বস্তুবাদীরা বিশ্বাস করে, বস্তুবাদই সত্য। অর্থাৎ, তাঁরা ‘বিশ্বাস’ করেন, বিশ্বাস বলে কিছু নাই।
যেহেতু, বিশ্বাস একটা ভাববাদী ব্যাপার, তাই তারা বিশ্বাসবিরোধী। তাই তাঁরা জড়বাদী।
জড় জগতে যদিও কোনো ‘বাদ’ বা ইজম নাই। জড় আছে বা নাই বা যেভাবে আছে তো আছে, নাই তো নাই।
শুদ্ধ জড় জগতে তাই ‘জড় আছে’ – একথা বলারও দরকার নাই।
এই অর্থে শুদ্ধ জড় জগতে ‘জড় আছে’ বা ‘জড়বস্তুই একমাত্র সত্য’ – এই ধরনের কথাবার্তাও অর্থহীন।
বস্তু আর ভাবের পার্থক্য আমরা মানে মানুষেরাই করি। যারা, জড়বাদীদের দৃষ্টিতে ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে’ আক্রান্ত।
দুঃখের সাথে লক্ষ করতে হয়, এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ হতে জড়বাদীরাও কিন্তু মুক্ত নন। এ যেন এক অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস।
জড়বাদীদেরকেও ‘বিশ্বাস’ করতে হয়, ‘জড়বাদ’ই সঠিক।
যদিও সর্বাংশ জড় জগতে শুধু ‘জড়বাদ’ কেন, কোনো মতবাদেরই অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। থাকার কথা নয় কোনো নৈর্ব্যক্তিক (abstract) ধারণার অস্তিত্ব।
নিতান্তই যে জড়, তার আবার মত বা মতবাদ থাকবে কেন? নিজস্ব মত বা বাদ না থাকার কারণেই তো কোনোকিছু জড় বা বস্তু হিসাবে গণ্য।
এই যে বললাম, ‘বস্তু হিসাবে গণ্য’ – এই কথাটাও জড়বাদী দৃষ্টিকোণ হতে প্রশ্নসাপেক্ষ।
‘আমরা’ যদি বস্তুই হই, তাহলে আমাদেরকে বস্তুবাদ নিয়ে তথা ‘বস্তু হিসাবে গণ্য’ হওয়া নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে কেন?
ভাব বা বিশ্বাস যদি অলীক বা অমূল (illusion) জাতীয় কিছু হয় তাহলে তো আরো মুশকিল।
খাঁটি বস্তময় জগতে তো ‘অলীক’ (fictitious) বা অমূল বলে কিছু নাই। থাকারও কথা না।
বস্তুবাদীদের বস্তুবাদের ওপর বিশ্বাসই প্রমাণ করে আদতে বস্তুবাদ সঠিক নয়।
তাঁরা এক প্রকারের বিশ্বাস দিয়ে (যেমন– বস্তুবাদের ওপর বিশ্বাস) অন্য প্রকারের বিশ্বাসকে (যেমন– দেহ-মনের দ্বৈতবাদে বিশ্বাস) খণ্ডন করতে চান।
বস্তুবাদ কর্তৃক সত্ত্বাগত দ্বৈতবাদ (ontological dualism) ‘খণ্ডনের’ মাধ্যমে আদতে বস্তুবাদই খণ্ডিত হচ্ছে।
কেননা, একটা কিছুর ওপর বিশ্বাসের দাবী পূরণ করতে গিয়ে তাঁরা অন্য কোনো বিশেষ বিশ্বাসকে বর্জন করছেন।
দিনশেষে তাঁরা তো কোনো না কোনো বিশ্বাসব্যবস্থার মধ্যেই থাকছেন।
তো, যে ধরনের বিশ্বাসই হোক না কেন, বিশ্বাস বিশেষকে যারা গ্রহণ করেন তাহলে তারা তো জড়বাদের সংজ্ঞা অনুসারেই জড়বাদী হতে পারেন না।
দেখা যাচ্ছে, জড়বাদের সংজ্ঞাটাই বেশ গোলমেলে। সর্ষের ভেতরেই ভূত আছে এমন ‘সর্ষে পড়া’ দিয়ে ভূত তাড়ানোর চেষ্টার মতো পৌরাণিক পণ্ডশ্রম।
বস্তুবাদ টিকে আছে এর সাংস্কৃতিক আবেদনের কারণে। জড়বাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বহু আগেই ধ্বসে পড়েছে। এর দার্শনিক ভিত্তিও অতিশয় দুর্বল। … অতএব, দেখা যাচ্ছে কোনো কিছু জ্ঞান হিসাবে টিকে থাকার জন্য বিজ্ঞান ও দর্শনের চেয়ে সংস্কৃতির অবদানই বেশি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ভোগবাদিতার রুচিতে তাই বস্তুবাদই যেন সবকিছুর ভিত্তি…।
খুব সুন্দর লিখেছেন স্যার!