চবি দর্শন বিভাগ আন্তঃবর্ষ ক্রিকেট খেলা। তুমুল প্রতিযোগিতা। ১ম বর্ষ বিএ (সম্মান) বনাম এম.এ। কারা জিতেছে জানি না। আমি ছিলাম ঘণ্টা দেড়েক। দেখলাম তারা বেশ প্রাণবন্ত। টোয়েন্টিপ্লাস ইয়াং পিপল স্বতঃস্ফূর্ত হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তারপরও কেমন যেন লাগলো।

কেন? সেটা বলার জন্য এই এই লেখা।

খুব কম ছেলেমেয়েকে আমরা ক্লাসে এবং একাডেমিক এরিয়াতে স্বতঃস্ফূর্ত হিসেবে পাই। আমার প্রতিটি ক্লাসে আমি অন্তত একজন সাধারণত গরহাজির (absentee, meaning passive in participation in the class) ছেলে বা মেয়েকে ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ক্লাস’ হিসেবে সিলেক্ট করি। নামধাম ইত্যাদির পরে তাকে বলি, তুমি আজকের ক্লাসের ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ক্লাস’। আজকের বিষয়টা যদি তোমাকে বোঝাতে পারি তাহলে বুঝবো অন্যরাও মোটামুটি বুঝেছে। এরপরে পুরো সময়জুড়ে ওর সাথে এনগেইজড থাকি।

এভাবে আমি বহু স্টুডেন্টকে আমি আত্মবিশ্বাসী করতে পেরেছি। পড়ালেখামুখি করাতে পেরেছি। সেটি অন্য প্রসঙ্গ।

খেলা দিয়ে শুরু করে ক্লাসে চলে আসার তাৎপর্য হলো, টেন্টে বসে আমি উপলব্ধি করলাম, ক্লাসে নিষ্ক্রীয়ভাবে বসিয়ে রাখার মাধ্যমে এইসব ছেলেমেয়েদেরকে আমারা এক হিসেবে বরং শাস্তি দিচ্ছি। বুঝতেছি না এমন বিষয়ের আলোচনায় আমাকে যদি কেউ এভাবে বসিয়ে রাখতো, কোনো ইন্টারেকশান নাই, এপ্রিসিয়েশান নাই, পানিশমেন্ট নাই, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগতো। পানিশড, সাফোকেটেড ফিল করতাম।

ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্টুডেন্টরা হৈ হল্লা করা শুরু করে। তুমুল। পাশের রুমে যে অন্য একটি ক্লাস চলছে, তাতে তারা ভ্রুক্ষেপ করে না। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকরা এসে ফিলসফির স্টুডেন্টদের বকা দেয়। আমরাও হিস্ট্রির স্টুডেন্টদেরকে অনেক সময়ে শাসিয়েছি। কাজের কাজ কিছু হয় নাই।

এবসেন্টি কোনো স্টুডেন্টের সাথে যখন আমি পাঠ্যবিষয়ে কথা বলা শুরু করি তখন এটি জেনে তাজ্জব বনে যাই, এর আগে সে কোনো টিচারের সাথে সে এভাবে ক্লাসে কথা বলে নাই …! অথচ, তখন সে অনার্স থার্ড বা ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট।

স্টুডেন্টদেরকে বকা দেয়ার ইচ্ছা অনেক সময়ে সম্বরণ করি। এই যে স্টুডেন্টরা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, টিচারদের দৃষ্টিতে এরা অচ্ছুত। ইন জেনারেল। এরা কীভাবে গাদাগাদি করে ট্রেনে চড়ে আসে তার খবর টিচাররা রাখে না। আমার মেয়ে তখন চবি’তে ভর্তি হয়েছে। কী কারণে যেন আমরা ট্রেনে করে শহরে গেছি। আড়াইটা বা চারটার ট্রেন। সেদিনকার সেই ট্রেনে কী যে ভীড় ছিল তা মনে করলে আমার এখনো খুব খারাপ লাগে।

হলগুলোতে অনেক সিট খালি। ‘পলিটিকাল’ না হলে হলে থাকা যায় না। কত বছর ধরে হলে এলটমেন্ট বন্ধ তা আমি জানি না। ইনফ্যাক্ট গত এক দশকে কোনো হলে এলটমেন্ট হয়েছে, এমনটি শুনি নাই। কোনো হল তৈরী হয়ে পড়ে থাকবে, হল চালু হবে না, আমাদের সময়ে এটি ছিল অকল্পনীয়। এখন অনেকগুলো হল তৈরী হয়ে পড়ে আছে। হলে থাকার ব্যাপারে ছাত্রদের আগ্রহ নাই। কে যাবে ক্রসফায়ারিংয়ে পড়ে জানটা খোয়াতে ….! ছেলে মেয়েরা গার্ডিয়ানের টাকা খরচ করে মেসে মেসে কষ্ট করে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

কথায় বলে, পেটে দিলে পিঠে সয়। ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্য সুবিধাদি আমরা ন্যূনতম মানেও নিশ্চিত করতে পরি নাই। কোন মুখে তাদেরকে শাসন করবো?

আমাদের ক্লাস রুমের একোমোডেশন সর্বোচ্চ ৮০ জন। আমরা ভর্তি করাই ফি বছর ১৪০ জন। ‘ভাগ্য ভালো’, সব স্টুডেন্টরা ক্লাস করতে আসে না। নুতন ভবনগুলোতে গড়ের মাঠের মতো সুবিশাল স্পেস। একেকটা রুম যেন লেকচার থিয়েটার। আমার বুঝে আসে না, যারা এত বড় ক্লাসরুম বানিয়েছে তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বুঝে না, এটি কী করে সম্ভব…!

মাঝে মাঝে মনে হয় matt walsh এর what is a woman এর মতো করে একটা ডকুমেন্টারি মুভি বানাই, what is a university?

যা বলছিলাম, ডিপার্টমেন্টে দু’একটা লেকচার থিয়েটার বা গ্যালারি থাকতে পারে। তাছাড়া ক্লাস রুম হবে সর্বোচ্চ ৪০জন বসার উপযোগী। কতজন অডিয়েন্স থাকলে একটা লাইভলি ইন্টারেক্টিভ ক্লাস হতে পারে, তা আপনারা জানেন কিংবা সহজে অনুমান করতে পারেন। প্রয়োজনে গুগল করতে পারেন। কয়েকশ’ লোকের সামনে বক্তৃতা করা যায়, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা-পর্যালোচনা করা যায় না।

বিশেষ করে কলা অনুষদের কথা আমি বলতে পারি, কোনো শিক্ষকের সাথে লেখাপড়ার কোনো বিষয়ে এমনকি দশ/পনের/বিশ মিনিটও ওয়ান-টু-ওয়ান কথা না বলে অধিকাংশ স্টুডেন্ট কী এক জাদুমন্ত্রবলে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে যায়…!

অথচ, একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করে তারা এখানে ভর্তি হয়েছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, টিচাররা যাদেরকে অগারাম বলে মনে করে, দুনিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এদেরকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়, তাদের সব রিকোয়ারমেন্ট ফিলাপ করেই তাদের প্রত্যেকেই পাশ করবে। অধিকাংশ ভালো পাশ করবে।

আসলে, a bad system makes good people bad। এর বিপরীতে, a good system makes bad people good।

কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্মস এন্ড ভেলু নিয়ে লিখেছিলাম। এখানকার অন্যতম নর্ম হলো পরীক্ষার আগে ছাড়া পড়ালেখা না করা। এমনকি অনেকে গ্যাপে গ্যাপে পড়ে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে। আমাদের সময়ে নকলে ধরা পড়লে অন্তত এক বছর লস হতো। নকলে ধরা পড়ার কারণে ছাত্রত্ব বাতিল কিংবা কয়েক বছর তো দূরের কথা, কারো ইয়ার লস হয়েছে, এমনটা আমি শুনি নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু সেই দিনের পরীক্ষাটা বাতিল করা হয়, যা উক্ত পেপারে সাপ্লি রাখার সামিল।

যেসব ছেলে মেয়েরা টেক্সট থেকে লেখে, বুঝে লেখে, অযথা গরুর রচনা না লিখে মূল কথাটুকু সংক্ষেপে লেখে, হাতের লেখা স্লো হওয়ার কারণে যারা ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ১৪৬ পৃষ্ঠা বা তার কাছাকাছি লিখতে পারে না, কিংবা যাদের হাতের লেখা খারাপ, তারা অন এন এভারেইজ কম নম্বর পায়। যারা মুখস্ত লেখে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত গাইডবই হতে লেখে, সিনিয়রদের নোট কপি করে, তারাই সাধারণত বেশি নম্বর পায়।

এর ওপরে আছে ডুয়েল একজামিনেশনের মতো এক অদ্ভূত ব্যবস্থা। দুনিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দ্বৈত উত্তরপত্র পরীক্ষণ ও তৃতীয় পরীক্ষক প্রথা নাই। টিচারদের নাই কোনো ধরনের এসেসমেন্ট লিটারেসি বা স্কিল। নাই কোনো rubric তথা উত্তরপত্র মূল্যায়নের গাইডলাইন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি না, চবি’তে নাই প্রাপ্ত ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো ব্যবস্থা। একেকজন শিক্ষক যেন একেকজন সাক্ষাত দেবদূত। ভালো ছাত্র হওয়া, ভালো শিক্ষক হওয়া, ভালো গবেষক হওয়া ও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারা, এগুলো IELTSএর পড়া, শোনা, বলা ও লিখার মতো আলাদা আলাদা স্কিল বা আসপেক্ট।

হোক জীবনের জন্য দর্শন। জীবিকার কী হবে? পেট শান্তি না থাকলে তো মাথা কাজ করবে না। আমার পরামর্শ হলো, ফিলসফির মতো যেসব সাবজেক্ট জবঅরিয়েন্টেড না, তাদের উচিত স্টুডেন্টদের ক্রিটিকেল থিংকিং এবং কমিউনিকেটিভ স্কিলকে যথাসম্ভব ডিভেলপ করার উদ্যোগ নেয়া, যাতে করে সে কর্মজীবনে কিছু একটা করে সারভাইভ করতে পারে।

কেউ বলতে পারেন, আপনি এসব নিয়ে কী করছেন? আপনার কমিউনিটিতে বলছেন না কেন?

এ ব্যাপারে আমার ডিফেন্স আমি ক’দিন আগে দিয়েছি। হয়তো পড়েছেন। সেখানে আমি ৫ ধরনের শিক্ষকের কথা বলেছি। একদা শিক্ষক, আমলা শিক্ষক, কামলা শিক্ষক, গবেষণা ব্যবসায়ী এবং শুধুই শিক্ষক। আমি শেষোক্ত ক্যাটাগরির শুধুই শিক্ষক। তাই অবভিয়াসলি রিজেক্টেড বাই হিজ কমিউনিটি। প্রতিবাদ হিসেবে গত ১৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পর্ষদের নির্বাচনে ভোট দেই নাই। অথচ, আমি ছিলাম সাদা দলের দীর্ঘকালীন স্টিয়ারিং কমিটির মেম্বার। আর কী কী ছিলাম তা বলার জায়গা এটি নয়। আমার তৎপরতা ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রে’ সীমাবদ্ধ। বিশ্বাস করি, মূল্যবোধের উন্নয়ন ছাড়া সমাজ পরিবর্তন অসম্ভব।

ছাত্রছাত্রীদের কথায় আসি। ওদের দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। পড়ালেখার নামে জীবনের সবচেয়ে উর্বর সময়টাকে তারা এখানে নষ্ট করছে। তাদের মোটিভ, সোশ্যাল হায়ারআর্কিতে যথাসম্ভব উচ্চতর পজিশনে ঠাঁই পাওয়া। শেষ পর্যন্ত তারা কিছু একটা হয়ও বটে, কিন্তু তার জন্য তারা যে মূল্য দেয়, তা অতিবড়, অতীব বেদনাদায়ক এবং ফেটাল, আল্টিমেইটলি।

মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সবই আছে, নাই শুধু নির্ভয়ে হক কথা বলার মতো মুক্ত পরিবেশ। দলছাড়া আপনি এখানে আ বিগ জিরো। বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক রঙ্গমঞ্চ। ফ্যাকাল্টির ভেতরে অডিটরিয়াম বানানো হয়েছে একাডেমিক এবং এক্সট্রাএকাডেমিক কাজে ব্যবহারের জন্য। এক সময়ে ক্লাস আওয়ারে এ’সব অডিটরিয়ামে কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হতো না। এখন যেন গানবাজনাই সব, লেখাপড়াটা উপলক্ষ্য মাত্র।

বিকেলে কবি আখতারুজ্জামান আজাদের একটা আলোচনা শুনছিলাম। একটু আগে। তিনি বলছিলেন, আমাদের আত্মারা যেন মরে গেছে। আমি উনার সাথে একমত, আমাদের আত্মারা, মানে বিবেক যেন (অনেকখানি) মরে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামক জাতীয় তামাশা চলছে, চলবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামে যতসব পাবলিক নুইসেন্স চলছে, চলবে। সার্বিকভাবে বললে, টপ-টু-বটম আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ফ্রম উইদিন একপ্রকার ভেঙ্গে পড়েছে। বিধ্বস্ত ভবনে অনন্যোপায় হয়ে বসবাস করার মতো আমরা এখানে দিব্যি আছি খোশ হালে। জাতির যা-ই হোক, চাকরী তো আছে।

আমি মনে করি না, সমস্যার গোড়া (অপ)রাজনীতি; যদিও রাজনীতিকে ব্যবহার করে শিক্ষা নামক জাতীয় মেরুদণ্ডকে আঘাত করা হচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে সমস্যার গোড়া হলো প্রতারণা, দুর্নীতি ও অন্যায়ের ব্যাপারে সমাজের মধ্যে তৈরী হওয়া গণসম্মতি। যে যাকে যেভাবে পারছে ঠকাচ্ছে। ছাত্ররা ঠকাচ্ছে শিক্ষকদেরকে আর তাদের গার্ডিয়ানদেরকে। শিক্ষকরা ঠকাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদেরকে আর জাতিকে। দিনশেষে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত, যদি আমাদের ততটুকু বোধোদয় অবশিষ্ট থেকে থাকে।

শিক্ষকদের একটা জীবনচক্র আছে। সেই ছকবদ্ধ সুখের জীবনকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। নিরবে। নজরুলের ভাষায়, ‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা’। পুরো লেখাটা কেউ হয়তো পড়বেও না। তাতে কী? What is the other way? প্রফেট মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, কোনো অন্যায় দেখলে তোমরা হাতে বাধা দাও। না পারলে মুখে প্রতিবাদ করো। তাও না পারলে অন্তরে ঘৃণা করো।

হাজার হাজার তরুণকে এখানে শিক্ষার নামে নিয়ে এসে আমরা ছেড়ে দিয়েছি হেলায় ফেলায় সময় কাটানোর জন্য, নিজেদের ক্রিয়েটিভিটিকে ধ্বংস করে একেকটা জম্বি হিসেবে গড়ে উঠার জন্য, এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে ফিরে।

তোমাদের বয়সের চেয়েও আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অনেকখানি বেশি। একজন বয়োজেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। চাই, খেলার মাঠে তোমরা যতখানি স্বতঃস্ফূর্ত শ্রেণী কক্ষেও হয়ে উঠ ততখানি স্বতঃস্ফূর্ত। দলাদলির এই সময়েও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ শিক্ষকরা আশা করি উঠে দাঁড়াবে এক সময়ে, একাত্ম হবে শিক্ষা সংস্কারের এই সামাজিক আন্দোলনে। পুরনো কথাটা আবার বলে শেষ করছি স্বগতোক্তিমূলক এই কথামালা, identification of the problem is half of the solution।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *