শিক্ষার সংকট

স্কুলে মশারি টানানো আর আলু ভর্তা করা শেখানো, এ ধরনের শিক্ষাকার্যক্রমের সমস্যা কোথায়?

আপনি কাউকে যত যা কিছু শেখানোর চেষ্টা করেন না কেন, ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করেই শিক্ষা গ্রহণ করে। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণে ব্যক্তিকে সহযোগিতা করার জন্যই শিক্ষার যত আয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন।

স্কুলের শিক্ষা হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এর পাশাপাশি আছেন অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার দুইটা বিশাল ক্ষেত্র: পরিবার ও সমাজ।

পাশ্চাত্যে পরিবারব্যবস্থা ভঙ্গুর। সমাজ তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী। তাদের ওখানে প্রত্যেক ব্যক্তি সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। সেটআপটাই এমন, সিটিজেন এন্ড স্টেইট, ওয়ান টু ওয়ান রিলেশন।

ফলত শিক্ষার ৩টা স্বতন্ত্র স্পেইসের মধ্যে তারা সবটুকু গুরুত্ব দেয় তৃতীয় পর্যায় তথা আনুষ্ঠানিক (রাষ্ট্রীয়) শিক্ষার ওপর। বাচ্চাদেরকে যা কিছু শেখানোর সবকিছুকে তাই তারা তাদের স্কুল কারিকুলামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে।

সেখানকার একটা বিরাট সংখ্যক পরিবারে বাবা নামক জিনিসটাই অনুপস্থিত। আমাদের এখানে কোন কারনে বাবা না থাকলে মা বাচ্চাদেরকে নিয়ে যেভাবে পড়ে থাকেন, ওখানকার মায়েরা সেরকম নয়। হাজবেন্ড না থাকলেও সিঙ্গেল মাদারদের থাকে সক্রিয় যৌনজীবন। বয়ফ্রেন্ড, হোমোফ্রেন্ড, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, ডেইটিংসহ আরো যত হাবিজাবি।

যার কারনে অনুপস্থিত বাবার মতন শিশুদের জীবনে মায়েরা থাকে থেকেও না থাকার মত করে। নিজ পিতা ছাড়া অন্য পুরুষকে মায়ের সংগী হিসেবে সন্তানেরা কখনোই মেনে নিতে পারে না, বিশেষ করে ছোটবেলায়।

পিতা-মাতা হলো বাচ্চাদের জন্য দুইদিকের দুই ব্রাকেটের মতো প্রটেকশান। লংটার্ম হিটারোসেক্সুয়াল রিলেশান, এককথায় প্রচলিত পারিবারিক ব্যবস্থার ভেতরে বাচ্চারা মানসিকভাবে হেলদি গ্রোথ পায়। এটি অন্য কোনোভাবে পাওয়া অসম্ভব। মানুষ শত সহস্র লক্ষ বছরে এভাবেই গড়ে উঠেছে।

আমাদের এখানে পরিবার ব্যবস্থা আলহামদুলিল্লাহ এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। সমাজ ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে মজবুত গাঁথুনির। ভাল।

ফলে এখানকার একটা শিশুর শিক্ষা শুরু হয় এবং তার লাইফ লং টিচিংগুলোর ভিত গড়ে ওঠে পরিবার থেকে। পরিবারে পাওয়া শিক্ষাগুলোরই প্রতিফলন সে দেখতে পায় আশেপাশে। সমাজে। পরিবার ও সমাজ থেকে শিশুরা কিছু বেসিক নন-টেকনিক্যাল শিক্ষাও পেয়ে যায়। যেমন, কৃষক পরিবার এবং হাতের কাজ জানে এমন পরিবারের শিশুরা পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পারিবারিক পেশায় দক্ষতা অর্জন করে ছোটবেলা থেকে। ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।

শিক্ষায় ধর্ম ও সমাজের ভূমিকা

ধর্ম আমাদের সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধর্মজীবীদের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মোটের উপরে আমাদের সমাজে ধর্মের ভূমিকা অনেক বেশি ইতিবাচক। মাঠের অপর অংশের ঘাসকে অধিকতর সবুজ বলে মনে হয়। সেরকম আমাদের কাছে কখনো কখনো মনে হয়, ধর্মহীন দেশগুলোতে শিক্ষার্থীরা মুক্ত জ্ঞান লাভ করে। কতটুকু ‘মুক্ত’ তা চট করে বোঝা না গেলেও সময়ে সময়ে তা প্রকট হয়ে উঠে। পাশ্চাত্যের উদারতাবাদ চাপিয়ে দেয়া উদারতা। এরবেশি এখানে আপাতত না বলি।

একজন মুসলিম হিসেবে আমি প্রাথমিক যৌন শিক্ষা লাভ করেছি ধর্মশিক্ষায়। এবাদত করার জন্য অর্জন করতে হয় তাহারাত বা পবিত্রতা। তাহারাত অর্জন করার পূর্বশর্ত হচ্ছে বেসিক সেক্সুয়াল এডুকেশন। ধর্মশিক্ষা আমাদের কী কাজে লাগে, এটি তার একটা ছোট্ট উদাহরণ।

কোনো বিষয়ে বিরোধ মীমাংসা বা আরবিট্রেশন পারিবারিক পর্যায়ে যেভাবে কার্যকর হয়, সামাজিক পর্যায়ে যেভাবে সুষ্ঠুভাবে এটি করা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনী প্রক্রিয়ায় এটি ততটা ভালোভাবে অর্জন করা সম্ভব হয় না।

যেমন, দাম্পত্য কলহ ও বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে বিসিএস পাশ করা একজন বিচারক যেভাবে ফয়সালা দিতে পারবেন, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে এটি করা সম্ভব আমাদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক কিংবা সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার মাধ্যমে।

এমনকি কোনো এক পক্ষ থেকে ঘুষ খেয়ে কেউ যদি একটা বাজে বিচার করে, ওই সমাজে তাকে যেভাবে সবসময় এটার জন্য নানা ধরনের সামাজিক নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়, অনুরূপ ঘুষ খেয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন একটা বাজে রায় দিয়ে কদিন পরে অন্য এলাকায় বদলি হয়ে চলে যায় তখন তাকে তেমন কিছু করা যায় না।

আমরা যখন একটা ব্যবস্থার সুবিধা পাই তখন অটোমেটিকেলি পেয়ে যাওয়া সেই সুবিধা আমাদের নজরে পড়ে না। বরং সেই ব্যবস্থার যতগুলো ফাঁকফোকর আছে, অসংগতি আছে, ত্রুটি আছে, সেগুলোই আমাদের বেশি নজরে পড়ে।

এর পাশাপাশি আছে বামপন্থী আঁতলামির সমস্যা।

সেন্ট্রালাইজড এডুকেশন সিস্টেমের অসুবিধা

এটা একটা বামপন্থী খাসলত, সমাজকে সবসময় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। অথচ সমাজটা আছে বলেই কিন্তু আমরা এত দুঃখ কষ্ট এবং দারিদ্র্যের মধ্যেও টিকে আছি। সমাজ হলো আমাদের জাহাজ। পরিবার হলো তার এক একটি কামরা।

পরিবার ও সমাজকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে সওদাগরী জাহাজকে পাহারা দেওয়া যুদ্ধজাহাজের মত। এখানে সমাজ হলো সওদাগরী জাহাজ। আর সেটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যায় যে যুদ্ধজাহাজ, সেটা হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। সমাজকে দুর্বল করে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে তোলা হলো সওদাগরী জাহাজ আর যুদ্ধজাহাজকে এক করে ফেলা। উন্নয়নের সামগ্রিক ধারনা ব্যতীত পাশ্চাত্য জীবনপদ্ধতির অন্তর্গত ত্রুটি অনুধাবন করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়।

সে যাইহোক, একটা হেলদি ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্টে বাচ্চারা যে শিক্ষাটা পায়, সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের লোকদের কাছ থেকে পাওয়া নানা ধরনের মূল্যবোধগত শিক্ষায়। যেমনটা আমরা আমাদের ছোটবেলায় পেয়েছি।

পরিবার এবং সমাজ থেকে পাওয়া অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাগুলোরই প্রতিফলন ঘটে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে। এতে করে সেই শিক্ষা হয় অনেক বেশি মজবুত। টেকনিক্যাল এবং নন-টেকনিক্যাল উভয় ধরনের শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।

ভঙ্গুর পারিবারিক এবং দুর্বল সমাজ ব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছে পাশ্চাত্য বিশ্বে।

সমকালীন পাশ্চাত্য মডেলের সমস্যা হচ্ছে, আপনি যখন সকল বিহিত ব্যবস্থাকে একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত করবেন তখন সর্বাত্মককরণের যে সমস্যা, তার সবকিছুর উদ্ভব হবে। এইটাকে আমরা বলতে পারি সেন্ট্রালাইজেশন প্রবলেম।

আজকের বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার যে সঙ্কট, এর মূল কারণ পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব কমিয়ে শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে সীমিত করে ফেলা। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একেক জন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ক্ষমতার কোনো হিসেবে একজন জাফর ইকবাল স্যার পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। ঘোলা পানি মাছ শিকার করার মতো করে দেশীয় মূল্যবোধ বিরোধী এনজিওগুলো আমাদের মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও ধর্মের গোড়া কাটছে। কিশোর-কিশোরীদের পাঠ্যক্রমে চলে এসেছে শরীফ থেকে শরিফায় রূপান্তরের গল্প। রংধনুর নানা রং-এর বয়ান।

শিক্ষার পাশ্চাত্যব্যবস্থা কি আসলেই উন্নতমানের?

পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র, এই তিন তরফ থেকে যখন বাচ্চারা একই ধাঁচের শিক্ষা লাভ করে, তখন শিক্ষা কার্যক্রম হয় তিন ইঞ্জিনের গাড়ির মতো। এর কোনো একটা দুর্বল হলে বা ফেইল করলে বাকি দুটো, এমনকি দুটোই ফেইল করলে অন্ততপক্ষে একটা ইঞ্জিন পুরো গাড়িটাকে চালিয়ে নিতে পারে। কোনো একটা অপশক্তি কর্তৃক এ ধরনের মাল্টিলেয়ার প্রটেক্টেড সিস্টেমকে এককভাবে ম্যানুপুলেট করা কঠিন।

শুরুতেই যা বলেছি, পাশ্চাত্যবাদ তথা চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিক লাইফভিউর দৃষ্টিতে পরিবার ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে সমাজ বলে তেমন ভায়াবল কোনো অথরিটি স্বীকৃত নয়। ‘আমরা সবাই রাজা’ টাইপের পরিস্থিতিতে সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রব্যবস্থা সেখানে শক্তিশালী আইনি কাঠামো নিয়ে হাজির হয়। আইনই হয় সেখানে শেষ কথা।

এটি খুবই স্বাভাবিক, আইন যেখানে মেইন অ্যাপ্রোচ তথা অধিকতর শক্তিশালী, নৈতিক চেতনাসহ সব নন-লিগ্যাল অ্যাপ্রোচ সেখানে হবে ততটাই দুর্বল। এটি অংকের নিয়মের মতো সত্য।

এটি অনস্বীকার্য, পশ্চিমাদের নৈতিক আচরণ কিছু কিছু দিক থেকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ের ভালো। এর মানে এই নয় যে তারা অল গুড বা বেটার পিপল। আমার দৃষ্টিতে তারা আমাদের থেকে কিছু কিছু দিক থেকে বড়জোর খানিকটা ভালো। অনেক দিক থেকে বরং তাদের থেকে আমরা অনেক ভালো। ‘ততটা নয় যতটা দাবী করা হয়’ – আমার এই ফর্মূলা অনুসারে তাদেরকে যতটা ভালো দাবি করা হয় তারা আসলে ততটা ভালো নয়। এর প্রমাণ হলো সেখানকার অজস্র নজরদারি ব্যবস্থা এবং তুচ্ছ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগের অপরিহার্যতা।

রাষ্ট্র যেখানে সব বিষয়ে নাক গলায় সেটা কোনোক্রমেই উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন একটা নৈতিক সমাজ হতে পারে না।

সে যাইহোক, আজকের আলোচনা বিষয় ছিল শিক্ষা ব্যবস্থা। এ নিয়ে এখানে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলো নিয়ে খোলামেলা প্রচুর আলাপ আলোচনা হওয়া উচিত।

আমাদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে সারাই-মেরামত করার পরিবর্তে যেভাবে আমরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করছি, এটি মারাত্মকভাবে একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে। মাথাব্যথার কারণে মাথাটাই কেটে ফেলার চেষ্টাকে কোনোক্রমেই সমর্থন করা যেতে পারে না। ভালো থাকুন।

লেখাটির প্রথম পর্বের ফেইসবুক লিংক

লেখাটির ২য় পর্বের ফেইসবুক লিংক

লেখাটির ৩য় পর্বের ফেইসবুক লিংক

লেখাটির ৪র্থ পর্বের ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *