কোনো কিছু আমাদের জানা হয়ে উঠে মোট ছয় ধাপে, যখন আমরা ধারাবাহিকভাবে এই কাজগুলো করি: to doubt, to raise question, to verify properly, to accept the findings, to practice according to knowledge and to fight for what is known as true. নিছক তথ্য বা ধারণা, জ্ঞান হয়ে উঠে না। জ্ঞানের বিষয়টি যা-ই হোক না কেন। হতে পারে এক একটি ধাপ আমরা খুব দ্রুত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিক্রম করে গেছি। অথবা, কোনো একটা ধাপে আটকে গেছি।
১. সন্দেহ করা: সন্দেহ হলো জ্ঞান অনুসন্ধান ও অর্জনের সূচনামূলক পদ্ধতি। সন্দেহ না করে কোনো কিছুকে গ্রহণ করা হলো নির্বিচারবাদী পদ্ধতি। ডগমেটিজম। কোনো ধারণা বা বিশ্বাসকে জ্ঞান হতে হলে তা নিঃসন্দেহ হতে হয়। সমস্যা হলো, শুরুটাই যদি হয় সন্দেহ ব্যতিরেকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহ হলো কী করে? আমরা জানি, সন্দেহবাদ যখন হয় পদ্ধতিগত, তখন তা জ্ঞানেরই পদ্ধতি। হোক সে জ্ঞান বিজ্ঞানের বা দর্শনের। কিংবা নৈমিত্তিক কিছু।
২. প্রশ্ন করা: কোনো বিষয়কে যখন আমরা সন্দেহ করব তখন আমাদের মধ্যে সেই বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে। অতঃপর সেটাকে কীভাবে আমরা সমাধান করবো, অর্থাৎ কীভাবে সন্দেহকৃত বিষয়টিকে যাচাই করব তাও আমরা স্বভাবতই ঠিক করে নিবো। এর মানে, কোনো বিষয়কে সন্দেহ না করা যেমন ভুল তেমনি সেই সন্দেহ নিরসন করার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন উত্থাপন না করাও তেমনি ভুল। সন্দেহ করার মাধ্যমে আমরা বিষয়টিকে বিবেচ্য বিষয় হিসেবে রিকগনাইজ করি। সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে আমরা বিষয়টিকে যাচাই করার পদ্ধতি সম্পর্কে একমত পোষণ করি।
৩. যাচাই করা: এর পরের ধাপের কাজ হচ্ছে সেই এগ্রিড পদ্ধতিতে বিষয়টিকে যাচাই করা। এটি যদি বিজ্ঞানের বিষয় হয় তাহলে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেটাকে যাচাই করতে হবে। এটি যদি দার্শনিক কোনো বিষয় হয় তাহলে যুক্তি দিয়ে সেটাকে যাচাই করতে হবে। এভাবে যে বিষয় যাচাইয়ের যে সম্মত পদ্ধতি, সে পদ্ধতিতে সেটাকে পরখ করে দেখতে হবে।
৪. গ্রহণ করা: কিছু কিছু জ্ঞানপথযাত্রীদের দেখা যায়, যারা সন্দেহ করা, প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং যাচাই করার ব্যাপারে খুব উচ্চবাচ্য করেন। কিন্তু সন্দেহ করা, প্রশ্ন করা ও যাচাই করার অনস্বীকার্য পরিণতি এবং অপরিহার্য নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে যা কিছুকে সঠিক হিসেবে পাওয়া গেলো সেটাকে অকপটে স্বীকার ও গ্রহণ করে নেয়ার ব্যাপারে এ ধরনের লোকেরা পলায়নপর। অনিচ্ছুক। যা তারা পেয়েছে তা বলা ও বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে তারা যেন অপারগ। এরা সুবিধাবাদী। নৈরাজ্যবাদী। নিহিলিস্ট।
এটি তাদের স্ববিরোধিতা এবং দ্বিচারিতা। জ্ঞানগত নৈতিক স্খলন। সত্যকে সত্য হিসেবে পাওয়ার পরও সেটা নিয়ে অনর্থক সন্দেহ করা, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং প্রযোজ্য নয় বা প্রয়োজনীয় নয় এমন ধরনের যাচাইয়ের দাবি করা, এগুলো এক ধরনের রোগ। এপিসটেমিক ডিজিজ। হিপোক্রেসি। এই ধরনের উত্তর-আধুনিকতাবাদী রোগের সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা জরুরি।
৫. বাস্তবায়ন করা: সত্য হিসেবে যেটাকে আমি পেয়েছি, ন্যায় হিসেবে যেটাকে আমি গ্রহণ করেছি, আমার দায়িত্ব হলো সেটাকে আমার জীবনে বাস্তবায়ন করা। অন্য কারো না হোক, আমার দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে। অর্জিত জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো ধরনের বিষয় থেকে অন্তত নিজের জীবনকে মুক্ত করতে হবে। পরিশুদ্ধ হতে হবে সব ধরনের স্ববিরোধ থেকে।
৬. সংগ্রাম করা: আমি যেটাকে সঠিক মনে করি, সেটাকে অন্যদের উপর আমি জোর করে চাপিয়ে দিতে পারি না। এটি সঠিক। কিন্তু অপর সকলের জন্য একজন কল্যাণকামী বন্ধু হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো যেটাকে আমি সঠিক মনে করি সেটাকে অপরের কাছে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সুন্দরভাবে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরা।
অপরাপর সুশীল যুক্তিবাদীদের সাথে আমার পার্থক্য হলো, আমি জানি, কিছু মানুষ তাদের অন্তর্গত অসৎ প্রবণতার কারণে কিংবা বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার মতো পর্যাপ্ত সাহস না থাকার কারণে অথবা এই উভয় কারণে, যত যুক্তিই আপনি দেন না কেন, সত্য ন্যায় ও কল্যাণের বিষয়টাকে তারা গ্রহণ করে নিতে অনিচ্ছুক।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যেককে স্বীয় বিবেচনা ও স্বাধীনতা মোতাবেক চলার সুযোগ দিতে পারলেও সবাইকে আমরা সব ক্ষেত্রে সমান স্বাধীনতা দিতে পারি, এমন তো নয়। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সংঘর্ষ। যুক্তি ও বাছবিচারহীনভাবে একতরফা চাপিয়ে দেওয়া সত্য, আদৌ সত্য হয়ে উঠে না। আবার যুক্তি স্বয়ং নিজে নিজে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। সেজন্য ব্যক্তিকে কাজ করতে হয় এই দুই অ্যাপ্রোচেই। যুক্তি-বুদ্ধির অ্যাপ্রোচ এক পর্যায়ে মানুষকে লড়াইয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
যুক্তির লড়াই জারি না রেখে, যুক্তির অ্যাপ্রোচ ম্যাচিউরড হওয়ার আগেই শক্তির লড়াই শুরু করা কিংবা শক্তির লড়াইয়ে জয় লাভের ন্যূনতম সম্ভাবনা ব্যতিরেকে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া হচ্ছে হঠকারিতা করা বা ফেতনায় লিপ্ত হওয়া। যুক্তির লড়াই exhausted হওয়ার পরে শক্তির লড়াইয়ে জড়িত হওয়াই হলো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক অনভিপ্রেত বাস্তবতা। তাই, সংগ্রাম ব্যতিরেকে কোনো জ্ঞান, সত্যিকারের জ্ঞান হয়ে ওঠে না।
অর্জিত জ্ঞানকে মানুষ তার বাস্তব জীবনে ঐকান্তিকভাবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করলে কিংবা নিজে যেটাকে অনুসরণ করেন সেটাকে বৃহত্তর সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা না করলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তির জ্ঞানবোধ অসম্পূর্ণ। কিংবা তিনি যেটাকে জ্ঞান হিসেবে অনুসরণ করেন সেটি আসলেই (objectively or independently) জ্ঞান হওয়া সত্ত্বেও ওই ব্যক্তির কাছে তা এক ধরনের অসম্পূর্ণ জ্ঞান বা নিছক ধারণা মাত্র। জ্ঞান হওয়ার জন্য যে ধরনের সলিড আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা এক্বীন থাকা দরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উক্ত জ্ঞান-ধারণায় সেটি নাই।
এ ধরনের ব্যক্তির সন্দেহ, প্রশ্ন, যাচাই ও গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই সমস্যা থাকার কারণে তার জ্ঞান এমনকি তার নিজ জীবনের পথ চলাকেই গাইড করতে পারছে না। তার জ্ঞান, অজ্ঞানতার অন্ধকারকে ভালোভাবে দূর করতে পারে নাই। তিনি বরং জ্ঞান ও অজ্ঞানতা তথা আলো-আঁধারের এক মিশেল আবহে পাশবিক জীবন যাপন করছেন। এ ধরনের লোকেরা কখনো সত্যিকার অর্থে সত্যবাদী, প্রজ্ঞাবান ও জীবনবাদী হতে পারে না।
জ্ঞান হচ্ছে এমন এক ধরনের ‘ভাইরাস’ যা কোনো জ্ঞানীকে একজন নির্বিবাদী সুশীল হিসেবে জীবন কাটাতে দেয় না। ন্যায় ও সত্যের পথে যিনি অকুতোভয় নন, যিনি লড়াকু নন, যিনি আপসকামী, সংঘাত-সংঘর্ষকে যিনি ভয় পান, তিনি সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করতে পারেননি। চোখে দেখা, কানে শোনা তথা আমাদের গ্রস ফিজিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সকে যেমন করে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তেমনি করে কোনো বিষয় সম্পর্কে যে জ্ঞান আমাদের কাছে আছে, সেটাকে অনুসরণ না করে আমরা শান্তি ও স্বস্তি লাভ করি না। সোজা কথায়, কারো আচরণ তার জ্ঞানের বিপরীত হওয়া অসম্ভব।
সত্য-মিথ্যার এই যে দ্বন্দ্ব, ন্যায়-অন্যায়ের এই যে সংঘাত, এর প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা, মানবিক জীবন যাপনের জন্য অতীব জরুরি।
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
ইনক্লুসিভ মুহাম্মদ ইকবাল: আল্লাহ! জ্ঞানের এত কঠিন মূর্তি!! তাইলে তো আমি গণ্ডমূর্খ।
Mohammad Mozammel Hoque: অস্পষ্ট ধারণামূলক বা তথ্যমূলক জ্ঞান যতটা সহজ, দায়দায়িত্ব নিয়ে কোনো কিছু সত্যিকারভাবে জানা তথা হৃদয়ঙ্গম করা, কোরআনে যেটাকে বলা হয়েছে হাক্কুল ইয়াকীন হিসেবে, এতমিনান সহকারে জ্ঞান অর্জন করা, এটি যথেষ্ট সিনসিয়ারিটির ব্যাপার। এটাকে এখন কেউ কঠিনও বলতে পারে। আমার দৃষ্টিতে অবশ্য আন্তরিকতা এবং সততা থাকা সাপেক্ষে জ্ঞান অর্জন করা সহজতর বিষয়।
ইনক্লুসিভ মুহাম্মদ ইকবাল: অতএব যে ব্যক্তি (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) দান করে ও (আল্লাহকে) ভয় করে, এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সহজ করে দেব। (সূরা লাইল: ৫-৭)
স্যার সত্য বলেছেন।