প্রশ্ন: সমস্যা কি শুধুমাত্র জামায়াতের কর্ম-কৌশলগত, নাকি তাত্ত্বিক? অথবা উভয়ই?
উত্তর: সমস্যা যদি শুধুমাত্র জামায়াতের কর্ম-কৌশলগত তথা কাজের ভুল হয়ে থাকে তাহলে জামায়াতের সংস্কার বা একটি বিকল্প জামায়াতের কথা ভাবতে পারেন। আমি মনে করি, সমস্যা শুধু জামায়াতের নয়। জামায়াত এ দেশের অপরাপর ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো করে সর্বাত্মকবাদি, ভক্তিবাদী ও পপুলিস্ট ধাঁচে গড়ে উঠেছে। এটি (JI) থাকুক, এবং ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা establishmentসমূহ ও একধরনের ধারাবাহিকতার ওপর ভর করে এটি টিকে থাকবে। বরং জামায়াত কনটিনিউ করাটাই সবার জন্য ভালো।
আমার বিবেচনায়, জামায়াতের ইসলামি আন্দোলন তত্ত্বকে আমূলভাবে পূণর্গঠন করা জরুরী। অতএব, জামায়াত আমার head-ache নয়। যারা জামায়াতের reform from within এর আশায় ও দাবী নিয়ে আছেন, তাঁরা ভুল করছেন। রিফর্মের কথা বলে সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
জামায়াতের paradigm নিয়ে আর একটি ‘জামায়াত’ই হতে পারে। জামায়াতের ঐতিহাসিক ভূমিকাপালন সম্পন্ন হয়েছে। তাই ইসলামী মতাদর্শভিত্তিক নতুন সামাজিক আন্দোলনে ‘জামায়াত-চর্চা’ মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়।
ইসলাম ও একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা – এই দুইয়ের সমন্বয়ে সমাজ আন্দোলনের একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ নতুন চিন্তা-কাঠামো বা পদ্ধতির (paradigm of thought) উপস্থাপণাই আশু কর্তব্য মনে করি।
মনে রাখতে হবে, ইসলামের তাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠত্ব কোরআন-হাদীসে তথা কাগজের পাতায় লিপিবদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজে বাস্তবিক অর্থেই একে গ্রহণযোগ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা আপনার আমার সব ইসলামপন্থীর দায়িত্ব। এর মানে এই নয় যে, জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা কর্ম শেষ করে প্র্যাকটিক্যলি (সামাজিক) কাজ শুরু করবো।
কোরআন ও হাদীসের বর্ণনা মোতাবেক জ্ঞানের অন্বেষণই শ্রেষ্ঠ আমল। আমল যথাসম্ভব পারফেক্ট আর জানা-শোনা ন্যূনতম – আমলবাদীদের এই ধারণা ভুল। ‘লিমা তা ক্বুলুওনা মা লা তাফয়ালুওন’ (তোমরা সে কথা কেন বল যা তোমরা কর না) –এর তাৎপর্য হলো কাজ যেন জ্ঞানের বিপরীত না হয়। অতএব জানা ও করা – দুটোই সমানতালে চলা চলবে।
জামায়াত করার মানে যদি হয় ইক্বামতে দ্বীনের ফর্মূলা অনুসারে জামায়াত বহির্ভূত সবার কাজকে নিছক ‘খেদমতে দ্বীনে’র ট্যাগ লাগিয়ে বাস্তবে খারিজ করা, তাহলে আমি এর সাথে নাই। আবার জামায়াত না করার মানে যদি হয়, জামায়াতের অনস্বীকার্য অবদানগুলোকে অস্বীকার করার চেষ্টা, তাহলে এই নব্য র্যাডিকালিস্টদের সাথেও আমি নাই।
বস্তুত: কোরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট হেদায়েত থাকার পরও জামায়াতে ইসলামী বা এ ধরনের কোনো লোকাল সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা থাকা না থাকার প্রসঙ্গটি বড় করে দেখার কিছু নাই। মসজিদে যখন আমরা নামাজ পড়ার জন্য যাই, তখন কি আমরা এর ব্যবস্থাপণা, কর্তৃপক্ষ, এমনকি ইমাম সাহেবকে নিয়েও খুব একটা ভাবি? অতএব, ভালো কাজের প্রসঙ্গ আসলে সহযোগিতার কাজে প্রতিযোগিতায় নেমে পরতে হবে। কোনো ভুল কাজ হলে, এ সংক্রান্ত হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী নিজের ঈমাণের পরীক্ষা দিতে হবে। হাদীসে বলা হয়েছে, কোনো অনুচিত কাজকে হাত দ্বারা বাধা দিতে হবে, না পারলে মুখে বাধা দিতে হবে, তাও না পারলে, সংশ্লিষ্ট খারাপ বিষয়টিকে প্রতিরোধের জন্য চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ঈমানের এটি সর্বনিম্নস্তর।
রাসূলুল্লাহর (সা.) ইন্তিকালের পরে হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক হযরত উমর(রা.)কে মুকাবিলা করার ঘটনাটি যথেষ্ট শিক্ষণীয়। মসজিদে নববীর সামনে হযরত উমার (রা.) শোকের আবেগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে তরবারী বের করে চিৎকার করে বলছিলেন, যে বলবে মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাকে কত্বল করা হবে। হযরত আবু বকর (রা.) এসে তা দেখে পাশেই দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সুরা আল আলে ইমরানের শেষাংশ হতে তিলাওয়াত করা শুরু করলেন, ‘… মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া কিছু নয়, তাঁর পূর্বেও রাসূলরা গত হয়েছেন। সুতরাং, যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা পিছনের দিকে ফিরে যাবে?…’ লোকজন যারা এতক্ষণ উমর (রা.) কে ঘিরে তামশা দেখছিলো তারা আবু বকর (রা.) কে ঘিরে দাড়িয়ে তাঁর তিলাওয়াত শুনতে লাগলো। হযরত উমর পরবর্তীতে বলেছেন যে, আবু বকর (রা.) এর তিলাওয়াত শুনে উনার মনে হয়েছে যে, উনি আগে এই আয়াতগুলো শোনেন নাই এবং রাসূলুল্লাহ (স.) সত্যিই ইন্তিকাল করেছেন। বলাবাহুল্য, উমার(রা.)কে নিবৃত্ত করার এই কৌশল কার্যকরী হয়েছিল। তেলাওয়াত শেষ হওয়ার পর পরই হযরত উমর (রা.) তরবারী ফেলে দিয়ে বসে পড়েন এবং কাঁদতে শুরু করেন।
অতএব, প্রো-একটিভ সেন্সে কাজ করুন। বেটার অলটারনেটিভ সেট করুন। স্রোতহীন নালার পাশে খাল কেটে দিতে পারলে সেটি পরিষ্কারকরণের প্রয়োজনীয়তা কিম্বা সম্ভাব্যতা-সংকট ইত্যাদি আর প্রাসঙ্গিক থাকে না, তাই না? এই ‘আক্বাবা’ (কঠিন বাধা) অতিক্রম করার সামর্থ্য কথিত সংস্কারবাদীদের আছে কিনা, তাই দেখার বিষয়। কোনো প্রতিষ্ঠিত ধারায় কাজ করে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যত সহজ, নতুন কোনো ধারা সৃষ্টি করা তারচেয়েও ঢের কঠিন!!!!!!!!!!! অতএব ………..