প্রশ্নটা ছিল ‌‘ঠিক-বেঠিক আর ভুলশুদ্ধের মাঝে পার্থক্য কী?’

একজন উত্তর দিয়েছেন, ‌‘পার্থক্য হলো আপনার অনুসরণ করা স্কেল। অন্যের স্কেলে যা ঠিক, আপনার স্কেলে তা বেঠিকও হতে পারে।’

আমি সেখানে মন্তব্য করেছি, স্কেলের ভিন্নতা উপরিতল বা সুপারফিশিয়াল লেভেলের ভিন্নতা। ভিত্তি স্তর বা গ্রাউন্ড লেভেলে মানুষের ভালো-মন্দ পার্থক্য করার স্কেলটা একই। সেইম। যেটাকে আমরা বিবেক বলি।

সমস্যা হলো, বিবেকের দোহাই দেওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় মানুষ বিবেকের যথাযথ ব্যবহার করে না। এক্ষেত্রে বুদ্ধি এবং যুক্তির আলো দিয়ে আমরা যদি পুরো ব্যাপারটা দেখি, তখন আমাদের বাস্তব কর্ম ও বিবেকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া বৈপরীত্যকে অনায়াসে ধরতে পারি।

সত্যকে জানার প্রবল ঐকান্তিকতা থাকাটা জরুরী। সত্যকে জানার পদ্ধতি একটাই। আর সেটি হলো, যুক্তি-বুদ্ধির আলো দিয়ে বিবেকের কাছে পৌঁছা; এবং বিবেক কী বলে সেটাকে মেনে নেওয়া।

ইটস এ ম্যাটার অফ হাউ ডিপ সামওয়ান আজ সিরিয়াস টু ডিগ, ওয়ান্টস টু গো টু দ্যা বটম। এনিওয়ে।

সত্যকে উপস্থাপন বা বাস্তবে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আমরা মাঝে মাঝে ভুল করি। এ থেকে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়, একক সত্য বলে কোনো কিছু নাই।

বরং, সত্য এবং ন্যায় সব সময়ই one and the same। মনে রাখতে হবে, multiplicity of understanding and appearance of the truth, does not mean that truth itself is multiple. খণ্ডিত ‌‘সত্য’, আদৌ সত্য নয়। সত্যতার স্বগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি সদাসর্বদা এক ও অখণ্ড।

সত্যতা হলো বাস্তবতা। বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নেয়া হলো ন্যায়।

আলাপ-আলোচনা করে আমরা সহজেই একমত হতে পারি, প্রত্যেকটা মানুষের মৌলিক জ্ঞান কাঠামো হুবহু এক। যেটাকে আমরা বেসিক হিউম্যানিটি বলে মনে করি।

প্রকৃতি বা ঈশ্বর প্রদত্ত এই বিবেকবোধকে মানুষ কীভাবে কাজে লাগায়, সত্য ও ন্যায়কে জানার ক্ষেত্রে মানুষ কতটুকু আন্তরিক, ঈশ্বর বা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এই মৌলিক মানবীয় বোধ বা আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে সে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছে, কতটুকু গভীরে সে যাওয়ার চেষ্টা করছে, এসব কিছুর উপর নির্ভর করবে সত্য ও ন্যায় সম্পর্কে তার জ্ঞানের সঠিকতা কিংবা ভ্রান্তি।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Mahdi Hasan: স্যার কি এটা বলতে চাচ্ছেন যে সত্যকে বুঝার পদ্ধতি ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতে পারে, মানে একেক জন একেক উপায়ে সত্যকে বুঝতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সত্যটা সবার জন্য একই। অর্থাৎ Methodology ভিন্ন হলেও প্রকৃত সত্যটা পরিবর্তন হবে না বা হয় না।

Mohammad Mozammel Hoque: পদ্ধতি নয়, বরং আমি বলতে চাচ্ছি সত্যকে জানার প্রবল ঐকান্তিকতা থাকাটা জরুরী। সত্যকে জানার পদ্ধতি একটাই। আর সেটি হলো, যুক্তি-বুদ্ধির আলো দিয়ে বিবেকের কাছে পৌঁছা; এবং বিবেক কী বলে সেটাকে মেনে নেওয়া।

ইটস এ ম্যাটার অফ হাউ ডিপ সামওয়ান ওয়ান্টস টু ডিগ, ওয়ান্টস টু গো ইনডেপ্থ।

Faruque Alam: আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে এমন তিনটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যার মাধ্যমে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ের ইলম (জ্ঞান) অর্জিত হয়ে থাকে। একটি হলো মানুষের ইন্দ্রিয় অনুভূতি অর্থাৎ চোখ, কান, মুখ, হাত এবং পা। দ্বিতীয়টি হলো বিবেক বা আকল-বুদ্ধি। তৃতীয়টি হলো ওহী। কাজেই মানুষ অনেক বিষয় স্বীয় ইন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে জানতে পারে। অনেক বিষয় বিবেক বা আকল-বুদ্ধির মাধ্যমে জানতে পারে। আর যে সকল বিষয় এ দুটোর মাধ্যমে জানা যায় না, সেগুলো ইলমে ওহীর মাধ্যমেই জানা যায়। ইলমের এই ত্রিবিধ মাধ্যমের এরূপ ক্রমবিকাশ রয়েছে যে, প্রত্যেকর একটি নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে। যে ক্ষেত্রের বাইরে সেটা কাজে আসে না।

এ বিষয়টি একটি উপমার সাহায্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ধরা যাক, কারো হাতে একটি পিস্তল রয়েছে, চোখ দ্বারা তা দেখে এর সাইজ ও আকৃতি বুঝতে পারা যায়। হাত দ্বারা স্পর্শ করে বুঝতে পারা যায় এটি কঠিন উপাদান দ্বারা তৈরী। ট্রিগার চেপে বুঝতে পারা যায়, এর থেকে একটি গুলি প্রবল বেগে বের হয়ে দূরে চলে যাচ্ছে এবং বিকট শব্দ শুনে বুঝা যায় কীরূপ ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এর নল শুকে বুঝতে পারা যায়, এর থেকে বারুদের গন্ধ বের হয়। এ সকল তথ্য পঞ্চইন্দ্রিয় সরবরাহ করছে। কেউ যদি বলে এটি কে নির্মাণ করেছে? পঞ্চইন্দ্রিয় এর জবাব দিতে অক্ষম। এক্ষেত্রে বিবেককে কাজে লাগালে বিবেক বলে দিচ্ছে, এ পিস্তল নিজে নিজে অস্তিত্বে আসেনি, বরং কোনো কারিগর এটাকে তৈরি করেছে। সেই কারিগরকে আমি চোখ দ্বারা দেখছি না, কর্ণ দ্বারা আওয়াজ শুনছি না। কিন্তু বিবেক দ্বারা জানা গেলো একে কোনো কারিগর তৈরি করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ পিস্তলটির কোন ধরনের ব্যবহার বৈধ আর কোন ধরনের ব্যবহার বৈধ নয়? এ প্রশ্নের জবাবেও বিবেক একটা সীমা পর্যন্ত সাহায্য করতে পারে। বিবেক দ্বারা চিন্তা করে বুঝা যায়, এর দ্বারা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা খুবই গর্হিত কাজ হবে, যা অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু এরপরও আরেকটি প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, কাকে নিরপরাধ আর কাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে? আর কোন ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে পিস্তল ব্যবহার করে হত্যা করা যেতে পারে? এটা এমন এক প্রশ্ন, যে ব্যাপারে যদি শুধু বিবেকের ভিত্তিতে চিন্তা করা হয় তবে বিবেক মহাঘুরপাকে ফেলে দেবে।

উদাহরণত আপনার সামনে একজন হত্যাকারী দণ্ডায়মান। সে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। তার ব্যাপারে যখন বিবেক দ্বারা চিন্তা করা হয়, তখন বিবেক একবার বলে এই ব্যক্তি এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, তার স্ত্রীকে বিধবা করেছে, তার সন্তানদের এতিম করেছে। কাজেই এই অপরাধীকে হত্যা করে অন্যদের জন্য শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত বানিয়ে দেওয়াই হবে তার যথোপযুক্ত শাস্তি। অপর দিকে, এ বিবেকই আরেকটি যুক্তি উপস্থাপন করে, যে মরার সে তো মরেই গেছে, হত্যাকারীকে হত্যা করলে তো নিহত ব্যক্তি ফিরে আসবে না, আর তার পরিবার-পরিজন ও তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পাবে না। আর এ স্থলে হত্যাকারীকে যদি হত্যা করা হয় তবে তার ও নিরপরাধ পরিবার-পরিজন কষ্ট পাবে।

এ ধরনের পরস্পরবিরোধী যুক্তি একই বিবেক থেকে এসেছে। তাই শুধুমাত্র বিবেকনির্ভর হয়ে এরূপ ক্ষেত্রে সিদ্বান্ত নেয়া দুষ্কর যাতে বিবেক সন্তুষ্ট হতে পারে। এটা সেই জায়গা যেখানে ইন্দ্রিয় এবং বিবেক দ্বারা সমাধান করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সেই দিকনির্দেশনার প্রয়োজন, যা তিনি নবীর (সা) মাধ্যমে মানবতাকে সরবরাহ করেছেন। এর দ্বারা এটি স্পষ্ট হলো, শুধুমাত্র বিবেক ও চাক্ষুষ জ্ঞান মানুষের রাহনুমায়ির জন্য যথেষ্ট নয়, বরং রাহনুমায়ির জন্য ঐশী ওহীর অনিবার্য প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু বিবেকের পরিধি শেষ হলে ওহীর কার্যক্রম শুরু হয়, তাই ওহীর প্রতিটি কথা যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেক দ্বারা উপলব্ধি করা জরুরী নয়।

Mohammad Mozammel Hoque: তুমি খুব চমৎকারভাবে বলেছো।

ফিজিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স, র‍্যাশনাল এক্সারসাইজ এবং রেভিলেশন— এগুলো হায়ারার্কিক্যাল।

এর দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে নাকচ করে এবং তৃতীয়টি দ্বিতীয় এবং প্রথমটিকে অকার্যকর করে। ব্যাপারটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পরে প্রাথমিক পর্যায় তখন আর এফেক্টিভ থাকে না।

একই কথাকে যদি আমরা অন্যভাবে বলি,

আমাদের জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস আমাদের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাকে আমরা কাটাতে পারি যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে। একইভাবে, আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে পারি একটা সার্বিক সত্তার উপরে আমাদের বিশ্বাস এবং সেই সত্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত গাইডেন্সের মাধ্যমে।

যুক্তি-বুদ্ধি মাঝখানে থেকে ভূমিকা পালন করে। একদিকে সে অভিজ্ঞতার ত্রুটিকে সমাধান করার চেষ্টা করে; অন্যদিকে তার নিজের যে সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা আছে সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের কী করা উচিত তা বলে দেয়।

আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি আমাদেরকে বলে দেয়, যেহেতু আমরা সত্তাগতভাবে সসীম তাই আমাদের যুক্তিবুদ্ধিও সসীম হতে বাধ্য। আমরা যদি কোনো কিছুকে ভালো করে জানতে চাই, তাহলে সসীমতার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এক সার্বিক সত্তার কাছ থেকে সঠিকভাবে তা জেনে নেয়া দরকার।

এ কারণেই আমরা এ ধরনের একটা সার্বিক সত্তার সন্ধান করি। এক পর্যায়ে আমরা খোদার কাছে নিজেদেরকে সারেন্ডার করি। খোদার কাছে নিজেদের সারেন্ডার করার মানে যুক্তিবুদ্ধিকে বাদ দেয়া নয়। বরং সেটাকে অতিক্রম করে যাওয়া।

যুক্তিবুদ্ধি হলো সাধারণ চিকিৎসকের মতো। বিশেষ জটিল পরিস্থিতিতে একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার ডক্টর, আমাদেরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের যে পরামর্শ বা ব্যবস্থাপত্র দেয় সেটা অনুসারে সে রোগীকে ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *