একজন সৌদিপন্থী সালাফী আলেম ইবনে সিনাকে কাফের বলেছেন। এ ব্যাপারে একজন প্রাজ্ঞ শ্রদ্ধেয় আমার কাছে বলেছেন, “ইবনে সিনার দর্শন ও তাকে কাফের বলা নিয়ে বিস্তারিত কোথায় জানা যায়? আপনার এই বিষয়ে অধ্যয়ন আছে কি? আপনার সংগে একদিন এটা নিয়ে ডিটেইলস আলোচনা করার ইচ্ছা।”

উনাকে আমি যা বলেছি তার একটা অংশ হলো, ‘… ইবনে সিনাকে কাফের বলা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই। ফালসাফা তথা ফিলোসফি চর্চাকেই যারা কুফুরী মনে করেন তাদের সাথে আমি কীভাবে এনগেইজ হবো?’

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়লো, কিছুদিন আগে আমি একটা ভিডিও শেয়ার করেছিলাম: কীভাবে বুঝবো কোন ধর্ম সঠিক?

সেখানে একজন সরলমনা সালাফী মনোভাবাপন্ন পাঠক মন্তব্য করেছেন, “ইসলামে ফালসাফার চর্চা কড়াভাবে নিষিদ্ধ। স্যার যেসব ওয়ার্ড য়ুজ করেন এসব আলোচনায়, তা কুফুরির সামিল। যে কোনো ‘আলিমকে দেখালেই বলবে, ‘সালাফরা এসব আলোচনায় ভয়ংকরভাবে রাগ করতেন।’ স্যার, আপনি স্মার্ট হতে পারেন, বাট আপনি ভুল পথে আছেন।”

প্রসঙ্গক্রমে উক্ত পাঠক এক পর্যায়ে পরোক্ষভাবে আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন, ঈমান বাঁচানোর জন্য আমি যেন ফিলোসফি পড়ানোর চাকরি ছেড়ে অন্য কোনো হালাল পেশায় নিয়োজিত হই। উক্ত পাঠকের মতে, “সুদী ব্যাংকে কেউ চাকুরী করলে ঈমানহারা হয় না, যদ্দুর জানি। তবে কবিরা গুনাহ হয়। … যারা ফালসাফা আর কালাম চর্চা নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। ঈমানহারা হয়েছে। … তাই আমার কথা, সুদী ব্যাংকে চাকরি করা আর ফিলোসফির শিক্ষক হওয়া, দু’টা সেম না।”

হ্যাঁ, এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কথা তো ঠিকই আছে। ফিলোসফি পড়া ও পড়ানো যদি কুফরীর শামিল হয়, তাহলে ইবনে সিনা কাফের হবে না কেন? আমিও বা এই তাকফির থেকে কীভাবে বাঁচবো?

এ ব্যাপারে অতি সংক্ষেপে আমার কথা হলো:

মানুষকে আপন করে নেয়া, লোকদের কাজকর্মকে যথাসম্ভব অনুমোদন দেয়া ও সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গকে নিজ পরিচয়গত বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষের দলীল ও রেফারেন্সগুলোকে কিছু লোকেরা সহজে খুঁজে পায়। এবং সেগুলোকে ফোকাস করে তারা সিদ্ধান্ত নেয়। এরা প্রোএক্টিভ বা ইতিবাচক মন-মানসিকতার লোক।

এর বিপরীতে, রিএক্টিভ বা নেতিবাচক মন-মানসিকতার লোকেরা স্বভাবতই হয়ে থাকে শুদ্ধতাবাদী। মতাদর্শগত দিক থেকে এরা পিউরিটানিক ও সেক্লুশনিস্ট। তাই সওয়াবের নিয়তে এরা প্রতিনিয়ত বাতিলের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকে। চান্স পাওয়া মাত্র চোখ বন্ধ করে যাকে তাকে খারিজ করে। টেকসই পদ্ধতিতে বাস্তব সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নিজেদের কেতাবী জ্ঞানের ভিত্তিতে এরা উদ্যোক্তাদের ভুল ধরা ও মুসলমানদের কাফের সাব্যস্ত করার কাজে দৃশ্যত হয়ে থাকেন বেশি মনোযোগী। উৎসাহী।

সার্বিকভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হচ্ছে, গোড়ার যে জিনিস, অর্থাৎ মন-মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটিয়ে রেফারেন্সের পাল্টাপাল্টি দিয়ে নেগেটিভিটির এই রোগ সারানো যাবে না। মানুষ যত বেশি জীবনঘনিষ্ট ও বাস্তবনিষ্ঠ হবে, তত বেশি তার মধ্যে প্রোএক্টিভনেস ক্রিয়েট হবে।

বিষয়টা এতটাই অবভিয়াস যে এ নিয়ে এখানে হাদীস-কোরআনের রেফারেন্স টানার আর দরকার মনে করছি না।

‘চিন্তার স্বাধীনতা ও ইসলাম’ শিরোনামে শ’দেড়েক পৃষ্ঠার একটা বই বের করবো, ইনশাআল্লাহ। সেখানকার একটা আর্টিকেল হলো: যুক্তিবুদ্ধির পক্ষে আল্লাহ তায়ালা। ইতোমধ্যে না পড়ে থাকলে পড়ে নিতে পারেন।

আচ্ছা, ইবনে সীনার কাছ হতে আপনি কি আকীদা শিখবেন? তিনি কি আকীদার শায়খ ছিলেন?

ইসলামপন্থীরা প্রায়শই মেন্টর, টিচার ও ইন্সট্রাক্টরের মধ্যকার পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলেন। তাদের সার্বিক অবনতির এটি অন্যতম কারণ। গুরু, শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের পার্থক্য বুঝার জন্য এবং এ বিষয়ে ইসলামপন্থীদের ভুলের জায়গা চিহ্নিত করার জন্য এ সংক্রান্ত এই লেখাটাও পড়তে পারেন: প্রশিক্ষক, শিক্ষক ও গুরুর মধ্যে পার্থক্য করতে না পারার ব্যর্থতা ও এর পরিণতি

ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Abdus Salam Azadi: ভাইজান, কী আর বলবো?

ইবনে সিনা, ফারাবী, আবু ফারিদ্ব– এরা ইসলামী সভ্যতায় কন্ট্রিবিউটার। কেউ মেডিসিনে, কেউ সংগীতে, কেউ দর্শন শাস্ত্রকে ইসলামীকরণে। তারা কেউ মুহাদ্দিস নন, মুফাসসির নন, ফুক্বাহা নন। তারা মুসলিম ছিলেন, মুসলিম ও ইসলামের উপকার করেছেন।

ব্যক্তি ইবনে সিনা কিভাবে মরেছেন, বা জান্নাতের কোন তলায় আছেন, অথবা জাহান্নামের দরকে আসফালে আছেন কিনা তা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমাকে কেউ দেয়নি। তার চিন্তার সাথে মেইনস্ট্রিম ইসলামীচিন্তার যেমন মিল নেই, তার দর্শনচিন্তাও পরবর্তী মুসলিম দার্শনিকগণের হাতে হেনস্তা হয়েছে। সেখানে আমরা তার সফলতা ব্যার্থতা খুঁজি।

এই এখন এসে যিনি নিজেকে মুসলিম দাবি করেছেন, মুসলমানদের জন্য অবদান রেখেছেন, ইসলামী সভ্যতাকে সারা দুনিয়ার মাথায় নিয়ে গেছেন তাকে কাফির বলার মধ্যে কী ফজিলত আছে, আমার জানা নেই।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *