প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো আদর্শের অনুসারী। হতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনাদর্শ স্বনির্মিত অথবা আরোপিত। যাদের জীবনাদর্শ স্বনির্মিত তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। অন্যদের উপর তারা নিজেদের জীবনাদর্শ চাপিয়ে দেন। এর বিপরীতে যারা অন্যদের কাছ থেকে ধার করা আদর্শ নিয়ে জীবনযাপন করেন, তারা আসলে ভীষণ স্বার্থপর। নিজের চাওয়া-পাওয়াকে তারা কখনো ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না। এজন্য তারা নিজেদেরকে নির্বিবাদী নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

খুব অল্পসংখ্যক মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্রে কার্যকর নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। সমাজে কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত থাকা মানে সেটি আধিপত্যশীল চিন্তা হিসেবে হাজির থাকা। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনাদর্শ, সংক্ষেপে আদর্শ কীভাবে গড়ে ওঠে তা খোলাসা করে বলা এবং আদর্শ নিয়ে যারা কাজ করতে চায় তাদের সাথে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।

যারা অন্যদের আদর্শকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে জীবনযাপন করেন, তাদেরকে আমরা শান্তিপূর্ণ জনগণ হিসেবে জানি। আমরা এদেরকে বলতে পারি আরোপিত জীবনাদর্শের অনুসারী। জীবনাদর্শ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্পষ্টত এটি ভুল পদ্ধতি। আমরা একে দুর্বল জীবনাদর্শও বলতে পারি।

এ ধরনের পরোক্ষ বা দুর্বল জীবনাদর্শ গড়ে ওঠে বিদ্যমান সামাজিক সংস্কৃতির প্রভাবে। এরই সাথে কাজ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব ঝোঁক প্রবণতা বা intention, যাকে আমরা জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি বা প্যারাডাইমও বলতে পারি। উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলোর সাথে বিবেক ও যুক্তিবুদ্ধিরও থাকে খানিকটা প্রভাব। মোটের ওপর এই ক্রমধারাটা হলো– (১) সংস্কৃতি, (২) আবেগ ও (৩) যুক্তি।

এ ধরনের লোকেরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তার চারপাশের সামাজিক সংস্কৃতি, অন্যান্যদের চালচলন, প্রচলিত রীতিনীতি বা রসম-রেওয়াজ ও প্রভাবশালীদের চিন্তা তথা যুগের ধারাকে। এরপরের লেভেলে তারা গুরুত্ব দেয় নিজের ভোগবিলাস, আরাম-আয়েশ, প্রাপ্তি ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে। দৃশ্যত তারা নৈতিকতার পক্ষে। সৎ। সমাজ যেটাকে ভালো বলে, নৈতিক বলে, সেটাকে তারা ভালো হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু শুদ্ধ যুক্তি ও মুক্তবুদ্ধি দিয়ে ভাবলে পরিপার্শ্বস্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের যেসব বিষয়কে মন্দ ও অনৈতিক বলে তারা স্বীকার করে সেগুলোকে প্রতিরোধ করা তো দূরে থাক, সামাজিক অনিয়মগুলোকে কার্যত পরিত্যাগ করতেও তারা অস্বীকার করে। এই ক্যাটাগরির লোকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সমাজ অনুমোদিত কাজগুলোতে আদৌ কোনো সমস্যা দেখতে পায় না। সমাজের চোখে ভালো হওয়াটাই তাদের মূল লক্ষ্য। ডমিন্যান্ট সোশ্যাল ট্রেন্ড তথা গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া এ ধরনের ব্যক্তিবর্গের বিবেক ও যুক্তি-বুদ্ধিবোধ সামাজিক সংস্কৃতি ও নিজস্ব স্বার্থচেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এর বিপরীতে রয়েছে এমন ব্যক্তিবর্গ, বিদ্যমান সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক জনপরিমণ্ডলে (intellectual public sphere) যারা নেতৃত্ব দেয়। তারা নিজেদের বিবেক ও যুক্তিবুদ্ধির সাথে আবেগ ও ভাবপ্রবণতার (intention) সমন্বয়ে নিজেদের জন্য জীবনাদর্শ নিজেরাই গড়ে তোলে। সমমনাদের সাথে তারা ততটুকুই থাকে যতটুকুতে তারা অন্যদের সাথে নিজের চিন্তাভাবনার মিল খুঁজে পায়। এরপর সম্ভাব্য সকল উপায়ে স্বীয় আদর্শের জন্য সহায়ক সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে। তারপর তা সমাজের বাদবাকি লোকদের ওপরে চাপিয়ে দেয়। তারা একইসাথে আদর্শের উৎপাদক, বিপণনকারী ও ভোক্তা। সংখ্যায় এরা অল্প, কিন্তু তারা হলো মাঠের মূল খেলোয়াড়। সমাজ পরিবর্তনে এরা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।

আমার দৃষ্টিতে এরাই হলেন মানুষ বলতে যা বুঝায় তেমন ধরনের মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাকিরা হলো শুধুই জনসংখ্যা। জনগণ। মতাদর্শসমূহের পারস্পরিক সংঘাতে এই নিরীহ জনসংখ্যা, যাদেরকে আমরা শান্তিপ্রিয় জনগণ হিসাবে জানি, তারা স্থূল মানসিকতার দর্শকমাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজপতিরা নানা ধরনের আবেগ ও আবহ তৈরি করে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়। তাই ‘জনগণের শক্তি’ বলে যে একটা কথা বলা হয়, তা আসলে ভেড়ার পালের ‘বিপুল শক্তির’ মতো কিছু একটা। রাখাল আর বাঘই হলো আসল পক্ষ ও প্রতিপক্ষ তথা মাঠের মূল খেলোয়াড়।

আপনার কাছ থেকে আমার জানার বিষয় হলো, আপনি কি রাখাল হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে চান, নাকি হতে চান বিরোধী মতাদর্শের উপর হামলাকারী বাঘ? এর যে কোনো একটি আপনি হতে পারেন। আমি আপনার সাথে আছি। যদিও রাখাল হওয়াটা আমার কাছে পছন্দনীয়। নিজের অনুসারীদের কাছে আপনি রাখালের মতো, নেতা। আর বিরোধীদের কাছে আপনি যেন বাঘ। আপনি যদি যোগ‍্য রাখাল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চান তাহলে আপনার উচিত হবে, অনুসারীদের মধ্যে আপনার মতের পক্ষে যুক্তির আবহ ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করা। তাদের জন্য যতটা সম্ভব শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করা।

নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মানুষ অধিকাংশ সময়ে কার্যত যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয় না। মানুষ প্রায়শই বিবেক-বুদ্ধির দোহাই দেয়। বাস্তবতা হচ্ছে– ঝোঁক, প্রবণতা, আবেগ ও অনুভূতি দ্বারা মানুষ বেশি প্রভাবিত। বিদ্যমান সাংস্কৃতিক আবহের বিপরীতে গিয়ে খুব কম মানুষই নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চায়। প্রত্যেকে চায়, একটা কমফোর্ট জোনের মধ্যে খেয়েপরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে। এজন্য দেখবেন, কারো কাছে কোনো বিষয় যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করার পরেও তিনি সেটা মানতে নারাজ। মানুষ যদি নিছকই বুদ্ধিসম্পন্ন ও যুক্তিনির্ভর হতো তাহলে মানুষকে যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে কোনো কিছু পরিষ্কার করে তুলে ধরলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে তা গ্রহণ করে নিতো। যা বাস্তবে সাধারণত ঘটে না।

কেন মানুষ এ রকম স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে, তা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো– মানুষের চরিত্রের মধ্যে রয়ে গেছে তার অন্তর্গত আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গির সুগভীর প্রভাব। আবেগের তাড়নায় যুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষ আদর্শকে নির্মাণ করে অথবা খুঁজে নেয়। অধিকাংশ লোকের আদর্শচেতনা ও জীবনবোধ গড়ে উঠে ও বিকশিত হয় অনুকূল সাংস্কৃতিক বলয়ের রক্ষাব্যূহের ভেতরে।

তাই, যারা নিজেদেরকে আগামী দিনের সমাজকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যে বলছি– যুক্তিবুদ্ধির (appeal to reason) সাথে সাথে মানুষের মধ্যে শুদ্ধ আবেগ সৃষ্টির (appeal to emotion) জন্যও কাজ করতে হবে। নিজে না পারেন তো এ ধরনের কাজে যারা উপযুক্ত তাদেরকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেন। যোগ্য ব্যক্তিদেরকে প্রমোট করাও বিরাট কাজ। অধিকাংশ মানুষ, যাদেরকে আমরা জনগণ হিসেবে জানি, তারা ভাবাবেগকে বিবেক-বুদ্ধির উপরে স্থান দিয়ে থাকে। ক্রীড়া, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলার সাথে সাথে আধ্যাত্মিক চেতনা (sense of transcendence) সৃষ্টি করার মাধ্যমেও মানুষের আবেগকে শুদ্ধ পথে পরিচালনা করা সম্ভব।

মাঠ যতই উপযুক্ত হোক, বা কৃষক হিসেবে আপনি যতই যোগ্য হোন না কেন; অথবা, আপনার আদর্শ যতই বেহেতর হোক না কেন, শক্তিশালী সংস্কৃতিক গ্রিন হাউজ নির্মাণ করা ছাড়া আদর্শের কোনো ফসল আপনি শেষ পর্যন্ত তুলে আনতে পারবেন না

সংস্কৃতির আলোচনা করতে গিয়ে কিছু কিছু ‘অবুঝ প্রাজ্ঞ’ (?) ব্যক্তিদেরকে দেখা যায়, তাঁরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-আচরণ, এক কথায় সবকিছুকে সংস্কৃতির আওতার মধ্যে টেনে আনেন। সংস্কৃতি নিয়ে এ ধরনের শূন্যগর্ভ বিশ্লেষণ দেখে আমি কয়েকজন নামকরা চিন্তাবিদ ও গবেষকের সংস্কৃতি বিষয়ক কয়েকটা বই আজ পর্যন্তও পড়ার ‘সময়’ পাই নাই। অহেতুক পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে তারা সংস্কৃতির আসল উপাদান ‘বিনোদন সংস্কৃতিকে’ কার্যত খারিজ করে দিয়েছেন। অথচ, বিনোদন সংস্কৃতি হলো সংস্কৃতির মূল ক্ষেত্র।

যাহোক, মানুষ সম্পর্কে আমি শেষ পর্যন্ত আশাবাদী। মানুষের মধ্যে রয়েছে বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য। মানুষ যেমন স্বার্থপর, তেমনি পরার্থপরও বটে। মানুষের মধ্যে রয়েছে ভাবাবেগ। অথচ সে নিছক ব্যক্তিস্বার্থপ্রসূত আবেগ দ্বারা সবসময়ে চালিত হয় না। সময়ে সময়ে মানুষ বিবেক ও যুক্তিবুদ্ধিকে প্রাধান্য দেয়। সেজন্য প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষই পেরেছে সভ্যতা গড়ে তুলতে।

ক্যামেরার শাটার যেমন খুব অল্প সময়ের জন্য খুলে আবার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়, তেমনি করে মানুষের জীবনে নীতি, আদর্শ ও যুক্তিবোধ খুব অল্প সময়ের জন্য উন্মুক্ত হয়। অত্যল্প সময়ে গ্রহণ করে নেয়া আদর্শের সেই ছাপকে অধিকাংশ মানুষ সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। আদর্শের দিক থেকে মানুষ সার্বক্ষণিকভাবে উর্বর (fertile or receptive) থাকে না। তাই আদর্শবাদীদের দায়িত্ব হলো, সব সময় কোনো না কোনোভাবে আদর্শের ফেরি করে বেড়ানো। কার মনের দুয়ার কখন যে খুলে যাবে তা তো আর আগাম বলা যায় না। তাই না?

আগামী দিনের জন্য আজকে যারা কাজ করতে চান তাদেরকে নিজ নিজ ময়দান সম্পর্কে overestimation এবং underestimation-এর প্রান্তিকতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে– কেউ কেউ মানুষ, বাদবাকি সব জনগণ। এই লেখাটা এতটুকু যখন পড়েছেন তখন আমি নিশ্চিত আপনি জনগনের মধ্যকার একটা সংখ্যা মাত্র নন। আপনি সত্যিকার অর্থে যারা মানুষ তাদেরই একজন। চাইলে আপনিও হতে পারেন অধিকতর যোগ্য জীবনবাদী সমাজকর্মী তথা একজন মানবিক মানুষ।

পোস্টটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *