[এই লেখাটি একটা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ফেয়ার ট্রান্সক্রিপ্ট।]
দেখুন, এখানে আমি ‘ইসলামী আন্দোলন’ টার্ম ব্যবহার করি নাই। এর পরিবর্তে ‘ওয়ার্ক ফর ইসলাম’ বলেছি। অবশ্য ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ পরিভাষা নিয়ে আমার কোনো এলার্জি নাই। কিছু কিছু লোকের মাঝে কিন্তু ইদানিং এ নিয়ে খুব এলার্জি দেখা যায়। তাঁরা বলেন, ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ বলা যাবে না। তাহলে কী বলতে হবে?
যাইহোক, কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে আমি এখন কথা বলবো। এসব বিষয় খুবই র্যাডিকেল। তবুও এসব আমি বলতে চাই। শুনে আপনারা হয়তো তাজ্জব বনে যাবেন। সময় স্বল্পতার কারণে আমি দ্রুত ও সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করবো। চারটি বিষয়ে আমি কথা বলবো– (ক) তাত্ত্বিক ভিত্তি, (খ) কর্মকৌশল, (গ) সাংগঠনিক কাঠামো ও (ঘ) উপসংহার।
আলোচনাটির অডিও শুনুন
অডিও ডাউনলোড ||| পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন
(১) তাত্ত্বিক ভিত্তি
ধর্মতত্ত্ব নয়, দর্শনই সমস্যা:
আজকের দিনে ইসলামের জন্য কাজ করতে গেলে যে সমস্যাটি আপনি সবচেয়ে বেশি ফেইস করবেন, তা আগেকার মতো ঠিক থিওলজিক্যাল সমস্যা নয়। এখনকার মূল সমস্যা হলো তাত্ত্বিক বা দার্শনিক। দয়া করে বলবেন না– “আপনি তো ফিলোসফির লোক, তাই ফিলোসফিকে হাইলাইট করছেন। একইভাবে, ইকোনমিক্সের লোক তো ইকোনোমিক্সকে হাইলাইট করবে” ইত্যাদি ইত্যাদি। না। আপনি ভালো করে চিন্তা করলে দেখবেন, নানা রকমের তত্ত্ব, মত ও পথ আজকাল যতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, সে তুলনায় থিওলজি এখন আর অতটা সমস্যার ব্যাপার নয়।
সাধারণত মনে করা হয়, কনসেপ্টের দিক থেকে আমাদের সবকিছু ঠিকই আছে। ইসলাম হলো জীবনের সবকিছু। কমপ্লিট কোড অব লাইফ। অতএব, এসো, আমরা ইসলাম কায়েম করি। আমিও একসময় এমনটা মনে করেছি। ট্রাডিশনাল ইসলামিক মুভমেন্টে আমরা তখন শরিক ছিলাম। আমার পুরো জীবনটাই কেটেছে আন্দোলনের এই ধারায়। যেসব শ্লোগান এখন দেওয়া হয় না, সেসব শ্লোগান দিতে দিতেই আমাদের গলাগুলো বসে গেছে। ‘বিপ্লব, বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব’ ইত্যাদি শ্লোগান এখন আর দেওয়া হয় না।
তাওহীদের নিরবচ্ছিন্ন আন্ডারস্ট্যান্ডিং:
তাওহীদের নিরবচ্ছিন্ন আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা অত্যন্ত জরুরি। আপনারা বলবেন, তাওহীদের কথা তো আমরা জানি– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই’। তাওহীদের কথা তো হয়েই গেলো। এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমি বার বার বলেছি। যারা আমার দু’চারটা লেখাও পড়েছেন তারা তাওহীদ সম্পর্কে আমার এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খুব সম্ভবত পরিচিত। সেটা হলো– তাওহীদের একটা আক্বীদাগত দিক রয়েছে। এটা বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা, তাবলীগ জামাত, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অফশুটস সংগঠনগুলো এবং আহলে হাদীস থেকে শুরু করে হিজবুত তাহরীর নামে যারা হঠকারী চরমপন্থার অনুসরণ করছেন তারা সবাই কালেমার ব্যাপারটা জানে। তাওহীদের বেসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা সবার কাছে ক্লিয়ার।
কিন্তু, এর বাস্তব অনুসরণ কীভাবে করা হবে? বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও ধাপগুলোর রূপরেখা কী? আমাদের জীবনে তাওহীদের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে ক্রিয়াশীল রাখতে হবে? আমাদের সামাজিক জীবন কীভাবে তাওহীদভিত্তিক হবে? আমাদের অর্থনৈতিক জীবন কীভাবে তাওহীদের সাথে কানেকটেড থাকবে? আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় তাওহীদের পথনির্দেশ প্রতিফলিত হয়েছে কিনা, তা কীভাবে বুঝা যাবে? প্রচলিত ‘ইসলামাইজেশানের বড়ি’ গিলানোর চিন্তা বাদ দিয়ে জীবনের অনাবিল আনন্দ, সুখ, জাতীয় সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে তাওহীদের অন্তর্গত ভূমিকা বাস্তবে কী হবে – এসব নিয়ে কি আপনারা ভেবেছেন? হয়তোবা। কিন্তু আমি এর কোনো লক্ষণ দেখি না।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য কোনো রূপরেখা ও নিজেদের যোগ্যতা-দাবিকে আস্থাযোগ্য হিসাবে উপস্থাপনের কঠিন পন্থাকে বাদ দিয়ে শর্টকাট ধর্মবাদী ইসলামী আন্দোলন চর্চা করা এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি হতে ইসলামকে একটা প্যানাসিয়া বা সর্বরোগ বটিকা হিসাবে উপস্থাপনের বিপদ বহুমাত্রিক ও অনিবার্য। “সব সমস্যার সমাধান/দিতে পারে আল-কোরআন।” ওকে, বুঝলাম। আল-কোরআনকে সামনে রাখেন, এবার যুগোপযোগী সমাধান বের করেন। না, প্রপার ও কন্টিনিউয়াস আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব তাওহীদ না থাকলে শুধু কিতাব থেকে সঠিক পথ নির্দেশ কেউ লাভ করতে সক্ষম হবে না। ঐশী হেদায়েতের সাথে গভীর উপলব্ধির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
জীবন ও সমাজের ব্যাপারে শার্প অবজারভেশান ও অত্যন্ত সংবেদনশীল মন না থাকলে কোনো ছাপানো কিতাবকে ভিত্তি করে কেউ ব্যক্তি, সমাজ ও সামষ্টিক কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, হোক তা স্বয়ং কিতাবুল্লাহ! তাওহীদের কনসেপ্ট আমাদেরকে ইবাদতে এনগেজ করে। তৎসত্ত্বেও নিছক ইবাদতের জন্য তাওহীদ আসে নাই। ফেরেশতারাই এজন্য যথেষ্ট ছিলেন। মানুষ যাতে জগতে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে পারে তার জন্যই তাওহীদ এসেছে। তাই মুসলমানেরা জন্মগতভাবেই লিডার। আমাদের এক সহকর্মীকে এ নিয়ে আমি বকেছি। তার নামটা বলবো না। তিনি কোরিয়া থেকে ডিগ্রি করে এসেছেন। আইডিওলজিকেল দিক থেকে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ প্রসংগে অত্যন্ত সিনসিয়ার এই শিক্ষক এক পর্যায়ে আমাকে বললেন– “স্যার, আমি সব সময়ে কর্মী, ফলোয়ার…।” আমি বললাম– “মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালা বানাইছেই লিডার করে, আর আপনি জীবনের এই পর্যায়ে এসেও বলছেন আপনি ফলোয়ার। কী আশ্চর্য!”
বাতির নিচে যে অন্ধকার থাকে তাকে ব্লাইন্ড স্পট বলে। ট্রাডিশনাল ইসলামী আন্দোলনের তেমন একটা ব্লাইন্ড স্পট হচ্ছে, গণহারে জনশক্তির আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তি-উদ্যোগের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেওয়া। বলা হয়, আপনি নত হোন, নিজেকে বড় মনে করবেন না, ইত্যাদি। এসব নাকি ঈমানের দাবি! অথচ, আমরা পড়েছি আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘You develop your ego, your Khudi, yourself. You brand yourself’. এ বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করছি।
সাধারণত তাওহীদের আলোচনায় সমাজে প্রচলিত শিরক-বিদাত ইত্যাদির উপর ফোকাস করা হয়। এগুলো নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাওহীদের আলোচনা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আগেও অনেক আলোচনা আছে। বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা খণ্ডন, ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কিত সমস্যার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান ইত্যাদি ধরনের সমকালীন যুগ-সমস্যার সমাধান বের করাই আজকের দিনে তাওহীদ আলোচনার অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পাশ্চাত্য চিন্তাকে খণ্ডনের মাধ্যমে নয়, বরং জীবন অভিজ্ঞতা হতেই ইসলামকে অনুধাবন করতে হবে। ইসলামকে বুঝতে হবে ওয়েস্টকে ডিসফাংশান করে, মোকাবেলা করে– এ রকম একটা ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ছড়িয়েছে। হতে পারে এটি ইসলামাইজেশান প্রকল্পের কুফল। আমি অনেক তত্ত্ব পড়াশোনা করেছি। তত্ত্ব আলোচনাই আমার চাকরি। কিন্তু আমি দেখেছি ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু’– রবীন্দ্রনাথের এই কথার মতো আমাদের আটপৌরে জীবনের নৈমিত্তিক তথা সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোই ইসলামকে বুঝা, জীবনের বৃহত্তর সত্যকে জানা, এক কথায় জ্ঞান অর্জনের জন্য যথেষ্ট। সব গুরুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্য থিওরিকে জানার কী দরকার? আপনি যদি নিজের সত্তাকে সত্যিকারভাবে জানতে চান, জীবনে চলার জন্য সঠিক পথ চিনতে চান, আপনার ব্যক্তি অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। ইসলামবিরোধী তাবৎ মতাদর্শকে জানা ও খণ্ডন করার কাজটা বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দিন। সবাইকে এক্সপার্ট হতে হবে– কীভাবে যেন এ ধরনের ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
লোকেরা ভাবে, বিশেষ করে শিক্ষিত ইসলামী আন্দোলনপন্থী তরুণদেরকে দেখি, তারা ভাবে বা বলে– “আমি তো বোধহয় ঐ থিওরি ভালো করে জানি না, বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার হতে অনেক কিছু বোধহয় অজানা থেকে গেলো। আমি বোধহয় নাখান্দা বান্দা। অতএব, আমি তেমন কিছু করতে পারবো না।” এগুলো ভুল ধারণা। এ রকম ভাবা ঠিক নয়। ঐ যে সেই মাঝির গল্পের মতো। মাঝিকে এক সাহেব বলছে, তুমি কি এটা জানো? জানি না। ওটা জানো? জানি না। প্রতিটা না জানার জন্য কিছু কিছু বাদ দিতে দিতে সাহেবের হিসাবে মাঝির বারো আনাই বাদ গেছে। এমন সময় নদীদে ওঠলো ঝড়। আপনারা নিশ্চয় গল্পটা জানেন। মাঝি তখন বলেছে– সাহেব, তুমি কি সাঁতার জানো? সাহেব জবাব দেয়– না, সেটা তো জানি না। তখন মাঝি বলে– তাহলে তো তোমার ষোল আনাই মিছা।
জীবনবোধ থেকে যার ইসলামটা গড়ে ওঠে নাই, ইসলামকে যিনি জীবনবোধ থেকে নিতে পারেন নাই, বরং বিভিন্ন আদর্শকে খণ্ডন করে করে যিনি ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে গড়ে উঠেছেন, তিনি আমার দৃষ্টিতে খুব রিস্কি পজিশনে আছেন। ইসলাম হলো ইতিবাচক ব্যাপার। নেতিবাচক পদ্ধতিতে যারা ইসলাম চর্চা করেন, তারা প্রপার মেথডলজি ফলো করছেন না। গোলাম মোহম্মদ কাদিয়ানী, কোরআনে ১৯ সংখ্যার তাৎপর্য বের করেছেন যিনি– রশীদ খলিফা, তুরস্কের হারুন ইয়াহিয়া, এ রকম অনেক লোকজন আছেন বা ছিলেন, যারা খুব ভালো তর্কবিশারদ। তারা ইসলাম বিরোধীদেরকে হটিয়েছেন, তর্ক ও বাহাসে পরাজিত করেছেন। অথচ এক পর্যায়ে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছেন। কারণ, তাদের ইসলাম বুঝার পদ্ধতিটাই ভুল ছিলো।
কাউকে যুক্তিতর্ক দিয়ে রিফিউট করতে না পারলেও জীবন ও জগত সম্পর্কে যদি আপনার সঠিক বুঝ থাকে, সঠিক পথে থাকার জন্য তা-ই যথেষ্ট। থিওরি কপচানোর চেয়ে সাদামাটা জীবনোপলব্ধি অনেক অনেক কাজের জিনিস। উপলব্ধি কেউ এনে দিতে পারে না। এটি গড়ে উঠে। এর জন্য মনের দরজা খুলে দিতে হবে। আশেপাশের তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। হেদায়েত অর্জনের জন্য এটাই কোরআনিক মেথডলজি।
(২) কর্মকৌশল
ইসলামিক প্রিজম দিয়ে নয়, মানবিক দৃষ্টিতে দেখুন:
সবকিছুকে ইসলামীকরণ করার চেষ্টা করবেন না। আমি কয়েকদিন আগে আমার ছোট মেয়েটাকে বলেছি– তুমি যখন কারো কাছে সত্য কথা বলো তখন তোমার বলার দরকার নাই যে, কোরআনে বলেছে, হাদীসে বলেছে, ইসলাম সত্য কথা বলতে বলেছে, আল্লাহ বলেছেন, এজন্য আমি সত্য কথা বলছি। তোমার সত্য কথা বলাটাই ইসলামিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আপনারা ইবাদত (নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি) ও মুয়ামালাতের (সামাজিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক লেনদেন) পার্থক্য সম্পর্কে জানেন। অতএব…।
কথাটা উঠেছিল অন্য একটা রেফারেন্সে। নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা শাসনতান্ত্রিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা, সেই প্রসঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্র ধারণা নিয়ে আলোচনা উঠেছিল। এ সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক আলোচনা হলো– ইসলামী রাষ্ট্র কাজেকর্মে ইসলামী হলেই হলো। এর নামের মধ্যে ইসলাম না থাকলেও সমস্যা নাই। কারণ, রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট সবকিছুই মুয়ামালাতের বিষয়। ইবাদতের জন্য বাহ্যিক কাঠামো, পদ্ধতি ইত্যাদি আর মনোভাব বা নিয়ত – উভয়ই যেভাবে বলা হয়েছে হুবহু সে রকমই হতে হবে। আর মুয়ামালাতের বিষয়ে ব্যক্তির ইনটেনশানই যথেষ্ট। এটা আপনারা সবাই আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। কিন্তু জানা জিনিসও অনেক সময় স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, যেন কাজের বেলায় এটা মনে থাকে।
কামারুজ্জামান ভাই আমাকে বলেছিলেন– দেখেন ‘আমাদেরকরণ’ এমন হইছে যে, দাফন-কাফনের কাজে সহযোগিতার জন্য সুপারিশ করেছি, তখনও কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেছে, ‘লোকটা কি আমাদের ছিলো?’ জরুরি অবস্থায় মিলিটারি সরকার আসার পরে উনি আমাকে এই ঘটনা বলেছিলেন। এটা একটা এক্সট্রিম উদাহরণ। উনি যেহেতু বলেছেন, সুতরাং এটি সত্য ধরে নিচ্ছি। সত্য না হলে তো উনার মতো লোক এমন কথা বলতেন না। অত্যন্ত অনাকাংখিত হলেও এ ধরনের দলীয়করণ কিন্তু হচ্ছে। আচরণ থেকে শুরু করে সবকিছুর ব্যাপারে আমরা খুঁজি তা ‘ইসলামিক’ কিনা। আপনি মানবিক হোন, সত্যকে অনুসরণ করুন, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করুন। হয়ে গেলো ইসলামিক। মানবতা, সত্য ও ন্যায়ের বাইরে কোনো ইসলাম নাই। আছে ইসলামের নামে দলীয়পনা।
আরেকটা ব্যাপার হলো, ইসলামের জন্য যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে এক ধরনের কৌলিন্যবোধ কাজ করে। তাদের মনোভাবটা এমন, আমরা তো মানুষকে (দোজখ থেকে) বাঁচাচ্ছি, তাদের জন্য নাজাতের ব্যবস্থা করছি। আমরা লোকদের উদ্ধার করতেছি, তাদেরকে আমরা তাজকিয়া করতেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্সিটি তাদের মধ্যে কাজ করে। এবং এটা মানুষ যখন প্রকাশ করে তাও ভালো। প্রকাশ না করলে এটা একটা কৃত্রিম বিনয় সৃষ্টি করে। সেটি আরো বেশি ডিজগাস্টিং। আপনার ভেতরে কী আছে, সেটা কিন্তু প্রকাশিত হবেই। আপনি তার সম্পর্কে কী মনে করেন, মানুষ কীভাবে যেন তা বুঝে ফেলে। আমাদের মধ্যে যদি মানবতাবোধ থাকে, মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করার যদি মেন্টালিটি থাকে তাহলে সেটা আমাদের আচরণের মধ্যে প্রকাশ পাবে। আমাদের চট্টগ্রামে হুজুরেরা ওয়াজের মধ্যে খুব বিনয় দেখায়। এগুলোর সাথে আমি খুব পরিচিত। এবং ইসলামের জন্য কাজ করে তারাও কিন্তু এক ধরনের প্রিস্ট-লাইক বিহেভিয়ার করে। এমন মেন্টালিটি পোষণ করে যে, ‘আমরা হলাম ভালো আর তোমরা খারাপ। আমরা তোমাদেরকে উদ্ধার করতে আসছি’। এভাবে মানুষের মন জয় করা যায় না। কৌশল হিসাবে এটি মোটেও ভালো কিছু নয়।
নিজেকে নাখান্দা (for nothing) ভাবা বাদ দিন:
সেলফ ব্র্যান্ডিং করুন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে অনেক জায়গায় বলেছেন, “আমি কোনো কিছুকে অনর্থক সৃষ্টি করিনি।” প্রত্যেকটা মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন। আপনাকে আমার মতো হওয়ার দরকার কী? আপনি আপনার মতো হোন। আপনার ভেতরে যে সুপ্ত সম্ভাবনা, ইনার পটেনশিয়ালিটি রয়েছে, তা খুঁজে বের করুন এবং সেটাকে আপনি ক্লেইম করুন। দেখুন, কালেমা কিন্তু ক্লেইম করতে হয়। প্রপার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের আউটকাম হিসাবে কালেমা তাইয়েবাকে যদি কেউ ডিক্লেয়ার করে, তাহলে আমার দৃষ্টিতে এরচেয়ে বেশি ক্রিয়েটিভ ও ফান্ডামেন্টাল কন্ট্রিবিউশান আর কিছু হতে পারে না। আমরা এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত যে, আমি কিছুই নই। ঐ যে আমাদের ক্লাসিক্যাল লেখকরা লিখতেন ‘আরজ গুজার, নাখান্দা, আমি কিছুই না, লিখেছি আর কি কোনোমতে’ ইত্যাদি; সেখান থেকে বোধহয় এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
আপনি যেটা বুঝেছেন, সেটা আপনি বলবেন। কেন বলবেন না? হ্যাঁ, হতে পারে নিজেকে এভাবে তুচ্ছ হিসাবে তুলে ধরাটা ঐ সময়ের ডমিন্যান্ট সোশ্যাল এন্ড ইন্টেলেকচুয়াল কালচার হিসাবে হয়তো ঠিকই ছিলো। বর্তমান সময়ে এ ধরনের এপ্রোচ অচল। যা বুঝেছেন, সঠিক মনে করছেন; তা আপনি দাবি করবেন। যা বুঝেননি কিংবা সঠিক মনে করেন না, তা জানার চেষ্টা করেন এবং সেটা অহেতুক আপনি দাবিও করবেন না।
এরপরে যে পয়েন্টটা সেটা খুবই startling –
More thinking, less reading:
কম পড়ুন, বেশি ভাবুন। বুকিশনেস পরিহার করুন। শিখতে থাকুন থামাথামি বাদ দিয়ে। আমি এই মাসে দশটা বই পড়বো– (আরে বাবা রে বাবা!) এগুলো কিন্তু একদম খারাপ পলিসি। অনেক স্টুডেন্ট হয়তো এটা করে থাকে পাশ করার জন্য। বিষয়বস্তু ঠিক মতো না বুঝেই কিছু লোক বলে, আমি এই এই বই পড়েছি। আমাদেরও রকম হয়ে গেছে যে, বিসিএস পরীক্ষা, অমুক পরীক্ষা, তমুক পরীক্ষাতে অমুক বইয়ের নাম ইত্যাদি পোলাপাইনের সব মুখস্ত, কিন্তু বইয়ের চেহারাও সে দেখে নাই! এমন একটা ফাঁকিবাজি এখানে চলছে। বিদ্যমান সিস্টেমের কারণেই হয়তো আমাদের মধ্যে এটা হয়েছে।
আমি কিন্তু শুরুতেই বলেছিলাম, আমার কথাবার্তা যথেষ্ট র্যাডিকেল। আপনারা হয়তো মোটেও ভাবতে পারেন নাই, আমি আপনাদের কম পড়তে বলবো! হ্যাঁ, যতটা পড়বেন, তারচেয়ে বেশি ভাববেন। বইয়ের কথাবার্তা ও মেসেজগুলোকে নিজের মতো করে আত্মস্থ করবেন। আপনার চিন্তাকে সহযোগিতা করার জন্য বই। নিজের চিন্তনকার্যে সহযোগিতা নেয়া আর অপরের চিন্তাকে গলাধকরণ করা– দুটো ভিন্ন জিনিস। কারো জন্যই আমি দ্বিতীয়টিকে সাজেস্ট করি না। স্বাধীন চিন্তাটা পাঠের চেয়ে অনেক বেশি হতে হবে। আশা করি ভুল বুঝবেন না।
আমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা যে ছবি আঁকেন সেগুলো কোথা থেকে পান? এগুলো তো আগে ছিলো না। এগুলো তো খুব ক্রিয়েটিভ জিনিস। তিনি আমাকে বললেন, আপনি কেন মনে করছেন এটা খুব ক্রিয়েটিভ? এগুলো তো সব প্রকৃতির মধ্যে আছে। আমি বললাম, কিন্তু আমি তো দেখি না। তিনি বললেন– দেখুন, যে বর্ণমালা পড়তে পারে না সে নিছক কতগুলো আঁকিবুকি দেখবে, কিন্তু যে পড়তে পারে সে লেখা পড়তে পারবে এবং সেটা থেকে অর্থ খুঁজে পাবে। তেমনি আপনি বুঝতে পারছেন না বলে…। অর্থাৎ, সব ন্যাচারের মধ্যে আছে। আমরা কী করি? আমরা এগুলোকে কালেক্ট করি আর কানেক্ট করি এবং এক জায়গাতে একটা ক্যানভাসের মধ্যে নিয়ে আসি।
অতএব, বেশি বেশি চিন্তা করুন। চিন্তার উপাদানগুলোকে কালেক্ট করুন এবং নিজের মতো করে সেগুলোকে কানেক্ট করুন। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ মত তথা ইসলামের অনুসারী হয়ে নিজেকে অন্ধ অনুসরণকারীর স্তরে অবনমিত করবেন না। জীবনে সঠিক পথে চলার জন্য যতটুকু বুঝজ্ঞানের দরকার তা হাসিল করা আপনার পক্ষে খুবই সম্ভব। এজন্য অতি বড় তত্ত্বজ্ঞানী হওয়া লাগবে না।
(৩) সাংগঠনিক কাঠামো
এরপর যে কথাগুলো বলবো তা সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে। ধারণা করছি, আপনারা একধরনের অর্গানাইজেশনাল সিস্টেমের মধ্যে আছেন। আমিও এক সময়ে ছিলাম। আমার এ কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আপনারা যেভাবে অভ্যস্ত তার সাথে সাংঘর্ষিক হবে। কিন্তু আপনারা যেহেতু এসেছেন আমার কথাগুলো শোনার জন্যে সেহেতু আমি যা ভালো মনে করছি তা-ই আপনাদের বলবো। ইসলামের জন্য কাজ করবেন। মুসলিম হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। হিসাবটা আপনি কীভাবে করবেন? ‘বিশ্ব-বাংলাদেশ এবং ইসলাম’– এই সূত্রের আলোকে করণীয় নির্ধারণ করবেন? নাকি আপনি যে বিশেষ একটি ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত – সেই সংগঠন যেহেতু কোরআন-হাদীস মোতাবেক চলছে বলে ধরে নিচ্ছেন – অতএব, সেটির চশমা দিয়ে আপনি বিশ্ব, বাংলাদেশ এবং সবকিছুকে দেখবেন? দুইটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি।
আমি বলবো, আপনারা সোজাসাপ্টা ইসলাম নিয়েই ভাবুন। যে কোনো বিষয়ে একপাশে বিশ্ব পরিস্থিতি, আরেকপাশে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে রেখে ইসলাম আপনাকে কী করতে বলে, সেভাবে নিজের করণীয়-কর্তব্য নির্ধারণ করুন। আপনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। এ দেশই আপনার ঠিকানা। কাজের ক্ষেত্র। আপনি যতই বিদেশে যান না কেন, আপনি বাঙ্গালি। লুঙ্গি না পরলে আপনার ঘুম আসে না, ভাত না খেলে আপনার মাথা ঠিক থাকে না, বাংলা ভাষায় ব্লগ না লিখলে আপনার দেশোদ্ধারের দায়িত্ব পালন হয় না ইত্যাদি।
আপনি যেহেতু বাংলাদেশে কাজ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত এবং বাংলাদেশটা বিশ্বব্যবস্থারই অংশ, সেহেতু বিশ্বের কোথায় কারা কীভাবে কাজ করছে সেগুলো আপনার পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, একেপি তুরস্কে যা করছে, চলো আমরা তাই করি। কিংবা, রশিদ ঘানুশী তিউনিশিয়াতে যা করছেন, চলুন আমরা তাই করি। শিক্ষা নিবেন, অনুকরণ করবেন না। বরং, একটা বাংলাদেশ মডেল গড়ে তুলতে হবে। এই কাজে অবদান রাখার জন্য আপনারা অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি।পরবর্তী জেনারেশন, অর্থাৎ আজ থেকে দশ, পনের, বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পর আপনাদের পরবর্তী জীবনে (আমরা তখন থাকবো কিনা জানি না) মানুষ বলবে– আইআইইউসি’র ক্যান্টিনে বসে, কিংবা অমুক ইউনিভার্সিটির গ্যারেজে বসে, বিভিন্ন কোনায় বসে তারা কাজের এই ধারাটা গড়ে তুলেছে। সেসব হোক বা না হোক, এতে করে আপনার-আমার দায়িত্ব তো পালন হবে।
টপ-ডাউন এপ্রোচ বাদ দিয়ে বটম-আপ এপ্রোচে কাজ করতে হবে। সব ইসলামী সংগঠনসহ ট্রাডিশনালি যারা ইসলামের কাজ করে এই কথাটা তাদের অনুসৃত কর্মধারার বিপরীত। কিন্তু আগামী শতাব্দীতে সাসটেইনেবল কোনো কাজ করতে গেলে এই এপ্রোচ বাদ দিয়ে নতুন এপ্রোচে আসতে হবে। সবাই কীভাবে কাজ করে? টপডাউন এপ্রোচে। কিন্তু আমাদেরকে বটমআপ এপ্রোচে কাজ করতে হবে। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ঠিক হয়ে গেলেই সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে যদি কাজটাকে ভাবেন, তাহলে তা টপডাউন এপ্রোচ।
এটা হচ্ছে মার্কসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের সকল পরিবর্তনের মধ্যে যে চার-পাঁচটা উপাদান সবসময় থাকে, অর্থনীতি তার মধ্যে একটি। এখন তাতে করে তারা ধরে নিয়েছে, ইকোনমিই – ইকোনমিও তারা বলে না, তারা বলে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ – হচ্ছে সব কিছুর পেছনে ‘দ্যা ফ্যাক্টর’। এখন ধরেন বেঁচে থাকার জন্য আমার হৃৎপিণ্ডও দরকার, ফুসফুসও দরকার, কিডনিও দরকার। একইসাথে অনেকগুলো অর্গান ফাংশান করার দরকার আছে। কিন্তু এর মানে এই নয়, হৃৎপিণ্ডই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বা, এটি হলো দ্যা ফ্যাক্টর।
ইসলামী আন্দোলনের প্রচলিত ধারার নেতাকর্মীরা মনে করে, ক্ষমতায় যেতে পারলেই কেল্লা ফতে। ক্ষমতায় তো আপনারা গিয়েছেন। আপনারা তখন কী করতে পেরেছেন? আপনারা আওজুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ পড়ে ওযু-কালাম শুরু করে আসতে আসতেই তো শেষ…। আর বর্তমানে যারা আছে তারা ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে শিক্ষানীতি কায়েম করে ফেলেছে। কমিশন গঠন করে রিপোর্ট বের করে কায়েম করে ফেলেছে। ঐ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছিলো বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে, তিনি আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে স্বাক্ষর করার পর মুহূর্তেই পকেট থেকে লিস্ট বের করে একে বদলি, ওকে বদলি ইত্যাদি করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারের সব সাজানো নির্বাচনী ছককে উল্টায় দিয়েছিলেন। এই যে ট্রাম্প জিতেছে, এখন কাকে কী করবে সবকিছু ঠিক করা আছে। তাই, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে। উপরে ঠিক করে তারপরে ময়দান গুছাবেন, এমন চিন্তা আদতেই ফ্লড। মাঠের কাজ মাঠেই করতে হয়। অব্যাহতভাবেই করতে হয়।
রাষ্ট্র ও সমাজের স্বাতন্ত্র্য:
এরপরে আমি যা বলবো, তা আপনাদের কাছে আরো আশ্চর্যজনক লাগবে। এতোদিন মনে করা হয়েছে, আমরা সোসাইটি থেকে স্টেটের দিকে যাবো। না, সোসাইটি এবং স্টেট দুটি আলাদা ব্যাপার। মনে করেন, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলো। তখন সামাজিক লেভেলের কাজগুলোর কী হবে? ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে যা চলছে তা যে ঠিক, এটা দেখানো? এই ঢোল বাজানো যে, এই সরকারই ঠিক? মন্ত্রী এটা বলছে, এটাই ঠিক? সরকার এটা বলছে, এটাই ঠিক? এভাবে ইসলাম কায়েম হচ্ছে, সেভাবে ইসলাম কায়েম হচ্ছে– এ ধরনের ঢোল পিটানো?
ব্যক্তিগতভাবে ভুল মনে করলেও পাবলিকলি সাংগঠনিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার প্রচলিত ভুল সিস্টেম যে একটা আত্মঘাতী ব্যাপার, তা বুঝতে হবে। অপজিশন লাগবে। লাগবে না? নিশ্চয়ই লাগবে। হক্ব পথে থাকার জন্যই লাগবে। সোসাইটি এক জিনিস, আর স্টেট আরেক জিনিস। সোসাইটির মধ্যে এমন কাজের ক্ষেত্র আছে যেগুলো আপনি জীবনেও শেষ করতে পারবেন না। অথচ, সেগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে টপডাউন এপ্রোচে কাজ করার ‘আইএসআইএস মেন্টালিটি’র উদগ্র বাসনা দ্বারা তাড়িত হয়ে আগে স্টেট কায়েমের জন্য অনেকে পাগল হয়ে আছেন!
একশো বছর আগে মাওলানা মওদূদী যখন ইসলামী আন্দোলনের এই ধারাণাটি জগতে প্রতিষ্ঠা করেন (প্রতিষ্ঠাতা কয়েকজনের মধ্যে তিনি একজন), তখন জগতে যে পরিস্থিতি ছিলো, সেই পরিস্থিতি এখন আর নাই। তখন কী পরিস্থিতি ছিলো? তখন ছিল চারদিকে একনায়কতন্ত্রের জয় জয়কার। জার্মানিতে হিটলার, ইতালিতে মুসোলিনি, ব্রিটেনে তখনো নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র অনেক শক্তিশালী, চায়নাতে কম্যুনিজম, রাশিয়াতে কম্যুনিজম। তাঁর লেখা ‘একটি সত্যনিষ্ঠ দলের প্রয়োজন’ বইটা যদি পড়েন তাহলে দেখবেন তিনি বলেছেন– বাতিল মতাদর্শের জন্য যদি এরকম জানবাজ লোক থাকতে পারে এবং তারা যদি এতো সফলতা অর্জন করে, তাহলে ইসলামের জন্য এ রকম কর্মীবাহিনী তৈরি করা গেলে ইসলাম নিশ্চয়ই বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি ছিলো নিতান্তই সরল একটা চিন্তা। প্রাথমিক ধারণা হিসাবে এটি ঠিকই আছে। কিন্তু এডভান্স লেভেলের জন্য এটি ভুল।
শুরুতে একটা ভ্রুণ থাকে। এর থেকে একটা শিশু জন্ম লাভ করে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু কেউ যদি আজীবন শিশুই থেকে যায়, তবে তা বিরাট সমস্যার ব্যাপার। এ ধরনের আজীবন শিশুকে লালন করা যায়, কিন্তু তার কাছ হতে বৃহত্তর মানবিক দায়িত্ব পালনের কিছু আশা করা যায় না। এটি স্পষ্টতই ম্যালগ্রোথ। বনসাইকে সাজিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু তার থেকে ফল লাভ হয় না। যে কোনো সমাজ আন্দোলনের ক্রম অগ্রগতি থাকতে হবে। গ্রোথ হতে হবে প্রপরশনেইট। উনারা প্রথমে ঠিক করেছেন, শক্তি অর্জন করবেন। ভালো কথা। তারপর কী হবে? শক্তি অর্জন করার পর কী করবেন, কীভাবে করবেন, কাকে দিয়ে করবেন?
এদিক থেকে আমি বেশ সৌভাগ্যবান। জীবনে অনেক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাত করতে পেরেছি। একজনের কথা তো একটু আগে বললাম। অন্য আরেকজন হলেন মীর কাশেম আলী। আমার বাসায় একবার এসেছিলেন। উনার বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছে। তিনি তখন আমাদেরকে বলেছিলেন, পুরো বাংলাদেশ চালায় যেসব সাংস্কৃতিক কর্মী, গণমাধ্যমে তাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে তিনশোর মতো হবে। এই তিনশো মানুষ পুরো বাংলাদেশটাকে, আমরা যা কিছু করছি, তা সব বরবাদ করে দিচ্ছে। এই তিনশো মানুষ আপনি কীভাবে তৈরি করবেন? এই তিনশো মানুষ তৈরি তারা একদিনে করতে পারে নাই। কীভাবে হয়েছে?
আমাদের সমাজে ইসলাম কিন্তু এখনো মেইনস্ট্রিম। আপনি মাইক লাগিয়ে ওয়াজ করেন, কেউ কিছু বলবে না। যাই করেন না কেন। আর এরা? বামপন্থী-নাস্তিক হিসাবে সমাজের মূলধারা থেকে বিতাড়িত হয়ে, আপনার বাড়ির মধ্যে জায়গা না পেয়ে, ঐ কোনায় জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে কুঁড়েঘর তুলেছে। তারপর বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে। এভাবে কোনাকানাগুলো সব দখল করেছে। একদিন আপনি ঘুম থেকে ওঠে দেখলেন, আপনি তাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছেন। আপনার সব পথঘাট, সবকিছু তারা নিয়ে ফেলেছে! সুতরাং, সমাজের মূলধারা না হওয়া, সমাজ থেকে নানা ধরনের নেতিবাচক ট্রিটমেন্ট পাওয়া– এগুলো এক অর্থে আল্লাহর রহমত বটে।
তাহলে আপনি দেখেন, আজকের যুগে রাষ্ট্র, আর একশ বছর আগে রাষ্ট্র, দুইটা এক কিনা। তখন রাষ্ট্রক্ষমতা যারা চালাতো, তারা জনগণের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। বর্তমানে মিডিয়া একটা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট হাউস একটা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াও কিন্তু এক ধরনের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এখন অনেক নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান চলে এসেছে, যেগুলো নানাভাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র এখন কিন্তু ততটা নিয়ন্ত্রণ করে না। আপনি বলতে পারেন, রাষ্ট্র তো এখন প্রতিটা জিনিসের ভ্যাট নিচ্ছে। তারমানে রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এটা বোধ হয় ঠিক নয়। রাষ্ট্র শুধু টাকাটা নিচ্ছে, কিন্তু আপনাকে কিছু করতে পারছে না। এবং রাষ্ট্র নিজেও কিন্তু বড় বড় এসব শক্তিকেন্দ্রগুলোর উপর নির্ভরশীল। সেগুলোতে আপনারা ঢুকতে পারেন, সেগুলোতে আপনারা কাজ করতে পারেন, সেগুলোকে আপনারা গড়ে তুলতে পারেন।
তাই আগে রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে নেই তারপরে সব উতরিয়ে ফেলবো– এটা হচ্ছে শিয়াদের থিওরি। শিয়ারা মনে করে, তাদের ১২তম ইমাম আসবে এবং এসে তাদের সবাইকে উদ্ধার করে ফেলবে। এজন্য তারা হুকুমতকে এড়িয়ে চলতো। রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়াতো না। ‘বেলায়েতে ফকীহ’ নামে যে তত্ত্বটা ইমাম খোমেনী দিয়েছেন তা তাদের এই মিউচুয়েল এক্সক্লুশানের ফিকাহর মধ্যে যে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে, তা হলো ফকীহরা হচ্ছে বেলায়েতপ্রাপ্ত। ইমামত ইমামদের জন্য খাস হলেও গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহরা হলেন বেলায়েতপ্রাপ্ত। সুতরাং তাদের কথার বাইরে রাষ্ট্র চলতে পারবে না। এই তো কনফ্লিক্ট লাগলো। বাকী ইতিহাস তো আপনারা জানেন। এখন আপনারা ইমামতের অধিকারী না হলেও বেলায়েত তো অর্জন করতে পারেন। ইমামতের (এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা) দরজা বন্ধ হলেও বেলায়েতের (মান কোয়ালিটি অর্জন করার) পথ তো খোলা আছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ব্যক্তি উদ্যোগ গ্রহণ করুন। একটা কেন্দ্র হবে, সেটির প্রতিনিধি হিসাবে লোকালি কাজ করা হবে– এসব হচ্ছে সংগঠন করার প্রচলিত তরিকা।
আচ্ছা, একটা সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্র লাগবে কেন? বাংলাদেশের প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকা, আমরা জানি। এভাবে সব দেশের রাজধানী থাকে। ঢাকার কোন জায়গা হতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়? সচিবালয়, বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইত্যাদি হতে। বুঝলাম। তো বলতে পারবেন, বাংলাদেশ সমাজের কেন্দ্র বা রাজধানী কোথায়? পারবেন না। কারণ, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্র থাকে, সমাজের সে অর্থে কোনো ফিজিক্যাল কেন্দ্র থাকে না। সেন্ট্রাল বডিতে সংস্কৃতিমনা লোক না থাকলে কেন্দ্র পরিচালিত সংগঠন ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক কাজের অনুমোদন কে দেবে? আবার, সেন্ট্রাল কমিটিতে সাংস্কৃতিমনা লোক থাকলেও বিপদ, না থাকলেও বিপদ। না থাকলে তারা ময়দান উপযোগী সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। আর থাকলে উক্ত সংস্কৃতিমনা শীর্ষ দায়িত্বশীলেরা সাংস্কৃতিক ময়দানের বিপরীত বা ভিন্ন ফিল্ডগুলো সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। কারণ, কোনো মানুষই সকল সামাজিক কর্মক্ষেত্রকে সমানভাবে বুঝতে পারে না। একেকজনের একেক দিকে যোগ্যতা থাকে। কেউই অল-স্কয়ার হয় না। তাই সামাজিক আন্দোলনের কোনো কেন্দ্র থাকবে না।
আপনারা একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, প্রশাসনিক বিন্যাস আর সামাজিক কাজ দুইটা কিন্তু আলাদা। এডমিনিস্ট্রেটিভ সেটআপে হায়ারআর্কি ইজ আ মাস্ট। হায়ারআর্কি থাকা মানে হলো কেন্দ্র থাকা। হাদীসে বলা হয়েছে, তিনজন ব্যক্তিও যদি সফর করে তাহলে একজন আমীর হবে। যে কোনো কাজেই একটা ক্রমসোপান থাকে। খেয়াল রাখতে হবে, সামাজিক কাজের এডমিনিস্ট্রেটিভ সেটআপ হলো লুজ এন্ড মোস্টলি হরাইজন্টাল। অফিসের প্রধান, আমীরে সফর আর নামাজের ইমাম– এগুলো ঠিক এক ধরনের হায়ারআর্কি নয়। প্রথমটা যতটা স্ট্রিক্ট, দ্বিতীয়টা ততটা নয়। পথ চিনে এমন যে কেউ আমীরে সফর হতে পারে, যদিও তিনি সফরের উদ্দেশ্যের দিক থেকে খুব একটা কোয়ালিফাইড নন। পথ চলার যে নেতৃত্ব তা যোগ্যতার সাথে বেশি সংশ্লিষ্ট। আর নামাজের ইমামতির সাথে সংশ্লিষ্ট যে নেতৃত্ব তার সাথে কোয়ালিটির সম্পর্ক অনেক বেশি।
এই যে গুগল, এর সেন্টার কোথায়? একটি অফিস আছে বটে, কিন্তু কোনো কারণে অফিসটা যদি ভেঙ্গেও পড়ে তবু গুগল বন্ধ হবে না। কারণ, ক্লাউড সার্ভার সিস্টেমের মাধ্যমে পুরো দুনিয়া জুড়েই এর নেটওয়ার্ক রয়েছে। বর্তমানে যে ধরনে কাজ হতে হবে, তা হতে হবে ব্যক্তি উদ্যোগ নির্ভর। এই যে আপনারা বলছেন, আমাদের কমিটি করা দরকার, আমাদের ওয়েবসাইট করা দরকার…, কিছু একটা বললেই ফর্মাল একটা কমিটি-স্ট্রাকচার করার কথাবার্তা চলে আসে। কমিটি-স্ট্রাকচার এগুলো থাকা খারাপ নয়। কিন্তু স্ট্রাকচার আর ইনস্পিরেশনের যে অনুপাত তা ঠিক থাকতে হবে। কাজের প্রেরণা ও স্পৃহা, কাঠামোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কমিটি ফরমেশন আর স্ট্রাকচার করার উপর যত বেশি ফোকাস করা হয়, কর্ম-উদ্যোম ততই কমতে থাকে। অথবা, এ ধরনের মাথা ভারী স্ট্রাকচারে প্রকৃত কর্মীরা সামনে আসতে পারে না। তাই পারতপক্ষে এগুলো না করা, বা একান্তই করতে হলে এগুলোকে বড় করে দেখা উচিত নয়।
দেখুন, সামান্য এস্টাবলিশমেন্ট নিয়ে – হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেছে – এখন আর অনেকে ইসলামী আন্দোলন করে না। আবার দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় প্রফেসর কিন্তু নিজের পজিশনকে খুব একটা বড় করে দেখেন না, কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথম জন তার এস্টাবলিশমেন্টটাকে হজম করতে পারে নাই। আর দ্বিতীয় জন এস্টাবলিশমেন্টকে কাজে লাগাচ্ছেন। এস্টাবলিশমেন্ট তাকে গিলতে পারে নাই। অতএব, আপনারাও প্রয়োজনে স্ট্রাকচার করবেন। তবে, সেটাকে কাজের প্রয়োজনে গড়ে উঠতে দেন। চাপিয়ে দিবেন না। আর ইন্সপিরেশানের ব্যাপারটাকে বেশি করে খেয়াল রাখবেন।
এই ব্যাপারে শেষ কথা হচ্ছে ইউনিট করা নিয়ে। সাংগঠনিক ইউনিট কীভাবে করবেন? যে কোনো একটা কাজের জন্য ইউনিট করা (গড়ে উঠা অর্থে) ভালো। যেমন আপনারা এখানে এটা করেছেন। এটা আইআইইউসি বেইজড। আমি যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করি, সেই কারণে সিএসসিএস চবি বেইজড। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, কিংবা দাওয়াতী সংগঠন ইত্যাদি যে সংগঠনই বলুন না কেন, সাধারণত এলাকাভিত্তিক এগুলোর ইউনিট করা হয়। ভবিষ্যতে যারা কাজ করবেন তারা ইউনিটগুলো করার ক্ষেত্রে লোকালিটি তো দেখবেনই, সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মনমানসিকতাও দেখবেন বা দেখতে হবে। একই এলাকায় থাকা সত্ত্বেও একেকজন একেক মনমানসিকতার হয়ে থাকে। আলেমদের সংগঠন, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন, গণমাধ্যমের সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন– এভাবে একেক ক্ষেত্রের কাজের জন্য আলাদা আলাদা ইউনিট হতে হবে। সবকিছুকে গুলিয়ে ফেললে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই তেমনভাবে হবে না।
(৪) উপসংহার: ব্র্যান্ডিং ইসলাম
শেষ কথা হলো, ইসলামকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, ধর্ম হিসাবে নয়। একটা অদ্ভুত কথা আমাদের খুব জ্ঞানীগুণী লোকেরাও বলেন– ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যার মধ্যে রাজনীতি আছে, সমাজনীতি আছে, সংস্কৃতির সবকিছু আছে, অর্থনীতি আছে, যুদ্ধনীতি আছে, এক কথায় সবকিছু আছে। ব্যাপারটা এমন যে, এটা হচ্ছে এমন একটা মহিলা যে পুরুষের কাজও করে, বাচ্চাদের কাজও করে, সবার সব কাজই করে! এটা তো সোনার পাথরবাটির মতো অদ্ভুত একটা ব্যাপার।
ধর্মের কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। সুনির্দিষ্ট পটেনশিয়ালিটিজও আছে। আবার সীমাবদ্ধতাও আছে। এটা মনে রাখতে হবে। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত কথা না বলে শুধু উপসংহারটুকু বলতে চাই। ইসলাম হলো ইসলাম। ধর্মীয় দিকটা এর কোর বা মূল অংশ। যেমন করে মস্তিষ্ক আমাদের দেহের একটা ক্ষুদ্র অংশ, যদিও তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংগ। ইসলামকে বড়জোর আইডিওলজি হিসাবে বলতে পারেন। শরীয়াহর কথাই ধরুন। যারা শরীয়াহর পক্ষে বা বিপক্ষে, বাংলাদেশে কিংবা বিদেশে– তাদের কাউকেই শরীয়াহকে ইসলামী হিসেবে ডিফাইন করতে হয় না। শরীয়াহ বললেই বুঝায় ইসলামী শরীয়াহ। এটা কিন্তু সবাই বুঝে ফেলেছে। যেমন, ভারতীয় একটা শব্দ হলো গুরু। গুরু শব্দটা কিন্তু ইংরেজি ডিকশনারিতে এখন ছাপা হয়ে গেছে। তাহলে, ইসলামও একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে অসুবিধা কী?
ইসলামকে ইসলাম হিসাবেই ব্র্যান্ড করুন। ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, যুদ্ধনীতি ইত্যাদি মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সবদিক নিয়ে যেখানে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শের কথা বলা আছে। আপনি ইসলামের জন্য কাজ করবেন। ইসলামে সবকিছু থাকলেও আপনি সবকিছুতে এনগেজড হবেন না। প্রচলিত সংগঠনগুলো ইসলামের সামগ্রিকতা বুঝতে এখানেই ভুল করে সবাইকে দিয়ে সব কাজ করাতে চায়। আপনি যখন কালচার নিয়ে কাজ করবেন, আপনি এটা নিয়েই থাকবেন। আপনি আর কিছুই করবেন না। বাকিগুলোকে আপনি অন্তরে সমর্থন করবেন। যারা রাজনীতি করবে তারা ফুলটাইম রাজনীতি করবে। অন্য বিষয়ে তারা নাক গলাতে আসবেন না। মিছিলে বক্তব্য দিয়ে শববেদারীতে আলোচনা পেশ করার যে প্রচলিত রীতি, তা বাস্তবতার বিরোধী। কেউ এতো সুপার হিউম্যান হয় না। এ ধরনের ভজঘটের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ওভারঅল কাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাহোক, এটা তো নিশ্চিত, Islam will prevail and it will be the ideology of the 21st century। তাহলে এতে আপনার কন্ট্রিবিউশান কী? ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যাওয়া এই কাজের ধারায় আপনার অবস্থান ও কর্মতৎপরতা নিশ্চিত ও দৃশ্যমান করুন। Take your part.
বাংলাদের যেমন একটা স্পেসিফিসিটি দরকার, একটা বাংলাদেশ মডেল দরকার, ঠিক তেমনি আপনার কাজেরও কিন্তু একটা ক্ষেত্র ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ জরুরি। এটি আপনাকেই করতে হবে। আমি ইসলামের কাজ করবো, দায়িত্বশীলেরা যতটুকু বলে ততটুকু– এ রকম মানসিকতা পোষণ করলে আপনাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। অবশ্য একটা কাজ হবে। সেটা হলো, আপনি একটা ভালো কাজে লেগে আছেন, অন্ততপক্ষে কোনো গুনাহর কাজে লিপ্ত হন নাই। এটুকুই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এক একজন দাঈ ইলাল্লাহ ও খলিফাতুল্লাহ হিসাবে দায়িত্ব পালনের তৌফিক দিন। আমীন।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
ইশতিয়াক হায়দার চৌধুরী: ছন্দের মতো। এক নিমিষে পড়ে ফেললাম। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে অবজারবেশন আছে, এর উপর এনালাইসিস আছে কিন্তু ডিরেকশনটা কম। অনেককেই এমন নতুন কিছু বলতে শুনি। এদের অধিকাংশই ‘করতে হবে’ এই তত্ত্বের উপর জোর দেয় কিন্তু ‘ কিন্তু কিভাবে করতে হবে’ এই বিষয় তাদের আলোচনায় খুব কম পাওয়া যায়।
এরপর আপনি আল্লামা ইকবালের একটি উক্তি দিয়েছেন ‘সেল্ফ ব্রেন্ডিং’। সেখানে আপনি বলতে চেয়েছেন নিজেকে ছোট করে দেখতে নেই; কিন্তু আল্লাহর রাসূল কিন্তু দোয়া করছেন ‘আল্লাহ! আমি যেনো নিজেকে ছোট ভাবি, মানুষ যেনো আমায় বড় ভাবে’। অর্থাৎ ছোট ভাবার বিষয়টি যেমন আছে তেমনি স্লেফ ব্রেন্ডিং এর বিষয়টি আছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনি ডিবেট করেছেন সেখান আমার মনে হয়েছে এটি পরিভাষাগত সমস্যা। কিন্তু ভেতরের ভাব কিন্তু এক। যেমন নিজেকে ছোট করে দেখো এর মানি এই নয় হুম তুমি বড় হবে না কিন্তু…. যেমন অর্গান সিস্টেমে অনেকে রাগ করে বলে, তোমার মতো লোক দরকার নেই’। আসলে এটি তো হিট দেওয়ার জন্য,তাই নয় কি??? তবে একটি বিষয় খুব ভাল লেগেছে মওদূদী সাহেবের চিন্তা ও সমসাময়িক বিশ্ব নেতৃত্বের যে কনসিক্যুয়েন্স করেছেন তা ভালো লেগেছে। হতেই পারে একটি সময়ের চরিত্র আরেকজনকে প্রভাবিত করতে পারে। যাইহোক আপনি বলেছেন, যা পড় তারচেয়ে বেশি চিন্তা করো। তাই অল্প পড়ে এই বিস্তর এলোমেলো চিন্তা। ক্ষমা করবেন স্যার।
Mohammad Mozammel Hoque: প্রচলিত কাজের সমস্যার দিকগুলো নিয়ে পৌণে চারশো পৃষ্ঠার একটা বই ইতোমধ্যে তৈরী করেছি। করণীয় বা নতুন কর্মপদ্ধতি নিয়ে এই সাইজের একটা বইও প্রায় তৈরী। আশা করি, এ মাসের মধ্যেই এগুলোর পিডিএফ লিংক দিয়ে পোস্ট দিতে পারবো।
Mohammad Mozammel Hoque: @ Shaikhul Abrar, বর্তমান সময়ের সমস্যা ধর্মতাত্ত্বিক নয়, কনসেপ্টচুয়্যাল বা ফিলোসফিক্যাল – এই কথাটা দিয়ে শুরু করলেও সবাইকে ফিলোসফি চর্চা করার কাজে নিরুৎসাহিত করেছি। কিছু তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত বাতিল মতাদর্শসমূহকে মোকাবিলা ও খণ্ডনের কাজে নিয়োজিত থাকবে। বাদবাকী বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা জনশক্তি নিতান্ত ব্যক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতা হতে নিজ নিজ ‘জীবন দর্শন’ গড়ে তুলবে, সরল ও অবিমিশ্র জীবনোপলব্ধির আলোকে পথ চলবে। নেতিবাচক তর্কে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ইতিবাচক সত্যকে জানার উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করবে। এ জন্য নিজস্ব জীবনবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও তাওহীদের অটল প্রত্যয় দিয়ে মজবুত সামাজিক রক্ষাবলয় (safe belt or shield) তৈরী করতে হবে। প্রজন্মকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র উপায়। বিষয়টা সিগনিফিক্যান্ট।
Farid A Reza: পড়লাম। চমৎকার। যথেষ্ট চিন্তার খোরাক আছে এখানে। সেইভ করে রাখলাম। সময় করে লেখবো। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘দায়ী ইলাল্লাহ’ বা ‘খলিফাতুল্লাহ’র পরিবর্তে একজন অনুগত বান্দাহ হিসেবে বাঁচতে চাই এবং মরতে চাই। এটা নিজের জন্যে নিজের চিন্তা।
Muhammad Abu Bakr Molla: অনুগত হলে তো আপনাকে দায়ী ইলাল্লাহ এবং খালিফা হতেই হবে
Abdullah AL Takdir: আলহামদুলিল্লাহ! গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সংশোধন এবং সংস্কারের জন্য সুন্দর খোরাক। লেখাগুলো সফল তখনই যখন এই চিন্তার ভিত্তিতে ময়দানে আমরা কাজ করতে পারবো। কিন্তু সমস্যা হলো লেখাটা পড়ার পরক্ষনেই গতানুগতিক হয়ে যাই, হতে বাধ্য হই! এক্ষেত্রে করণীয় কি?
Mohammad Mozammel Hoque: এই সব বলাবলিই একদিন করা-করিতে পরিণত হবে। সেটি কত শীঘ্র হবে তা নির্ভর করছে আপনার-আমার-আমাদের উপর।
Abdullah AL Takdir: সেমিনার/সিম্পোজিয়াম ভাল ফলাফল দিতে পারে।
স্যারের অনেক চিন্তা আমি নিজে থেকেই অগোছালোভাবে করি এবং বলি। এজন্য লেখাটি বেশি ভাল লেগেছে।
বাস্তব ময়দানের চ্যালেঞ্জ কঠিন এবং নতুন হচ্ছে দিন দিন। বিশেষ করে ছোট ছোট ঘরগুলোতে সত্যিই চারদিকটা পূর্ন হয়ে গেছে। ব্যক্তি উদ্যোগ অনুপ্রেরিত হওয়ার বিপরীতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নিজেদের থেকেই। চিন্তার যায়গায় অনুকরণীয়তা চলার গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারছে না। দোয়া চাই, সর্বোচ্চ চেষ্টার ইচ্ছা আছে।
Shahadat Mahmud Siddiquee: সবই আগে কোথাও না কোথাও পড়েছি মনে হচ্ছে, এবং আপনার লিখাতেই। তবে প্রেজেন্টেশানটা দারুণ। দুইটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না।
এক. তাওহীদ প্রসঙ্গ। ‘প্রপার ও কন্টিনিউয়াস আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব তাওহীদ না থাকলে শুধু কিতাব থেকে সঠিক পথ নির্দেশ কেউ লাভ করতে সক্ষম হবে না’।
দুই.স্ট্রাকচার আর ইনস্পিরেশনের অনুপাত প্রসঙ্গ। ‘কাজের প্রেরণা ও স্পৃহা, কাঠামোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কমিটি ফরমেশন আর স্ট্রাকচার করার উপর যত বেশি ফোকাস করা হয়, কর্মউদ্যোম ততই কমতে থাকে। অথবা, এ ধরনের মাথা ভারী স্ট্রাকচারে প্রকৃত কর্মীরা সামনে আসতে পারে না’।
দ্বিতীয়ত, এডিট করে নিতে পারেন- একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।
তৃতীয়ত, মাওলানা মওদূদী ‘একটি সত্যনিষ্ঠ দল’ বলতে ঠিক ওরকম কোনো দলই কি বুঝিয়েছেন? বিশেষত, ‘ইসলামী বিপ্লবের পথ’ পড়লে সেরকম মনে হয় না। তিনি সেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য ‘ব্যক্তিগত, দলীয় এবং সামাজিক চরিত্র সৃষ্টি’র কথা বলেছেন। ‘সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি’র কথা বলেছেন। এবং পুরো প্রক্রিয়াকে বীজ থেকে ফল ফলানোর সাথে তুলনা করেছেন।
এছাড়া ‘ভাঙ্গা গড়া’ এবং ‘ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি’তে তো ‘মৌলিক মানবীয় চরিত্রে’র কথা বলতে গেলে অপরিহার্য হিসেবেই এনেছেন। সমস্যা আসলে এইসব পড়াপড়ির চেয়েও আরো জটিল আরো গভীর। ঐ যে বললেন- ‘জীবন বোধ থেকে বেড়ে ওঠা’! এটা কিভাবে এই অনিশ্চিত দৌঁড়াদৌড়ির পৃথিবীতে পুঁজিবাদী জীবন দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করে বেড়ে উঠতে পারে, সেটা এখন ক্রমাগত বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে…