একদিন ভোরে একজন সহকর্মীর কাছে একটা মেইল করলাম। অন্য আরো ৫০ জন সহকর্মীর কাছে এটির কপি পাঠালাম। ২০ জনের মতো প্রাপ্তি স্বীকার করে ফিরতি মেইল করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকজন বিস্তারিত মন্তব্য করেছেন। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের যারা তাঁরা সাক্ষাতে মৌখিকভাবে বলেছেন– “তোমার/আপনার মেইল পেয়েছি। ভালো, তবে…” ইত্যাদি। নিয়মিত মেইল চেক করা ও উত্তর দেয়ার অভ্যাস এখনো (কাজের চাপে!) তাঁরা রপ্ত করতে পারেন নাই। মূল আলোচনাটা ইংরেজিতে ছিল। আমার পাঠানো মূল ইমেইলটা এবং এর সূত্রে যে আলোচনা হয় তা পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।

***

সালাম নিবেন। আজকের এই সকালে আপনার জন্য এখানে ৮টি প্রপজিশন লিখলাম। মন্তব্যের প্রত্যাশায় –

. ধর্মপরিচিতি হতে ইসলামকে বাঁচাতে হবে

Islam must be rescued from its religion-image. Islam is a deen, a life-view, a social ideology having a few religious aspects (rituals or nusuk).

. ইসলামসহ যে কোনো সামাজিক আদর্শের জন্য এর ব্যবহারিক তথা বাস্তবায়নযোগ্যতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

Practicality is the most important aspect for any social ideology including Islam.

. যত বেশি ধর্মনিরপেক্ষ তত বেশি আচারনিষ্ঠ

The more secular, the more ritualistic.

. সংশ্লিষ্ট সকল হাদীস ব্যাতিরেকে কোরআনের কিছু কিছু অংশ বাহ্যত (নাউযুবিল্লাহ) পরস্পরবিরোধী প্রতীয়মান হতে পারে!

Without all the concerned hadith collection, some portions of the holy Quran may apparently seem contradictory!

. কোরআনহাদীস অধ্যয়নের অনিবার্য প্রাপ্তি/পরিণতি হলো ফিকাহ

Fiqh (jurisprudence) is the necessary outcome of the study on the holy Quran and hadith collection.

. মুয়ামালাত তথা বস্তুগত সামাজিক বিষয়াদির অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা রয়েছে/থাকবে

Matters concerned with social behavior (muamalat), is obviously rationalizable.

. ঈমান হলো বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত শুদ্ধ উপসংহার

Islamic belief (iman) is or has to be nothing but a rational finding.

. ইসলাম ইসলামী আন্দোলনের সঠিক জ্ঞানের জন্য কোরআনহাদীসের সঠিক সূত্র ও বর্ণনাসমূহের অবগতি যথেষ্ট নয় এতে সংশ্লিষ্ট সকল বর্ণনার সমন্বয় এবং বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক

Merely authentic references from the Quran and Hadith are not enough for the proper understanding of Islam and Islamic movement. There has to be comprehensiveness or totality and graduality.

অন্যদের ফিডব্যাক ও মন্তব্য

মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম: আপনি কি ৩ ও ৬ নং পয়েন্টকে ব্যাখ্যা করবেন?

ইব্রাহীম হোসেন: প্রতিটা প্রপজিশনের অধিকতর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এতে এসব বিষয়ে আমাদের কনসেপ্ট আরো পরিষ্কার হবে। স্বচ্ছ ধারণা ছাড়া কোনো লক্ষ্যে কেউ পৌঁছতে পারে না। … আমাদেরটির মতো কোনো ইসলামী আন্দোলনে কর্মীদের উপর নেতৃত্বশীলদের ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান। নেতৃত্বের পক্ষ হতে যা বলা হয় বা করা হয় কর্মীবাহিনী তা সাধ্যমত অনুসরণ করে। নামাজে যেভাবে আমরা ইমামের অন্ধ-অনুসরণ করে থাকি, সংগঠনেও তাই করে থাকি। সব দায়দায়িত্ব ইমামের উপরই মূলত বর্তায়। এ কারণে শুধু সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনাতেও যোগ্য ইমামের দরকার বলে মনে করি। … মসজিদের ইমামতি বলেন আর সাংগঠনিক ইমামতি বলেন, সব ক্ষেত্রে ইমামতির দায়িত্বপ্রাপ্তির কারণে তারা যে কোনো ভিন্নমতকে ভুল মনে করে সেটিকে নাকচ করা ও নিজ অবস্থানকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করেন।

সাইফুল ইসলাম: বিশেষ করে আমি ১ম পয়েন্টের বিষয়ে দৃঢ়ভাবে ঐক্যমত পোষণ করছি। আমাদের উচিত ব্যাপকভাবে এটির প্রচার করা।

মোঃ মশিউর রহমান: আমি ১ ও ৫ নং পয়েন্টের ব্যাপার পুরো একমত। কিন্তু ২ ও ৪ নং পয়েন্টে বর্ণিত বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কিভাবে আমরা র‍্যাশনালিটি তথা বিচারবুদ্ধিকে সংজ্ঞায়িত করবো? ৬ নং বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে এর নানা ধরনের ব্যাখ্যা সম্ভব। ৭ নং বিষয়টির ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ৮ নং প্রপজিশন ইসলামকে একটা বিতর্কের মধ্যে ফেলবে। অলরেডি হাদীসের বিষয়ে অনেক কথা বা আপত্তি আছে। এর সাথে কোরআনকে জড়ালে অনাকাঙ্খিত প্রশ্ন সৃষ্টি হবে বলে মনে করি।

তানভির মো: হায়দার আরিফ: তথাকথিত ‘আমাদের’কে নিয়ে এ সমস্যাটা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। আমাদের বিরোধীদের ক্ষেত্রে এ দৃশ্যটি একেবারে ভিন্ন। তারা যোগাযোগের গুরুত্ব যথাযথভাবে বোঝে। একবার আমি প্রাক্তন চবি ভিসি মান্নান স্যারকে প্রায় মধ্যরাতে তাঁর কোনো লেখায় ভিন্নমত পোষণ করে মেইল করি। তিনি সাথে সাথে উত্তর পাঠিয়েছিলেন। আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতাসমূহ সম্পর্কে খুব কমই সচেতন। কারণ আমরা নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু মনে করি, যদিও অন্যরা আমাদেরকে তেমন (উপযুক্ত) মনে করে না।

কাজী আশরাফুজ্জামান: আপনার পয়েন্টসমূহে উল্লেখিত অনেকগুলো পরিভাষা প্রথম তিন যুগের যোগ্য বিশেষজ্ঞদের লেখার মধ্যে আমি পাই নাই। আপনার কিছু কথা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। আবার কিছু কিছু সুন্নাহপন্থীদের কাছ হতে সমর্থনযোগ্য নয়। এরই প্রেক্ষিতে এসব কথা আরো সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনের উসূল নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। আমার যতটুকু বুঝজ্ঞান, দ্বীনের উসূল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জ্ঞান ও ইবাদতের বিষয়ে আমাদের উসূল-আদ্দ্বীনের আলোচনা স্বচ্ছ ও পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত। আপনি যদি ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ‘ইয়াহইয়া আস সুন্নাহ’ বইটি পড়েন তাহলে দেখবেন সাহাবাহ’দের যুগে যার কোনো নজীর খুঁজে পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে কথা বলার মাধ্যমে সকল বিদাআহ’র শুরু হয়েছে। উসূল আল-দ্বীন নিয়ে কোনো মৌলিক কথা বলার জন্য আমি যথেষ্ট সাহসী নই। আমার অবলম্বন হলো কোরআনের সে কথা: ‘তুমি যদি না জানো তাহলে যারা জানে তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করো।’ [সূরা নাহল ১৬:৪৩]

নিয়ামত উল্লাহ: আপনি মাঝে মাঝে দার্শনিক কথাবার্তা বলেন। দর্শনে জ্ঞান কম থাকায় এসব বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আপনি বরং এসব বিষয়ে কোনো একাডেমিক আর্টিকেল লিখুন। তখন আমাদের জন্য [কঠিন!] বিষয় বুঝা ও মন্তব্য করা সহজ হবে।

এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Salam: এক নাম্বার পয়েন্টটার সাথে কোনো রকম কনফিউশন ছাড়া কঠিনভাবে একমত। যখন কথা বলতে যাই তখন বুঝি, অমুসলিম/ইসলাম বিদ্বেষী তো বটেই, সহানুভূতিশীল মুসলিমদের মধ্যেও এই পয়েন্টের নেতিবাচক প্রভাব ভয়াবহ রূপে ধরা পড়ে। তিন নাম্বারের ব্যাপারে আমার পর্যবেক্ষণ একটু ভিন্ন। চার নং পয়েন্ট বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। কনফিউজিং…। দুয়েকটা উদাহরণ দিয়ে পরিস্কার করলে ভালো হয়।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলামকে বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে, অর্থাৎ, সুন্নাহ তথা এর বাস্তব প্রয়োগের যে মডেল তার মাধ্যমে। হযরত আলী (রা) যখন খারেজীদেরকে বুঝানোর জন্য প্রতিনিধি পাঠান তখন তিনি তাদেরকে বুঝানোর জন্য সুন্নাহর উপর ফোকাস করে কথা বলার জন্য বলেছেন। কোরআনের যেসব আয়াত আল্লাহর জাত সম্পর্কিত সেগুলোর মধ্যে কতক স্পষ্ট (মুহকাম), কতক অস্পষ্ট (মুতাশাবিহ)। ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহও স্পষ্ট। মানুষের করণীয় তথা বাস্তব সামাজিক সংশ্লিষ্টতা আছে এমন অনেক আয়াত হাদীসের সহায়তা ছাড়া সঠিকভাবে আমল করা সম্ভব নয়। প্রতিটা বিভ্রান্ত গোষ্ঠী কোরআন হতে নিজেদের মতের পক্ষে সূত্র দেখিয়েছে, এখনো দেখাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেখাতে পারবে। ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর জন্য এই পয়েন্টকে নতুনভাবে লিখছি। ধন্যবাদ। ৩ নং পয়েন্ট সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যারা যত বেশি সেক্যুলার, দেখা যায় তারা তত বেশি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাবন্দী করে। যেমন, যিনি নামাজ সাধারণত পড়েন না, তিনি যখন পড়তে আসেন তখন টুপি-পাঞ্জাবী পরে সব সুন্নত-নফল পড়তে থাকেন। কোরবানী দেয়ার ব্যাপারে ভীষণ আনইজি ফিল করেন। যে কোনো বিষয়ে প্রিস্ট-ক্লাস তথা আলেম সমাজের উপর নির্ভর করেন। আর যারা ইসলামকে জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, তারা যে কোনো জায়গায় কোনোমতে হলেও নামাজ পড়ে ফেলছেন, প্রিস্ট-ক্লাসকে ততটা পাত্তা দেন না। বরং সরাসরি জানা ও বুঝার চেষ্টা করেন। এই আরকি!

আর কোরআন ও হাদীসের ব্যাপক অধ্যয়ন করার পর এসবের আপাত বিরোধ ও বৈপরিত্যগুলোকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভাববেন। সমন্বয় করার চেষ্টা করবেন। কোনো একটিকে আমলের জন্য প্রেফার করবেন। অথবা প্র্যাকটিসের জন্য একটা ক্রমসোপান নির্ণয় করার চেষ্টা করবেন। এসব করতে গেলেই এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে যারা কাজ করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে তিনি খোঁজখবর নিবেন। এসবই স্বাভাবিক। এটিই হচ্ছে ফিকাহর পদ্ধতি। কোরআন-হাদীসের রেফারেন্স হচ্ছে ফার্মেসির মতো। কোন ঔষধটি খেতে হবে সেটি ঠিক করা হচ্ছে ডাক্তারীবিদ্যা। ফকিহরা এ কাজটিই করেন।

ফিকাহর ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ইউসুফ কারযাভীর অনুগামী। উনার ‘প্রায়োরিটিজ অফ ইসলামিক মুভমেন্ট ইন দ্য কামিং ফেজ’ বইটি যদি পড়ে না থাকেন, তাহলে কষ্ট করে ডাউনলোড করে পড়বেন!

ইসলামে কোনো বিষয় মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধির অগম্য নয়। যেমন, আল্লাহকে আমরা কি জানি? যদি না জানি, তাহলে কীভাবে মনে করি যে তিনি আছেন? আল্লাহর স্বরূপ কি আমরা জানি? না। জানার দরকারও নাই। আল্লাহর যেসব কাজ আমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট তা আমরা বিশেষত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানি। বুদ্ধি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম (আন্ডারস্ট্যান্ড) করি। শুধু আল্লাহ নয়, স্ট্রিক্ট সেন্সে আমরা সবকিছুকেই তার এফেক্টের মাধ্যমে জানি। সত্তাটাকে আমরা ধারণা করি। এই ধারণাটা প্রাপ্ত এফেক্টের সাথে মিলে গেলে আমরা সেটিকে জ্ঞান হিসাবে গ্রহণ করি। যা হোক, আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য যেসব সামাজিক বিধিবিধান দিয়েছেন তা বুদ্ধি দিয়ে সমর্থন করা সম্ভব। ওহীর রেফারেন্সকে উহ্য রেখে সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো করণীয় নির্ধারণ করলে দেখা যাবে আমরা সেই কর্মকেই সাজেস্ট বা ডিটারমাইন করছি যা হুবহু ওহীর নির্দেশের অনুরূপ। যেমন– নামাজ কেন এভাবে পড়তে হবে তা আমরা জানি না, তবে এভাবে পড়াটা সামাজিক দিক থেকে সর্বাধিক কল্যাণজনক তা তো আমরা জানি। এই আরকি!

পোস্টটির মূল লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *