ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের জন্ম গোপালগঞ্জে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অনার্স করার পর ১৯৭৩ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮১ সালে এমফিল করেন। তারপর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলস থেকে দার্শনিক নৃতত্ত্বের উপর ১৯৮৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৪ সালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণা করেন। ১৯৯৭ সালে পুনরায় কমনওয়েলথ ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকটি পোস্ট ডক্টরেট করেন। পরবর্তীতে লন্ডনের কিংস কলেজে তুলনামূলক ধর্ম ও দার্শনিক নৃতত্ত্বের উপর কাজ করেন।

বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে কর্মরত বরিষ্ঠ শিক্ষক। অধ্যাপনার পাশাপাশি South Asian Fraternity-র বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উপাধি ‘নিম্বার রত্ম’ লাভ করেছেন।

কিছুদিন আগে একাডেমিক কাজে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এক ফাঁকে ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ পরিদর্শন করেন। ধর্ম, দর্শন ও রাষ্ট্রসহ নানা বিষয়ে তাঁর সাথে আলাপ হয়। বিশেষ করে সিএসসিএস-এর সাম্প্রতিক মৌলিক গবেষণা ‘ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন’ সম্পর্কে তিনি মতামত প্রদান করেছেন। চবি ক্যাম্পাসে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সিএসসিএস-এর পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

*****

সিএসসিএস: যে কোনো আদর্শকেই ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে (historical approach)-এ ব্যাখ্যা করার বিপদ হলো, ব্যাখ্যাকারগণ স্থানীয় অভিজ্ঞতার আলোকে আদর্শের ব্যাখ্যা করেন। ফলে আদর্শের মূলে যাওয়া যায় না। যেমন কমিউনিজমের ব্যাখ্যা ও প্র্যাকটিস  রাশিয়া ও চীনে ভিন্ন রকম হয়েছে। আবার বাংলাদেশসহ নানা দেশে এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কমিউনিজম বলতে নির্দিষ্ট  কোনো ব্যাপার নাই। এর টেক্সট ও প্র্যাকটিস মিলিয়ে একে বুঝতে হয়।

অন্যদিকে ইসলামের প্রামাণ্য গ্রন্থ হচ্ছে আল-কোরআন এবং এর ব্যাখ্যা হচ্ছে হাদীসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ। তাই আমরা মনে করছি ইসলামকে বিষয়নিষ্ঠ পদ্ধতিতে (thematic approach) বুঝা ও যাচাই করা সত্যনিষ্ঠ গবেষণার দাবি। এ সম্পর্কে আপনার  কী?

ড. আনিসুজ্জামান: যদিও ইসলামের মূল ভিত্তি কোরআন এবং হাদীস। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রভেদে কোরআন-হাদীসকে বুঝা, উপলব্ধি করা এবং এগুলোর প্রয়োগ-ক্ষেত্র সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। অর্থাৎ ঐশী জ্ঞান কোনো বদ্ধ কিছু নয়। যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠানোর তাৎপর্য হলো ইসলামের অন্তর্নিহিত বহমানতা ও গতিশীলতা। অর্থাৎ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানিয়ে নেয়াটা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

রাসূল (সা) যে শেষ নবী- এর গভীর দার্শনিক ও ব্যবহারিক দিক হলো, ঐশী জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ পূর্ণত্ব বা সাবালকত্বে উপনীত হয়েছে। কোরআন-হাদীসে বর্ণিত মৌলিক নির্দেশনাই মানুষের জন্যে যথেষ্ট। এগুলোকে মূলনীতি ধরে স্থান-কালের প্রেক্ষিতে এর প্রয়োগ হবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে হিস্টোরিক্যাল এপ্রোচের প্রয়োজন আছে। একইভাবে থিমেটিক এপ্রোচেরও প্রয়োজন আছে। ক্ষেত্রবিশেষে, প্র্যাগম্যাটিক ও কম্পারেটিভ এপ্রোচেরও প্রয়োজন আছে। স্ব স্ব জায়গায় পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

সিএসসিএস-এর সামাজিক আন্দোলনের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে আমি মনে করি, এটা অত্যন্ত অপটিমিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত। একে আমি ঠিক অ্যাপ্রোচ না বলে স্ট্যান্ড-পয়েন্ট বলতে চাই। এটিকে অনেক উদার এবং সমন্বয়মূলক মনে হয়েছে। অন্যান্য মতাদর্শের মতো ইসলামেরও কোনো একক ভাষ্য নাই। এমনকি কোরআন-হাদীসকে অপরিবর্তনীয় হিসাবে ধরে নিলেও, স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর ব্যাখ্যার (আন্ডাস্ট্যান্ডিং অর্থে) তারতম্য হবে। যেমন: একক কমিউনিজম কোথাও নাই। কমিউনিজম কতগুলো গাইডলাইন দেয়। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ হয়। যারা ইতিহাস এবং জীবনের এই যুগপৎ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না, তারাই আসলে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতির বিপক্ষ শক্তি।

একজন মুসলমান হিসেবে আমি বিশ্বাস করি জ্ঞান, সমাজ, মানুষ ও মানব মনসহ আল্লাহ হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। মানব সমাজে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো তাঁর তথা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার ফলেই হচ্ছে। সেদিক বিবেচনায় এই প্রস্তাবনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইসলামের গতিশীলতাকে এতে ধারণ করার চেষ্টা রয়েছে এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রকেও চিহ্নিত করার চেষ্টা আছে। এটা করতে গিয়ে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে রেখে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রেজেন্টেশনটা দেখে আমার মনে হয়েছে, একটা সমন্বয়ের কথা চিন্তা করা হচ্ছে, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ইসলাম শান্তি, প্রগতি ও সম্প্রীতির ধর্ম। আল্লাহ সকলের স্রষ্টা- এই ব্যাপারটা অনেকে বুঝেন না। অনেকে ইসলামকে অন্য ধর্মের মতো মনে করেন। ইসলাম প্রচলিত অর্থে ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে একাধারে দর্শন, বিজ্ঞান ও জীবন ব্যবস্থা। এটি শুধু পার্থিব জীবন ব্যবস্থা নয়; এটা একটা অন্তহীন সম্ভাবনাপূর্ণ এবং বাস্তব জীবন ব্যবস্থা। যিনি জীবন ও জগতের স্রষ্টা, তিনি সর্ববিষয়ে ঐশী দিশা দিয়েছেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যেহেতু মানুষ তাঁর প্রতিনিধি, তাই মানুষকে তিনি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এই ব্যাপারটা প্রস্তাবনায় ধারণ করার  চেষ্টা করা হয়েছে।

ইসলামের এই শিক্ষাটা মানুষকে দিতে হবে যে, আল্লাহ শুধু মুসলমানদের জন্য নন। এমনকি শুধু মানুষের আল্লাহও নন। বরং তিনি সপ্রাণ ও জড়বস্তু, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান- এমন সব কিছুরই আল্লাহ। একই কথা রাসূল (সা)-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তিনিও সবার রাসূল। কোরআন শরীফে তাঁকে বলা হয়েছে ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’। আর আল্লাহকে ‘রব্বুল আলামীন’ বলা হয়েছে। ‘রব’ মানে যিনি সৃষ্টি করেন, প্রতিপালন করেন। যিনি একটা বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটা গন্তব্যে মানুষকে উপনীত করেন, তাঁকে ‘রব’ বলে। আল্লাহর চারটা বড় দিক হলো তিনি একইসাথে  স্রষ্টা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং বিবর্তনকর্তা।

ইসলামে রাষ্ট্রের ধারণা আছে- এই ব্যাপারটা দুনিয়া জুড়ে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে অনুধাবন করতে পারছে না। এই খণ্ডিত ধারণাকে পুঁজি করে স্বাভাবিকভাবেই অন্যেরা এর সুযোগ নিচ্ছে। ইসলামের ভিতরে রাষ্ট্র আছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিতরে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। স্থুলভাবে যেমন বলা যায়, ইসলামের ভিতরে দাড়ি আছে কিন্তু দাড়ির ভিতরেই ইসলাম নেই। ইসলামের ভিতরে পর্দা ও শালীনতা আছে, কিন্তু পর্দা ও শালীনতা ইসলামের প্রমাণ নয়, ব্যবহারগত পরিচয় মাত্র।

সিএসসিএস: তারমানে, ইসলামের মধ্যে নানা রকমের বিধি-বিধান থাকলেও বিধি-বিধানের সমষ্টিই ইসলাম নয়?

ড. আনিসুজ্জামান: যেহেতু রাষ্ট্র জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেহেতু ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিকতা, মূল্যবোধ, কর্তব্য, দিশা ইত্যাদিও থাকবে। কিন্তু অনেকে একে বদ্ধ করে ফেলে। এর পরিণতি হিসেবে সেই রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একটা সর্বাত্মকবাদী (totalitarian) বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে রূপ লাভ করতে পারে।

সিএসসিএস: তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, দুটিই প্রান্তিকতা? রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নাই– এ রকম দাবি করা এক ধরনের প্রান্তিকতা; আর রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হলো ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য, যাকে পলিটিক্যাল ইসলাম বলা হচ্ছে- তাও আরেক ধরনের প্রান্তিকতা? বরং রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম যে কল্যাণ অর্জন করতে চায়, তা অর্জন করা একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা?

ড. আনিসুজ্জামান: রাষ্ট্র তো মূল উদ্দেশ্য নয়। রাষ্ট্র তো মানব কল্যাণের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় মাত্র।

সিএসসিএস: তাহলে মূল উদ্দেশ্যটা কি হবে?

ড. আনিসুজ্জামান: মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি। আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় জগতের মুক্তি।

সিএসসিএস: একটা কথা বলা হয়, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারণা ১৭’শ শতাব্দীর। তারমানে ‘ইসলামে রাষ্ট্র ধারণা’র প্রাসঙ্গিকতা নাই?

ড. আনিসুজ্জামান: একটা কথা বলে রাখা দরকার। অনেকে মনে করেন, ইসলাম মূলত একটা ধর্ম। তাহলে ইসলামে রাষ্ট্র থাকবে কেন? এ ধরনের কথা যারা বলেন তারা ইসলাম সম্পর্কেও জানে না; মানব প্রকৃতি, রাষ্ট্র– এগুলো সম্পর্কেও জানে না। আমরা যদি ইসলামকে স্বীকার করি, তাহলে ইসলামের প্রত্যেকটা কথার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তা বুঝতে হবে। ইসলামকে ইসলাম উপস্থাপিত কাঠামো অনুযায়ী বুঝতে হবে। যদি রাষ্ট্র জীবনের অঙ্গ হয়; আর ইসলাম যদি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার কথা বলে তাহলে রাষ্ট্রের ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য থাকবে না– এমনটা হতে পারে না। এটা আসলে হয়েছে খ্রিষ্ট ধর্মের ব্যাপারে একটা ভুল বুঝাবুঝি থেকে। খ্রিষ্ট কনসেপ্টে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নাই। কিন্তু ইহুদী ও হিন্দু ধর্মে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা আছে।

সিএসসিএস: হিন্দু ধর্মেও কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে?

ড. আনিসুজ্জামান: অবশ্যই। ভগবত গীতাতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

সিএসসিএস: এটা তো যুদ্ধ। কিন্তু আপনি হিন্দু ধর্মে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকার কথা বলেছেন…

ড. আনিসুজ্জামান: অবশ্যই রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে। হিন্দু ধর্ম রাম-রাজত্বের কথা বলেছে, শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, যা থেকে মহাত্মা গান্ধী উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মের রাষ্ট্রব্যবস্থার মডেল অনেক আগের। ইতোমধ্যে স্থান-কাল ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, সব বড় ধর্মের মধ্যে ইসলাম সবার শেষে এসেছে। সুতরাং ইসলামে অন্যান্য ধর্মের সমস্ত শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুলো, যেগুলো যুগের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই যারা ইসলামের রাজনৈতিক ধারণার কথা শুনলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান, তাদের এ ধরনের মনোভাব সঠিক নয়। তাদের না ইসলাম সম্পর্কে ধারণা আছে, না তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন।

আরেকটা কথা বলে রাখি, আমরা যে সেক্যুলারিজমের কথা বলি, তার কতগুলো মডেল আছে।  এর মধ্যে চারটি মডেলকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

প্রথমটা হচ্ছে রেনেসাঁ পরবর্তী মডেল। এটা নিয়ে এখানকার অধিকাংশ লোক চক্রের ভেতরে পরে আছেন। একে তারা ইহজাগতিকতা বলেন। দ্বিতীয় মডেল হলো রাষ্ট্র মানুষের ধর্মীয় ব্যাপারে অংশগ্রহণ করবে না। কিংবা ধর্ম ও রাষ্ট্র সমান্তরালভাবে চলবে। তৃতীয় মডেলটা হচ্ছে ভারতীয় মডেল। এই মডেলে তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আর্থিক বা অন্য কোনো বিশেষ সুবিধা দেবে না, আবার বিরোধিতাও করবে না।

আর বাংলাদেশে আরেকটি মডেল আছে, যা এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে গেছেন। এটা হচ্ছে চতুর্থ মডেল। এটা একটা উন্নততর মডেল বলে আমি মনে করি। এই মডেলের সারকথা হলো, যেহেতু জনগণের পয়সায় রাষ্ট্র চলে এবং জনগণের মধ্যে বহু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ আছে, সেহেতু প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাসকে সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্যে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। তাই বঙ্গবন্ধু যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছেন, অন্যদের জন্যেও এ ধরনের কাজ করেছেন। যে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা যেমন করেছেন, অন্যদেরও সে সুযোগ দিয়েছেন।

এই মডেল অনুসারে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ বিশ্বাসের প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র সহায়তা করবে। কতক্ষণ পর্যন্ত করবে? যতক্ষণ তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করবে। এটা অনেকটা মদিনা সনদের অনুরূপ। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, আমার ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা অর্থে নয়, বরং সীমিত পরিসরে ও শর্ত সাপেক্ষে সব ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সহযোগিতা অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি মনে করি, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

সিএসসিএস: কিন্তু ওই সময়ে তো ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল? তা কি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

ড. আনিসুজ্জামান: আমি বঙ্গবন্ধুকে যতটুকু চিনতাম তাতে আমার মনে হয়েছে, এটা ছিল সাময়িক কৌশলমাত্র। তিনি ছিলেন মূলত গণতন্ত্রের লোক। আমি মনে করি ওই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি ছিল।

‌’৭৪ পরবর্তীতে যখন দেশীয়-আন্তর্জাতিক নানা ষড়ন্ত্রের কারণে অর্থনীতি, রাজনীতি ও আইন-শৃঙ্খলা একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তখন হয়তো সাময়িকভাবে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা তো হতেই পারে। যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়…. অবশ্য এ ঘটনাকে ঠিক জরুরি অবস্থা বলব না, কিন্তু আমার ধারণা, এটা একটা সাময়িক পদক্ষেপ ছিল। ওই অবস্থা কাটিয়ে উঠার পর হয়তো তিনি নিজেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করতেন। পরবর্তীতে কিন্তু তা বিকশিত হয়েছে।

সিএসসিএস: আপনি বলেছেন, বিভিন্ন মতাদর্শের মতো ইসলামেরও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামের একটা মূল জায়গা (core) কি থাকে না? থাকা উচিত নয়?

ড. আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, আমি সেটাই বলেছি। অবশ্যই ইসলামের কিছু মূলনীতি রয়েছে। কোরআন শরীফ এবং হাদীস– এগুলোকে আমাদের মানতেই হবে। কোরআনের টেক্সট যদিও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সব তাফসীর একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তেমনি হাদীসের টেক্সট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার সব ব্যাখ্যা সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। হাদীসের কাজ হলো কোরআন শরীফের ব্যাখ্যা করা, বিরোধিতা করা নয়।

যেমন, আমাদের দেশে বুজুর্গ ও ওলি-আল্লাহদের কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কাজ হচ্ছে কোরআন-হাদীসের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা, বিকশিত করা; বিরোধিতা করা নয়। ইদানীং সুফিজম একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে উঠছে। সুফিজমের নামে কেউ কেউ রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার একে ব্যবহার করে অনেকে সুফিজমের নামে যা খুশি তাই বলছে। এগুলো ইসলামের চেতনার সাথে মিলে না। সুফিজম বলতে ইসলামের একটা অন্তর্গত দিক আছে– এটা তো ইসলাম সমর্থন করে। কিন্তু অনেকে কোরআন-হাদীসের স্পিরিটের বাইরে গিয়ে সুফিজম চর্চা করছে– এটাও ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে হাদীসের কোনো ভাষ্য কোরআনের মূল শিক্ষার বিরোধি হলে তা গ্রহণযোগ্য নয়, ঠিক একইভাবে কোনো ওলি-আল্লাহ যদি এমন কিছু বলেন যা কোরআন-হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং বিরোধী, সেটাও পরিত্যাজ্য।

সিএসসিএস: হাদীসের সত্যতা নিয়ে কোনো কোনো স্কলার প্রশ্ন তুলেছেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান নাকি বলেছেন, মাত্র ছয়টি হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা আছে, বাকি হাদীসগুলো সংশয়পূর্ণ। তাঁর এ কথাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ড. আনিসুজ্জামান: স্যার সৈয়দ আহমদ খানদের যুগটা ছিল পরাজিত মানসিকতার। যে কোনো লোককে বুঝতে হলে, তার সময়টাকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন বার্টান্ড রাসেল বলেছেন, একজন দার্শনিক যেমন তার সময়ের প্রোডাক্ট, তেমনি তিনি তার সময়কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিতও করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খানসহ ঐ সময়ের বিশ্বব্যাপী অনেক স্কলারই তাদের লেখায় এ জাতীয় বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এখন আর তেমনটা নাই।

যদি বিশুদ্ধতার দিক থেকে (authenticism) আমরা ইতিহাসকে প্রশ্ন করি, সম্রাট আকবর নামে কেউ আদৌ ছিল কিনা, তাহলে তো কোনো ইতিহাসই টিকবে না। খ্রিষ্ট ধর্মে বহু লোক সন্দেহ পোষণ করে, যিশু খ্রিষ্ট নামে সত্যিই কেউ ছিল কি না! ‘Did Jesus ever exist?’ নামে একটা বইও দেখেছি। এটা তো ঠিক নয়। এগুলোকে ‘ইতিহাস নিয়ে নৈরাজ্যবাদ’ (historical nihilism) বলে।

হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী নিয়ে ‘রিজাল শাস্ত্র’ রয়েছে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় সম্ভাব্য সব রকমের পরীক্ষা-পদ্ধতির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে হাদীস গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হয়েছে। এ জন্যই তো আমরা সব হাদীস গ্রহণ করি না, বরং হাদীসের শ্রেণী বিন্যাস আছে। যেমন: মওজু হাদীস, জয়ীফ হাদীস, জাল হাদীস ইত্যাদি।

সিএসসিএস: সুন্নী মুসলমানরা সিহাহ সিত্তাহর অন্তর্ভুক্ত হাদীস গ্রন্থগুলোকে গ্রহণযোগ্য মনে করে। কিন্তু শিয়া ধারায় তো এমনটা মনে করা হয় না। কোরআনের প্রামাণ্যতা স্বীকার করার পরও তারা নিজেদের মত করে হাদীস গ্রন্থগুলোকে…

ড. আনিসুজ্জামান: আমার মনে হয় এটা আলাদা আলোচনার বিষয়। শিয়াদের সাথে আমাদের বিশ্বদৃষ্টি, আমাদের….. তবে শিয়াদের এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি শিয়াদের সম্পর্কে ততটা জানি না। তবে আমি শুনেছি তারা বলেছে, ছয় জন ছাড়া সব সাহাবী মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন– এ কথা তো মানা যায় না।

সিএসসিএস: ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ আপনি পরিদর্শন করেছেন। সিএসসিএস সম্পর্কে আপনি যদি কিছু বলতেন।

ড. আনিসুজ্জামান: সেন্টারটি আমার ভালো লেগেছে। যদিও এটা এখনো গড়ে ওঠার পর্যায়ে আছে। কিন্তু আজকে এই সাক্ষাৎকারে আমরা যেসব বিষয় নিয়ে কথা বললাম, তার প্রেক্ষিতে এই সেন্টারটিকে fundamental research in Islamic ideology and applications- এ ধরনের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা মনে হয় এর উদ্যোক্তাদের রয়েছে।

সিএসসিএস সম্পর্কে আমি এখনো পুরোপুরি জানি না। তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এর গবেষকদের মধ্যে চিন্তার উদারতা রয়েছে। জোর করে ইসলামকে চাপিয়ে দেয়া নয়, বরং ইসলামের অন্তর্গত যুক্তি বা শক্তি এবং ধর্ম হিসেবে ইসলামের বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাপারটা তারা বুঝতে পেরেছেন। সম্ভবত এর ভিত্তিতেই সেন্টারটি গড়ে উঠছে। আমি আশা করি, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ও সদর্থক ভূমিকা রাখবে।

সিএসসিএস: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. আনিসুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Similar Posts

৩ Comments

  1. দীর্ঘ এক মাস পারিবারিক কাজ শেষে আজ প্রথম দেখাতেই সাক্ষাৎকারটি পড়ে ফেললাম। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ সিএসসিএস কে সাক্ষাৎকারটি পরিবেশনের জন্য। তবে সাক্ষাৎকারটি একটু ছোট হয়ে গেছে।

  2. ড. আনিসুজ্জামান:
    মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি। আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় জগতের মুক্তি।
    At this point Need further clarification.Can anyone tell me what is the highest Islamic value?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *