয়ে বসে থাকবো, অথবা ভিন্ন কোনো সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করবো। আর যদি মনে করা হয়, এই ১০০ মাইলের মধ্যে ১০টা মনযিল রয়েছে, তাহলে প্রত্যেক যাত্রী সর্বোচ্চ গতিতে অগ্রসর হবে। ধারণা করা যায়, সবাই যার যার মতো করে কোনো এক সময় গন্তব্যে পৌঁছবে। একেক জন ব্যক্তির একেক অবস্থা, একেকটা সমাজের একেক অবস্থা, একেকটা এলাকারও একেক অবস্থা। বিশ্ব-আদর্শ হিসেবে ইসলাম, মোর স্পেসিফিক্যালি ইসলামী শরীয়াহ, একেক দেশে একেকভাবে প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই ক্রমধারা ও বৈচিত্র্যকে নির্ধারণ করতে হবে, বুঝতে ও বোঝাতে হবে, বাস্তবসম্মতভাবে জনসমাজকে আশ্বস্ত করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠা বিদ্যমান ধর্মীয় কাঠামোর সাথে এটি বিরোধপূর্ণ হওয়ায় বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে হবে।
যদি মনে করা হয়, রসূল (সা) চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের যেটা আদেশ দিয়েছেন সেটা থেকে তৎপূর্ববর্তী কোনো স্তরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নাই, তাহলে হযরত আয়েশার (রা) মদ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ হাদীসটির কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম অবতীর্ণ আয়াতেই যদি বলা হতো– তোমরা মদ পান করো না; তাহলে তাঁরা অবশ্যই বলতো– আমরা কখনোই মদ্যপান ত্যাগ করবো না।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৪৭০৭)
আমরা জানি, মোট চার ধাপে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। সাহাবীদের জন্য যদি ক্রমধারা দরকারী হয়, অন্যদের জন্য তা হবে না কেন? ব্যক্তি গঠনের জন্য ক্রমধারাকে অনুমোদন করা হলে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য সেটি কার্যকর হবে না কেন? অর্গানিক থিওরি অনুসারে ব্যক্তি বিশেষের মতো সমাজেরও একটা স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে। তাই না?
সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াত অনুসারে কোরআনের আয়াতসমূহ দুই ধরনের: দ্ব্যর্থহীন ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। হেদায়াতের জন্য দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহই যথেষ্ট। সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিরসনে প্রচলিত পদ্ধতি হলো নাসেখ ও মানসূখের ধারণা। এই পদ্ধতি বা ধারণা একদিক থেকে সঠিক আবার অন্যদিক থেকে ভুল। সমাজ গঠনের ধাপ নির্ণয়ে আমাদেরকে অবশ্যই নাযিলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতে হবে। কোনো অগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা অতিক্রম করে আসা কোনো প্রাথমিক স্তরের বিধি-বিধানকে অনুমোদন করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তৃতীয় স্তরে থাকে সেখানে দ্বিতীয় স্তরের বিষয়াদি কার্যকর থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা জনপদ এখনো প্রাথমিক স্তর হতে উত্তরণ লাভ করতে পারে নাই সেখানে নাসেখ-মানসূখের কথা বলে অ-প্রযোজ্য উচ্চতর বা সর্বোচ্চ ধাপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো পণ্ডশ্রম নয় কি?
আমাদের এখানকার ইসলামী সংগঠনগুলো পপুলিস্ট! তারা মনে করে, যদি এই এই বিষয়ে অপ্রচলিত কিন্তু সত্য কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা হয় তাহলে মানুষ ভুল বুঝবে। অতএব সত্য কথা বলা যাবে না! হক এবং হেকমতের মধ্যে যদি সামঞ্জস্যবিধান করা না যায়, তাহলে বাস্তবে গিয়ে সব বরবাদ হয়ে যাবে। হকের দিক থেকে হবে এক ধরনের বরবাদী, আর হেকমতের দিক থেকে হবে অন্য ধরনের বরবাদী। হক হওয়া আর হক কায়েম হওয়া বা করা – এক জিনিস নয়। আল্লাহর রাসূল (সা) জানতেন, এরা হলো মুনাফিক। তৎসত্ত্বেও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেননি। আল্লাহ তায়লা জানেন, তিনি কী কী বিষয় আরোপ করবেন, কী কী বিষয় নিষিদ্ধ করবেন। মানুষের মননশীলতায় ও বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্যতা (receptiveness) সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত কী করা হবে, তা তিনি প্রকাশ (নাযিল) করেননি।
হেকমত অবলম্বন না করার পরিণতি হলো চরমপন্থা অবলম্বন করা। ফিতনাকে জিহাদ মনে করা! আবার সবসময়ে হেকমতকে প্রাধান্য দেয়া হলো হীন আপসকামিতা, যাকে আমরা অ্যাপোলোজেটিক ট্রেন্ড বলে থাকি। কোনো কোনো শুভাকাঙ্খী আমাকে বলেছেন, আপনি যে কাজ করছেন তাতে ‘ইসলাম’ নাম নেয়ার দরকার কী? যেমন Center for Social & Cultural Studies (CSCS) নামে যা কিছু করা হয়েছে, তা সবই ইসলামের পক্ষে গেছে। ফোরামের নামের সাথে ‘ইসলাম’ না লাগানোতে কোনো সমস্যা হয়েছি কি? কথিত এই ‘ক্যাপসুল ফর্মূলা’ অনুসরণ করে আমরা অনেক কিছু করতে পারি বটে; কিন্তু আমরা যে মুসলিম, ইসলাম যে আমাদের জীবনাদর্শ, অপরাপর জীবনাদর্শগুলোকে যে আমরা বাতিল মনে করি – একে কি আমরা শেষ পর্যন্ত গোপন করতে পারি? অতি-হেকমতের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, মূল বিষয়টাকেই [the basic claim] নেগোশিয়েট করে ফেলা! রাসূল (সা) এ ধরনের কোনো নেগোশিয়েট করেননি বলে তাঁকে জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছিল!
হক এবং হেকমতের মধ্যকার ভারসাম্যকে বুঝতে হবে, মানতে হবে। একজন সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ক্লাসের মধ্যে ইসলামের কথা বলেন?’ আমি বললাম, ‘একেবারেই কদাচিৎ ও নিতান্তই প্রসঙ্গক্রমে।’ তিনি আমাকে বার বার এ বিষয়ে তাগাদা দিয়ে বলছিলেন, ‘আমাদের উচিত এই সুযোগে কিছু দাওয়াতী কাজ করা। তাহলে দশজনে জানলো এবং ইসলামের কিছু প্রচার-প্রসার হলো।’ তখন আমি বললাম, ‘ভাই, ইসলাম এমন কোনো ঔষধ না যে কৌশলে খাইয়ে দিলেই হলো!’ কোনোমতে মুসলমান হিসেবে নাম লেখানোর মাধ্যমে আদমশুমারী অনুসারে মুসলমানের সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতিবৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো ফললাভ হবে না। এসব অ-বুঝ মুসলিমরা খালেস নিয়তে অ-ইসলামকেই লালন করবে এবং সত্যিকারের ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে সওয়াবের নিয়তে (?) সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধিতা করবে।
ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এর দায়-দায়িত্বকে মেনে নিয়ে। একটা all out intellectual exercise এর the only rational outcome বা conclusion হবে spelling of the kalma-e-tayyaba। এমন নয় যে কোনোমতে একে বুঝিয়ে দেয়া হলো অথবা লোকেরা সাময়িক কোনো বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার কারণে ইসলাম গ্রহণ করে নিলো। এভাবে অধিকাংশ লোক ইসলাম মেনে নিলে কি ইসলামী সমাজ অটোমেটিক্যালি কায়েম হয়ে যাবে?! মদীনার অধিকাংশ লোকেরা কি শুরুতে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো? না, নেয়নি। মুসলিম জনসংখ্যা এক দশমাংশও ছিলো না। মদীনা সনদ স্বাক্ষরের সময় রাসূল (সা) ছিলেন মাইনরিটি লিডার। যোগ্যতার কারণে তাঁকে সবাই নেতা মেনে নিয়েছিলো। ইসলামাইজেশন বলতে আমি সিস্টেম ম্যানেজমেন্টকেই বুঝি।
হক ও হেকমতের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কীভাবে এটি সম্ভব? আমাদের প্রত্যেকের বিবেক আছে। Our conscience will say that. আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ফাআলহামা-হা ফুজু-রাহা ওয়া তাক্বওয়াহা।
[পুনশ্চ: বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির উপর গবেষণা করে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন চবি’র রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের এমন এক সহকর্মীর সাথে ১০/১১/২০১০ তারিখে এসই-২৮ নং বাসায় বিকেল বেলা এ বিষয়ে আলাপ করেছিলাম। কথা বলার সময় ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারটি অন করে রেখেছিলাম। বহুবার নিজেই রেকর্ডটা শুনেছি। সাধ্যমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ আলেমদের সাথে কথা বলেছি। সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রফেসর ড. আ.ক.ম. আবদুল কাদের মুহাম্মদ আল গাযালীর ‘কাইফা নাতাআমালু মায়াল কোরআন’ বইটা হতে আমাকে ঘন্টাখানেক পড়ে শোনানোর পর ভাবলাম, নেটেও অন্যদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। ভেবেছিলাম, অডিও ফাইলটা আপলোড করে লিঙ্ক দেবো। দেখলাম, কথার মাঝে আমি যত ‘আম খেয়েছি’ তাতে এটি না দেওয়াই ভালো। তাই, শুধু কনটেন্টটাই দিলাম।]
এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
মেধাবিকাশ: কিন্তু সবকিছু কি ধাপে ধাপে করা যাবে? যেমন মদ চারটি ধাপে হারাম করা হয়েছে, আবার কি প্রথম ধাপ থেকে চতুর্থ ধাপে যাওয়ার অবকাশ আছে? তাহলে তো মদ আবার হালাল হয়ে যায়। পাল্টা যুক্তি নয়, জানতে চাওয়া।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক:
ধাপ-১ = আপত্তি নাই।
ধাপ-২ = বিষয়টির উপকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হলো।
ধাপ-৩ = বিষয়টিকে অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয় বলা হলো।
ধাপ-৪ = নিষিদ্ধ করা হলো।
আপনার সমাজগঠন অনুসারে আপনি অর্থাৎ আপনার সমাজ কোনো বিধি-বিধানের ব্যাপারে যে অবস্থানে আছেন বা থাকবেন; সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানের ব্যাপারে আপনি সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করবেন। তাই, গ্লোবালি কোনো কিছু হ্যাঁ বা না হতে পারে না। তবে তাত্ত্বিকভাবে রাসূল (সা) যা দিয়ে গেছেন তা-ই আছে, থাকবে। কোনো বিশেষ সময়ে কোনো বিশেষ সমাজে আইন হিসেবে প্রয়োগ করার সময় আমরা কীভাবে কী করবো– সে বিষয়েই আমার বক্তব্য। যেমন, হজ্ব ফরজ। তবে এই ফরজিয়াত শুধু মাত্র তার উপরই প্রযোজ্য যার বাংলাদেশী টাকায় ৪ লক্ষ টাকা মজুদ আছে। এসবই আমার মত। আমি আলেম নই। শুধুমাত্র একজন বুঝ-জ্ঞানের মুসলিম। আমি বিশ্বাস করি, Everyone has to have the right to put question, any question, even if it is a stupid question. And each question must be answered properly. If it is a wrong question, then let him/her know that he/she has misunderstood, or it is a category mistake.
বাংলাদেশে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের পরে আর একজন একাডেমিক আলেম লেখক হিসেবে গড়ে উঠছেন। ড. আহমদ আলী। উনাকে আমি সম্প্রতি বলেছি, আপনার বিদআত বইয়ে কোনো উদাহরণ ছাড়া শুধু বিদআতের উপর একটা প্রাথমিক খণ্ড করবেন। কারণ, লোকেরা আপনার এত বড় বই নিয়ে সূচিপত্র খুলে নিজের আমলের সাথে মিলায়। কোনোখানে না মিললে তিনি বইটা পড়ার উৎসাহ লাভও করতে পারেন, আবার উৎসাহ হারিয়েও ফেলতে পারেন। লোকেরা আগে বিদআত কী, কেন, কীভাবে হয় – এসব আগে জানুক। তারপর সংশোধন হবে। তাছাড়া সব বিদআতই মৌলিক নয়। তাই, ছোটখাটো বিষয়গুলোকে প্রথমেই তুলে না ধরাই উত্তম। দাঈর দৃষ্টিকোণ হতে। আপনার প্রশ্নের সাথে এর একটা সাযুজ্য আছে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। ধন্যবাদ।
জান্নাত: এ পর্যন্ত যারা গেলে নাই তাদের জন্য চতুর্থ ধাপ প্রযোজ্য। নিজেদের মুসলমান মনে করে অথচ গেলায়ও অভ্যস্ত তাদের জন্য কী করা যায়, তা যাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি জবাব দিবেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোনো স্পেসিফিক বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে মূল বক্তব্যকে আচ্ছন্ন (ওভারশ্যডোড) করতে চাই না। শুধুমাত্র কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছি–
মেডিকেল পড়ুয়াদের পর্দা আর মাদ্রাসা ছাত্রদের পর্দা কি এক মাত্রায় হবে? এককেন্দ্রিক পরিবারের সদস্যদের পর্দা চর্চা আর যৌথ পরিবারের পর্দা কি একই হবে? বাংলাদেশে কেউ মদ খেতে পারবে না। যেহেতু এটি সমাজবিরুদ্ধ একটা কাজ। পশ্চিমা দেশে কি তা জায়েয হবে? আমি হ্যাঁ বা না কোনোটাই বলবো না। সেখানকার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ তা নির্ধারণ করবেন। আমি যদি সেখানে থাকতাম, নিশ্চিত বলতে পারি, আমি তা খেতাম না।
তাওহীদের এককত্বের অনুসারী হওয়ার কারণে, হতে পারে, আমরা একটা পপুলার ভুল করি। তা হলো সব কিছুতে এক, এক-পন্থাকে খোঁজা, জোর করে হলেও সবাইকে এক করার চেষ্টা করা। একই দিনে ঈদ পালনের দাবি, সবাইকে ফিকহী ব্যাপারে একই আমল বা তরীকায় আনার চেষ্টা – এই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বা উদাহরণ। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে বৈচিত্র্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ইসলামী আইন, ইসলামী রাষ্ট্র এসব এক মাত্রার বা একক চরিত্রের নয় যদিও ইসলাম হলো সিঙ্গুলার। এর একটা পরিদৃশ্যমান ও সুনির্দিষ্ট বাউন্ডারি আছে। ‘ইউনিটি উইদিন ডাইভারসিটি’ কথাটাকে যদি আমরা বুঝি, তাহলে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি আশা করি তা বুঝতে পারবেন; নো ম্যাটার হোয়েদার ইউ সাপোর্ট অর নট। ধন্যবাদ।
শামিম: অনেক ডিটেইলিং করেছেন! আমার যা মনে হয় তা হলো–
কালেমা, রোযা, নামাজ, হজ্জ্ব (প্রযোজ্য হলে), যাকাত (প্রযোজ্য হলে) – এগুলো ব্যক্তিগত জীবনে পালন তো করতেই হবে, অবলম্বন করতে হবে তাজকিয়া, স্টেপ বাই স্টেপ। একজন মানুষ জন্ম লাভ করেই ইসলাম সম্পর্কে সবকিছু জানবে না, জানবে শিখবে ও ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করবে। আমাদের রোল-মডেল হলেন রাসূল (সা)। এখন একজন মানুষ কখনোই ঐ রোল-মডেলের মতো হতে পারবে না, কিন্তু ঐ অপটিমাম লাইন ধরে এগুতে হবে। আমার মনে হয় আপনার লেখাতে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন।
আমরা আসলেই কালেমার প্রকৃত অর্থ বুঝি না, আবার এই অর্থ বুঝানোর কোনো ব্যবস্থা কিন্তু নেওয়াও হয় না। আমাদের ভেতর যদি সেন্স না আসে যে ইসলাম রাষ্ট্রীয় জীবনে আনার জন্য আমার কী দায়িত্ব আছে, তাহলে শুধু হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ইসলাম পালনে সীমাবদ্ধ থাকবো। আসলে সবকিছু সিস্টেমেটিক ওয়েতে পড়ছে না কেমন যেনো। একটা ফ্লো-চার্ট টাইপ কিছু থাকলে ভালো হতো। যেমন–
১। কালেমার অর্থ বুঝা
২। ঈমান ও আকীদা বিষয়ক জ্ঞানার্জন।
৩। ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম নিয়ে আসা, সাথে সাথে ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। এখানে ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম বলতে একজন ভালো মানুষ হওয়া। যেমন– ভালো সন্তান, ভালো ভাই, ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু হওয়া (তথাকথিত ভালো নয়, বরং সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতে হবে, এটা কনফার্ম করতে হবে)।
৪। ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়া। এখানে একটা কনফিউশন তৈরি হয় যে কোন ধরনের জামায়াতে কাজ করতে হবে। এই জন্য পড়াশোনা করা দরকার আসলে। তবে এদের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এরূপ–
১। আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।
২। আল্লাহকে তারা ভালোবাসেন।
৩। তারা বিশ্বাসীদের প্রতি সহানুভুতিশীল। যে কোনো মুসলিম ভাইবোনদের কষ্টে তারা কষ্ট পায় এবং সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়।
৪। অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর।
৫। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, কাফিররা তাদের ব্লেইম করে, ফাইট করে তাদের বিরুদ্ধে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ফ্লো-চার্টের সাথে যদি পবিত্র আল কোরআনের বিধি-বিধান সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসের অথেনটিক রেফারেন্সসমূহের একটা টাইমলাইন জাতীয় কিছু থাকতো, তাহলে খুব ভালো হতো।
ইসলামের কনসেপ্ট ঠিক মতো না বুঝিয়ে প্রচলিত ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতিতে বিশেষ করে এর সামাজিক প্রেক্ষিতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ও যথাসম্ভব নেতিবাচক দিক থেকে দেখে শুধুমাত্র কোরআন-হাদীসের অথেনটিক রেফারেন্সের সমষ্টিকে মুখস্থ করানো হয়। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছাড়া ও বাস্তবে সেটিকে ডিল করার দক্ষতা ছাড়া কারো হাতে কোনো পাওয়ারফুল জিনিস তুলে দিলে যা হওয়ার কথা, বর্তমান প্রচলিত ইসলামী শিক্ষায় ঠিক তা-ই হচ্ছে। কথায় কথায় উনারা কোরআন-হাদীসের মতনসহ এবারত দেন। এতে সাধারণরা মনে করে, বিষয়টি ঠিক না হয়ে যায় কোথায়! অথচ, রেফারেন্স সহীহ হওয়ার সাথে সাথে সুন্নাহর টাইমলাইনে সেটা কোন জায়গায় ফিট হয় – সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করা হয়।
অন্তত দু দশক আগে ছাত্রজীবনে পড়ার টেবিলের খাঁজে লিখে রেখেছিলাম– Islam is a concept, not a bundle of rules!
বুলেন: ১. “সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততাই হলো জিহাদ ও ফিতনার মাপকাঠি” – সমাজের ৭/৮ ভাগ প্র্যাকটিসিং মুসলিমের প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামপন্থীরা যখন এ দেশের শুরু থেকেই বাকি ৯২/৯৩ ভাগের মতাদর্শের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেটাকেই কি তাহলে প্রকারান্তরে ‘ফিতনা’ হিসাবে অভিহিত করা যায়?
২. শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারায় মদীনা সনদকে সামনে রাখলে তো সবার আগে ন্যায়বিচার, সাম্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করাই অগ্রগণ্য কর্মসূচি হওয়া উচিত। ন্যায়বিচার না থাকলে কিসাসকে জুলুম হিসেবে উপস্থাপন করা হবে, সাম্য না থাকলে জিজিয়ার কথা তোলা মানেই অপরাধ, নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাই থাকে না, ধর্মীয় স্বাধীনতা না থাকলে ইসলাম যে একটা ধর্ম তাই অস্বীকার করা হবে।
লিখাটা মনে হয়, আরেকটু সহজবোধ্য হলে আরো অনেককেই আলোচনায় পাওয়া যেত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ব্লগে আমি প্রথম থেকেই ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়া, অধিকাংশ ব্লগার ছাত্র ও তরুণ হওয়ার কারণে বয়সের ব্যাপার, লেখার বিষয়বস্তু প্রায়শই তত্ত্বগত ও ভারী হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমার লেখার পাঠক সংখ্যা বেশ কম। অবশ্য জনপ্রিয় বক্তা বা লেখক বনে যাওয়াকে আমি নিজের জন্য কখনো পছন্দ করিনি। নিয়মিত কলাম লেখকরা সাধারণত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখতে পারে না। এ বিষয়টাও আমি খেয়াল করি। আর একটা অনাকাঙ্খিত ব্যাপার হলো আমি সিরিয়াস কথা এক ধরনের বাংলিশে বলি! এই লেখাটাও এক ধরনের অনুবাদ। এক স্টুডেন্টকে দিয়ে করিয়েছি। পরে আমি অনেক এডিট করার চেষ্টা করেও দেখছি তা সুখপাঠ্য হয়নি। দেখি রিরাইট করা যায় কিনা। এতবড় লেখা সাধারণ পাঠকরা পড়বে না জেনেও প্রচার, বিশেষ করে একটা রেকর্ড রাখার জন্য এটি পোস্ট করেছি। এক কেন্দ্রীয় নেতার অনুরোধে ক্যাডার সিস্টেমের উপর একটা লেখা লিখেছিলাম। গত বছর। সেটিও ভাষান্তর করে ক’দিনের মধ্যেই পোস্ট করবো ভাবছি।
শুধুমাত্র মদীনা সনদের উপর লেখা আসা উচিত। আপনারা কেউ লিখলে অংশগ্রহণ করতে সুবিধা। এই লেখায় রাসূলকে (সা) মাইনরিটি লিডার বলে হুজুগেদের চিন্তার অচলায়তনে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছি। মদীনা সনদ পৃথিবীর প্রথম লিখিত সনদ নয়। হাম্মুরাবির সনদটাই ইতিহাসের দৃষ্টিতে প্রথম। মুহাম্মদ (সা) প্রথম নবী না হলেও যেমন উনার শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ন হয় না, তেমনি মদীনা সনদও প্রথম লিখিত সংবিধান প্রমাণিত না হলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমে যায় না। মদীনা সনদ কমপক্ষে তিনটি আলাদা আলাদা চুক্তির সংকলন।
আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাই হলো সকল অপযুক্তি, অজ্ঞান, অচলায়তন ও পশ্চাৎপদতা নিরসনের একমাত্র উপায়। এক সময় খুব বলতাম, ইসলাম এসেছে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। পাশ্চাত্যের কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পর্কে জানার পর থেকে আর তা বলি না। এখন সর্বান্তকরণে মনে হয়, ইসলাম এসেছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগের প্রয়োজনে। আবেগ কাজে লাগে না, বুদ্ধিবৃত্তি কাজে লাগে। তবে আবেগ থেকেই বুদ্ধিবৃত্তির উৎপত্তি।
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
যাররিনের বাবা: আপনার লেখার একজন অগভীর পাঠক, তাই অনেক সময়ই মন্তব্য করা হয়ে ওঠে না। লেখাটি পড়তে পড়তে মনের ভেতরে বেশ অনেকগুলো জিজ্ঞাসা নড়েচড়ে উঠছে। তার সবগুলো হয়তো বলার মতো নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি কিংবা প্রশ্নসমষ্টি না বলে পারা যাচ্ছে না, সেটা হলো–
১. ইসলামের রূপরেখা – তত্ত্বে এবং কর্মপরিধিতে – যা আমাদের কাছে এসেছে, তার একটি সিলসিলা আছে। আল্লাহ–রাসূল (সা)–আসহাব– তাবেয়ী–তাবে তাবেয়ী–সালফে সালেহীন…। প্রশ্ন হলো, আজ আমাদের জন্য ‘নস’কে (হলি টেক্সটসমূহ) নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে কিনা? আরেকটু সহজ করে যদি বলি, তা হলো– বিদায় হজ্জের সে পূর্ণতাদানকারী আয়াত নাজিল হওয়ার পরে, পূর্ববর্তী কেউ (খুলাফায়ে রাশিদা, সাহাবী, তাবেয়ী কিংবা মুসলিম সুলতানগণ) কোনোখানে শরীয়তের বাস্তবায়নকালে আপনার উল্লেখিত ক্রমধারা অবলম্বন করেছেন, কিংবা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইসলামী শরীয়তের প্রান্তিক আহকামের জায়গায় তুলনামূলকভাবে প্রাথমিককার হুকুম প্রচলন করেছেন কি?
২. যদি না থাকে, তাহলে কুরআন-হাদীসের শাব্দিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নবতর বিশ্লেষণ, তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র-জনকাঠামোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উদ্ভূত দ্বীনের রূপরেখাটি কতটুকু শরয়ী মর্যাদার দাবিদার?
৩. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করার মধ্যে কোনটি ফরজ? দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ends & means, দুটোই শুদ্ধ হওয়ার একটি শর্ত রয়েছে। সুতরাং বিদ্যমান সমাজকাঠামো সর্বাঙ্গে দ্বীনকে গ্রহণ করতে রাজি নয়, কিংবা প্রস্তুত নয়– সে বিবেচনায় ক্রমধারা অবলম্বন করাটা, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এক ধরনের ব্যাকুলতার ফলশ্রুতি বলে মনে হয়! নাকি শুদ্ধতর প্রক্রিয়া হবে, পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে নিয়ে অগ্রসর হওয়া, জাগতিক বিবেচনায় তা যতই অবিবেচনাপ্রসূত হোক না কেন…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: “… ইসলামী শরীয়তের প্রান্তিক আহকামের জায়গায় তুলনামূলকভাবে প্রাথমিককার হুকুম প্রচলন করেছেন কি?”
না, করেন নাই। তাহলে এখন কেন এ প্রসঙ্গে বলছি? কারণ, ইসলামের যে সৌধ তখন নির্মিত হয়েছিল তা এখন আর বাস্তবে কোথাও, অন্ততপক্ষে এই জনপদে, নাই।
আমাদের পৈত্রিক বাড়িটা দোতলা। এখন আমরা এর তিনতলা বাঁধার চিন্তা করছি। যেখানে দোতলা বাড়ি আছে সেখানে ফাউন্ডেশন বা একতলা-দোতলার কাজ করা বা করার চিন্তা করা অর্থহীন। চট্টগ্রামের নতুনপাড়া এলাকায় অবস্থিত এই বাড়িটা চারতলা পর্যন্ত বাঁধা যাবে। এরপরে আসবে এর শ্রীবৃদ্ধির প্রসঙ্গ। স্ট্রাকচার আর হবে না।
তেমনি ইসলামের যে ভিত্তি ও কাঠামো আল্লাহর রাসূল (সা) গড়ে দিয়ে গেছেন, পরবর্তীরা সেটিকে পূর্ণতা দিয়েছেন। ইসলামী শরীয়াহ, বিশেষ করে এর প্রশাসনিক দিকসমূহ খোলাফায়ে রাশেদের হাতে সম্পন্ন হয়েছে।
সেই রাষ্ট্র তো নাই। নাকি আছে? নেই অথচ তা গড়তে হবে – এহেন পরিস্থিতিতে আমরা কী করবো? কীভাবে করবো? কোনখান থেকে শুরু করবো? এসব প্রশ্নেরই উত্তর হলো গ্র্যাজুয়ালিটি কনসেপ্ট অফ আন্ডাস্ট্যান্ডিং ইসলাম অ্যান্ড ইসলামিক মুভমেন্ট।
আর হ্যাঁ, ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বনাম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা’ – এভাবে যদি বলেন, তাহলে পরিষ্কার যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমাদের উপর নাই!? আমরা শুধু সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করতে পারি।
লোকমান বিন ইউসুপ,চিটাগাং: আপনার চিন্তাধারা যে পথে আগাচ্ছে বলে আপনার লেখা পড়ে প্রতীয়মান হলো, ঠিক আমিও দেখছি সে পথে আছি। আপনার চিন্তাধারার সাথে আমার চিন্তার কাকতালীয়ভাবে মিল লক্ষ্য করছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোনো বিপ্লব করার জন্য লাগে একটা চিন্তাগোষ্ঠী বা নিউক্লিয়াস। এ ধরনের নিউক্লিয়াস মাওলানা মওদূদী তদীয় পত্রিকার মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন, যাদেরকে দিয়ে তিনি জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোম শহরের ফৌজিয়া মাদ্রাসায় অনুপস্থিত ইমামের প্রতিনিধির তত্ত্ব দিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনী এই রকমের একটা নিউক্লিয়াস তৈরি করেছিলেন, যারা এখনো ইরানের বিপ্লবকে ধরে রেখেছে।
এ রকমের নিউক্লিয়াস অলরেডি তৈরি হয়েছে। নচেৎ জেলখানায় বসে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের লেখা চিঠি পড়ে এক তরুণ সহকর্মী কীভাবে বলেন, ‘আপনার রুমে বসে যেসব কথা আমরা বলি, সেসবই তো দেখি সাজিয়ে লেখা হয়েছে’!?
যাহোক, ঐক্যমত হলেই কোনো কিছু অটোমেটিকেলি হয় না। এ জন্য দরকার উপযুক্ত ব্যক্তির নেতৃত্বে ত্বড়িৎ, সাহসী ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার। এ কাজটি কে বা কারা করবে? দিজ ইজ দ্য মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন ব্রাদার!! ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
ঈগল: আপনার লিখাটি পুরোটাই একবারেই পড়তে চেষ্টা করেছি। বুঝতে কিছু সমস্যা রয়ে গেল, আবার পড়তে হবে। বুঝতে সমস্যা হয়েছে কিন্তু গ্রাজুয়াল কনসেপ্ট ব্যাপারটি বুঝতে পারছি এবং বিষয়টির একটি দিকে আমার দ্বিমত আছে। এর জন্য মোবাইলে আলোচনা করাই বেস্ট।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না বুঝে ঐক্যমতের চেয়ে দ্বিমত থাকা ভালো। অপর ভাইয়ের সমালোচনা যথাসম্ভব না করা, বিশেষ করে প্রকাশ্যে – এ রকম একটা প্রফেটিক এডভাইসের ভুল ব্যাখ্যার কারণে মতামত দেয়া ও বিশ্লেষণ করার সময়ও ‘সাংগঠনিক অভ্যস্থতার’ কারণে আমরা যথাসম্ভব ঐক্যমতে থাকার চেষ্টা করি! একাডেমিক প্র্যাকটিস হচ্ছে দ্বিমতগুলোকে হাইলাইট করা। অতএব, স্বাগতম!
ফরীদ আহমদ রেজা: আপনার লেখা পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। বাংলাদেশের লেখকদের ইসলাম সম্পর্কে লেখা পড়তে গেলে বার বার হোঁচট খেতে হয়। আপনার লেখার বিষয়বস্তু এবং প্রকাশভঙ্গি – দুটোই আমাকে আকর্ষণ করেছে। ফিতনাকে যারা জিহাদ মনে করে তাদের মৌলিক ইবাদত ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ের সাথে কালিক এবং স্থানিক সম্পর্ক বুঝানো সহজ নয়। বুঝাতে গেলে অনেক সময় বন্ধু শত্রু হবে এবং শত্রু হাততালি দেয়ার সুযোগ পাবে। আপনারা যারা বৃত্তের বাইরে থেকে খোলা মনে দ্বীনি কাজ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন, তারা নিজেদের মধ্যে নিয়মিতভাবে এ সকল বিষয় নিয়ে ডায়লগ করলে আমাদের চিন্তা-ভাবনা কিছুটা প্রসারিত হবে।
ভালো থাকুন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: “বৃত্তের বাইরে থেকে” কথাটা বুঝলাম না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ফরীদ আহমদ রেজা: ধন্যবাদ। বৃত্তের বাইরে থেকে কথাটা আসলেই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আমি যা বলতে চেয়েছি তা হচ্ছে, কিছু লোক চিন্তার ক্ষেত্রে নিজের পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে যেতে পারে না। মুক্তভাবে চিন্তা করতে না পারার কারণে নিজের জানা বা পরিচিত জিনিসকেই শুধু দেখে, এর ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে পারে না। আপনি সেটা পেরেছেন, এ জন্যে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ, আপনার ব্যাখ্যাটা সুন্দর। ভালো লাগলো। আপনার স্নেহাস্পদ এম এন হাসান এই বৃত্তাবদ্ধতাকে বলেছেন ‘কমফোর্ট জোন’। প্রত্যেকেরই একটা কমফোর্ট জোন থাকে। বেশিরভাগ লোক নিজ নিজ কমফোর্ট জোন হতে বের হওয়ার কথা ভাবতে পারে না।
ধন্যবাদ।
ঈগল: আপনার লেখাটি আমার অতীত ধারণাকে টালমাটাল করে দিয়েছে। বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি। আজকে দুপুরে কুরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে হঠাৎ একটি প্রশ্ন মাথায় এলো। ঐ প্রশ্নটিসহ আরো কয়েকটি প্রশ্ন করবো, আশা করছি উত্তর দিবেন।
১। ব্যক্তি জীবনে ক্রমধারার অপরিহার্যতা সম্পর্কে সালফে সালেহীনগণ কি কিছু বলেছেন?
২। আমি এখন মুসলিম হলাম। মদ্যপানে আমি কঠিনভাবে অভ্যস্ত। আমি কি মদ্যপান ছাড়ার জন্য ক্রমধারা অবলম্বন করবো? ক্রমধারা অবলম্বন করতে গিয়ে কি আমি গুনাহগার হবো না?
৩। আমরা জানি, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ দিকে কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মদ পান করার ক্ষেত্রে বা সুদ না খাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কি ক্রমধারা অবলম্বন করেছেন?
আমার ধারণা, ক্রমধারার ব্যাপারটি হুকুমত কর্তৃক জনগণের উপর শরীয়াহ কায়েমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে নয়। যেমন– সলাত, সিয়াম কিংবা হালাল হারামের ক্ষেত্রে ক্রমধারা গ্রহণযোগ্য নয়।
আপনার মতামত আশা করছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনার আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগছে। ফিকাহ, জিহাদ, গণতন্ত্রসহ কিছু মৌলিক বিষয়ে আপনার সাথে আমার কিছুটা দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও আপনি আমার লেখাগুলো পড়েন, দ্বিমত প্রকাশ করেন, প্রশ্ন করেন, টাচ করেন! এই ধরনের নির্মোহ ও আপসহীন মনোভাবের জন্য আল্লাহ আপনাকে রহম করুন।
গ্র্যাজুয়ালিটি নিয়ে Understanding Islam and Islamic Movement এই শিরোনামে একটা লেখা অনেক আগে তৈরি করেছিলাম। ২৫ পৃষ্ঠার মতো। এ বিষয়ে জনৈক সহকর্মীর সাথে করা একটা আলোচনার বলতে পারেন, হুবহু টাইপ কপি হচ্ছে উপর্যুক্ত পোস্টটি। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে শুধু দু-এক লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র; ব্যাখ্যা করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ কথা সংক্ষেপে বলার কারণে অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
আযিমত ও রুখসতের বিষয়ে মূল পোস্টে যা বলেছি এবং গ্র্যাজুয়ালিটিকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না মর্মে যা কিছু বলার চেষ্টা করেছি তার ভিত্তিতে আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা সম্ভবপর হতে পারে।
এর মূলকথা হলো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বা সোশ্যাল ম্যাচিউরিটি অর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড একসেপ্ট্যাবিলিটিকে সদাসর্বদা বিবেচনা করতে হবে।
এ বিষয়ে আমার দুজন সহকর্মীর দুটি প্রশ্ন আপনার মাধ্যমে সবার অবগতি ও চিন্তার জন্য পেশ করছি:
প্রশ্ন-১। গ্র্যাজুয়ালিটি যদি অপরিহার্য হতো তাহলে কোরআন কেন নাযিলের ধারাক্রম অনুসারে সংকলিত হলো না?
সম্ভাব্য উত্তর: কোরআন সংকলনের ধারাবাহিকতা অনুসারে কোরআন পাঠ ও অনুসরণ কি বাধ্যতামূলক? উত্তর যদি না হয়, তাহলে ‘পুরো কোরআনকে আমরা অনুসরণ করবো’ ধরনের কথার অনেক বিপদ আছে। কোরআনের কিছু অংশ অপর কিছু অংশের সাথে বাহ্যত বিরোধপূর্ণ। জীবন্ত কোরআন তথা সুন্নাহর লাইন অফ কনসিসটেন্সিকে অনুসরণ করলেই কোরআনের তথাকথিত সব বিরোধের সমাধানসহ কোরআন পাঠের সিলেবাস, কোরআন অনুসারে আমলের ধারাক্রমসহ সব সম্ভাব্য সমস্যার পাকা সমাধান যে কেউ পেতে পারেন।
প্রশ্ন-২। গাজুয়্যালিটির অপরিহার্যতার দলীল কী?
সম্ভাব্য উত্তর: আমি দলীলের চেয়েও দলীলের দালালাতের (বা দলীলত্ব?) উপর বেশি বিশ্বাস করি। দলীল লাগবে– এই কথাটার দলীল কী? কেন দলীল হিসেবে উপস্থাপিত কোনো কিছুকে কখনো আমরা দলীল হিসেবে গ্রহণ করি, কখনো করি না? আমি সব দলীলের যে ভিত্তি বা দলীল অর্থাৎ আক্বলের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পক্ষপাতি। যেখানে যুক্তি চলবে না সেখানে যুক্তি দিয়েই দেখাতে হবে, কেন সেখানে (প্রচলিত) যুক্তি অচল। এটি হলো থিমেটিক অ্যাপ্রোচ। এর মানে এই নয়, গ্র্যাজুয়ালিটির পক্ষে যুক্তি নাই।
সালফে সালেহীন কর্তৃক গৃহীত কর্মপন্থা জানা দরকার। তারচেয়েও বেশি দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কোরআন ও হাদীস হতে সরাসরি জ্ঞান লাভ করা। আমি হিস্ট্রিক্যাল অ্যাপ্রোচে কমফোর্ট ফিল করি না। পেশাগত জীবনেও আমি থিমেটিক অ্যাপ্রোচে কাজ করি। গ্র্যাজুয়ালিটি কনসেপ্ট নিয়ে কখনো বই বের করলে সেটিতে কিছু ট্রাডিশনাল দলীল অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছি। তৎপূর্বে আপনি মুহাম্মদ আল গাযালী ও ইউসুফ আল কারজাভীর এ সংক্রান্ত প্রচুর দলীলসমৃদ্ধ বইগুলো পড়তে পারেন।
আবু জারীর: ইসলামীক সংগঠনগুলোতে intellectual bankruptcy বা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা বলতে যা বোঝায় সেই জিনিসটা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বিদ্যমান! শতবার, হাজার বার, আমি বার বার বলে যাবো কথাটা ঠিক এবং ঠিক। অন্তত আমার বিবেচনায়।
ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে গবেষণা ও থিসিসের এর দাবি রাখে। যারা ইসলামী আন্দোলন করেন অন্তত তাদের এ বিষয়গুলোর উপর ব্যাপক গবেষণা করা সময়ের দাবি।
অনেক পরিশ্রম করেছেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আচ্ছা, এতক্ষণে আপনাকে পাওয়া গেল! ধন্যবাদ।
সালমান আরজু: CSCS সম্পর্কে আরো একটু জানতে পারলে ভালো হতো।
আমার মতে, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের এখন একটা প্যারাডাইম শিফট দরকার। প্রয়োজন একজন মাওলানা মওদূদীর। কিংবা মার্ক্সের মতো একজন থিউরিস্টের।
নিদেনপক্ষে একটা স্কুল অব থ্যট ডেভেলপ করা যায়। একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে আপনি এখানে একটু হলেও অবদান রাখতে পারেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সিএসসিএস আমার স্বপ্ন এবং দুঃখ! এটিকে নিয়ে আমি ভাবি। আমার একটা দাঁড়াবার জায়গা হিসেবে। কিছু মাল্টিমিডিয়া, সেমিনার, আর ফিল্ম শো’র বাইরে গত এক যুগে যার কোনো প্রেজেন্টেবল প্রোডাক্ট নাই। সাইফুল্লাহ মানছুর ভাইকে নিয়ে ২০০১ সালে আইডিবি থেকে পিনাকলের ডিভি-৫০০ এডিটিং কার্ড ব্যবহারের উপযোগী দেড় লাখ টাকার কম্পিউটার কিনেছিলাম। তখন ১৭ ইঞ্চি মনিটর খুব রেয়ার ছিলো। সাইফুল্লাহ মানছুর ভাইও তখন সবেমাত্র এ ধরনের ক্যাপচার কার্ড কিনেছেন। সাইফুল্লাহ মানছুর ভাইয়ের কত কাজ, পরিচিতি, টাকা! পক্ষান্তরে আমি? চবির বাহিরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি! (ব্লগিংয়ের সুবাদে কেউ কেউ হয়তোবা এখন চিনে!?) এসব ব্লগচর্চা ইত্যাদিসহ জীবনের কোনো কিছুই সিস্টেমেটিক্যালি ও গুছিয়ে করতে পারলাম না! শুধু স্বপ্নের সওদা করে বেড়ালাম!
আবু আফরা: জাযাকাল্লাহু খায়রান। আপনার ইনভাইটেশনের আগেও লেখাটা পড়েছি। আবশ্যই লেখাটা ভারী, গভীর, দার্শনিকতা ঋদ্ধ সন্দেহ নেই। এবং মৌলিক বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে আপনার আর্টিকেলটা পূর্ণাংগ হতো যদি আরো কয়েকটি দিক এখানে জায়গা পেতো। যেমন:
১। দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আমাদের নবী (সা) যে পন্থা অবলম্বন করেছেন সেটাই যে সবখানে সব ক্ষেত্রে পালিত হবে এমন যদি হত, তাহলে দাউদের (আ) জালুত হত্যা, তালুতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া, সুলাইমানের (আ) মুলুকিয়্যাত পাওয়া, ইব্রাহিমের (আ) দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি কথাগুলো আল্লাহ আমাদের গোচরিভূত করতেন না। খেলাফত ও নবুওয়াতি সিস্টেম ভেংগে যাওয়ার পরেও একজন ব্যক্তি মুলুকিয়্যাতের তখতে থেকেও খুলাফা রাশেদীনের মধ্যে গন্য করে আমাদের সালফে সালেহীন দেখায়েছেন সুলায়মানী পন্থাও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় লাগতে পারে। কাজেই একবারে মক্কী জিন্দেগী, তারপর তায়েফীয় অত্যাচারের পর মাদানী জিন্দেগীর মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার মেথডলজি স্বতঃসিদ্ধ নাও হতে পারে।
২। ঘুনে ধরা মুসলিম সমাজকে সাথে নিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে আমাদের নবীর (সা) পন্থায় কাজ করতে যাওয়া যে কত ঝামেলার ও সেখানে ‘অসম্ভবতা’র দেখা পাওয়া যে কত স্বাভাবিক তা আমার উস্তায মাওলানা মাওদূদী নিজেই যেমন বুঝেছেন, আমাদেরকেও তেমন বুঝানোর সুযোগ দিয়েছেন। তিনি ‘ইসলামী হুকুমাৎ কিস তারাহ কায়িম হুতি হায়’ বইয়ে মহানবীর (সা) ক্রমধারা ও তাঁর মিনহাজকেই সকল যুগের ও সকল সমাজের একমাত্র মিনহাজ বলেছেন। ফলে তিনি মুসলমানদের মাঝে আরেক নিস্পাপ মুসলিম দলের অভ্যুদয় ঘটানোর প্রয়াসে বহু অংশে অসফল হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। অথচ এই ঘুনে ধরা মুসলিম সমাজ নিয়ে দ্বীন কায়িমের জন্য মাহদী বিন তাওমারত, ফকীর আলমগীর এবং এই প্রায় এক শতক আগের শহীদে বালাকোটের প্রচেষ্টার সফলতা আমাদের বলে দেয়, ভেংগে পড়া খিলাফাত কায়িমের জন্য ঘুনে ধরা মুসলিমকে নিয়ে কাজ করতে এক্কেবারেই মহানবীর (সা) মতো ক্রমধারা রাখতে হবে এমন নয়। শরিয়াত প্রতিষ্ঠার ক্রমধারা কিছু ক্ষেত্রে দরকার তো হয়েছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়।
৩। যদি আমরা মুসলিম বিশ্ব থেকে অমুসলিম দেশে আসি সেখানে কিন্তু মুহাম্মাদীয় (সা) পন্থাই সবচেয়ে ভালো পথ। এখানে মক্কী জীবনের দিকগুলোই বেশি চলে এবং ঐ ক্রমধারা অবশ্যই মেনে চলতে হয়। তবে এখানে একটা দিককে আপনিও কারো কারো প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আমি যেহেতু অমুসলিম দেশে থাকি, আমি কি মদ পান করবো? আপনি বলেছেন, পান করবো না। এবং আপনিই সঠিক। কারণ ইসলামের একটা বড় মুজিযা হলো এর যেসব মেনে চললে একজন মানুষ জান্নাতের অধিকারী হতে পারে, সেসব কাজ উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, জাপান থেকে আমেরিকা পর্যন্ত সব যায়গায় মেনে চলা যায়। এ ছাড়া শরীয়াতেরও অনেক কিছু এই সব ‘দারুল কুফরে’ (?) মেনে চলা যায় যদি ইসলামী সমাজ বা কম্যুনিটি তৈরি করা যায়। লন্ডনের এই মুসলিম সমাজ কর্তৃক শরিয়া মানার তোড়জোড় দেখে এখানের Archbishops of Canterbury উইলিয়ামস রাওয়ান বলেছেন: shariah law is unevitable in the UK. কারণ আমরা হালাল হারাম শক্ত ভাবে মেনে চলছি, ছেলেমেয়েদের ইসলামী শিক্ষা দিতে ১১৭ টা বড় বড় মাদ্রাসা বানিয়েছি, এমন কোনো শহর পাওয়া যাবে না যেখানে মসজিদ নেই। বিয়ে, তালাক, মৃতের দাফন, মীরাস ইত্যাদিতে এখানের কোর্ট মুসলিম আইন মানতে বাধ্য হচ্ছে। অগণিত ইসলামী ব্যাংক এখানে হয়ে গেছে, এমনকি কড়া সুদী ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিং উইং খুলতে বাধ্য হয়েছে। আমার তো মনে হয় চুরি করলে হাত কাটা, যেনা করলে পাথর বা বেতানো ছাড়া ইসলামী শরীয়াতের কুরআনিক ৫০০ আয়াতের অধিকাংশ এখানে মানা যাচ্ছে।
যাহোক, এটা ইসলামের সৌন্দর্য। তবে ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণ, ইসলামভিত্তিক ১০০% জীবন যাপন ইত্যাদির জন্য যে শারয়ী রাষ্ট্র দরকার তা বানাতে শত বছর লাগতে পারে। এবং এখানেই আসবে আপনার ক্রমধারার দর্শন।
আরো অনেক বিষয় আপনার সাথে শেয়ার করার মতো ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল আপনি লিখেছেন। সময়ের অভাবে সবটা হলো না, সময় পেলে আপনাকে নিয়ে আবার বসা যেতে পারে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ উম্মাতের উন্নয়নে এই সুন্দর সময়ের সমষ্টি দান করছেন বলে।
আরো লেখার প্রত্যাশায়, ওয়াসসালাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যে ক’দিন থেকে ব্লগ লিখছি, আজকের এই মন্তব্যের মতো এতটা খুশি হইনি কোনোদিন! আপনার এই সমর্থনমূলক বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক) ‘ইসলামাইজেশন অফ নলেজ বলতে আমি সিস্টেম ম্যানেজমেন্টকেই বুঝি।’ – এ ধরনের একটা বাক্য পোস্টের ভিতরে খেয়াল করে থাকবেন। যদিও লম্বা পোস্ট, কিন্তু বিষয় অনুযায়ী বিবেচনা করলে, এটি অতি সংক্ষিপ্ত (?) লেখা। হ্যাঁ, ‘বিপ্লবের’ মডেল শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদই (সা) নন, কোরআনে উল্লেখিত সব নবীদের কর্মধারাই মডেল হতে পারে। খুব সম্ভবত হযরত ঈসার (আ) প্রক্ষিপ্ত নয় এমন কথাগুলো লিখে রাখার প্রস্তাবে নবী করীম (সা) হযরত উমরকে (রা) ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, আজ যদি তিনি স্বয়ং জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিলো না। অন্য নবীদের কর্মধারা সম্ভাব্য কোনো কালে ও স্থানে মডেল হতে পারে এই বক্তব্যের সাথে উপর্যুক্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাহ্যত বিরোধপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন, নবী করীমের (সা) উদ্দেশ্য ছিল শরীয়তে মুহাম্মদীর ইবাদতের বিষয়গুলোকে সুসংরক্ষণ করা। অন্য নবীদের শরীয়ত যদি সরাসরি কোট করার অনুমতি দেয়া হতো তাহলে কোরআনের মধ্যে প্রক্ষেপণের সম্ভাবনা না থাকলেও মুসলমানদের আমলী জিন্দেগীতে অধুনা পরিত্যক্ত ‘ইসরাঈলী বর্ণনা’সমূহের এক ধরনের বৈধ প্রভাব সৃষ্টি হতো। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের প্রসঙ্গ যেহেতু বিস্তারিতভাবে স্বয়ং কোরআনেই উল্লেখিত রয়েছে তাই সরাসরি কোরআন অনুসরণ করলে অন্যান্য পয়গম্বরদের বিষয়টাও একোমোডেইট হয়ে যায়।
খ) সুন্নাহভিত্তিক গ্র্যাজুয়ালিটিকে গাইডলাইন হিসেবে মানতে হবে, স্কেল হিসেবে নয়। রেলগাড়ি চলে অন্ধ বা যান্ত্রিকভাবে, স্কেল অনুসরণ করে, আর মটরগাড়ি ও বিমান চলে রাস্তার সীমানাকে গাইডলাইন হিসেবে বিবেচনা করে। অবশ্য কোনো কোনো ফিল্ডে (যেমন– বিনোদন-সংস্কৃতির জগত) টিকতে হলে, সমাজের মূলধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, সমাজের মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে ইসলামী আন্দোলনের এক একটি কর্মীকে এক একটি যুদ্ধ জাহাজের মতো হতে হবে। সওদাগরী জাহাজের সাথে যুদ্ধ জাহাজের পার্থক্য হলো সওদাগরী জাহাজ নির্ধারিত রুট ধরে চলে। আর যুদ্ধ জাহাজ প্রতিনিয়ত পথ তৈরি বা খুঁজে নিয়ে চলে। অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাষায়, আমাদেরকে ইঞ্জিন-মার্কা কর্মী হতে হবে, বগি-মার্কা হলে চলবে না।
গ) সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা নির্ণয়ের প্রসঙ্গে বিদ্যমান সমাজ হলো গাঁথুনীর দাগ আর সুন্নাহ হলো ওলন। দেয়াল গাঁথার সময়ে মিস্ত্রীরা ইট বসিয়ে একটা কাঠি দিয়ে দাগ ধরে। কাঠির ফুটা দিয়ে একটা সুতার মাথায় পিতলের ভারী একটা লাঠিমের মতো বস্তু থাকে যাকে ওলন বলে। তারা কতটুকু ইট গাঁথার পর পরই ওলন দিয়ে সর্বনিম্নের ইটের সাথে মিলিয়ে দেখে। ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদেরকে এভাবে দুটো জিনিসকে মিলাতে হবে: সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা ও সুন্নাহ।
ভাষার ব্যাপারে যেমন কোনো শব্দ চালু হয়ে গেলে তা জায়েয, ইসলামী বা যে কোনো সরকারী কর্তৃত্ব যেমন কায়েম হয়ে গেলে তা বৈধ বা জায়েয, সামাজিক পরিপক্কতাও তেমনি সৃষ্টি বা তৈরি হয়ে গেলে সেটি ফিক্সড হয়ে যাবে। সেটা যেখানেই হোক না কেন। কোনো একটা পর্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তার পিছনে যাওয়া যাবে না যতদিন না সেই সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। এজন্য পোস্টের এক জায়গাতে ‘গণতান্ত্রিক কিম্বা অন্য কোনো উপায়ে’ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা (রিসেপটিভনেস) ও পরিপক্কতা (ম্যাচিউরিটি) অর্জনের কথা বলেছি। আমলী দিক থেকে আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে আরোহী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রচলিত অবরোহী পদ্ধতিতে স্ব-বিরোধ ও প্রান্তিকতা সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
ভালো থাকুন, দোয়া করবেন।
ঈগল: সব মিলিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম এবং চিন্তামুক্ত হলাম, মাথাটা হালকা হয়ে গেল। ক্রমধারার বিষয়টি আসলেই আপেক্ষিক। কখনো পাপ, কখনো ফরজ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলামী শরীয়াহর বাস্তবায়নে ক্রমধারা অবলম্বন অপরিহার্য। এটুকুই আমার বক্তব্য। ধন্যবাদ।
অনুরণন: ইংলিশ আর বাংলা মিশ্রিত লেখা পড়তে অসুবিধা হয়। তাই লেখা প্রথম প্যারার পরে পড়ি নাই। তবে বেশ কিছু মন্তব্য ভালো লাগলো। বিশেষত, আবু আফরা ভাই, যাররিনের বাবা আর বুলেন ভাইয়ের মন্তব্য।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বাংলিশ চর্চা ভালো নয়। এটি নীতি কথা। বাস্তবতা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে এ ভাষাই ডমিন্যান্ট। এই যে ‘ডমিন্যান্ট’ শব্দটা ব্যবহার করলাম, তার পরিবর্তে প্রভাবশালী বা প্রাধান্য বিস্তারকারী ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করলে সেটি কি অধিকতর সুখপাঠ্য হতো?
আমাদের বাবা-মা-চাচাদের দেখেছি, কোনো কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতে গেলে উনারা উর্দু ভাষায় সেটি বলতেন। যেভাবেই এটি চালু হোক না কেন, কোনো কিছুকে ফর্মালি বলতে গিয়ে আমরাও অপ্রচলিত ভাষা যেমন ইংরেজি ব্যবহার করে থাকি। স্বীকার করি, মাতৃভাষায় সহজভাবে কোনো কঠিন কথা বলতে পারা একটা বিশেষ দক্ষতা যেটি ভালোভাবে অর্জন করতে পারি নাই। এটি কোনো কৃত্রিম বিনয় বা ক্ষোভের সাথে বলছি না। হতে পারে, আমার ক্ষেত্রে এটি পেশাগত সমস্যা। ভাবাবেগের প্রাবল্যে কোনো আত্মভোলা মৃদুভাষী লোকও যেমন কিছু একটা বলতে থাকেন, তেমনি লেখক না হওয়া সত্ত্বেও জীবনের কিছু উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার বিনিময় করার জন্য মাঝে মাঝে ব্লগ লিখি। যদিও ভালো ইংরেজি জানি না, তবুও লেখার মধ্যে ইংরেজী শব্দের উপস্থিতি খানিকটা বেশি থাকে, সেজন্য দুঃখিত!!
পোস্টের নিচে খেয়াল করে থাকবেন লিখেছি, একজন ভাইয়ের সাথে আলাপের রেকর্ড হতে এটি টাইপ করা। ভেবেছিলাম, মূল অডিওটা নেটে দিয়ে পোস্টে সেটির লিঙ্ক দিবো। পরে দেখলাম, কথার মাঝে মাঝে আমি যত খাপছাড়া কথা ও অসম্পূর্ণ বাক্য ব্যবহার করেছি, আমতা আমতা করেছি তাতে শ্রোতাগণ বিরক্ত হবেন। তাই দিই নাই।
মূল পোস্টটা পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।