আলোচনার প্রেক্ষাপট: ‘নারী অধিকার প্রসঙ্গে শরীয়াহর নির্দেশ বনাম নির্দেশনা’ এবং ‘যৌথ পরিবার ব্যবস্থা প্রসংগে ‘ইসলামী নারীবাদ’ বিষয়ক কিছু অনুক্ত বয়ান-বৃত্তান্ত’ শীর্ষক লেখা দুটো সম্প্রতি ফেসবুকে শেয়ার দেয়ার পর বিষয়গুলো নিয়ে দুজন ছাত্রীর সাথে কয়েক সেশনে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই আলাপচারিতাটি এ রকম একটি সেশনের ফেয়ার ট্রান্সক্রিপ্ট। কোনো কিছু প্রবন্ধাকারে লেখা আর কোনো আলোচনার লিখিত রূপ– এ দুটো ভিন্ন প্যাটার্নের জিনিস, যদিও কনটেন্ট একই। যাইহোক, ভাবলাম এটিও পাবলিশ করি। অন্তত একজন সমঝদার পাঠকও যদি পাওয়া যায়।
সিএসসিএস কী ধরনের এক্টিভিজম করতে চায়, আমার কনসিসটেন্ট এফোর্ট হতে তা হয়তো আন্দাজ করা যাবে। প্রচলিত থিংক-ট্যাংকগুলোর মতো আমরা শুধু আইডিয়া দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবো না। সিএসসিএস, বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আমি এক্টিভিজম করবো। এমনকি বর্তমান বিরূপ পরিবেশেও তা অব্যাহত রাখছি। যদিও এসব তৎপরতা তথা এক্টিভিজম একান্তই বুদ্ধিবৃত্তিক। এই কাজে সূরা তওবার ১২২ নং আয়াতটাকে আমি গাইডিং প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে মেনে চলি।
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
অর্থ: “আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।”
সারসংক্ষেপ:
(১) ইসলামে সম্প্রদায় পরিচয়কে নয়, সাম্প্রদায়িকতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(২) অন্য দ্বীনের অনুসারীদের পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ।
(৩) ভাষা, বর্ণ এবং জাতি ও গোত্রভিত্তিক পরিচয়কে অনুমোদন করা হয়েছে।
(৪) পুরুষের বিশেষ পোশাক পরা নারীদের জন্য যেমন নিষিদ্ধ তেমনি নারীদের এক্সক্লুসিভ পোশাক পরা পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ।
(৫) কমন প্যাটার্নের পোশাক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরতে পারবে।
(৬) বাঙালি সমাজে মেয়েদের জিন্সের প্যান্ট পরা যতটা বেমানান, লুংগি পরা তারচেয়ে কম বেমানান নয়। অথচ লুংগি, তাও সেলাইবিহীন, ছিল রাসূল (সা) ও তাঁর সহধর্মিনীসহ তদানীন্তন আরব নারী-পুরুষের অন্যতম কমন পোশাক।
(৭) পাতলা কাপড়ের সালোয়ার পরার চেয়ে আঁটোসাঁটো নয়, এমন জিন্সসহ যে কোনো মোটা কাপড়ের প্যান্ট নারীর ইসলামসম্মত পোশাক হিসাবে ভালো (better)।
আলোচনাটির অডিও শুনুন
জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা ও জাত্যাভিমানের মধ্যে পার্থক্য কী?
ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে নিষিদ্ধ করেছে। যেটাকে জাত্যাভিমান বলা হয়। অর্থাৎ, আমার জাতি, আমার এলাকা এটাই সেরা– এমন মনে করাটা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু জাতিগত যে পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য সেটাকে কিন্তু ইসলাম অনুমোদন করেছে। কোরআন শরীফে এ সংক্রান্ত দুইটা আয়াত আছে:
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
অর্থ: “তাঁর আরো এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (সূরা রূম: ২২)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থ: “হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ (আদম) এবং একজন নারী (হাওয়া) থেকে (এদিক দিয়ে তোমরা সকলেই সমান), আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। বস্তুত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদাশীল সে ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরহেজগার।” (সূরা হুজরাত: ১৩)
একটা আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে আমি নানা বর্ণ ও ভাষা দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ আরেকটা আয়াতে আছে, ‘আমি বিভিন্ন গোত্র এবং জাতিগতভাবে আলাদা করে সৃষ্টি করেছি যাতে তারা পরস্পর পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারে।’
আমাদের মধ্যে কোনো ডিফারেন্স যদি না থাকে, আমরা যদি সব একই রকম হই, তাহলে আমরা কীভাবে পরিচিত হবো? এর পাশাপাশি আবার আরেকটা হাদীস আছে, কেউ যদি নিজের সম্প্রদায়ের দিকে কাউকে আহবান করে তাহলে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। হাদীসে এ নিয়ে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। মসজিদে নববীতে একবার আওস ও খাজরাজ গোত্রের দুজন সাহাবীর মধ্যে ঝগড়া লাগলো। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মারামারি লাগার উপক্রম হলো। তখন তারা নিজ নিজ গোত্রের মানুষদেরকে সাহায্য করার আহবান জানালো। এমনকি যার যার পক্ষের লোকেরা নিজেদের পক্ষে দাঁড়িয়েও গেলো। এভাবে একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর রসূল (সা) এসে যখন ঘটনা দেখলেন, তখন তিনি তাদেরকে থামালেন এবং উপরোক্ত কথাটা বললেন।
তাহলে, এটার মানে হচ্ছে আমি আমার জাতির কথা বলতে পারবো, আমি আমার এলাকার কথা বলতে পারবো। আমার ভাষা, আমার পরিচয় (Identity) এগুলোর চর্চা ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো যতক্ষণ না আমি কোনো সীমালঙ্ঘন করি। অর্থাৎ, ন্যায়-অন্যায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো জাতি, বর্ণ, ভাষা, পরিচয় কাউকে বিশেষ সুবিধা দেবে না। এর পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে, ইসলাম মানুষের জাতিগত পরিচয়কে বহাল রেখেছে। কোরআন শরীফের উপরোক্ত দুইটা আয়াত থেকে তা স্পষ্ট। ফলে আমাদের মাঝে পপুলার যে রেটরিক কাজ করে, ইসলামপন্থীরা কথায় কথায় যেসব বলে, সেগুলো আসলে বাস্তবসম্মত নয়। যদিও তা খুবই এস্টাবলিশড।
আলেম-উলামারা গণহারে বলাবলি করার কারণে সাধারণ লোকেরা মনে করে– হ্যাঁ, এটাই হয়তো সত্য, জাতীয়তাবাদ তো হারাম, ইসলাম জাতীয়তাবাদকে অনুমোদন করে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে বলেছেন, আমি মানুষকে নানা ভাষা ও বর্ণে সৃষ্টি করেছি। আল্লাহ তায়ালা জিনিসটাকে পজিটিভলি বলেছেন। আর আমরা জিনিসটাকে নেগেটিভলি নিচ্ছি এই অর্থে যে, সাম্প্রদায়িকতা ভালো নয়। আচ্ছা, জাতীয় পরিচয় অর্থে জাতিয়তা আর সাম্প্রদায়িকতা বা জাত্যাভিমান (Chauvinism) কি একই জিনিস? নৃতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক জাতিগত পরিচয়ের দিক থেকে যেমন আমরা বাঙ্গালী, তেমনি কেউ পাকিস্তানী, কেউ ভারতীয়, কেউ আরব, কেউবা ইউরোপীয়। তো এই জাতিগত পরিচয়টা কি ইসলাম অস্বীকার করে? আমি কোথাও সেটা পাইনি।
হাদীসে তো আরব-অনারবদের কথা বলা হয়েছে…
কেন, রাসূল (সা) চুক্তি করেছেন না? মদিনা সনদ তো গোত্রগুলোর মাঝে সম্পাদিত পারস্পরিক চুক্তির সংকলন। গোত্র পরিচয়ও তো এক ধরনের জাতিগত পরিচয়। তাই না?
হ্যাঁ, গোত্র পরিচয় তো ছিলো। আর কোরাইশদের মর্যাদা ছিল তখন সবার উপরে…
হ্যাঁ। কোরাইশদের মর্যাদা নিয়ে যে কথা বলা হয়েছে, তাতেও কিন্তু কোরাইশদের ‘কোরাইশ’ পরিচয়কে মেইনটেইন করা হয়েছে। আমরা বাঙ্গালিরা ভাত খাই। যারা নানা কারণে কয়েক দিন ভাত খেতে না পারে, তাদের কলিজা নাকি ফেটে যায় ভাত খাওয়ার জন্য। দুনিয়াতে বহু এলাকার লোকেরাই ভাত খায়। একটু করে ভাত খায়। আমরা যেমন একটু করে তরকারী খাই, তেমন। এখন যারা ভাত খায় আর যারা ভাত খায় না– এদের মাঝে কারা ভালো? ভাত খাওয়া না খাওয়ার মাঝে কোনটা ভালো? আসলে এগুলো তো ভালো-মন্দের বিষয় নয়। এগুলো খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও পরিচয়ের বিষয়। যেহেতু সাম্প্রদায়িকতা বা স্বজনপ্রীতি খারাপ তাই যুক্তি দেয়া হয়, জাতীয়তাভিত্তিক পরিচয়ই খারাপ। এমন হলে তো সবকিছুকেই খারাপ বলতে হবে। দুনিয়াতে প্রত্যেকটা ভালো জিনিসেরই কিন্তু একটা খারাপ প্রয়োগ আছে। এমনকি ইসলামেরও একটা খারাপ দিক আছে। ইসলামের অনুসরণের ক্ষেত্রে এর খারাপ দিকটা হচ্ছে নিফাক। নিফাক হলো ঈমানের অপপ্রয়োগ, এই অর্থে যে ঈমানের দাবিদার হয়ে এর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলো নিচ্ছে অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে ঈমান নাই। ঈমানের নামে প্রতারণা। প্রত্যেকটা ভালো জিনিসেরই কিন্তু মন্দ প্রয়োগ অর্থে অন্তত একটা হলেও খারাপ দিক আছে।
যেমন?
যেমন দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো জিনিস ইসলাম। কিন্তু এটিরও একটা খারাপ প্রয়োগ কেউ কেউ করে। যাদেরকে বলা হয় মুনাফিক। নিফাক কিন্তু বাহ্যিক দিক থেকে ইসলাম ও কুফরের বাইনারীতে ইসলামেরই ব্যাপার, অথচ এটি ইসলামের একটা অপপ্রয়োগ। ইংরেজিতে যাকে malpractice বলে। ইসলামকে ইসলামের মতো করে গ্রহণ না করে ভিন্নভাবে নেওয়া, অথচ নিজেকে ইসলাম অনুসারী তথা মুসলিম দাবি করা– এটি ইসলামের একটি অপপ্রয়োগ।
কিন্তু সেটা তো নিষেধ করা হয়েছে…
হ্যাঁ, সেটা নিষেধ করা হয়েছে। একটা ভালো জিনিসের খারাপ প্রয়োগ তো নিষিদ্ধ হবেই। সেটা কেন অনুমোদন করা হবে? এমন কোনো ভালো জিনিস নাই, হতে পারে না যার কোনো অপ্রপ্রয়োগ মানুষ করে না। মানুষ এমনি এক পিক্যুলিয়ার চিজ। কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, মানুষ হচ্ছে ‘জালুমান জাহুলা’ (শ্রেষ্ঠ জালেম)! এরা যে কোনো জিনিসের একটা খারাপ প্রয়োগ করার পথ বের করবেই।
এ কথাটা এজন্য আসলো যে, আমাদের যে জাতিগত পরিচয়, এথনিক বা কালচারাল আইডেন্টিটি, এমনকি আমাদের পোশাকের মধ্যেও কিন্তু এগুলোর রিফ্লেকশান ঘটবে। যে জাতির লোকেরা যে ধরনের পোশাক পরে, সেখানকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ের পোশাকে সে এলাকার আঞ্চলিক প্যাটার্নের একটা ছাপ থাকবেই। একে আমরা সাংস্কৃতিক কারণ বলতে পারি। আবার এই পার্থক্য ও বৈচিত্র্যের ভৌগলিক বা পরিবেশগত কারণও আছে। যেমন, আরবে অনেক বেশি গরম পরে। কড়া রোদটা যাতে গায়ের সাথে না লাগে সেজন্য তারা মাথা থেকে একদম পা পর্যন্ত ঢেকে রাখে।
অনেকে বলে পাঞ্জাবী নাকি হিন্দুদের পোশাক, আর রাসূল (সা) যা পরতেন সেটা নাকি জোব্বা ছিল?
রাসূল (সা) কী পরতেন সেটা ভিন্ন আলোচনা। এ বিষয়ে একটু পরে বলছি। তো যা বলছিলাম, আরব অঞ্চলের লোকদের যারা আমাদের দেশে আসে বা ইউরোপে যায়, কিংবা আরবের বাইরে যায় তারা কিন্তু তখনো সেই ধরনের আপাদমস্তক ঢাকা পোশাকই পরে, এমনকি পুরুষেরাও। তারা সেটা কেন করে? কারণ হলো, সেটা তাদের কালচারাল প্র্যাকটিস। আমাদের দেশের পুরুষেরা যখন ইউরোপ, আমেরিকা বা বিদেশে যায় তখন ব্যাগের মধ্যে একটা লুঙ্গি নিয়ে যায়। কারণ, সারাদিন প্যান্ট পরে থাকার পর ঘরের মধ্যে লুঙ্গি না পরলে তাদের নাকি ভালো লাগে না। গতকাল আমি একজনের সাথে কথা বলতে গেলাম। তিনি হজ্ব করে এসেছেন আর কি। তিনি বললেন– হজ্বের মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে কিছু লোককে দেখলাম কাবা শরীফ তাওয়াফ করছে, তাদের পরিধানে ছিল ধুতি! আমি উনাকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কনফার্ম করলেন– হ্যাঁ, সত্যিই তিনি এ রকম লোক দেখেছেন। তারা ইন্ডিয়ান। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম– এই যে তারা ধুতি পরেছে, এর ফলে তাদের সতর কি ঠিক ছিল? তিনি বললেন– ধুতিটা কয়েক প্যাঁচ দিয়ে পরলে সতর কেন দেখা যাবে? আমরা নিজেরাই তো সেলাইবিহীন লুঙ্গি পরে সেখানে কয়েকদিন কাটিয়েছি।
উনারা কি মুসলিম ছিলো?
মুসলিম হবে না মানে? কি বলো! কাবা শরীফে কি অমুসলিম কেউ যেতে পারে নাকি?
তাহলে ধুতি পরে ছিল যে?
কারণ এটাই তাদের পোশাক। তারা এতেই অভ্যস্ত।
বাংলাদেশে…
না, এখন বাংলাদেশে যা হচ্ছে সেটা কালচারাল কারণে হচ্ছে। আর তখন যা হয়েছে, সেটা কিন্তু আমাদের ভৌগোলিক কারণে হয়েছে। দেখো, বৃষ্টি-কাদামাটি এলাকার মানুষ কি আপাদমস্তক লম্বা কাপড় পরবে? নাকি গোছ মেরে চলা যায়, তেমন কাপড় পরবে? যাহোক, প্রাথমিকভাবে পরিবেশের কারণে একটা কিছু গড়ে উঠে। কিন্তু পরবর্তীতে সেটা সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ করে। কালচারাল হয়ে উঠার পর এনভাইরনমেন্ট চেঞ্জ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এর চর্চা রয়ে যায়।
যেমন, আমরা ইউরোপের কথাই ধরি। শীতপ্রধান দেশ। অথচ সেখানকার মেয়েরা স্কার্ট পরে, যেটা তাদের জন্য ফিজিকেলি খুবই অসুবিধাজনক। সেখানকার অধিকাংশ মেয়েরাই হাই হিল পরে, যদিও তারা এশিয়ান মেয়েদের চেয়ে টল ফিগার। স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করার ক্ষেত্রে হাই হিল জুতা অসুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিছক সাংস্কৃতিক কারণে সেটাই বেশি পরে। আমাদের দেশের মেয়েরা যে ধরনের পোশাক পরে, যেমন শাড়ি, এর তুলনায় সালোয়ার কামিজ ভালো। কিন্তু আমি ওখানে লিখেছি, জিন্সের প্যান্ট আটোসাটো না হলে এটি তুলনামূলকভাবে পাতলা ও স্বচ্ছ কাপড়ের তৈরি সালোয়ার-কামিজের চেয়ে ভালো। এখন, মেয়েরা জিন্সের প্যান্ট পড়বে বা পড়তে পারবে বা পড়লে ভালো হবে– কথাটা কেমন স্টানিং মনে হচ্ছে, কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাই না?
তাহলে এবার দেখা যাক আল্লাহর রাসূলের স্ত্রীগণ ও মহিলা সাহাবীরা কী পরতেন? তাঁরা তো সেলাইবিহীন লুঙ্গিও পড়তেন! তাঁরা তো সাধারণত সালোয়ার-কামিজ পড়তেন না। কেউ কেউ পড়তেন অবশ্য। আসলে তারা অনেকেই এতোটা ধনী ছিলেন না। কখনো দেখা যেতো এক টুকরো কাপড় ‘পারিবারিক পোশাক’ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। শুনতে খুব অন্যরকম লাগছে! তাই না? এক প্রস্ত কাপড়, সেটাকে প্যাঁচিয়ে পুরুষ সদস্য লুঙ্গি হিসেবে পরেছে, কখনো চাদর হিসেবে পরেছে। কখনো আবার একই কাপড় খণ্ডকে পরিবারের মহিলারা লুঙ্গি হিসেবে পরেছে! কখনো অন্য একটা কাপড়ের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে, বিশেষ করে নামাজের সময় মাথা ইত্যাদি ঢাকার কাজে ব্যবহার করেছে। মানে একই কাপড় হচ্ছে ওড়না, একই কাপড় হচ্ছে লুঙ্গি, একই কাপড় হচ্ছে সবকিছু।
তখন এতো কাপড় ছিল না। হযরত ওমরের (রা) একটি ঘটনা আছে। তিনি একটা জোব্বা সেলাই করেছিলেন তাঁর ছেলের কাপরের অংশ দিয়ে…।
আচ্ছা, এরপরেও তারা… মানে এতো বেশি ধনী ছিলো না আর কি…।
এখন হচ্ছে কি, কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন এই টাইপের কথা বলে যে– মুসলিম মেয়েরা… মুসলিম বলতে (যদিও তারাও তো মুসলিম) আসলে যারা ইসলামকে অনুসরণ করে, তারা হচ্ছে অপচয়কারী। একটা ঢোলা কাপড় পরে, বোরকা পরে, স্কার্ফ পরে, উপরে আবার ওড়না পরে। একটা বোরকা দিয়ে পাঁচ জনের ড্রেস বানানো যায়…।
এগুলো মতলবি কথাবার্তা। আমরা একটা একটা বিষয় আগে ক্লিয়ার করি। এই কথাটা আমি এ জন্যে বলছি যে, জাতীয়তা ও জাতীয় পরিচয় একটা ন্যাচারাল ফেনোমেনা। এটাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু জাত্যাভিমান, স্বজনপ্রীতি বা সাম্প্রদায়িকতা এগুলো হচ্ছে জাতীয়তার নেতিবাচক চর্চা। একেকটা জাতির লোকেরা একেক ধরনের পোশাক পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই পোশাক পড়তে গিয়ে তাদের যে জাতিগত স্বকীয়তা সেটা যাতে অবশ্যই বহাল থাকে। তার মানে হচ্ছে, একজন মুসলিমের পোশাকে নৃতাত্ত্বিকভাবে অমুসলিমের সাথে যে মিল সেটা থাকুক, কিন্তু অমুসলিমের ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে যেন মিলে না যায়।
এই যে, আমার সামনে একটা গ্লাস ও মগ। ধরি, এর একটা মুসলিম, আরেকটা অমুসলিম। এটির মধ্যে পানি, চা ইত্যাদি রেখে খাওয়া যায়। আর এটার মধ্যেও পানি, চা ইত্যাদি রাখা যায়। এই দুইটার মিল আছে অনেক, কিন্তু অমিলও আছে। সেটা হলো– এটা হচ্ছে মূলত একটা গ্লাস, আর এটা হচ্ছে মূলত একটা মগ। তো, একজন মুসলিম যখন একজন অমুসলিমের সাথে ইন্টার্যাকশনে আসে, তখন কি সব সময়ে কনফ্লিক্টে লিপ্ত থাকা লাগবে? অমুসলিম ব্যক্তিও তো তার নিজের এলাকারই মানুষ। নিজস্ব লোক। তার ভাষাতেই কথা বলে। তার দেখতে মতোই।
কিন্তু স্বকীয়তা থাকতে হবে না?
স্বকীয়তা থাকার মানেটা কী? এর মানে হচ্ছে বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অর্থাৎ, একজন অমুসলিম যেসব কাজ তার ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে করে – যা জাতিগত বিশ্বাসের পরিচয় নয় – সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া।
একটা বিষয় আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। সেটা হচ্ছে, অনেককেই বলতে শুনেছি– জিন্সের প্যান্ট বা স্কার্ট ইত্যাদির মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ করা, এগুলো কোনোভাবেই জায়েজ নাই। কিন্তু স্কার্ট অনেক বড় করে পরা হলে তো বোরকার কাজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কি কোনো সমস্যা আছে?
আমার আর্টিকেলটার মধ্যে হয়তো দেখে থাকবে– নারীরা যেটাকে বলে সালোয়ার আর পুরুষরা যেটাকে বলে পাজামা, এ দুটোর মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দুটো একই জিনিস।
বলা হয়েছে পুরুষদের পোশাকের অনুরূপ পোশাক না পরতে, বিজাতীয়দের পোশাকের অনুরূপ পোশাক না পরতে…।
হ্যাঁ, এই কথাগুলো সঠিক। কিন্তু এর মানে বুঝতে গিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে তা তাহলো, পুরুষও একজন মানুষ, নারীও একজন মানুষ…।
এটা নিয়ে অনেক কথা হয়। যেমন আমরা যারা ব্যক্তিগতভাবে বোরকা-নিকাব পরি, বাইরে গেলেই শুধু এভাবে চলাফেরা করি। তো আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা প্রাইভেট পরিবেশে লং স্কার্ট বা ফুলহাতা ফতুয়া পরি তখন মেয়েদেরই অনেকে নানা কথা বলে আর কি…।
দেখা যাচ্ছে, মুসলিম-অমুসলিম যখন পরস্পর মেলামেশা করবে তখন অমুসলিম যে কাজটা ইসলামের বিরোধিতা এবং নিজ ধর্মের বিশেষ করণীয় হিসেবে করে থাকে, মুসলিম ব্যক্তি ঐ কাজটা করবে না। যেমন– হিন্দু পুরুষেরা এক ধরনের টুপি পরে, দেখতে অনেকটা নৌকার মতো। তুমি দেখেছো কিনা জানি না, আমাদের এখানকার হিন্দুরা পরে। আমরা যে গোল টুপি পরি, ও রকম টুপি কিন্তু তারা পরে না। এখন এই নৌকার মতো টুপি যে এলাকায় শুধু হিন্দুরাই পরে, সেখানকার মুসলমানদের এটা পরা উচিত নয়। যেমন বৃটিশ আমলে বৃটিশরা ছিল অমুসলিম। তারা প্যান্ট-শার্ট পরতো। তখনকার আলেমরা ফতোয়া দিয়েছিলেন– মুসলমানরা প্যান্ট-শার্ট পরতে পারবে না, এটা কাফেরদের পোশাক। এখন ইউরোপে যেসব মুসলমান বসবাস করে, যারা হয়তো সেখানে জন্মগ্রহণ করেছে কিংবা এখান থেকে গেছে। বিশেষ করে সেখানে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা তো স্বীয় অঞ্চলের পোশাক প্যান্ট-শার্টই পরবে। সেখানে তারা কি তথাকথিত কোনো ‘ইসলামী’ পোশাক পরবে?
আমার একটা বান্ধবী তামিরুল মিল্লাতে পড়তো। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর জার্মানিতে চলে গেছে। ও দেশে থাকতে একটা ইসলামী সংগঠন করতো। খুব ভালো মানের ছিলো। ওখানে যাওয়ার পর ও তো আর বোরকা পরতে পারছে না। আমাকে ছবি পাঠিয়েছিল। স্কার্ট পরা। এদিকে আমার তখনকার রুমমেট আবার সংগঠন করতো। ও ছবি দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। আমি বলেছি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস করার তো কিছুই নাই। ওর তো এখন এগুলোই পরতে হবে। ও বাইরে বের হয়েছে স্কার্ট পরে, হিজাব পরে আর কি…।
আচ্ছা, স্কার্টের বিষয়টাতে আসা যাক। স্কার্টের মধ্যে যদি আমরা লং স্কার্টের কথা বলি… মিনি স্কার্টে যেহেতু শরীর দেখা যায়, সুতরাং সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা যেটাকে বলি ঘাগরা, লং স্কার্ট সেই একই জিনিস। আমরা যেটাকে বলি মেক্সি, মেক্সিটা হচ্ছে continued। আরেকটা জিনিস কি জানো? ইসলামপন্থীদের কাজের মধ্যে যেসব বড় ধরনের ত্রুটি আছে তার মধ্যে অন্যতম একটা ত্রুটি হচ্ছে, মানুষের জন্য ইসলামকে natural way and practice of life হিসেবে না নিয়ে way of salvation in the afterlife হিসেবে বিবেচনা করা। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। একটা হচ্ছে পরকালীন মুক্তির উপায়। আরেকটা হলো, এই জীবনকে সুন্দরভাবে যাপনের উপায়। এ দুটোকে either-or এর বাইনারীতে দেখাটাই ভুল।
ইসলামকে তারা উপস্থাপন করে পরকালীন মুক্তির উপায় হিসেবে, যেখানে ইহকালকে তারা অবহেলা করে। আল্লাহ তায়ালা কিন্তু বলেছেন, ‘আমি মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ আবার রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের শষ্যক্ষেত্র।’ আর দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতারা যখন বলেছে, ইবাদতের জন্য তো আমরা আছি। আল্লাহ তখন বলেছেন, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। অর্থাৎ, মানুষকে আমি এখানে একটা খেলাফত দিবো, দুনিয়া পরিচালনা করার জন্য। তাহলে দুনিয়া কারা পরিচালনা করবে? মানুষেরাই করবে। মানুষের মধ্যে কারা? ঈমানদারেরা। তার মানে মুসলমানেরা জন্মগতভাবেই নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিসিক্ত। যে ব্যক্তিকে সৃষ্টি করাই হয়েছে এই দুনিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, সমাজ ও জাতি গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সে তার কর্মক্ষেত্রকে বাদ দিয়ে কীভাবে পরকালীন সফলতা লাভ করবে?
এবার পরকালে সফলতার ক্ষেত্রে আসা যাক। যত আমলই আমরা করি না কেন, পরকালীন নাজাতের জন্য তা অপর্যাপ্ত, কিছুই নয়। শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা একান্তই নিজ অনুগ্রহে যদি নাজাত দেন, তবেই আমরা নাজাত বা মুক্তি পেতে পারি। আমল হচ্ছে উসিলা মাত্র, আপাত শর্ত। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর মহান সত্তার বিপরীতে কোনো কিছুরই ন্যূনতম প্রকৃত মূল্য (intrinsic value) নাই। তাই কোনো আমল দিয়ে কেউ নাজাত পেতে পারে না। রাসূল (সা) এটাই বলেছেন তাঁর পরিবারের মহিলাদেরকে। তিনি বলেছেন, ‘হে সাফিয়া! তুমি আল্লাহর রাসূলের ফুফু। ভেবো না এজন্য তুমি পার পেয়ে যাবে। হে ফাতিমা! তুমি আল্লাহর রাসূলের মেয়ে। কিন্তু ভেবো না এজন্য তুমি কোনো বিশেষ সুবিধা পাবে। তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করো। অন্ততপক্ষে একটা খেজুরের অর্ধেক হলেও দান করে তোমরা সেই চেষ্টা করো।’ এখানে চ্যারিটির কথা বলা হয়েছে। তোমার যদি উপার্জনই না থাকে, তাহলে তুমি দান-খয়রাত করবে কোত্থেকে? আর তুমি কীভাবে উপার্জন করবে যদি তুমি কামাই-রুজি অর্জনের জন্য আদতেই যোগ্য না হও?
যে কথাটা বলার জন্য আমি এতো কথা বললাম সেটা হলো– কোনো একটা আইডিওলজিকে যদি মানুষের জন্য উপযুক্ত আইডিওলজি হতে হয়, তাহলে এর মধ্যে প্লুরালিটি থাকতে হবে, আনন্দময়তা থাকতে হবে, প্যাশন এন্ড ফ্যাশন থাকতে হবে। সাধারণ ইসলামিস্ট কিংবা হুজুরেরা যেসব কথাবার্তা বলেন সেগুলো মানুষের কাজে লাগে না কেন? কারণ, তারা এমন এক ভাষায় বলে যে ভাষা লোকেরা বুঝে না। কিংবা বুঝলেও দূরের অর্থটা বুঝে, কাছেরটা বুঝে না।
মানুষকে ফ্যাশনের অনুমতি ও সুযোগ দিতে হবে। একে চর্চা করতে হবে। এর মধ্যে আনন্দময়তা থাকতে হবে। উদাহরণ হিসাবে হিন্দু ধর্মের কথা বলা যায়। এই ধর্মের মধ্যে কোনো রকমের যুক্তি নাই। যুক্তি ছাড়া এটি টিকে আছে কীভাবে? এর প্রবল সাংস্কৃতিক শক্তির বলে, বিশেষ করে বিনোদন সংস্কৃতির বলে।
ইসলামপন্থীরা সংস্কৃতি নিয়ে যখন কথা বলে, তখন বিনোদন তথা আনন্দময়তার দিকটা বাদ দেয়। ভাবখানা এমন যে… ঐ যে একটা গল্প আছে– বাচ্চাটা ট্যাবলেট খেতে চাচ্ছে না। তো ওর মা করেছে কি, মিষ্টির মধ্যে ট্যাবলেটটা ঢুকিয়ে দিয়ে ওকে বলেছে, তুমি মিষ্টিটা খাও, আমি ওইদিকে তাকিয়ে আছি। খাইছো? হ্যাঁ, খাইছি। পুরোটা খাইছো? না, বিচিটা ফেলে দিছি। তো, খেয়াল করলে দেখবে, মানুষ কালচার কথা বললে ইসলামপন্থীরা মাওলানা মওদূদীর ‘ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা’, আবদুল মান্নান তালিবের ‘ইসলামী সাহিত্য: মূল্যবোধ ও উপাদান’, মানুষের জীবন যাপনের সংস্কৃতি, খাওয়া-দাওয়ার সংস্কৃতি, ঘুমানোর সংস্কৃতি– এইসব নিয়ে আলোচনা নিয়ে আসে। আরে এগুলো তো বৃহত্তর অর্থে সংস্কৃতি। কিন্তু সংস্কৃতির স্পেসিফিক ইন্টারপ্রিটেশনটাই তো হচ্ছে বিনোদন সংস্কৃতি। সেটা কই? বিনোদন সংস্কৃতির একদম প্র্যাকটিক্যাল সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা হবে, সেসব নিয়ে ওসব বইয়ে তেমন কিছু পাই নাই। তারা বলেন– না, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে কী ব্যবহার করা যাবে? দফ ব্যবহার করা যাবে। দফ মানে হচ্ছে, একপাশে খোলা ঢোল। তো ঠিক আছে, তারা দফই ব্যবহার করেন না কেন? আসলে তারা ভিতরে ভিতরে মানবিক আনন্দময়তারই বিরোধী।
তখন ইসলামটা মানুষের কাছে অনেক কঠিন হয়ে যায়…।
কঠিন ব্যাপার এবং নিছক পরকালীন মুক্তির একটা ব্যাপার হিসাবে গণ্য হয়। এই অবস্থায় মানুষ মনে করে– ঠিক আছে, পরকালীন মুক্তির ব্যাপারে যা হওয়ার হবে, এখন আমি ইহকালে আগে ঠিক মতো থাকি। অথচ, ইসলাম এসেছে জগতকে পরিচালনা করতে, মুসলমানেরা যার নেতৃত্ব দিবে। মানুষকে আনন্দময়তা দিতে চাইলে বৈচিত্র্যবোধকে অনুমোদন দিতে হবে। নিছক এবাদত-অর্চনা ছাড়া খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, ভাষা, পারস্পরিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে মানুষকে তার মতো করে চলতে দিতে হবে। আচ্ছা, ইসলাম আসলে এই পোশাকটাই বা কেন দিয়েছে? প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেরই কিছু অলিখিত টেক্সট, নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ থাকে। এর জন্য ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে– public sphere। বাংলায় যাকে জনপরিমণ্ডল বলা হয়। অর্থাৎ, এইটা, স্পেসিফিক এই লেখা, এই কথা, এই বই, এগুলোই– এভাবে কিছু নয়। কিন্তু সবকিছু মিলিয়েই এর একটা আমেজ, রূচি ও আবহ গড়ে ওঠে।
পাশ্চাত্য মডেলে গড়ে উঠা এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে একটা আবহ তৈরি হয়েছে যে, সৎ হতে হলে আমাদেরকে প্রকৃতির মতো হতে হবে, as like as ‘mother-nature’। এগুলো কিন্তু এক ধরনের এন্টি-ইসলামিক প্রচারণা। যারা প্যাগান, প্রকৃতি-পূজারী… ভোরে খুব সুন্দর সূর্য ওঠছে, তাই একটু প্রণাম করি…। এখন এই প্রণাম করাটা, এভাবে ফিজিক্যালি প্রণাম করার ব্যাপারট সেক্যুলার-মুসলিমদের মধ্যে না থাকলেও এর সেন্সটা রয়ে গেছে। ঐ যে ‘আমাদেরকে প্রকৃতির মতো হতে হবে’। যেমন, তসলিমা নাসরিন একটা লেখায় বলেছেন– বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সম্পর্ক তো প্রকৃতির মধ্যে আছে। আচ্ছা, প্রকৃতির মধ্যে কী কী আছে? প্রকৃতির মধ্যে যা আছে সবকিছু কি আমরা নেই? প্রকৃতির মধ্যে তো সব ধরনের জিনিসই আছে। তাই না? আমরা প্রকৃতিকে ভেঙ্গেচুরে, ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকার ও প্রতিরোধ করেই তো সভ্যতা গড়ে তুলেছি। সেজন্যই তো সভ্যতার ক্ষেত্রে ‘গড়ে তোলার’ কথা বলা হয়।
এই অর্থে মানব সভ্যতা তো আরোপিত। আদিম মানুষদের তো সভ্যতা নাই। প্রাকৃতিক জীবনে আমরা তো গুহায় বসবাস করতাম। ঘরবাড়ি তো কোনো প্রাকৃতিক ফেনোমেনা নয়। তাই না? তাহলে আমরা কেন পোশাক পরিধান করি? এই জন্যেই করি যে– আমাদের যে শারীরিক গঠন এবং এর সাথে মিল রেখে আমাদের যে মানসিক গঠন, অর্থাৎ মানুষের যে প্রবৃত্তি, আবেগ ও চাহিদা রয়েছে, সেগুলোকে আমরা কম্পার্টমেন্টালাইজ করতে চাই। অর্থাৎ, এটা এখানকার জিনিস, ওটা সেখানকার জিনিস, আর এটা ওখানকার জিনিস– এভাবে ভাগ করতে চাই। যদি আমরা আমাদের প্রবৃত্তি, আবেগ ও চাহিদাগুলোকে কম্পার্টমেন্টালাইজ না করি, তাহলে কী হবে? ওভারঅল একটা নৈরাজ্য তৈরি হবে। সমাজব্যবস্থা ভেংগে পড়বে। পরিণতিতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে আমরা বৃহত্তর অর্থে সাধারণ কল্যাণের জন্য আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে কম্পার্টমেন্টালাইজ করছি। এগুলোকে আমরা বিভিন্ন কম্পার্টমেন্ট বা কুঠুরিতে বিভক্ত করে রাখছি।
আমরা বিপরীত লিঙ্গের দুজন ব্যক্তিই মাত্র সমাজে বাস করি না। আমাদেরকে ঘরে বাইরে অন্য লোকদের সাথে কাজকর্মে মেলামেশা করতে হয়। তখন যেন অন্য কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের সাথে যাতে অযাচিত ও অনুচিতভাবে প্রভাবিত না হয়ে পড়ি, সেজন্য বাধা বা আড়াল তৈরি করা হচ্ছে। এটি খুবই যুক্তিসংগত। আমি কথাগুলো যেভাবে বলছি এতে কারোর একদমই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমরা যখন এগুলো কম্পার্টমেন্টালাইজ করি, তখন সেটা সিভিলাইজেশনাল ডেভেলপমেন্ট হিসাবে গণ্য। আমরা যখন সভ্যতা গড়ে তুলি তখন আমরা ন্যাচার থেকে থেকে বিচ্যুত হই। তবে এতে করে আমরা কিন্তু ন্যাচারকে থামিয়ে দিতে পারি না। আমাদের খেতে হয়, আমরা না খেয়ে থাকতে পারি না। আমাদের ঘুমাতে হয়, আমরা না ঘুমিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক করতে হয়, না করে আমরা থাকতে পারি না। আমাদের প্রাকৃতিক চাহিদাগুলোকে আমরা থামিয়ে দিতে না পারলেও সেগুলোকে নিজেদের সুবিধা মোতাবেক চ্যানেলাইজ করতে পারি, রিঅ্যারেঞ্জ করতে পারি।
মানে, স্রোতকে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া বা উৎসটাই রুদ্ধ করে দেওয়া, এটা হলো এক ধরনের জিনিস। আরেকটা হলো, স্রোতকে বন্ধ করলাম না, করতে পারলাম না, বাঁধও দিতে পারলাম না কিন্তু খাল কেটে এর প্রবাহকে চ্যানেলাইজ করলাম। তাতে কী হলো? আমার ইরিগেশন হলো। তাই না? তাহলে আমাদের যে মানবিক চাহিদাগুলো আছে সেগুলোকে যথাযথভাবে চ্যানেলাইজ করার জন্যই সভ্যতা ও রীতিনীতি। পোশাক হলো এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পশ্চিমা সভ্যতার অনুসারীরা বলে, একজন মানুষকে একটা ক্লথ-প্যাক বা ক্লথ-ব্যাগের মধ্যে কেন ঢুকিয়ে রাখা হবে?…
অনেক মেয়ে আছে যারা সবসময় মাথায় কাপড় দিয়ে রাখে। মেয়েদের হলের ভিতরে টিভি রুম বা পেপার রুমে আসার সময়ও তারা ওভাবে আসে। তো অনেকে মন্তব্য করে, ওরা প্যাকেট হয়ে থাকে কেন সবসময়! অনেকেই ‘প্যাকেট’ বলেই ডাকে এদের…
আচ্ছা, আমরা আপাতত আলোচনার সুবিধার জন্য ধরে নেই, এটা একটা এক ধরনের ‘প্যাকেটিং’ বা ‘প্যাকেট’। আবার এর উল্টোটাও আছে– ‘ন্যাকেড’। প্যাকেটটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে ন্যাকেডটা কেন ঠিক হবে? তাই না?
প্যাকেট কিংবা ন্যাকেডের কোনোটাই তো ঠিক নয়…
হ্যাঁ, দুইটার কোনোটাই ঠিক নয়। প্যাকেটিংয়েরও বাড়াবাড়ি আছে। আমার ছোট ফুফুর বয়স আশি বছরের বেশি হবে। আমি মাস দুয়েক আগে গেলাম। দেখি তিনি মাথায় কাপড় দিয়ে বসে আছেন। আমি উনার মাথার কাপড় সরিয়ে দিলাম। উনার চুলগুলো দেখি তখনো ভেজা ভেজা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ভেজা চুলে মাথায় কাপড় দিয়ে আছেন, কী ব্যাপার? আপনি জানেন না, মহিলাদের বয়স হয়ে গেলে তাদের মাথা আর বুকে-পিঠে কাপড় পরার ফরজিয়তটা আর থাকে না? কোরআন শরীফে আছে…। তিনি তো আমার কথা বিশ্বাসই করলেন না। বললেন, এ রকম আছে নাকি? আমি বললাম, আছে। এখনি আপনাকে আমার ট্যাব থেকে বের করে দেখাবো। তিনি তখন বললেন, না, এভাবে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। অথচ তখনো উনার চুলগুলো ভেজা। তো এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
উনি হয়তো জিনিসটা বুঝেন না। উনার অনেক বয়স হয়েছে, আরো অনেক পারিপাশ্বিকতা রয়েছে। কিন্তু আমরা যারা মেয়েদের হলে থাকি। নিজেদের রুমে, টিভি রুমে বা পেপার রুমে গেলে যখন আমাদের চুল ভেজা থাকে তখন আমরা মাথায় কাপড় দেই না। এটা নিয়ে ইসলামী সংগঠনের কিছু বোন বলেন– এভাবে চলাফেরা করা ঠিক নয়। মাথায় কাপড় দাও।
আমাদের দেশে ইসলামের কাজ করে এ রকম সংগঠনগুলোর প্রত্যেকেই নারীদের ব্যাপারে এক্সট্রা-সেনসিটিভ। এটা যতটা ধর্মীয় কারণে, তারচেয়েও বেশি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে। নারীদের ব্যাপার মানেই যা কিছু নেতিবাচক তা সব প্রথমেই হাজির করা। এক ধরনের অপ্রেসিভ টেনডেন্সি।
এখন আমি বা আমরা যাদের সাথে বাস করছি, যাদেরকে নিয়ে আমরা কাজ করছি বা করবো, যে সমাজের নেতা হিসেবে আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে, সেখানে নেতৃত্বটা আমাকে ন্যাচারালি দেওয়া হয়নি। নেতৃত্বটা অর্জন করে নিতে হবে। যেমন আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে মনোনীত করেছেন। এখানে কারো কোনো হাত নেই। কিন্তু অনেক কষ্ট করে, যুদ্ধ করে, শারিরীকভাবে আহত হয়ে, মানুষের কাছে দাওয়াতী কাজ করে, নানাভাবে তাঁকে সামাজিক নেতৃত্বটা অর্জন করে নিতে হয়েছে। তো, আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা লিডার করে বানিয়েছেন। কিন্তু নেতৃত্বটা তো আমাদেরকে অর্জন করে নিতে হবে। আমি যদি আমার কথাবার্তা, চলাফেরা, পোশাক-আশাক এবং প্রাসঙ্গিক সবকিছুর মাধ্যমে আমার কম্যুনিটির সাথেই অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করতে না পারি, তাহলে আমি কীভাবে তাদের নেতা হবো?
আমি তখন তাদের বলেছি– আসলে আপু, এখানে তো সবাই মেয়ে তাই এখানে এভাবে…। ক্যান্টিনে বা নিচে দোকানে যাবার সময় তো আমি বোরকা পরে যাচ্ছি। এখানে তো শুধু মেয়েরা আছে। তখন তারা বলেন, বিধর্মী মেয়েদের সামনেও তো পর্দা করতে হয়। হ্যাঁ, এটা আছে। কিন্তু আমি যখন এই বিধানের প্রেক্ষাপট বুঝাইতে যাই তখন তারা বলেন, মাদ্রাসার মেয়েরা বেশি বুঝে…
ওটাই। প্যাটেকিংয়ের যে বাড়াবাড়ি সেটাও কিন্তু আছে। আবার উল্টাটাও আছে। ওয়েস্টে দেখো, সেখানে মেয়েরা কত অসহায়। সেখাকার সামাজিক অপসংস্কৃতির কাছে তারা জিম্মি। প্রচণ্ড শীতেও মেয়েরা উপরে-নিচে অনেকখানি অনাবৃত। এর বিপরীতে আমাদের এখানে ছোট ছোট মেয়েরা, এমনকি বয়স্ক মহিলারাও এক ধরনের পর্দা রক্ষা করে চলে। ওদের সমাজে যেমন চাপিয়ে দেয়া ন্যাকেডনেস রয়েছে, এর উল্টোভাবে আমাদের সমাজে চাপিয়ে দেয়া প্যাকেটিং রয়েছে। দুইটাই কিন্তু কালচারাল কন্সট্রাক্ট। আমি এই সরল কথাটাই বলতে চাচ্ছি।
আরেকটি ইসলামী সংগঠনের এক আপুর সাথে আমার পরিচয় আছে। একদিন দেখা হওয়ার পর উনার মধ্যে অনেক পরিবর্তন খেয়াল করলাম। তিনি অনেক বড় বোরকা পরেন, এর উপর জিলবাব পরেন, তার উপর আবার আরেকটা ওড়না দিয়ে নেকাব পরেন। হাত মোজা, পা মোজা তো আছেই। হঠাৎ এই পোশাকে উনাকে দেখে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। আমি ক্লাস থেকে আসছিলাম। আমাকে দেখে তিনি সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর শামসুন্নাহার হলে চলে গেলেন। তিনি আমাকে বলছিলেন– দেখো, তুমি যে বোরকা পরতেছো, এই কালার বোরকা, এগুলোতে তো পর্দা হয় না। কালো বোরকা পরতে হবে। এ রকম করতে হবে। এসব বলছিলেন। আমি বলেছি, ‘আচ্ছা আপু, আমি আরেকটু পড়াশোনা করি। আগে ব্যাপারটা একটু বুঝি, তারপর দেখা যাবে। এ ঘটনার পর উনার এগুলো নেয়ার জন্য তিনি আমাকে অনেকদিন কল দিয়েছেন।
কোরআন-হাদীসে মুসলিম নারীদের ব্যাপারে যে বর্ণনাগুলো আছে, সেগুলোর একটা হাইয়েস্ট ফর্মকে তারা ফলো করার চেষ্টা করছে। মনে করো, আমি একজন স্টুডেন্ট। আমার সিলেবাসের যে কোর্সগুলো আছে তার মধ্যে কোনো কোনোটাতে আমি খুবই ভালো করলাম, আর বাকিগুলোতে বা জরুটি কোনোটাতে আমি ফেল করলাম। তখন একজন স্টুডেন্ট হিসেবে আমার যে অবস্থাটা হবে, ওদের অবস্থাও হচ্ছে সেরকম। ইসলামে মুসলিম নারীদের ব্যাপারে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে সেগুলোর একটা হাইয়েস্ট ফর্ম নিয়ে তারা পড়ে আছে। নারীদের চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি বিষয়ে সর্বোচ্চ মান এবং ন্যূনতম মানের ব্যাপার আছে। আমরা যদি সিম্পল একটা উদাহরণ দেখি– হযরত খাদিজা (রা) এবং হযরত আয়িশা (রা), তারা দুজনেই উম্মুল মুমেনিন। এদের একজনের ক্ষেত্রে পর্দার কোনো প্রসঙ্গ আলোচনাতেই নাই। হযরত খাদিজার (রা) কথা বলছি। আমরা ধারণা করছি, তৎকালীন সভ্রান্ত কুরাইশ মহিলারা যে ধরনের পোশাক পরিধান করতেন, তিনি তেমন ধরনের প্রচলিত সাধারণ পোশাকই পরতেন…
তখনো তো পর্দার বিধান আসে নাই।
হ্যাঁ, বিধান আসে নাই। তাই তারা আমলও করে নাই। প্রশ্নটা হলো, যদি আমরা ভাবি, বিধানটা কেন আসে নাই? তাহলে কি উন্নততর এই বিধানের আমল করা হতে আল্লাহ তায়ালা উনিসহ অপরাপর মুসলিম মহিলাদেরকে মাহরূম করলেন (নাউজুবিল্লাহ)!
না, তখন হয়তো পর্দার প্রয়োজন ছিল না।
কেন? মানুষদের কি তখন ‘সে রকম কোনো চাহিদা’ ছিলো না? খুব অস্বস্তিকর প্রশ্ন, তাই না? তাহলে একটা জিনিসের প্রয়োজনটা কখন দেখা দেয়? একটা উদাহরণ দেই। চতুর্থ সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হয়েও প্রথম সেমিস্টার নিয়ে পড়ে থাকলে যেমন একজন স্টুডেন্টের পড়ালেখা ও পাশ করা হবে না, তেমনি সিলেবাসে আছে বলেই প্রথম সেমিস্টার পাশ না করে চতুর্থ সেমিস্টারের পড়াশোনা নিয়ে মাতামাতি করলেও সে নির্ঘাত ফেল করবে, নিশ্চিত ড্রপ-আউট হবে। তাহলে তখনকার সময় আর এখনকার সময় বলে একটা ফারাক আছে।
এখন আমাদের সমাজটা কি তখনকার সময়ের (মক্কী যুগ) সাথে মিলে, নাকি পরবর্তী সময়ের (মাদানী যুগ) সাথে মিলে? আমাদের সমাজটা কি সুন্নাহর শুরুর দিকটার সাথে মিলে, না শেষের দিকের সাথে মিলে? আসল কথা হলো, আমাদের সমাজটা তাওহিদী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়েই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা প্রাইমারি লেভেলে বসে ইসলামী শরীয়াহ নামক সিলেবাসের উচ্চতর বিষয়গুলো নিয়ে এক ধরনের ফ্যান্টাসিসুলভ ব্যর্থ টানাহেঁচড়ায় লিপ্ত। সুন্নাহর টাইমলাইনকে ফলো না করার কারণে আমাদের সত্যিকার অগ্রগতি হচ্ছে না। আমরা কেবল বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার মতো আগ-পিছ করছি।
আর কেউ কেউ ইসলামের এই বিধানটাকে এতো বেশি কঠিন করে ফেলে যে…। মানে পর্দা করা যে রকম ফরজ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখাটাও তো সে ধরনের ফরজ কাজ।
যে কোনো একটা বই থেকে এর ভূমিকা ও শুরুর চ্যাপ্টারগুলো ইগনোর করে লাস্ট চ্যাপ্টার বা কনক্লুশান হতে খণ্ডিতভাবে একটা কিছু রেফার করলে, তা তো কাজের কাজ কিছু হবে না।
সাধারণ মেয়েরা, সাধারণ মেয়ে বলতে একদম সাধারণ যারা, তাদের সাথে অনেক কথা হয়, মত বিনিময় হয়। ওদের মত হচ্ছে, ছাত্রী সংস্থার মেয়েরা কোরআনের নির্দিষ্ট কিছু আয়াত নিয়ে বা নির্দিষ্ট কিছু হাদীস নিয়ে মানুষকে বলে যে…
ছাত্রী সংস্থা না শুধু। কোনো একটা ইসলামী সংগঠন করে এমন যে কারো জন্য এটি প্রযোজ্য। তাবলীগ, সালাফী– এরা প্রত্যেকেই কিন্তু। ওরা সুনির্দিষ্টভাবে কোরআন-হাদীসের অংশবিশেষ ফলো করছে। ওরা ওদের কাজের পক্ষে কোরআন-হাদীসের কিছু রেফারেন্স দেখায়। কিন্তু রেফারেন্স থাকলেই তো হবে না। এমনকি রেফারেন্স যদি সহীহও হয়। সংশ্লিষ্ট রেফারেন্স বা নসের পূর্বাপর, প্রেক্ষিত ও প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। কোরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে একে বলা হয় শানে নুজুল, আর হাদীসের ক্ষেত্রে একে বলা হয় শানুল উরুদ।
মনে করো, একটা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশান দেয়া হয়েছে। এরপর নিচ তলা, দ্বিতীয় তলা, এভাবে পঞ্চম তলা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে। তারপর যেভাবেই হোক একসময় বিল্ডিংটা ভেঙ্গে পড়েছে। এখন আবার তুমি সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করছো। এখন তুমি কি শুরুতে পঞ্চম তলার মাল-সামান আগে যোগাড় করবা, নাকি ফাউন্ডেশান আগে দিবা? ফাউন্ডেশানটাই আগে ঠিক মতো দেয়ার কাজ করবা, তাই তো? তাহলে ইসলামের যে সৌধ তথা খেলাফত ব্যবস্থাটা রাসূলুল্লাহ (সা) কায়েম করে গেছেন সেটা তো কলাপ্স করেছে। আমরা যদি খেলাফতে রাশেদার কথা বলি, সেটা তো ৩০ বছরেই কলাপ্স করেছে। আর আমরা যদি রাজতন্ত্র ইত্যাদি সব মিলিয়ে নামকাওয়াস্তে হলেও ধরি তাহলেও তো উসমানীয় খেলাফতের পতনের মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ইসলামী নেজাম তথা খেলাফত ব্যবস্থা দুনিয়া হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তদুপরি বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক হতে নানা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থারও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একে তো আর পিছিয়ে দেয়া যাবে না। এডাপ্ট করতে হবে। এখন তো দুনিয়ায় কোনো খেলাফত নাই। তাই না? তাহলে, এখন আমাদেরকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আমাদেরকে সুন্নাহর টাইমলান ধরে মক্কী যুগ থেকেই শুরু করতে হবে।
পক্ষান্তরে কোরআন শরীফে কিন্তু মক্কী যুগে প্রথম অবতীর্ণ আয়াত প্রথমে, তারপর অবতীর্ণ আয়াতগুলো এর পরে– এভাবে সংকলিত নাই। আল্লাহ তায়ালার নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে এবং সে অনুসারে আল্লাহর রাসূলের মাধ্যমে কোরআনের এক ধরনের সংকলন-বিন্যাস আমরা পেয়েছি।
তাহলে আমরা যখন কোরআন থেকে একটা কিছু পড়বো, তখন কি বর্তমান… মক্কী যুগের লোকেরা কি মাদানী যুগের নির্দেশনা পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। সেখান থেকে তারা প্রেরণা গ্রহণ করবে। শিক্ষা নিবে। তাদের সমাজকে সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। কিন্তু অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করবে মক্কী যুগের নির্দেশনাগুলোকে। আগেরটাকে এগজস্ট না করে, ঠিক মতো প্রতিষ্ঠা না করে, পরেরটাতে লাফ দেয়ার চেষ্টা করবে না। আগেরটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করার পরেই পরবর্তী ধাপকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে।
এবার ঐ যে তুমি পাঞ্জাবী-পাজামার কথা বলেছিলে, সে কথায় আসা যাক। রাসূলুল্লাহ (সা) জীবনে কোনোদিন পাজামা পরেন নাই। তবে একটা পাজামা তিনি কিনেছিলেন, এ রকম বর্ণনা আছে।
কী জন্যে পরেন নাই?
ডিটেইলস তো নাই। ওখানে আছে, তিনি একটা পাজামা কিনেছেন। কিন্তু পরার কোনো বর্ণনা নাই।
তিনি যদি কিনে থাকেন, তাহলে সেটা পরবেন না?
হয়তো পরেছেন। কিন্তু তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। আচ্ছা, তিনি যেহেতু কিনেছেন তাহলে ধরে নিচ্ছি সেটা পরেছেনও। সে অর্থে পাজামাও পরা যাবে। কিন্তু যেটা পরার বর্ণনা আছে সেটা হচ্ছে, তিনি সেলাইবিহীন লুঙ্গি পরতেন। ওটা হলো তাঁর পোশাক। আবার যে পোশাক পুরো শরীর একসাথে ঢেকে রাখে, যাকে জোব্বা বলা হয় বা আমরা যাকে ম্যাক্সি বলি– এই ধরনের পোশাক তিনি মাঝে মধ্যে পরতেন। এটার বর্ণনা আছে। তো, যা পরার বর্ণনা আছে, আর যা পরার বর্ণনা নাই কিন্তু বুঝা যায় হয়তো এটা পরেছেন– এগুলোর কোনটা পরার গুরুত্ব বেশি?
যা পরেছেন বলে বর্ণনা রয়েছে, সেটা।
তারমানে কি সেলাইবিহীন লুঙ্গি পরাটা আমাদের জন্য সুন্নত?
না…।
এটাই হচ্ছে আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সুন্নাহর মূল কথা। ঐ যে গতকাল আলোচনা করেছি– মূলনীতি এবং মডেল। কোনো শরয়ী বিধান বা স্ট্রাকচারের যে অন্তর্নিহিত ভাবধারা বা উসূল আছে, সেগুলোকে খেয়াল রাখতে হবে। উসূল বাদ দিয়ে শুধু বিধান নিয়ে এনগেজ থাকা মানে বিচি ফেলে দিয়ে বাচ্চাটার মিষ্টি খাওয়ার মতো ব্যাপার।
আমরা কিছু ইয়ে দেখি যে, কম্পিউটার ব্যবহার করা যাবে না, ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে না, এগুলো ব্যবহার করা হারাম– এই টাইপের কথা বলে। তাদের যুক্তি হলো, রাসূল (সা) তো এগুলো ব্যবহার করে নাই। রাসূলের (সা) যুগে তো এগুলো ছিলো না। অথচ এগুলো এখন দরকার, প্রয়োজন…
আরে রাসূলের (সা) যুগে তো আমরা যে স্যানেটারি সিস্টেম ব্যবহার করি, সেটাও ছিলো না…
হ্যাঁ, তখন তো মানুষ প্রাকৃতিক কার্য প্রাকৃতিকভাবেই সারতো…
তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী দাঁড়াচ্ছে? আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সুন্নাহ– এই ব্যাপারটার কিন্তু একটা মেথডলজি আছে। এই জিনিসগুলো লোকদেরকে বুঝাতে হবে। লোকেরা কোরআন-হাদীসের প্রচুর দলীল জানে। জাকির নায়েক এসে রেফারেন্সের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। রেফারেন্স না জানার আগে সমস্যা ছিলো, লোকেরা কিছু জানত না। হুজুরেরা যা বলতো, লোকেরা সেটাই মানতে বাধ্য হতো। ঐ যে গতকাল কোরআনের যে আয়াতটি বলেছিলাম,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّـهِ
অর্থ: তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের আহবার এবং রুহবানদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা তওবা: ৩১)
তার মানে হচ্ছে, ধর্মবেত্তারা যা বলতো লোকেরা সেটাই নির্বিচারে শুনতে বাধ্য হতো। এটা ছিলো আগেকার সমস্যা। লোকদের কাছে তখন টেক্সট এভেইলেবল ছিলো না। যে কারণে বিশেষজ্ঞ হিসাবে খেতাব প্রাপ্তরা যেটাই বলতো, তারা সেটাই মানতো।
এখন উল্টো আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন টেক্সট একদম এভেইলেবল হয়ে গেছে। কিন্তু টেক্সট থেকে গাইডেন্স ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেয়ার বা টেক্সটকে প্রপারলি ইন্টারপ্রিট করার নেসেসারি মেথডলজি কিন্তু লোকেরা পায় নাই। তার মানে হচ্ছে, নব্য ইসলামী সৈনিকরা গোলা-বারুদ ও বন্দুক-মেশিনগান ঠিকই পেয়েছে, কিন্তু কাকে মারতে হবে, কোনদিকে ফারারিং করতে হবে, সেটাই জানে না। কী ভয়াবহ অবস্থা! গাড়িটা পেয়েছে, কিন্তু চালাতে জানে না। অথবা, চালানোর নিয়ম কানুন মুখস্ত জানে, কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চালানোর যোগ্যতাই অর্জন করে নাই। অথবা, গাড়ি চালাতে শিখেছে কিন্তু গাড়িটা দিয়ে সে কোথায় যাবে, কী জন্যে যাবে– সেটা জানে না। ফলে যেখানে ব্রেক কষা দরকার, সেখানে সে একসেলেটর চাপে। যেখানে স্পিড দেয়া দরকার, সেখানে শম্ভূক গতিতে আগায়। শরীয়াহর সামগ্রিক জ্ঞানবঞ্চিত ইসলামী পণ্ডিতদের অবস্থা এমন আনাড়ি ভবঘুরের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্সপোজারের এই জমানায় যুক্তি দিয়ে কিছু বলতে গেলেই, বিশেষ করে তরুণরা নির্বিচারে কোরআন-হাদীসের ব্রাশফায়ার শুরু করে। সে যে বুঝে না, সেটাও বুঝে না। অধৈর্য-অসহিঞ্চুতা ও নানা ধরনের চরমপন্থার লক্ষণ দিয়ে এদেরকে আইডেন্টিফাই করা যায়।
আগে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু এতো ক্রিটিক্যালি ভাবি নাই…
আমার জামায়াত না করা বা ছেড়ে দেওয়ার একটা কারণ হলো– যারা ইসলামের কথা বলে, অনেকের চেয়ে ভালো বুঝে, এরাও দেখি একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের বেশি আর যেতে চায় না। যেটা হচ্ছে সেটা অনেকটা এনজিওদের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের মতো। তারা তোমাকে কিছু দিবে, তুমি বেঁচে থাকবা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার দারিদ্র্য দূর হবে না। তুমি আজীবন কিস্তি নিয়েও কখনো উদ্যোক্তার পর্যায়ে পৌঁছতে পারবা না। তোমার দারিদ্য বিমোচন হয়ে গেলে তো তাদের ব্যবসাই খতম! প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনপন্থীদেরও অবস্থাও কমবেশি এ ধরনের। তারা যা যা বলে, বাস্তবে সেগুলোতে তেমন সিরিয়াসলি এনগেজ হয় না।
একবার তাদের কয়েকজনকে আমার ডিপার্টমেন্টের রুমে ডেকেছিলাম। সেখানে কোনোদিন গেলে দেখবে বিশাল হোয়াইট বোর্ড লাগানো আছে। সেমিনার করার জন্য সবকিছু তৈরি আছে। সেখানে অনেক সেমিনার করেছিও। তো একবার আমি প্রজেক্টর নিয়ে রেডি, তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড তৈরি করেছি। কিন্তু কেউ আসে নাই! শুধু একজন এসেছিল। তার নাম বলছি না। ও বিদেশে যাবে হায়ার স্টাডিজের জন্য। নানা ধরনের ঝামেলার মধ্যে আছে। আমাকে বললো– স্যার, আমি তো ভেবেছি অন্যরা আসবে। আমি তো বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবো না। তখন আমি বললাম, তুমি কতক্ষণ সময় দিতে পারবা? সে বলল– স্যার, এক ঘণ্টা। শুধু তাকে নিয়েই আমি একঘণ্টা ফরমাল প্রেজেনটেশান দিয়েছি, আলোচনা করেছি। এটি আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা।
একবার দিল্লির জামে মসজিদে একজন বড় ইসলামী ব্যক্তিত্ব একটা খুতবা দিয়েছেন। খুতবা শুনে সবাই চলে আসছে, তিনিও চলে আসছেন। এমন সময় দেখলেন, সিঁড়ি দিয়ে একটা লোক খুব হন্তদন্ত হয়ে আসছে। লোকটা জিজ্ঞাসা করলো, খুতবা কি শেষ হয়ে গেছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। লোকটা বললো, হায়! আমি তো এই খুতবা শোনার জন্যই এসেছিলাম। তখন তিনি বললেন, তুমি বসো, খুতবাটা কিন্তু আমিই দিয়েছি। তুমি চাইলে, তোমার সাথে আমি এটা নিয়ে কথা বলি। তারপর হাজার লোকের সামনে তিনি যে খুতবাটা দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই সিঁড়িতে বসে খুতবার সেই কথাগুলো নিয়ে ওই অপরিচিত লোকটার সাথে আলোচনা করলেন। তখন লোকটা বললো, আচ্ছা, আপনি শুধু আমার একজনের জন্যে এতো কষ্ট করলেন, আবার পুরো জিনিসটা রিপিট করলেন! এটা তো আপনার জন্য খুব কষ্টকর হলো। তিনি তখন উত্তরে বললেন, তোমার মতো একজনের জন্যই তো আমি তখন খুতবাটা দিয়েছিলাম। সেখানে এমন একজন ছিলো কিনা আমি জানতে পারি নাই। কিন্তু এখন আমি জানলাম, আমার কথাগুলো শোনার উপযুক্ত একজনের কাছে আমি এ কথাগুলো বলতে পেরেছি।
আমি বিশেষ করে তরুণদেরকে খুব গুরুত্ব দেই। ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে একদিন আমাকে ফোন করে বললো– স্যার, আমি আপনার একটা লেখা পড়ছি, আমার নাম অমুক । আমি আপনার সাথে দেখা করবো। ফ্যাকাল্টিতে প্রথম যেদিন আমি তার সাথে দেখা করেছি, সেদিনই দেড় ঘণ্টা কথা বলেছি। পরবর্তীতে সে আমার বাসায় কয়েকবার এসেছে। এবং প্রত্যেকবারেই তার সাথে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা করে সময় দিয়েছি। আমি ইয়াংদেরকে খুব মূল্যায়ন করি। আমার ইচ্ছা করে, এখানে যত ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের কাছে গিয়ে অযাচিতভাবে, ঐ যে মার্কেটিং করার জন্য ঔষধ কোম্পানি বা বিভিন্ন রিপ্রেজেন্টেটিভরা যে রকম করে সেভাবে কথা বলি। আসলে আল্লাহর রাসূলগণ তো এভাবেই কাজ করেছেন। বুদ্ধিজীবী হিসাবে সেজেগুঁজে ‘তকরীর’ করার জন্য অপেক্ষা করেন নাই। অথাব, দাঈ হিসাবে কারো কাছ হতে ভাতাও নেন নাই।
আসসালাম….. বারাকাতুহ
আপনি বলেছেন-
আমার জামায়াত না করা বা ছেড়ে দেওয়ার একটা কারণ হলো– যারা ইসলামের কথা বলে, অনেকের চেয়ে ভালো বুঝে, এরাও দেখি একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের বেশি আর যেতে চায় না। যেটা হচ্ছে সেটা অনেকটা এনজিওদের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের মতো। তারা তোমাকে কিছু দিবে, তুমি বেঁচে থাকবা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার দারিদ্র্য দূর হবে না। তুমি আজীবন কিস্তি নিয়েও কখনো উদ্যোক্তার পর্যায়ে পৌঁছতে পারবা না। তোমার দারিদ্য বিমোচন হয়ে গেলে তো তাদের ব্যবসাই খতম! প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনপন্থীদেরও অবস্থাও কমবেশি এ ধরনের। তারা যা যা বলে, বাস্তবে সেগুলোতে তেমন সিরিয়াসলি এনগেজ হয় না।
এটি কি টপ-টু-বটম সম্পূর্ণটার জন্যই, নাকি ক্যাটেগরিক্যালী কোন বিভাজন আছে? আপনার পর্যবেক্ষণের উপসংহার কি পরিসংখ্যানের সূত্র দ্বারা নির্ণীত?
এ “ঢালাও মন্তব্য”টি আপনি নিজেই যথার্থ মনে করেন কিনা জানতে ইচ্ছে হয়!
যদি “যথার্থ” মনে করেন তবে একটি বিশ্লেষণমূলক পোস্ট দিতে অনুরোধ করবো!
যেহেতু আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি সেহেতু আপনার আদালত-এর ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি!
আলোচনার অন্যান্য বিষয়ে আরো পড়ে মন্তব্য করবো ইনশাআল্লাহ