একদৃষ্টিতে জ্ঞান হলো এক ধরনের সামাজিক ধারণা বা কার্যক্রম মাত্র। একুইজিশন অব নলেজ বা জ্ঞান অর্জনের বিষয়টা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। সমাজে প্রভাবশালী কর্তৃপক্ষ জ্ঞানচর্চার গতিপথ বাতলে দেয়। এর একটি অর্থ হলো, দৃশ্যত মনে হলেও কার্যত আমরা নিজেদের অবজারভেশন ও রিজনিংয়ের ওপর নির্ভর না করে বিদ্যমান সামাজিক-সংস্কৃতিকে অনুসরণ করি। বিভিন্ন অথরিটি ও ইনস্টিটিউশান কর্তৃক নির্ধারিত বাউন্ডারির ভেতরে থেকে আমরা ‘মুক্ত’ জ্ঞান চর্চা করি।

নারীদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অপর জাতিসত্তা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের দুর্বল অর্থনৈতিক শ্রেণী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন ধর্মের লোকদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, এ ধরনের নানা বিষয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনায় যে বিবর্তন, যাকে আমরা সভ্যতার উন্নয়ন হিসাবে জানি, সেটির দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, আজকে যা কিছুকে আমরা ফর গ্রান্টেড বা ‘নিশ্চিত জ্ঞান’ হিসাবে মনে করছি, ‘অমোঘ সত্য’ হিসাবে বিশ্বাস করছি, তাও হতে পারে ভবিষ্যতের তুলনায় আজকের এই অপরিণত সময়ের ফাঁদে আটকে পড়া ভুল চিন্তা।

অপরিণত যুগের প্রভাবে বা ভুলভাবে গড়ে উঠা সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষিতে এমনকি বিজ্ঞানের মতো অবজারভেশন এন্ড এক্সপেরিমেন্টনির্ভর জ্ঞানশাখাও ভুল ধরনের জ্ঞানকে প্রমোট করতে পারে। ভুল তথ্য ও তত্ত্বকে সন্দেহাতীত বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবে দাবি করতে পারে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে এটি আমরা জানতে পারি।

argument from error বলে একটা সংশয়বাদী যুক্তি আছে। এর মূলকথা হলো, আজকে যা কিছু আমাদের কাছে ভুল মনে হচ্ছে, অতীতে তার সবকিছুকে আমরা ‘অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবেই’ সঠিক মনে করতাম। তাহলে, আজকে যা কিছুকে আমরা সঠিক মনে করছি, আগামীকাল তার সবকিছুকে, অন্তত এর কিছু অংশকে আমরা ভুল সাব্যস্ত করবো, এমনটি তো হতেই পারে। আর্গুমেন্ট ফ্রম এররের এই এপ্রোচটি মাথায় রাখতে হবে। ইনিশিয়াল প্রপজিশন সঠিক হলেও তাদের সিদ্ধান্তটি ভুল।

আমার এই সঠিক কথাও আগামীতে ভুল হতে পারে, এই স্বীকৃতির মানে হলো, কোনো কিছুরই ফাইনাল গ্যারান্টি বলে কিছু নাই। সংশয়বাদীদের এই যুক্তি, এর পরিণতিতে গিয়ে স্ববিরোধিতায় লিপ্ত হয়। কেননা, কোনো কিছুরই গ্যারান্টি নাই, অন্তত এই কথাটার ফাইনাল গ্যারান্টি কিন্তু তারা অলরেডি দাবি করছে। তারমানে, ‘কোনো কিছুরই ঠিক নাই’ অন্ততপক্ষে এই কথাটা অন্টোলজিক্যালি বা তাত্ত্বিকভাবে সম্পূর্ণ সঠিক। তারমানে, কোনো কিছুই ঠিক নাই– এটি সেলফ-রিফিউটিং বা স্ববিরোধী উক্তি।

এসব কথার মূল কথা হলো, আমাদেরকে সব সময় চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। আমরা সময়ের সীমাবদ্ধতাজনিত ফাঁদে আটকা পড়লাম কিনা, তা বুঝার চেষ্টা করতে হবে। সময়ের গড্ডলিকা প্রবাহে যারা গা ভাসিয়ে চলে তারা নির্বিবাদী জনগণ। সময়ের উর্বরতা ও উপযোগিতা সম্পর্কে যারা সঠিক আন্দাজ করতে পারার পাশাপাশি কাল ও সমাজের সীমাবদ্ধতা ও কূপমণ্ডুকতাগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ্ ধারণা রাখে এবং এরই আলোকে করণীয় নির্ধারণ করে, তারাই কেবল সমাজকর্মী হওয়ার উপযুক্ত। তারা সমাজের আলোকবর্তিকা। লিডার।

সবাই সমাজকর্মী হতে পারে না। সবার সমাজকর্মী হওয়ার দরকারও নাই। কিছু কিছু লোকেরা সমাজকর্মী হবে। তারা মানুষকে সাধারণ কল্যাণের পথে ডাকবে। ন্যায়ের আদেশ দিবে। অন্যায় প্রতিরোধ করবে। তারা সমাজের সেন্টার অব গ্রাভিটি বা ভরকেন্দ্র গঠন করে। এই অল্পকিছু লোকের জন্যই সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব হয়। সমাজটা টিকে থাকে। এগিয়ে যায়।

আফসোস হয়, যখন দেখি আল্লাহ যাদেরকে সমাজকর্মী হওয়ার তৌফিক দেন নাই, তারাও সংগঠন বিশেষে বিশেষ পদাধিকারী হওয়ার কারণে নিজেদেরকে সমাজকর্মী, আসলে সমাজপতি, হিসাবে ভাবতে থাকেন। যুদ্ধ জাহাজের রাডারনির্ভর গতিপথ নির্ধারণ প্রক্রিয়ার মতো সমাজকে যে নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মধ্যে রাখতে হয়, এই অনুভূতির ছিটেফোঁটাও তাদের মধ্যে নাই। তৎসত্ত্বেও এসব সাংগঠনিক নেতারা মেকি সমাজপতি সেজে সমাজ পরিবর্তনে লেগে যান। সমাজকে না বুঝে রাষ্ট্র গঠনে ফানা ফানা হয়ে যান। তাদের অবস্থা ঈমান ছাড়া জিহাদ করার মতো।

এ ধরনের সংগঠনবাদী লোকদের অবলম্বন হলো আইন-কানুনের বই। সবকিছুকে তারা আইনী কাঠামোতে দেখে। বর্ণমালার তালিকায় আইনের পরপরই যে গাইন আছে, একটামাত্র নোকতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা তারা বুঝেন না। আইন-গাইন এসব কথার মানে হলো, আইনমাত্রই উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপটনির্ভর। আইন নিজে হলো একটা শুষ্ক জিনিস। যেমন আমাদের নখ। নখগুলো আঙ্গুল থেকে গজায়, আমরা জানি। তো, নখ দিয়ে চিমটে ধরার আগে পুরো শরীর, বিশেষ করে মগজ দিয়ে বুঝতে হবে এভাবে খোঁচানো বা চিমটি দেয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা।

কোনো বিষয় অথেনটিক কিনা, আইনী ব্যবস্থা নিয়ে অবসেসড লোকেরা এটাই দেখবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এটি (অসম্পূর্ণ অর্থে) ভুল। অথেনটিসিটির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নিছক অথেনটিসিটি দ্বারা কেউ সিরিয়াসলি মিসগাইডেড হতে পারেন। অথেনটিসিটির সাথে সাথে দেখতে হবে উক্ত মতাদর্শের গ্রেটার স্পেকট্রাম বা ব্রড বাউন্ডারির মধ্যে এই স্পেসিফিক বিষয়টা ঠিক কোন জায়গাতে কীভাবে আছে। অর্থাৎ, অথেনটিসিটির পাশাপাশি দেখতে হবে টোটালিটিকেও। আইনের বৃহত্তর পরিমণ্ডল ও মতাদর্শের টোটাল সিনারিওটা সব সময়ে নজরে রাখতে হবে। নচেৎ, কোনো কিছুর অথেনটিক রেফারেন্স বা ভিত্তি সঠিক থাকা সত্ত্বেও কাজটা শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য অথেনটিক না হয়ে উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আইনের বিশেষ কোনো নির্দেশকে তৎপূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট ও পরবর্তী করণীয়ের আলোকে বুঝতে হবে। আইনের ভিত্তি, ধারাবাহিকতা ও প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি আইনের বিশেষ কোনো কোনো ধারার খণ্ডিত প্রয়োগ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, বুঝতে হবে তিনি টোটালিটি বা সামগ্রিকতার নীতিকে ভংগ করছেন। পরিণতি হলো চরমপন্থা অবলম্বন। ধর্মীয় বা মতাদর্শগত শুদ্ধতাবাদের নামে যেসব চরমপন্থী যত্রতত্র বোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যা করে, তারা বরং ‘সুশীল’ চরমপন্থীদের তুলনায় ভালো। তারা মেন্টালি ক্র্যাক, কিন্তু হিপোক্রেসি মুক্ত। এ ধরনের সরলমনা এক্সট্রিমিস্টদেরকে চিহ্নিত করা যায়। নিন্দা করা যায়। প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু ধর্ম বা মতাদর্শের বই-কিতাব ঘেঁটে যারা প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতিবিযুক্ত বিশেষ কোনো মতকে নিজের বিকৃত রুচির কারণে যুৎসই মনে করে তা সমাজের ওপর বলপূর্বক কায়েম করতে চায়, তারাই আসল জংগী। অতিবিপ্লবী। প্রতিক্রিয়াশীল ও চরমপন্থী।

আমি ইসলামী আদর্শের পক্ষভুক্ত। তাই ঠিক সেভাবেই কাজ করতে চাই যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা) স্বয়ং কাজ করেছেন। এ জন্য অথেনেটিসিটি এবং টোটালিটির সাথে সাথে আমি আর একটা জিনিসের ওপর খুব গুরুত্বারোপ করি। সেটি হলো গ্র্যাজুয়ালিটি বা ক্রমধারা। ভালোমন্দ মিলিয়ে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বে খেলাফত ব্যবস্থা বলবৎ ছিলো। এরপর হতে প্রায় একশ’ বছর ধরে ইসলামী আন্দোলনের নামে মূলত খেলাফত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রভাব তৈরি করলেও মূল লক্ষ্য হাসিলের দিক থেকে তা ওভারঅল ব্যর্থ হয়েছে। ইংরেজদের শাসন হতে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরে দারুল উলুম দেওবন্দ এবং আলীগড় স্কুল প্রতিষ্ঠার মতো এখন সময় এসেছে নতুন ধারায় ইসলামী আন্দোলন শুরু করার।

নতুন ধারায় ইসলামী আন্দোলনের প্যাটার্ন বা ফ্লেভার কেমন হবে, তা নিয়ে আমার বিস্তর লেখালেখি আছে। গত দশ বছর ধরে আমি লিখছি। ইচ্ছা আছে, এগুলোকে গ্রন্থাকারে সংকলন করার। বুঝতেই পারছেন, সমাজগঠনের এই নতুন ধারা নিছক আইনী কাঠামোভিত্তিক হবে না। বরং তাতে লিগ্যাল অথেনটিসিটির পাশাপাশি আইডিওলজিক্যাল টোটালিটি এবং গ্র্যাজুয়াল এডাপ্টিবিলিটির ওপর যথোচিত গুরুত্বারোপ করা হবে। যে বা যারাই এই কাজ করুক না কেন, তাকে বা তাদেরকে অথেনটিসিটি, টোটালিটি ও গ্র্যাজুয়ালিটি, এই তিন নোশনকে সমবিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। আমার ইতোপূর্বকার ‘সমাজকর্মী হতে চান? আসুন, সব ধরনের কালচারাল বার্ডেন হতে নিজেদের মুক্ত করি’  শীর্ষক লেখাটার ফলোআপ হিসাবে এটি লেখা।

আগ্রহ ও সময় থাকলে আলোচ্য বিষয়ে আপাতত এই লেখাগুলো পড়তে পারেন:

১. ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন

২. ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা

৩. কাজের অগ্রাধিকার ও ক্ষেত্র নির্ণয়ে ইসলাপন্থীদের প্রান্তিকতা ও বিভ্রান্তি

৪. আদর্শবাদীদের চিন্তা ও কাজের মডেল

৫. অন্যান্য মতাদর্শের সাথে সম্পর্কের দিক থেকে ইসলামের ইতিবাচক অনন্যতা

৬. মানুষ আর জনগণের মধ্যে জীবনাদর্শগত পার্থক্য

৭. ইসলাম অনুসরণের ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল বনাম এসেনশিয়াল হুকুমের পার্থক্য বুঝার গুরুত্ব

৮. সুষম সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নৈতিকতা, স্বার্থ ও প্রবৃত্তির মধ্যে সমন্বয়ের অপরিহার্যতা

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *