“সমতায় নারী, ক্ষমতায় নারী” — এই লেখা নিয়ে ঢাউস সাইজের একটা ব্যানার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলেছে দীর্ঘদিন। ছাত্রী হলের দিকে ভিসি হিলের নিচে এটি দেখেছি প্রথমবার। এরপর এটি অনেক দিন ঝোলানো ছিল পুরাতন কলাভবনের দেয়ালে। সর্বশেষ দেখেছি গত সপ্তাহে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সামনে। আজকে বিকেল বেলায় সেখানে গেলাম সেটার একটা ছবি তোলার জন্য। দেখি, ব্যানারটা সেখানে নাই।

সে যাই হোক। ক্ষমতায় থাকলে সমতা হয় কী করে? সমতা আর ক্ষমতা তো পরস্পর পরস্পরকে নাকচ করে। কীভাবে অপরপক্ষকে ঘায়েল করা যাবে তা নিয়ে ক্ষমতাশালীমাত্রই সব সময়ে ফিকিরে থাকে। যেখানেই ক্ষমতা, সেখানেই রাজনীতি। রাজনীতি আর ভালোবাসা তো দুই তরীকার জিনিস। ক্ষমতাশালীরা পরস্পরের সাথে সন্ধি করে নিছক কৌশল হিসেবে। এটি ব্যক্তির জন্যও প্রযোজ্য, গোষ্ঠীর জন্যও প্রযোজ্য।

তারচেয়েও গোড়ার কথা হলো, law of identity অনুসারে দুনিয়াতে কোনো জিনিসই সমান না। যে বৃহত্তর ক্যাটাগরির অধীনে সমতাকে আমরা অনুমান করি, সেই বৃহত্তর ক্যাটাগরির অধীনে সব লোকজন থাকে ছোট-ছোট সাব-ক্যাটাগরিতে ভাগ হয়ে। এসব সাব-ক্যাটাগরির মধ্যে অসমতা বা হাইয়ারআর্কি থাকাটা অনিবার্য। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য তথা স্টাফ হিসেবে আমরা সবাই সমান। অথচ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় চলে একটা স্ট্রিক্ট অ্যান্ড ওয়েল ডিফাইন্ড হাইয়ারআর্কিতে। দুনিয়ার সবকিছুতেই এই হায়ারার্কি ক্রিয়াশীল।

ধর্মের দৃষ্টিতে বললে, আল্লাহ তায়ালা একজনকে অপরজনের ওপর, এক গ্রুপকে অপর গ্রুপের ওপর মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিকোণ হতেও ব্যাপারটা সেইম। প্রকৃতি কাউকে বা বিশেষ কোনো গ্রুপকে কোনো দিক হতে ফেভার করে যা অনুরূপ অনেককেই বা অপরাপর গ্রুপগুলোকে করে না। এই দৃষ্টিতে, luck-distribution is a brute fact in nature ।

খোদা তায়ালা কেন সবাইকে সমান করেন নাই, সর্বক্ষেত্রে সমতাবিধান করেন নাই তার সদুত্তর ধার্মিকের কাছে নাই। একইভাবে ‘প্রকৃতি’ কেন সবাইকে সমান করে নাই, সর্বক্ষেত্রে সমতাবিধান করে নাই, তার কোনো সদুত্তর প্রকৃতিবাদীদের কাছে নাই।

সমতা চলে শুধুমাত্র নৈতিক বিবেচনার ক্ষেত্রে। প্রয়োগিক দিক থেকে সমতার ধারণা অচল, অকার্যকর। সর্ট অব ডিসফাংশানাল ফ্যান্টাসি। এখানে ন্যায্যতার কথা আপনি আনতে পারবেন না। কেননা, আমরা জানি, equity is justified inequality ।

একটু ব্যাখ্যা করে বললাম কেন আমার কাছে, ‘সমতায় নারী, ক্ষমতায় নারী’ – এই শ্লোগানটাকে বিরোধপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। হতে পারে, এর তাৎপর্য আমি ধরতে পারি নাই। এ ব্যাপারে কেউ কি আমাকে একটুখানি হেল্প করবেন?

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Shahriar Johan: আসলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে কিছু এগজিস্ট করে না। মেল ডমিন্যান্ট সোস্যাইটিতে মেলরা নিজেদের সেন্ট্রালাইজ করে ফিমেলদের মার্জিনালাইজড করে দিছে। এখন নারীরা যদি তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। তাহলে নারীদের কাজ হবে নিজেদের সেন্ট্রালাইজ করে পুরুষদের মার্জিনালাইজড করা। ন্যাচারে নারী-পুরুষ সমতা বলে কিছু নাই। ইকুয়ালিটি একটা ভোগাস কনসেপ্ট।

Fahim Ushher: সমতা = ইকুয়ালিটি অফ অপরচুনিটি, ক্ষমতা = ক্ষমতায়ন/এম্পাওরমেন্ট। ইকুয়ালিটি অফ অপরচুনিটির উদ্দেশ্যে ক্ষমতায়ন, এইভাবে পড়া যাইতে পারে। স্লোগানে তো আর এভাবে ভেঙ্গে বলা সম্ভব না।

Mohammad Mozammel Hoque: সমতার দাবীকে Equality of opportunity অর্থে না নিয়ে equality of outcome অর্থে কেন নেয়া হবে না?

ন্যায্যতার মাধ্যমে কেউ যদি সমতা বিধান করতে চায় তাহলে তো তার উচিত সমতার কথা না বলে ন্যায্যতার কথা বলা। কেননা, অনির্দিষ্টভাবে শুধু সমতার কথা বললে সেটা equality of outcome-এর মত অবাস্তব জিনিসকেও তো ইকোয়ালি ইনক্লুড করে।

Fahim Ushher: আপনি যেভাবে সমতাকে সমস্যায়িত করছেন, আমি নিশ্চিত আপনি চাইলে ন্যায্যতা শব্দটাকেও একই মাত্রায় সমস্যায়িত করতে পারবেন। আমি স্লোগানটাকে বিপরীত চিন্তাকে বেনিফিট অফ ডাউট দেয়ার তরিকা অনুসারে ‘উদার’ভাবে পড়ার চেষ্টা করলাম, যে এটার কোনো ‘গ্রহণযোগ্য’ ইন্টারপ্রিটেশন থাকতে পারে কিনা। সেটাই বললাম।

Mohammad Mozammel Hoque: হ্যাঁ, গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা ভাষ্য তো হতেই পারে। যেমন, আপনি যেটা বললেন, আমিও যেটা বললাম। সুযোগের সমতা। এটা তো একটা ভালো জিনিস।

যারা সমতার কথা বলে তারা সুযোগের সমতার কথা বলে না। বৈষম্যের যেসব উদাহরণ তারা নিয়ে আসে, সমতা বাস্তবায়নের জন্য যেসব করণীয় এর কথা তারা বলে, তাতে করে বোঝা যায়, তারা সমতা বলতে ফলাফলের সমতাকে বুঝায়। সমস্যা ঠিক এখানে। এগেইন, equality in the sense of equality of outcome, এটি সম্পূর্ণ অসম্ভব, অবাস্তব এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ একটা দাবি।

Fahim Ushher: খুবই ট্রিভিয়াল একটা জিনিসের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ কর‍তে চাই। এই যেমন আপনি বললেন, যারা সমতার কথা বলে তারা ফলাফলের সমতাকে বুঝায় – নারীবাদ বা নারীবাদী বললে আমাদের মাথায় তাদের কথাই আসতেছে। তেমনি নারীবাদীরা যখন প্যাটিয়ার্কি শব্দটা শোনে, তাদের মাথায় প্যাট্রিয়ার্কির সবচেয়ে দুর্বল দিক এবং নিকৃষ্ট উদাহরণগুলাই আসে।

আমার একটা সহজ সরল অদার্শনিক প্রস্তাবনা হইল – প্যাট্রিয়ার্কির উৎকৃষ্ট ভার্সন আর ফেমিনিজমের উৎকৃষ্ট ভার্সনের প্রায়োগিক চেহারার মাঝে তেমন একটা পার্থক্য নাই। আমরা একে অপরের উপরে গোস্বা কম করলে এটা কিন্তু সহজেই ধরতে পারতাম।

Mohammad Mozammel Hoque: বাহ, আপনার সাথে চমৎকার আলোচনা হচ্ছে! আসলে আমরা যখন কোনো কথাকে বুঝার চেষ্টা করি, ইংরেজিতে বললে, when we try to define a term, আমাদের যেটা করা উচিত সেটা হল অধিকাংশ লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কথাটা দ্বারা কী বোঝে সেটাকে সেই জিনিসের সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করা।

যেমন, ধর্ম। কেউ কেউ বলতে চায় ধর্ম হলো এমন কিছু যেটার মধ্যে সবকিছু আছে। অথচ অধিকাংশ লোকেরা অধিকাংশক্ষেত্রে মনে করে, ধর্ম হলো মানুষের জীবনের একটা সুনির্দিষ্ট বিষয় যেখানে কিছু বিলিফ সিস্টেম, কিছু রিচুয়াল এবং কিছু সুপারন্যাচারাল জিনিস থাকে।

সেক্ষেত্রে আমরা বলবো না যে ধর্মের দুই ধরনের সংজ্ঞা আছে। বরং আমরা বলবো, ধর্মের সাধারণভাবে প্রচলিত আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা ডেফিনেশনটাই কারেক্ট। অন্যটা হলো এক্সট্রাপোলেশন বা ভুল ব্যাখ্যা।

তেমনি করে, কেউ কেউ নারী অধিকার অর্থে নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন। এই ধরনের etymological definition মারাত্মক ধরনের ভ্রান্তি ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। একটা শব্দের মূলগত বা বুৎপত্তিগত অর্থ যা, সচরাচর সেটার প্রচলিত অর্থ ঠিক তাই হয় না।

আগেই বলেছি, কোনো কিছুকে ডিফাইন করার ক্ষেত্রে আমি জেনারেল পিপলস কমন আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে প্রায়রিটি দেই। সে হিসেবে নারীবাদের যে সাম্প্রতিক বোঝাপড়া, গতিপ্রকৃতি এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রচলিত, নারীবাদ বলতে আমরা ঠিক সেটাকেই সঠিক সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করবো, বুঝবো। একে আমরা মানি বা না মানি, সঠিক বা ভুল মনে করি, সেটা ভিন্ন বিষয়।

এখানে আরেকটা সমস্যা আছে। পিতৃতন্ত্র এবং পুরুষতন্ত্র দুইটা ঠিক এক জিনিস না। অথচ ইংরেজিতে একটা শব্দ দ্বারাই দুইটাকে বোঝাতে হয়।

আর বিপক্ষকে মোকাবেলার সময় প্রত্যেক পক্ষের যে সুবিধাবাদিতার নীতি, সে ব্যাপারে যা বলেছেন সেটাও সঠিক। যে কোনো বিষয়ে বিবাদমান পক্ষদ্বয় পরস্পরের উইক পয়েন্টস নিয়ে কথা বলে এবং নিজেদের অপরচুনিটিগুলোকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *