সাধ্যের সাধারণ সীমার বাইরে গিয়ে কারো জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করবেন না। সুস্থ ও সুখী জীবন চাইলে, পরবর্তী জীবনে হায়-আফসোস করার মতো পরিস্থিতি হতে বাঁচতে চাইলে কারো জন্য অতিরিক্ত সেক্রিফাইস করা হতে বিরত থাকেন। এখন মনে হতে পারে, ‘করি না! আপনজন, নিজের লোকদের জন্যই তো…। সমস্যা হলে নিজেকে সামলে নেবো। থাক না! জীবনে তো সবকিছু পাওয়া হয় না…।’ না, আপনার এই ধারণা ভুল। এখনকার এই ‘কিছুটা ক্ষতি’ শেষ পর্যন্ত আপনি মেনে নিতে পারবেন না। আবেগের তোড়ে চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে নিজেকে আপনি এখন ভাবতে পারলেও বাস্তবতা হলো আপনার এই অপরিণত আবেগ শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হবে না।
আপনি যতটা ভাবছেন, বাস্তবতা তারচেয়েও ঢের বেশি জটিল ও রূঢ়। তাই, যে ধরনের সম্পর্কই করেন না কেন, সেটাকে সমাজস্বীকৃত সুনির্দিষ্ট give and take বা লেনদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা করেন। ধর্ম, সমাজ বা রাষ্ট্রের, এক কথায়, প্রচলিত সম্পর্ক-সূত্রের সীমারেখাগুলো যথাসম্ভব মেনে চলেন। কারো জন্য তার প্রাপ্যতার বাইরে একতরফাভাবে বিশেষ কিছু করতে যাবেন না। যদি করেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, আপনি হতাশ হবেন, দুঃখ পাবেন, পরাজিত হবেন।
যদি এমন কিছু ভুল ইতোমধ্যেই আপনার জীবনে সম্পন্ন হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে নিজের দুঃখবোধকে হজম করে আপনার দায়িত্ব হলো স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা। আপনারই ভুলে আজ আপনি যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তা যদি মেনে নিতে না পারেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনি আম-ছালা দুটোই হারাবেন।
২.
মনে রাখবেন, কোনো বঞ্চনা বা দুঃখবোধ, অপ্রাপ্তি বা ক্ষতি, এই মুহূর্তে আপনার কাছে যতই বড় মনে হোক না কেন, জীবনের বৃহত্তর ক্যানভাসে কোনো অপূর্ণতা বা ক্ষতি তেমন বড় কিছু নয়। সব ক্ষতি একসময় পুষিয়ে যায়। সব ক্ষতই এক সময় সেরে উঠে। শুকায়। আপনি বেঁচে আছেন, এরচেয়ে বড় সফলতা আর কী হতে পারে? আপনার জীবনের সব অর্জন কি হারিয়ে গেছে?
না, যায়নি। আমি জানি। অনেক বড় ক্ষতির পরেও অনেক অর্জন আপনার রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আপনার জীবনে রয়ে গেছে সৃজনশীলতার এক অপরিমেয় সম্ভাবনা। আপনার কোনো যোগ্যতা নাই, এমন মনে হচ্ছে? আচ্ছা, ভাবাবেগমুক্ত হয়ে একটু ভাবুন তো, আপনি একজন স্বাধীন মানুষ। আপনি একজন আত্মপরিচয় জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। সমাজে আপনি একজন সম্ভবনাময় কিংবা প্রতিষ্ঠিত মানুষ। আপনি তো অলরেডি বড় বড় সব সম্পদের অধিকারী। অস্বীকার করতে পারবেন? আমি কি ভুল বলছি? মনে রাখবেন, মানুষের সম্ভাবনা অপরিমেয়। জীবন নিয়ে মানুষের খেলা দু’চার রাউন্ডে শেষ হয়ে যায় না।
৩.
বেঁচে থাকাটাই আসলে সবচেয়ে বড় কথা। আপনার, আমার সকলের জীবনে একমাত্র জেনুইন লস বা পরাজয় হলো অপেক্ষমান ও অনিবার্য মৃত্যু। এছাড়া বাদবাকি সব ক্ষতি নিতান্তই সাময়িক। আংশিক। খোদা তায়ালা বা ‘প্রকৃতির’ নিয়ম হলো কোনো মানুষকে সর্বশেষ মুহূর্তেও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়া। এরমানে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ঈশ্বর কিংবা ‘প্রকৃতি’ কখনো কাউকে সম্পূর্ণ disfavour করে না। তাই, লড়াই থামিয়ে দেওয়া, ভেঙ্গে পড়া কিংবা পরাজয় মেনে নেয়া – এসব দুর্বলতার লক্ষণ। উঠে দাঁড়ানোর জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য, নিজের জন্ম ও স্বাধীন অস্তিত্বের স্বার্থকতা প্রতিপন্ন করার জন্য জীবনবোধ নির্ভর আপনার তেমন একটা সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। অবাস্তব আশা কিংবা অমূলক হতাশার প্রান্তিকতায় অযথা ভুগবেন কেন? অতি আশার পরিণতি হলো হতাশা। অতি আবেগের অনিবার্য পরিণতি তিক্ততা।
৪.
মানুষের জীবনের বিপুল, বিশাল ও ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি ও নির্যাস হলো ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলো গড়ে উঠেছে সুনির্দিষ্ট কিছু সম্পর্কসূত্র ও নিয়ম-কানুনের উপর ভিত্তি করে। এর মানে এই নয়, ধর্মের নামে, সমাজের নামে বা রাষ্ট্রের নিয়ম হিসেবে যা কিছু আছে তা সব ঠিক। বরং, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু কিছু বিষয় ভুল বা অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। যুক্তি দিয়ে, ক্ষেত্রবিশেষে শক্তি প্রয়োগ করে আপনি সেগুলোর বিরোধিতা করবেন। আমিও করি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু এর মানে এই নয়, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবকিছু ভুল কিংবা এসব প্রতিষ্ঠানের আদৌ দরকার নাই। মানুষ নামক একটা প্রাণী মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি তা হয়ে উঠে ধর্ম (আদর্শ অর্থে), সমাজ ও রাষ্ট্রের রীতিনীতিগুলোকে মানা সাপেক্ষে।
এ পর্যন্ত মানুষ ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা যা কিছুকে মানুষ আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলেছে তার মূল অংশটুকু মোটের উপরে সঠিক, যথার্থ ও উপযোগী। মূল কাঠামো ঠিক থাকলেও এগুলোতে সময়ে সময়ে কিছু না কিছু গলতি বা ভুল ইনকরপোরেটেড হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো সময়ে করা যাবে।
৫.
কারো জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইলে ততটুকুই করবেন, যতটুকুর ভার আপনি সইতে পারবেন। খামোকা নিজের ওপর আবেগনির্ভর বাহুল্য-সম্পর্কের বোঝা চাপাতে যাবেন না। নচেৎ শেষমেশ একুল-ওকুল দুকুলই হারাবেন। কাউকে মর্টগেজ ছাড়া ঋণ দিতে গেলে ততটুকু দিবেন যতটুকু সে রিটার্ন করতে পারবে। অথবা, বিধিবদ্ধ নিয়মনীতির বাইরে কাউকে কিছু দিতে গেলে এমনভাবে দিবেন যাতে করে সে যদি আপনার পাওনা পরিশোধ নাও করে তাতে যেন আপনার তেমন কিছু আসে না যায়।
মনে রাখবেন, নিঃশর্ত ভালবাসা বলে কিছু নাই। সো কলড ‘প্ল্যাটোনিক লাভ’ প্লাটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মতোই নিছক কষ্টকল্পনা বা ইউটোপিয়া। ভালোবাসা মানেই জান্তব। সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীন। চাইলেই আপনি কোনো প্রাকৃতিক নিয়মকে পরিবর্তন বা অস্বীকার করতে পারবেন না।
একপাক্ষিক ভালোবাসার পরিণতি কখনও সুখের হয় না। তাই, আস্থা রাখেন দ্বিপাক্ষিক ভালোবাসায়। সন্ধি-সমঝোতা করেন সুনির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে। এই কাজে ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র কখনো shelter হিসেবে, কখনো arbitrator হিসেবে, কখনো guarantor হিসেবে আপনার কাজে লাগবে। আবেগের বশে, একতরফা ভালবাসায় অন্ধ হয়ে প্রথাগত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কসূত্রকে অস্বীকার করার বোকামীসূলভ চেষ্টা না করাই ভালো। যে কোনো ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজস্বীকৃত সীমারেখা বজায় রেখে নিজ অধিকার ও দায়িত্বকে সদা সমান্তরালে বিবেচনায় রাখবেন। সব সময়ে সীমার ভিতরে থাকার চেষ্টা করবেন। পারস্পরিক সম্পর্কের এই ফর্মুলা যত বেশি মেনে চলতে পারবেন জীবনে তত বেশি সুখী হতে পারবেন। আমি নিশ্চিত। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এটি আমি বুঝেছি।
৬.
ভালোবাসা হলো বিদ্যুতের মতো। বিপুল শক্তির উৎস। সতর্কতার সাথে গ্রহণ করলে তা আপনাকে প্রভূত কল্যাণ দান করবে। কিন্তু অসতর্ক বা বেপরোয়া হয়ে সিস্টেমের বাইরে এনগেইজ হতে গেলে মুহূর্তেই তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কসূত্রগুলোর কোনোটাকে জোর করে রি-ডিফাইন বা রি-বিল্ড করার উন্মাদনায় আমরা মাঝে মাঝে এই জানাশোনা বিষয়গুলো ভুলে যাই। এক পর্যায়ে বিপুল ক্ষতির বোঝা যখন আমাদের উপর চেপে বসে তখন আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। ভেঙ্গে পড়ি। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মনোকষ্টে বা অপ্রাপ্য কোনো কিছু না পাওয়ার বেদনায় আমরা জীবনটাকেই বরং ব্যর্থ ও তুচ্ছ জ্ঞান করি। মনে করি, কী লাভ হলো এত কিছু করে?
জীবন সম্পর্কে এমন হতাশায় যারা ভুগছেন তাদেরকে বলছি– না, নিজেকে তুচ্ছ ভাববেন না। আপনার জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়নি। জীবনের ক্যানভাস অনেক অনেক বড়। সময় কখনো ফুরিয়ে যায় না। জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার মতো এখনো আপনার রয়েছে যথেষ্ট সময়। ব্যর্থতার চেয়ে যে কোনো মানুষের অর্জন কিংবা সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রয়োজন শুধু আত্ম-উপলব্ধির।