অতিরিক্ত বিনয় ভালো নয়। বিনয় থাকলে ভালো। বিনয়ী হতে পারলে ভালো। কিন্তু, কৃত্রিম বিনয় কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এ ধরনের ভদ্রতাসুলভ বিনয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই বা এক পর্যায়ে শেষ হয়ে যায়। এরপর দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ভদ্রলোক কিম্বা ভদ্রমহিলার আসল চেহারা। কপট বিনয়ের পরিণতি হলো, কোনো না কোনো ধরনের উগ্রতা বা একদেশদর্শিতা।

যাকে আপনি অন্তর থেকে সম্মান করতে পারছেন না, তাকে অসম্মান না করলেই চলে। আপনার ভেতরে সম্মানবোধ না থাকা সত্ত্বেও জোর করে কাউকে সম্মান দেখাতে যাবেন না। যদি তা করেন, তাহলে আপনার এই আরোপিত ধৈর্যের দেয়াল ভেঙ্গে পড়বে। নিজেকে আপনি এক পর্যায়ে আর সামলাতে পারবেন না। যাকে আপনি কৃত্রিমভাবে সম্মান দেখাচ্ছেন, তাকেই আপনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপমানিত করবেন। এটি নির্ঘাত ঘটবে। এ ধরনের অনিচ্ছাকৃত প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আপনি নিজেকে কখনোই সংযত রাখতে পারবেন না। মানব চরিত্র সম্পর্কে আমাদের বিশ্লেষণ এমনটাই বলে।

যে কোনো মানবিক অনুভূতি ভিতর থেকে আসা উচিত। হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা। হোক সেটা সম্মান কিংবা অসম্মান। বহু বছর আগে কোথায় যেন লিখেছিলাম,

love grows,
it cannot be made.
And, when it is gone,
nothing can back it again.

কারো জন্য যদি আপনার কোনো ইতিবাচক অনুভূতি না থাকে, সে ক্ষেত্রে সম্পর্কসীমার ভিতর থেকে যতটুকু করা দরকার, ততটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। অতিরিক্ত কিছু করতে যাবেন না। অতিরিক্ত বিনয় দেখাতে যাবেন না। অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে যাবেন না। অতিরিক্ত সম্মান দেখাতে যাবেন না।

জানেনই তো, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। জোর করে অতিরিক্ত কোনো কিছু যখন আমরা কারো জন্য করতে যাই, তখন তা এক পর্যায়ে ব্যাকফায়ার করে। এটি অনিবার্য। এ ধরনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যবস্থাকে আমরা কখনো অকার্যকর করে রাখতে পারি না। আবেগের জোরে বা বিশেষ কোনো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত সম্পর্কসীমাকে যতই আপনি খানিকটা এদিক-ওদিক করে নতুন বিন্যাসে সাজাতে চান না কেন, এক পর্যায়ে সেটি মূল প্রাকৃতিক সেটআপ অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিসেট হয়ে যাবে।

তাই, প্রকৃতিকে মেনে চলুন। প্রাকৃতিক জীবনযাপন করুন। প্রকৃতির সাথে, স্বভাবের সাথে, বাস্তবতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মানে পরাজয় অনিবার্য। প্রকৃতির নিয়মগুলো সরল ও সহজবোধ্য। যা কপট, কৃত্রিম, বানোয়াট কিংবা আরোপিত, তা কখনো টেকসই হয় না।

প্রকৃতি আমাদেরকে নির্ধারণ করে দিয়েছে– কে, কতটুকু, কখন, কীভাবে, কী পাবে। এই প্রাকৃতিক বণ্টন বা নির্ধারণ ব্যবস্থার নামই হচ্ছে শরীয়ত। হ্যাঁ, শরীয়ত হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা। বিশেষ করে ইসলামী শরীয়তের ক্ষেত্রে এ কথাটা আমি হলফ করে বলতে পারি। যা কিছু আমাদেরকে করণীয় ও কর্তব্য হিসেবে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, ব্যক্তিগত থেকে সমষ্টিগত, তা প্রকৃতিসম্মত জীবন ব্যবস্থারই নামান্তর। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কোনো বিধি, দায়িত্ব ও কর্তব্য কিংবা অধিকার কায়েমযোগ্য নয়। হোক সেটা ধর্মের বা সমাজের বা রাষ্ট্রের কিংবা কোনো আদর্শের নামে আরোপিত।

প্রকৃতির মধ্যে নাই কৃত্রিমতা, অভিনয় বা বাহুল্য বিনয়। প্রকৃতিতে যার যার অবস্থা ও অবস্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত। তাই আসুন, যে কোনো ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রকৃতি প্রদত্ত সীমানাগুলোকে মেনে চলি। কাউকে আগামীকাল বা পরশু অপমানিত করার চেয়ে আজকে তাকে অতিরিক্ত সম্মান না করাই ভালো। এমনকি সে নিজেও যদি এমন কৃত্রিম বিনয়, সম্মান বা ভালোবাসার আশা করে। পরবর্তী তিক্ততার চেয়ে বর্তমানের তিক্ততা শ্রেয়তর বটে।

যে কোনো সময়, যে কারো সাথে, যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বীয় ব্যক্তিত্ব বজায় রাখুন। এর সাথে ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমার সংজ্ঞাটিও মনে রাখতে পারেন– ব্যক্তিত্ব হচ্ছে সীমিত মাত্রার বেয়াদবি (personality is audacity within limit)।

যে কোনো অতিরিক্ত মাখামাখি সম্পর্কের পরিণতি হচ্ছে তিক্ততা, ছাড়াছাড়ি, বিচ্ছেদ ও বিরোধিতা। সম্পর্ক মাত্রেই তাই থাকা উচিত প্রপার এক্সিট প্ল্যান। সম্পর্কটা কীভাবে শেষ হতে পারে, সেটা পক্ষসমূহের জানা থাকা উচিত। দিনশেষে, সম্পর্ক মাত্রই, এমনকি ‘রক্তের সম্পর্ক’ ধরনের স্থায়ী সম্পর্কগুলোও কোনো না কোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক। ‘জীবনে মরণে একসাথে’ ধরনের কোনো সম্পর্ক শুধুমাত্র কল্পনাতেই থাকতে পারে। এ ধরনের অবাস্তব সম্পর্কের অলীক বাস্তবতা নিয়ে রচিত হতে পারে সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। কিন্তু বাস্তব জীবনে চিরস্থায়ী সম্পর্ক বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নাই। ছিলো না কোনো কালে।

রক্তের সম্পর্কের বাইরে কেউ কারো সাথে এ ধরনের স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করলে, সেটা কখনোই সুন্দর ও সুখের হবে না, নিশ্চিত বলা যায়। অবশ‍্য, সম্পর্কচ্ছেদের সম্মত ব্যবস্থা থাকা মানে এই নয় যে সেই সম্পর্কটি হবে ঠুনকো বা অস্থায়ী। বরং সম্পর্কচ্ছেদের সুসম্মত ব‍্যবস্থা থাকার মাধ্যমে অযাচিত সম্পর্কের অসহনীয় দায় ও সীমাহীন তিক্ততা থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি।

বারবার যে কথাটা বলি, এ প্রসঙ্গে সেটি আবারও বলছি। সম্পর্ক করেন। কিন্তু মনে রাখবেন, সম্পর্ক মাত্রই হচ্ছে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। সম্পর্ক মানেই হলো, সুনির্দিষ্ট কিছু অধিকার আদায় আর সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালনের ব্যাপার।

এই কথাটুকু যদি মনে রাখেন, তাহলে যে কারো সাথে আপনার সম্পর্ক থাকবে সুস্থ ও স্বাভাবিক। আপনার সম্পর্কটি হতে পারে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত কিংবা আদর্শিক। হতে পারে সেই সম্পর্ক ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক। সম্পর্কটি যে ধরনেরই হোক না কেন, প্রকৃতিসম্মত সম্পর্কসূত্রকে মেনে চলার কারণে, বলা যায়, জীবনে আপনি সুখী হবেন। সফল হবেন। একজন বাস্তববাদী, ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্র ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনাকে জানাই সালাম, শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *