যখন লেখার তাড়না অনুভব করি, খুব ভাল্লাগে। এক ধরনের অস্বস্তিকর এই ভালো লাগাটা মধুর হয়ে উঠে যখন কিছু একটা লিখে ফেলি। ঠিক যেন পাকা ফোঁড়া ভালো করে গেলে দেয়ার মতো এক অনির্বচনীয় কষ্টকর সুখ! এর থেকে অধিকতর শালীন ও যথার্থ আর কোনো উপমা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, সরি! জীবনে অনেক কিছু হওয়ার কথা ছিলো, ইতোমধ্যে। যা কিছু হইনি, হওয়ার তেমন ইচ্ছাও করিনি, সেসব কিছু না হয়ে উঠার কোনো বেদনা আমাকে খুব একটা তাড়িতও করে না। কারণ, জীবনের যে গভীর উপলব্ধি আমি পেয়েছি, সত্যের যে মর্ম অবারিতভাবে জেনেছি, সত্য-সুন্দর-ন্যায়কে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করার যে দুঃসাহস না চাইতেই, বলা যায়, স্বভাবগতভাবেই পেয়েছি, তা আমাকে দিনরাত মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে।

আসলে আমি আমার মতোই হয়েছি। তাই তো হওয়ার ছিলো। কেউ কারো মতো হয় না। হওয়া বা হতে চাওয়া উচিতও নয়। আমি কেন অন্যের মতো হবো? আমি আমার জীবনকেই নিঃসংকোচে যাপন করি। জীবনকে আমি শুধু উপলব্ধিই করিনি, উপভোগও করেছি, করছি। ঠিক যেন আলেফ্রেড টেনিসনের Ulysses-এর মতো। জীবনকে রীতিমতো তলানিশুদ্ধা উপভোগ করা। শ্রমে, শ্রান্তিতে, জয়ে এবং পরাজয়ে। সর্বদা সমভাবে।

ছোটবেলা থেকে ছিলাম জীবনবাদী, সাহসী, একরোখা। ধার্মিক ছিলাম না। এখনও ধর্মবাদীতাকে ভয় পাই। কাউকে খুব ধর্মনিষ্ঠ দেখলে আমি শংকাবোধ করি, না জানি কখন এই লোকের দুর্নিবার দুনিয়াদারিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে…! ধর্মের নামে কিংবা আদর্শের নামে যারা ত্যাগবাদী সাজে, ক্ষেত্রবিশেষে তারা উৎকট ভোগবাদী হিসাবে এক্সপোজড হয়। বিশেষ করে অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে। কোনো মতে জায়েজকরণ করতে পারলেই হলো। অবাক হয়ে ভাবি, দেখি, আইনসম্মত হওয়া আর নীতিসম্মত হওয়া যে এক জিনিস নয়, সে সম্পর্কে অনেক তথাকথিত জ্ঞানী-গুণীজনেরা ওয়াকেবহাল নয়!

আমি ত্যাগবাদিতাকে অপছন্দ করি, যথাসম্ভব অস্বীকার করি। কারণ, এই প্রায়-পঞ্চাশ বছরের বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতাতে প্রায় সব ‘ত্যাগী’দেরকেই দেখেছি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিম্বা ভেতরে ভেতরে ভোগবাদিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে। রোজার আগে আগে সপরিবারে বুফে চাইনিজ খেয়ে আসার মতো…! তাই, অকপটে স্বীকার করছি, স্থান-কাল-পাত্র ও ন্যূনতম সীমা বজায় রাখা সাপেক্ষে আমি যতটা সম্ভব ভোগের পক্ষে। অতএব বুঝতেই পারছেন, আমার কাছে ত্যাগবাদিতার চেয়ে ভোগবাদিতা ভালো। কারণ, ভেনটিলেশান প্রিভেন্টস এক্সপ্লোশান।

যা হোক, যা মনে করি, বিশ্বাস করি, সঠিক মনে করি, তা-ই বলি, তা-ই লিখি। লেখালেখির শুরু ২০১০ সাল হতে। আশ্চর্য হয়ে দেখি, আমার সব ছাঁচাছোলা অকপট কথাবার্তা অনেকেরই ভালো লাগে। এসব যেন তাদের মনের কথা। আমি সাহস করে বলে ফেলেছি, এই যা। দেখা যায়, কেউ একজন বলে ফেলার পরে অনেকেই একমত পোষণ করে। আমি ঘণ্টা বাজানোর লোক। কেউ একজন শুরু করুক, বা আসুন, সবাই মিলে করি – এ রকম মনে করে আমি বসে থাকার লোক নই। কবিগুরুর এ কথাটা আমার জন্য যথার্থ– যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে…। যখন সিরিয়াসলি ব্লগিং করতাম তখন কাকে যেন রাগ করে বলেছিলাম, আমি সিদ্ধার্থ হতে চাই। আপনি গোবিন্দ হয়ে থাকুন, আপত্তি নাই। হারমেন হ্যাসের ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসে গোবিন্দ হলেন প্রাপ্ত, প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত সত্যের অনুসারী। গোবিন্দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-সহচর সিদ্ধার্থ এর বিপরীত। তিনি সত্যকে খুঁজে নিতে আগ্রহী।

আমি গতানুগতিক নই, বরাবরই ব্যতিক্রমী। আমার কথাবার্তাও তাই ব্যতিক্রমী। গতানুগতিকরা আমাকে ইনকন্সিসটেন্ট মনে করে, অতীতে কখনো কখনো বলেছেও। আসলে জীবনবোধের লাইন অব কনসিস্টেন্সি যাদের খুবই দুর্বল, যারা স্বভাবগতভাবে নির্বিবাদী, চেঞ্জ-রেসিসট্যান্ট, তারা প্রচলিত ধারায় সফল জীবন যাপন করা সত্ত্বেও আমি একচুয়েলি তাদেরকে গতায়ু মনে করি। দুনিয়াতে এসব জীবন্মৃতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা সবকিছুকে পরিমাণ দিয়ে মাপে। কোয়ান্টিটিভ অ্যাচিভমেন্টই যাদের গর্ব। একটা মজার তথ্য হলো, পবিত্র কোরআন শরীফে ‘অধিকাংশ’ (আকছারু) শব্দটি যত জায়গাতে এসেছে সবখানেই নেতিবাচক অর্থে এসেছে। ইসলাম বা অনুরূপ কোনো সত্য-সুন্দর-ন্যায় কখনো সংখ্যাধিক্যনির্ভর নয়, হতে পারে না। কেবলমাত্র নিতান্ত প্রায়োগিক কিছু বিষয়ে গত্যন্তরহীন পরিস্থিতিতে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে মেনে নেই।

এমনকি আমি ‘সফলতা’তেও বিশ্বাসী না। প্রয়োজনে আমি স্বাধীন উদ্যোগ নেয়ার পক্ষপাতী। এবং এতে সফল হতেই হবে, তেমন কোনো বা কিছু সফলতা দেখাতেই হবে – এমন মনে করি না। সব ইট যদি দালানের উপরের অংশে থাকে তাহলে দালানটা দাঁড়াবে কী করে? ফাউন্ডেশনের ইটগুলোতে এমনকি আস্তর বা চুনকামও থাকে না। কথায় বলে, success is not always measured by what we see।

আমি মনে করি, ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসারীদের  মননশীলতা সমাজ-সংশ্লিষ্ট বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত সুপার-চেঞ্জ-সেনসেটিভ। নীতি-আদর্শের খাতিরে নিজেকে মোল্ড-আপ করার সৎ সাহস ও ঐকান্তিকতা যাদের নাই, তাদের মুখে ‘ইসলামী আন্দোলন’ কথাটা শোভা পায় না। যা কিছু অপরিবর্তনীয় তা অতি অল্প ও গভীর জীবনবোধ সংশ্লিষ্ট। যাকে মৌলিক বিশ্বাস হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বাদবাকি দুনিয়াবী সব বিষয়ে সুপার-অ্যাডাপ্টিভিটিই একমাত্র সঠিক তরিকা।

প্রথানুসারী ল্যাথারজিক লোকজনকে আমি তাদের সরল চিন্তার জন্য সম্মান করতে পারি। কিছুটা করিও বটে। কিন্তু ভালোবাসি ডাইনামিক লোকদেরকে। আমার অভিজ্ঞতায়, মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তাই তাদেরকে তীব্র গতিশীল হতে বাধা দেয়, অকর্মন্য, অপরের ছিদ্রান্বেষী ও বকোয়াজ করে রাখে। স্বার্থপর লোকেরা পরিবর্তন মাত্রকেই মোটাদাগে ভয় পায়। কোনো না কোনো ছাতার তলে জীবন কাটিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমি করি না। আমি রেস্টলেস। জীবনবোধ ও বিশ্বাসের বাইরে আমার কোনো শেষ বন্দর কিংবা নোঙর নাই। আমি কখনো মনে করি না, আমার জীবন লাস্ট স্টপেজে এসে গেছে। আমার মৃত্যুর দিনে আমার অবস্থানই হবে আমার শেষ পরিচয়। মৃত্যুর মতোই সেটি অনিশ্চিত।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা তীব্র গতিতে ছুটে চলো…! অথচ অধিকাংশ মানুষকে দেখি কোনোমতে একটা কিছুকে আঁকড়ে পড়ে থাকে। ক্যামেরার শাটারের মতো তাদের মনের দরজা কদাচিৎই খোলে। জীবনে মাত্র দুয়েকবার। অধিকাংশ মানুষ প্র্যাকটিক্যালি pick and choose নীতিতে বিশ্বাসী। সঠিক হলো প্রথমে চ্যুজ করা এরপর পিক করা। আমি প্রথমে চ্যুজ করি। যথাসম্ভব ভালোভাবে। আমার জীবনবোধের নিরিখে। নির্মোহ দৃষ্টিতে। কোনো লক্ষ্যবস্তুকে বোমারু বিমানের টার্গেট ফিক্স করার মতো। একবার প্রপারলি লকড হওয়ার পরে ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ জাতীয় চিন্তা কখনো আমাকে থামিয়ে দিতে পারে না। এর ফলাফল হলো সারাজীবন আমি এক্টিভিস্টই রয়ে গেছি। একাডেমিক ইন্ট্যালেকচুয়্যাল লিডার হতে পারি নাই। আমার পটেনশিয়ালিটিকে এড্রেস করে যারা আমাকে নিয়ে আফসোস করে, তাদের সরলতা ও বোকামী দেখে আমি অবাক হই। ইনাদের জন্য আমার করুণা হয়। তারা নানা দিক থেকে আমার আপনজন। আমি যা হতে চাই নাই, তা আমি হতে পারি নাই দেখে তারা হা-হুতাশ করে! অবুঝের মতো কখনো কখনো কেউ কেউ আমাকে ‘সান্তনা’ দেয়ার চেষ্টাও করে! কী আশ্চর্য!

এক দুরন্ত বন্য ঘোড়ার মতো আমি আপনমনে ছুটে চলি। ঝুঁকি নেয়াকে উপভোগ করি। নিস্তরঙ্গ সুন্দর সাজানো পরিপাটি জীবন আমার কখনো কাম্য ছিল না। নীতি আদর্শের জন্য অদম্য – এমন একজনকে বেশ কয়েকবার কথায় কথায় কোনো এক সময় ক্রেজি ডেকেছি। পরে খেয়াল করলাম, তিনি এই সম্বোধনে মাইন্ড করছেন। পরে বললাম, ‘ঠিক আছে থাক। আপনি হলেন মি. সিরিয়াস, আর আমি হলাম ক্রেজি।’ উনি হাসলেন। আসলেই আমি ক্রেজি পারসন। সত্যি। নিজেকে ক্রেজি বলতে আমি বিন্দুমাত্রও হ্যাসিটেন্ট নই। মাত্রা কমবেশি যা-ই হোক, মুসলমান-ঈমানদার মাত্রই বাই ডেফিনেশান ক্রেজি পিপল। নন-ক্রেজি লোকেরা মুসলামান হয় কীভাবে, আমি সেটি ভেবে পাই না। আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার দ্বিতীয় রুকুর শুরুতেই বলেছেন, সমাজের বাদবাকি ‘বুঝদার’ (?) লোকেরা সত্যিকারভাবে বিশ্বাসীদেরকে পাগল তথা ক্রেজি মনে করবে, বলবে। আফসোস, এখনকার অধিকাংশ ইসলামিস্টদেরকে দেখি, তারা সব ‘হুশ ঠিক মাথা খারাপ’ টাইপের পাবলিক। যাদের বাস্তব কর্মনীতি হলো রীতিমতো ‘খাই-দাই সেক্রিফাইস।’ কী অবাক কাণ্ড!

পোস্টটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *