সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানীদের কথা মানতে হবে। কিন্তু জ্ঞানীরা যখন পরস্পর বিপরীত কথা বলেন তখন কী হবে?

এই প্রশ্নের উত্তরে একজন সুধী সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, “অধিকতর সঠিকটি এবং অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিরা যে মত গ্রহণ করেন সেই পথ গ্রহণ করতে হবে।”

দেখুন, এখানে কোয়ান্টিটি আর কোয়ালিটিকে এক করে ফেলা হয়েছে। হতে পারে কোনো ক্ষেত্রে অধিকাংশের মতের চেয়ে ক্ষুদ্রাংশের মতই সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী। সত্য তো গণভোটের ব্যাপার নয়। আমার ২নং প্রশ্ন ছিল:

আওয়াম তথা সাধারণ জনগণের হক কথা বলার অধিকার না থাকলে রাসূল (স.) যে বলেছেন ‘তোমরা সম্ভব হলে আমার একটি কথা হলেও লোকদের কাছে পৌঁছাও’, এটার কী হবে?

তিনি উত্তর দিয়েছেন: “হ্যাঁ, রাসূলের (স.) প্রত্যেকটি কথাই পৌঁছে দিতে হবে, সেগুলো হাদিস। তবে সকল হাদিসের উপরে একত্রে আমল করা সম্ভব নয়।”

এখানে তিনি স্বীকার করেছেন, আওয়ামরাও কথা বলতে পারবে তাদের সীমিত জ্ঞানের ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে কমনসেন্স, নর্ম এবং গাইডেন্স হচ্ছে যা তারা জানে না তা জ্ঞানীদের কাছ হতে জেনে নিবে। আগেকার যুগে জ্ঞানীরা কোনো একটা করণীয় শুধু বলে দিতেন। কীভাবে এবং কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা নিয়ে আওয়ামরা মাথা ঘামাতো না। জন্মগতভাবে মুসলমান হওয়ার মতো মাজহাব অনুসরণটাও ছিল জন্মগত লটারির মতো ফিক্সড ব্যাপার।

‘এটাই ফেকাহর বিধান’ বলে কোনোকিছু চাপিয়ে দেয়ার সময় যে তথ্যপ্রবাহের এই জামানায় শেষ হয়ে গেছে তা আমাদের আলেম সমাজ মানতে পারছেন না। আলেম সমাজ জ্ঞানী সমাজ না হওয়ার চেয়েও বেশি হয়েছেন ধর্মগুরু সমাজ, প্রিস্ট ক্লাস। ধর্মীয় ব্যাপারে অথরিটি। মানুষ আর খোদার মধ্যস্থাকারী। ঝামেলা ঠিক এইখানে।

৩ নম্বরে আমি প্রশ্ন করেছি: কোনো মুসলিমকে যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভিন্ন ধরনের আমল করে এমন মুসলিম কিছু জিজ্ঞাসা করবে, বা কোনো অমুসলিম জানতে চাইবে, তখন সে কী করবে?

এর উত্তরে তিনি বলেছেন, “অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতামত এবং আমলের বিপরীতে হাদিস থাকতে পারে। সেটা সুন্নত কিনা দেখতে হবে। তবে এই ক্ষেত্রে যদি নিজে মুজতাহিদ হোন তাহলে সেটা ভুল হলেও একটি ছোয়াব পাবে। তবে যে কেউ মুজতাহিদ হতে পারে না।”

দেখুন, হাদিস আর সুন্নাহ’র পার্থক্য নিয়ে কথা বলে এই প্রশ্নের তিনি উত্তর এড়িয়ে গেছেন। কোরআন ও হাদিস হতে সুন্নাহ সাব্যস্ত করা হয়, এটি তো আমি অস্বীকার করি নাই। এখানেও তিনি ট্রুথকে কোয়ান্টিফাই করেছেন। এটি ভুল। অথচ আমরা জানি, পরিমাণ দিয়ে সবসময়ে সত্যনির্ণয় একটি বিপদজনক প্রবণতা। কোরআন শরীফে আকছার (মানে, অধিকাংশ) শব্দটি যত জায়গায় এসেছে তত জায়গাতেই এটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এরমানে আবার এটিও নয় যে কখনো অধিকাংশকে মানা যাবে না। ফলকথা হলো, সত্য এবং সংখ্যার সম্পর্ক অকেশনাল। মানে, নট নেসেসারি। আইডেন্টিকাল হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।

উনার কাছে আমার ৪নং প্রশ্ন: আমার মতো দর্শনবিশেষজ্ঞদের জ্ঞান কি ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন?

এর উত্তরে তিনি বলেছেন, “না, আপনি একজন মুসলিম। আপনার জ্ঞান ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত। তবে সেটা ইসলাম নয়। ইসলামি অনুশাসন মানার ক্ষেত্রে আপনার চেয়ে একজন ইসলামি স্কলারের কথা প্রাধান্য পাবে।”

প্রতিক্রিয়া: এ’জন্যই বলি, এইসব মসজিদ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে এ’গুলো লিবারেল সেকুলার সেটআপের ইন্টিগ্রাল পার্ট হিসেবে কাজ করছে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ ও কর্তৃপক্ষ শুধু ঈমান, আকীদা আর ‘আমল’ এর ব্যাপারে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে। দুনিয়া পরিচালনার দায়িত্বকে তারা কার্যত অস্বীকার করে। এ’ধরনের যোগ্যতা অর্জনও যে ফরজ কিংবা ওয়াজিব, তা তাদের মস্তিষ্কে ফাংশান করে না। আলেম বলতে তারা শুধু ‘নুসুকের’ (rituals) আলেম হওয়াকে বুঝে থাকেন।

কোরআন-হাদিসে আলেমের যে গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে সেই আলেমের পরিচয় বা লক্ষণ হিসেবে আমার জানা মতে তুলনামূলকভাবে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে কোরআনের সূরা রূমের ২২ নং আয়াতে। وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। And among His Signs is the creation of the heavens and the earth, and the variations in your languages and your colours: verily in that are Signs for those who know. (সূরা আর রূম: ২২ নং আয়াত)

আল্লাহ তায়ালা মানুষ বানাইছেন দুনিয়া পরিচালনা করার জন্য। সেই যোগ্যতা থাকা তো দূরের কথা, দুনিয়া পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করা যে দরকার, এই রিয়ালাইজেশনটুকু উনাদের নাই। উনারা আছেন শুধু আল্লাহর হক অর্থে যে এবাদত সেটা নিয়ে। বান্দার হক তথা মুয়ামালাত নিয়ে উনাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। খেলাফতের দায়িত্বপালনের কোনো পরিকল্পনা, কর্মসূচী, এমনকি দায়িত্ববোধ, এসবের বালাই উনাদের নাই। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আর অযথা ফখর দিয়ে সবার মাথা ভর্তি।

অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, খাদ্যনিরাপত্তা, জন ও সামরিক নিরাপত্তা, গণনৈতিকতা, মিডিয়া, কালচার, কমিউনিকেশন কোনোকিছু নিয়ে উনাদের কোনো টেনশন নাই। মাইক লাগিয়ে চিল্লাইতে পারলেই খুশী। উনাদের ফেকাহ চর্চা কেবলমাত্র তাহারাত জাতীয় বিষয়াবলীতে সীমাবদ্ধ। উনাদের ডোনার অসৎ ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে উনাদের কোনো কথা নাই। রাজনীতির ফেকাহ বলে যে কিছু একটা আছে সে ব্যাপারে উনারা থাকেন আজীবন সুখশীতনিদ্রায়।

“আল্লাহ যাকে প্রভূত কল্যাণ দান করতে চান তাকে দ্বীনের ফকিহ বানিয়ে দেন” — এই হাদিসে বর্ণিত ফকিহ আর ইফতা পাশ ফকিহ যে এক না তা বললে তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। ফতোয়া দিতে গেলে, যুগের সমস্যা সমাধান করতে গেলে এখনকার যুগে শুধু ক্লাসিকাল টেক্সট জানলেই যে হবে না, সমকালীন জগত ও জাগতিক সমস্যা তথা কনটেক্সটও যে জানতে হবে, না জানলে যারা জানে তাদেরকেও যে পাত্তা দিতে হবে, এটি এসব সনদপত্রপ্রাাপ্ত জ্ঞানীরা মানতে নারাজ।

উনারা নাস্তিকদের মোকাবেলা করতে চান। অথচ বিজ্ঞান ও দর্শনকে বিনাফসলে স্থায়ীবর্গা দিয়ে রেখেছেন নাস্তিকদের কাছে। দর্শন আর নিরীক্ষামূলক চিন্তন সম্পর্কে সবারই খুব দুর্বল ধারণা। আলেম-উলামাদের খুব বেশি দোষ দিয়ে লাভ নাই। তবে, সাধারণ শিক্ষিতরা না জানলে অতটা বড়াই করে না যতটা করেন মাদ্রাসাশিক্ষিত আলেমগণ। উনারা সায়েন্স আর ফিলসফিকে নিছক দুনিয়াবি এবং সেই অর্থে সেকেন্ডারি জ্ঞান বলে মনে করেন। এসব ফরজে কেফায়াহকে উনারা কার্যত মুবাহ-এর পর্যায়ে বিবেচনা করেন।

উনারা যেভাবে দ্বীন আর দুনিয়াকে ভাগ করে নিয়েছেন, দ্বীনি শিক্ষাকে দুনিয়াবি শিক্ষা হতে মিউচুয়েলি এক্সক্লুসিভ অর্থে পৃথক করেছেন, তা ইটসেলফ আনইসলামিক।                         

আমার শেষ প্রশ্ন ছিল: কেউ যদি মনে করে দর্শন যথেষ্ট জরুরী জিনিস, তাহলে তারা কি জ্ঞানীব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভূক্ত নন? যদি তা হোন তাহলে তাদের কাছ হতে অন্য ফিল্ডের জ্ঞানীদের কি শেখার কিছু নাই?

উনি এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “আপনার ফিল্ডের কথা আপনার থেকে গ্রহণ করায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ইসলামি মাসআলা-মাসায়েল ইসলামি অনুশাসনের ক্ষেত্রে ইসলামি স্কলারের কথা প্রাধান্য পাবে। আপনার কাছ থেকে অন্য ফিল্ডের মানুষ দর্শন শিখতে সমস্যা নেই। তবে ধর্ম শিখতে অবশ্যই আপনার কাছে আসাটা যুক্তিযুক্ত হওয়ার কথা নয়।”

ইসলামকে, ইসলামী শরীয়াহকে আমাদের ‘ইসলামিক স্কলারেরা’ যে নিছক ধর্মীয় লেভেলে নামিয়ে এনেছেন, এই উত্তরটি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ইসলাম একটা দ্বীন। ধর্মের ব্যাপারে যে কোনো দ্বীনের স্বতন্ত্র পজিশন থাকে। নীতিমালা থাকে। ধর্ম নিয়ে ইসলামেরও একটা নীতি আছে। ইসলামী মতাদর্শ ও জীবনপদ্ধতিতে ধর্ম হলো কেন্দ্রীয় বিষয়। কিন্তু একমাত্র নয়। ধর্ম হিসেবে ইসলামের সাথে বাদবাকী ইসলামের সম্পর্ক মস্তিষ্কের সাথে বাদবাকী দেহের সম্পর্কের মতো।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অন্যান্য সকল দ্বীনের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করতে’। এখানে মহান আল্লাহ তায়ালা শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী তথা ধর্ম হিসেবে পরিচিত দ্বীনের ওপর বিজয়ী হওয়ার কথা বলেননি। সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নারীবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যপ্রকারের বাতিল দ্বীনের বিরুদ্ধেও জয়ী হওয়ার কথা বলেছেন। ইসলামী মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক সকল তত্ত্বই বাতিল দ্বীন। ইসলামী জীবনপদ্ধতির সাথে সঙ্গতিবিহীন সকল লাইফস্টাইলই বাতিল দ্বীন তুল্য। আধুনিক এসব বাতিল দ্বীনকে মোকাবেলায় উনাদের হাতিয়ার কী?

কথা না বাড়িয়ে এক্ষণে শুধু এ’টুকুই বলবো, আপনাদের যে কোনো কিতাবের একটা পৃষ্ঠা আমাকে পড়ে শোনান। আমি আপনাকে বলে দিবো, এখানে কোন লাইনে ফিলসফির কোন তত্ত্ব ক্রিয়াশীল আছে। বিজ্ঞানবাদীরাও মনে করে, দর্শনের দরকার নাই। অথচ, মানুষ যেমন বাতাসের মধ্যে ডুবে থাকে, তেমন করে মানবীয় জ্ঞানের শাখামাত্রই কোনো না কোনো দার্শনিক তত্ত্বের উপর ভর করে গড়ে উঠে। কোনো না কোনো দার্শনিক পদ্ধতিতে কাজ করে। আপনি বা কেউ জানেন না, সেটি তার সমস্যা।

উত্তরদাতার পরিচয় জানাটা জরুরী কিছু নয়। তদুপরি, আমি যে কোনো প্রকারের বিবাদ-বিসম্বাতে অনাগ্রহী। আমার ওয়ালে আমি লিখলাম। পঞ্চাশ জনও যদি পড়ে তাও আমি খুশি। আমার এসব কথা উনার বা কারো পছন্দ না হলে তিনি তার ওয়ালে যেভাবে যা ভাল মনে করেন, লিখতে পারেন। আমার নাম ধরেও সমালোচনা করতে পারেন। শুধু আমাকে ম্যানশন বা ট্যাগ না করার অনুরোধ করছি।

আমি আলেমদের শ্রদ্ধা করি। যা জানি না, তা তাদের থেকে জেনে নেয়ার চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে রাস্তার উপর বাজার বসানো নিয়ে অন্তত আট-দশজন আলেমের সাথে কথা বলেছি। এমন দু’জনের সাক্ষাৎকার আমার ওয়ালেও আছে। দুঃখের ব্যাপার হলো, আমাদের মতো ‘দুনিয়াবী আলেম’দের কাছ হতেও যে উনাদের তেমন গুরুত্বপূর্ণ সবক নেয়ার আছে, তা উনারা মোটেও ফিল করেন না।

৫নং উত্তরের শেষের দিকে তিনি নারীবিদ্বেষী টোনে কিছু কথা বলেছেন। সে প্রসঙ্গে কী আর বলবো…! ব্যতিক্রমবাদে মাদ্রাসাশিক্ষিতরা সত্যিকারের নারীবিদ্বেষী জনগোষ্ঠীর উদাহরণ। নারীপ্রসঙ্গমাত্রই তাদের কাছে যৌনতাসংশ্লিষ্ট বা যৌনতাকেন্দ্রিক কোনো ব্যাাপার। ব্যাপারটা ভীষণ দুঃখজনক।

এর বিপরীতে আছে কিছু টেলিভিশন ও সোশ্যাল-মিডিয়া-কেন্দ্রিক ‘সিম্প হুজুর’। তারা নারীদেরকে নারীবাদ ও ইসলামের সব সুবিধাগুলো এনে দিতে চান, প্রতিদ্বন্দ্বী এই উভয় দ্বীন নারীদেরকে যেসব দায়িত্ব দিয়েছে সেগুলোকে নানা কায়দায় বাদ দিয়ে। এ’ আরেক বিপদ! আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুক, আ-মী-ন!

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Muhammad Muzahidul Islam: পোস্টের মূল বক্তব্য আমার মাথায় অনেকবছর আগে থেকেই প্রসিড করতো। এ কারণে আমি সকল আলিমের ফতোয়া গ্রহণ করি না। যে সকল আলিমের কুরআন ও হাদিসের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সমাজবিজ্ঞান ও ভূগোলের জ্ঞান আছে, কেবল তাদের ফতোয়াই গ্রহণ করি। যে সকল আলিমের এসব শাস্ত্রের জ্ঞান নেই, তাদের ফতোয়া অটোমেটিকলি ভুল হয়ে যায়।

Mohammad Mozammel Hoque: আলেমগণ চুরি ডাকাতির বিরুদ্ধে কথা বলে, কিন্তু জনগণের অধিকার চুরি, ভোট ডাকাতি, সরকারি তহবিল তসরূপ, এগুলা যে হদযোগ্য অপরাধ, সেটা নিয়ে কখনো মুখ খোলেন না। এ ধরনের বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার কথা উনারা স্বপ্নেও ভাবেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমরাও এক ধরনের সমঝোতা করে চলি। পার্থক্য হল, আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাকে স্বীকার করি। নিজেদেরকে নীতি আদর্শের সোল এজেন্ট হিসেবে দাবি করি না। কিন্তু উনারা করেন। সেটাই সমস্যা। ইহসান দূরের কথা, তাকওয়ার দৃষ্টিতেও উনাদের অবস্থানটা বরং আমাদের তুলনায় অধিকতর নাজুক।

Mustakim Al Gazipuri: যে জিনিষের মৌলিকত্ব হারাম তার ফুরু-ও হারাম। ভোটচোরকে কী ফাতাওয়া দিবে? গণতন্ত্র যে কুফুরি (ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক), এটা কি আপনি মানেন? আপনি একদিন মারকাযুদ্দাওয়াহ থেকে ঘুরে আসেন। মুফতি আব্দুল মালেক সাহেবের সাথে কথা বলতে পারেন।

Mohammad Mozammel Hoque: Mustakim Al Gazipuri, গণতন্ত্রকে যারা কুফুরি বলে মনে করেন তারা সেই বিষয়ে ফতোয়া দিক, এবং সুস্পষ্টভাবে এই কুফরি থেকে লোকজনকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্ক করুক, প্রতিবাদ করুক, এবং ক্ষমতা থাকলে এই ধরনের ফেতনা থেকে লোকদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করুক, ক্ষমতা না থাকলে সেই সক্ষমতা অর্জন করার চেষ্টা করুক। এগুলো তো সব ভালো কথা, ঔচিত্যবোধের কথা। সেটা তারা করে না কেন? আপনি সিনসিয়ারলি যেটাই মনে করেন না কেন, সেটা নিয়ে আপনি মাঠে ময়দানে আসেন। ভালো করে পজিশন নেন। ফাঁকতালে কোনো একটা কথা বলে দিলেই তো হলো না।

আপনি যে পক্ষেরই হোন না কেন, আমি নিশ্চিত, আপনি যদি ফতোয়ার কিতাবগুলো থরোলি ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেন, তাহলে এমন বিদঘুটে ফতোয়া দেখবেন, যা আপনার কাছেই খুব শিশুতোষ বলে মনে হবে। আর হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞদের পরস্পরের কাছে যাওয়া তাদের পারস্পরিক দায়িত্ব, ইংরেজিতে যাকে reciprocal responsibility হিসেবে বলে।

Mustakim Al Gazipuri: Mohammad Mozammel Haque, ফাতাওয়া প্রদান করা হয় দলিলের আলোকে, কিন্তু সব ফাতাওয়াই গ্রহণ করা হয়না, দলিলের আলোকে যেটা বেশি শক্তিশালী সেটা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু লেখারক্ষেত্রে সব পক্ষেরই মতামত লেখা হয়। যেমন, ইমাদ দাউদে যাহিরির একটি অভিমত আছে, বিবাহের প্রাক্কালে মেয়েদের সবকিছুই দেখা বৈধ। সবকিছু বলতে সবই। কিন্তু সেই মতামত প্রত্যাখ্যাত। সকল ইমামদের মতেই। এমন আরো অনেক কিছু লেখা রয়েছে ফাতাওয়ার কিতাবে।

Maimana Akter Tohfa: আমি মনে করি দর্শন নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে শুধু ইসলাম কেন সব ধর্ম সম্পর্কেই জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আলেমশ্রেণী যে যুক্তি দিয়ে হাদীস-কোরআন বুঝিয়ে দেয় সে যুক্তিটাই তো ফিলসফি। দ্বীনি ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। যে কোনো মুসলমান ইসলাম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে পারে, হোক সে জেনারেল শিক্ষিত। আর সেই জ্ঞান শুধু মাদ্রাসা থেকে একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব তা নয়। যাদের ফিলসফি সম্পর্কে ভুল ধারণা, তাদেরকে আমাদের ফিলসফি ডিপার্টমেন্টে আমন্ত্রণ জানানো দরকার।

Mohammad Mozammel Hoque: ফিলসফি সম্পর্কে লোকদের ধারণা খুব অস্পষ্ট, বিভ্রান্তি পূর্ণ। যারা ফিলসফি চর্চা করেছেন তারা এই বিভ্রান্তি তৈরীর জন্য প্রধানত দায়ী। যেমন, মধ্যযুগে উগ্র যুক্তিবাদী মুতাজিলারা এবং বর্তমান যুগে আধুনিক মুতাজিলাপন্থিগণ ফিলসফি সম্পর্কে জনমনে এই ধরনের ভীতি এবং বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। আমরা যারা ইসলামপন্থী এবং ফিলসফি চর্চা করি আমাদের বিরাট দায়িত্ব মানুষকে বোঝানো। তাদের কাছে যাওয়া। ধৈর্য সহকারে তাদের কথা শোনা। এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।

Md Hobaib: স্যারকে একটা পরামর্শ নয় বরং অনুরোধ করবো, যেন আমার ওস্তাদে মুহতারাম হাটহাজারীর মুফতি কিফায়াতুল্লাহ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে যাবতীয় প্রশ্ন ও সংশয়সমূহ পেশ করেন। এসমস্ত বিষয়ে হুজুর খুবই সুন্দর ব্যাখ্যা দেন এবং আলোচনা করেন।

Mohammad Mozammel Hoque: হ্যাঁ, ওনার সাথে আমার কোনো এক জায়গায় দেখা হয়েছিল এবং অনেক কথা হয়েছে। ওনার বয়ান আমি শুনেছি। অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এবং সুবক্তা। এবং যথেষ্ট পরিমাণে বিনয়ী। উনার বাড়ি সন্দ্বীপ। এবং দেখতে ততটা বয়স্ক মনে হয় না যদিও উনি অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ। উনি আমার ফোন নাম্বার নিয়েছেন। আমিও ওনার ফোন নাম্বার নিয়েছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে উনাকে একদিন সৌজন্যসাক্ষাতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য উনাকে বলেছি। ডিপার্টমেন্টের টিচারদেরকেও বলেছি। কিছুটা ঝামেলা কমলে সেটা হবে ইনশাআল্লাহ।

এর আগে মুফতি জসিম উদ্দিন সাহেবের সাথে আমার একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ কথা হয়েছে। উনিও খুবই যোগ্য মানুষ। তারও আগে আল্লামা জুনায়েদ বাবু নগরীর সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম শাহবাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার আগে উনাদের কাছে আমি অনেক কনটেন্ট সাপ্লাই করেছি এবং বেশ কিছু শীর্ষ আলেমের সাথে তখন আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। শাহবাগের সময়ে হেফাজতকে সমর্থন করে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের লেখার একটা সংকলন গ্রন্থ আমার কাছে আছে। যেখানে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আমার আর্টিকেলটাও ইনক্লুডেড আছে।

বদর আলী: স্যার, শরীয়তে ‘ইজমা’ নামক একটি বিষয় আছে এবং এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমোদন দিয়েছেন। অধিকাংশ ওলামায়ে হক্ক কোনো শরয়ী বিষয়ে একমত হওয়াকে ইজমা বলা হয়। সেই হিসেবে আপনি যার সাথে প্রশ্নত্তোরের কথা বললেন উনি ঠিকই বলেছেন।

Mohammad Mozammel Hoque: আমিও তো বলেছি যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকাংশের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সবক্ষেত্রে না। আমার লেখার সংশ্লিষ্ট অংশটুকু খুব ভালো করে পড়লে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।

Mohammed A. Bashar: মূল সমস্যটাই আপনি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন: আলেম সমাজ জ্ঞানী সমাজ না হওয়ার চেয়েও বেশি হয়েছেন ধর্মগুরু সমাজ, প্রিস্ট ক্লাস। ধর্মীয় ব্যাপারে অথরিটি। মানুষ আর খোদার মধ্যস্থাকারী। ঝামেলা ঠিক এইখানে। ধন্যবাদ।

Mohammad Mozammel Hoque: সমাজের মধ্যে কিছু বুদ্ধিজীবী আলেম শ্রেণি থাকবে, তারা জ্ঞান গবেষণা করবে, নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরে যতটুকু সম্ভব সেগুলোর ওপর আমল করবে। এবং অন্যদেরকে পরামর্শ দিবে, সতর্ক করবে, উপদেশ দিবে। এটা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সিস্টেম। এটাকে ইসলাম খুব গুরুত্ব দিয়েছে। আবার একই সাথে, সব ধর্মের মধ্যে যেটা আছে, ধর্মগুরু শ্রেণী, যাদের কাজ হচ্ছে ধর্মীয় ব্যাপারে অথরিটি হিসেবে কাজ করা, এই বিষয়টাকে ইসলাম পুরোপুরিভাবে খারিজ করেছে।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে তখন তুমি তাদেরকে বলো, আমি তাদের অতি নিকটে। আমি প্রত্যেক আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দিয়ে থাকি। অতএব তারা যেন সরাসরি আমাকেই ডাকে এবং আমার উপরেই ঈমান রাখে।” This verse is quite clear and self-explanatory.

বদর আলী: “আগেকার যুগে জ্ঞানীরা কোনো একটা করণীয় শুধু বলে দিতেন। কীভাবে এবং কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা নিয়ে আওয়ামরা মাথা ঘামাতো না। জন্মগতভাবে মুসলমান হওয়ার মতো মাজহাব অনুসরণটাও ছিল জন্মগত লটারির মতো ফিক্সড ব্যাপার। ‘এটাই ফেকাহর বিধান’ বলে কোনোকিছু চাপিয়ে দেয়ার সময় যে তথ্যপ্রবাহের এই জামানায় শেষ হয়ে গেছে তা আমাদের আলেম সমাজ মানতে পারছেন না। আলেম সমাজ জ্ঞানী সমাজ না হওয়ার চেয়েও বেশি হয়েছেন ধর্মগুরু সমাজ, প্রিস্ট ক্লাস। ধর্মীয় ব্যাপারে অথরিটি। মানুষ আর খোদার মধ্যস্থাকারী। ঝামেলা ঠিক এইখানে।”

স্যার, আলেম/মুজতাহিদ/ফকিহগণ মাসয়ালা দেন। একটা মাসয়ালা দেওয়ার জন্য আলেম/মুজতাহিদ/ফকিহগণ বহু সংখ্যক হাদিস, সুন্নাহ, পূর্বতন মাসয়ালা, সমকালীন অন্যান্য আলেম/মুজতাহিদ/ফকিহগণ এর সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করে ‘ইজমা’র ভিত্তিতে মাসয়ালা দেন। এত সব পর্যালোচনা আওয়াম বুঝবে না। কাজেই “‘এইটাই ফেকাহর বিধান’ বলে কোনোকিছু চাপিয়ে দেয়ার সময় যে তথ্যপ্রবাহের এই জামানায় শেষ হয়ে গেছে তা আমাদের আলেম সমাজ মানতে পারছেন না।” আপনার বক্তব্যের এই অংশটা আওয়ামের মানতে না পারার বিষয়, আলেম সমাজের না।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনটি কাজ একসাথে করতে হবে। যথা: তালিম, তাবলীগ ও তাজকিয়া। এটা আলেম ও আওয়াম সবার জন্য একই সাথে প্রযোজ্য। আলেম সমাজ তার সাধ্যমতো এই তিনটি কাজ করবে। কিন্তু হেদায়েত তো আল্লাহ তায়ালার হাতে। কাজেই আলেম সমাজ কাউকে ইসলাম পালন করার জন্য জোর করবে না; তাঁরা সর্বোচ্চ দোজখের ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু গায়ের জোর খাটাবে না। কাজেই আলেম সমাজ মানতে পারছেন না বিষয়টা এমন না। সকল নবী এভাবেই কাজ করেছেন, আলেমগণও সেভাবেই করবেন। একই কারণে আলেমসমাজ প্রিস্ট ক্লাস না। কেননা তাঁরা শুধু আল্লাহ ও রাসূলের কথা পৌঁছান, কিন্তু কাউকে বাধ্য করেন না। তারা কোনো মাসয়ালা Twist করেন না। বরং আওয়াম নিজেই মুজতাহিদ/ফকিহ হয়ে মাসয়ালা Twist করে নিজের সুবিধামতো পালন করে।

Mohammad Mozammel Hoque: কথাটা বোঝার চেষ্টা করেন। তথ্য প্রবাহের যুগ অথবা যাই বলি না কেন, সকল যুগে, সকল সময়ে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণ, এই ভাগাভাগিটা সবসময় ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আগে লোকজন যেভাবে চোখ বুজে বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করতো, এখন সেটা করে না। তারা বরং বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন মতের মধ্যে কোনটা সঠিক, সেটা বোঝার চেষ্টা করে। এবং এটা করার ব্যাপারে তাদের সক্ষমতা আগে তুলনায় বেশি।

এগেইন, বিশেষজ্ঞ না হওয়া হলো একটা বিষয়। আর বিশেষজ্ঞদের পারস্পরিক দ্বিমতের মধ্যে কোন বিশেষজ্ঞকে সে অনুসরণ করবে, সেটা বোঝার সক্ষমতাও না থাকা, সেটা ভিন্ন বিষয়। বিশেষজ্ঞ-মতামতের মধ্যে কোনটা সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, এটুকু যে বুঝতে পারে না, সে হলো অন্ধবিশ্বাসী। এটা খুবই বিপদজনক। এমনকি বর্তমান সময়ে যাদেরকে আপনি বিপথগামী বলে মনে করেন, তাদের দিকে দেখলে আপনি সহজেই এই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।

বদর আলী: “বিশেষজ্ঞ-মতামতের মধ্যে কোনটা সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, এটুকু যে বুঝতে পারে না, সে হলো অন্ধবিশ্বাসী। এইটা খুবই বিপদজনক।” স্যার, মাযহাবের বিষয়টা হলো সবগুলোই সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, সবগুলো মাযহাবই সঠিক। শুধুমাত্র যে অঞ্চলে যে মাযহাব অধিকাংশ জনগণ আমল করে, সে অঞ্চলে বহিরাগত ও স্থানীয় জনগণ সেই মাযহাবই অনুসরণ করবে। যেমন, সৌদী আরবে হাম্বলি মাযহাব অধিকাংশের আমল, আর বাংলাদেশের হানাফি মাযহাব। বাংলাদেশ থেকে কেউ সৌদি আরবে গেলে সেখানে সে হাম্বলি মাযহাবই অনুসরণ করবে, আবার সৌদি আরবের কেউ বাংলাদেশে আসলে সে হানাফি মাযহাবই অনুসরণ করবে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *