মানুষ স্বভাবতই যুক্তিপ্রবণ। এই যুক্তি এখানে এভাবে চলবে না, এইটাও সে কোনো না কোনো যুক্তি দিয়েই বলে। সেই দৃষ্টিতে আমার কথাটাই সঠিক, ‘যুক্তির বাইরে কিছু নাই’। আজকালকার যুগ যুক্তির যুগ। ভক্তির প্রাধান্য এখন অনেক কম। প্রযুক্তির কল্যাণে, বিশেষকরে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির এই সময়ে কোনো এক কোনায় অবস্থানকারী ব্যক্তিও ফিজিকেলি অনতিক্রম্য দূরত্বে থাকা সব বিরুদ্ধমতের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে। এভরিওয়ান ইজ ব্রুটালি এক্সপোজড টু ডিফারেন্ট অর অপোজিং থটস।
তাই, এই প্রশ্ন করা যাবে না, বা ওই প্রশ্ন করা যাবে না, এইসব বলে লোকজনকে থামিয়ে দেয়ার সুযোগ এখন আর অতটা নাই। এট দ্যা ফার্স্ট চান্স সুযোগ পাইলেই লোকেরা প্রশ্ন করছে। যাদের কাছ হতে সদুত্তর পাওয়া যাবে না বলে মনে করে তাদেরকে এড়িয়ে আমাদের মতো যুক্তিবুদ্ধির যারা কারবারী তাদের দ্বারস্থ হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, প্রশ্ন করা যাবে না, অথবা, এই প্রশ্নটা আলোচনার যোগ্য নয়, কোনো প্রশ্নের ব্যাপারেই এমন কথা বলা যাবে না। বরং কোনো কোনো প্রশ্ন যে ভুল, কেন ভুল, কনমসেন্সের ভিত্তিতে সেইটা দেখিয়ে দিতে হবে।
২.
সলিমুল্লাহ খান স্যারের সাথে আমি একমত, প্রচলিত মাদ্রাসাশিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার চেয়ে উন্নততর। নন-টেকনিকাল সাবজেক্টসমূহের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। আমিও একসময়ে মাদ্রাসাশিক্ষাকে যথেষ্ট তাচ্ছিল্য করতাম। পরবর্তীতে মাদ্রাসাশিক্ষা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানার কারণে আমার এই ভুল ভেঙ্গেছে।
যারা জাত শিক্ষক, আমার ধারনা, দু’চারদিন বিশেষকরে কওমী মাদ্রাসায় সকাল-বিকাল-সন্ধ্যায় যাওয়া আসা করলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার সাথে মাদ্রাসাশিক্ষার নির্মোহ তুলনা করতে সক্ষম হবেন।
সে যাই হোক, মাদ্রাসাশিক্ষার ভালোদিকগুলোর পাশাপাশি সেখানে যেসব মৌলিক ত্রুটি রয়ে গেছে, তার পহেলা নম্বরে আছে ক্রিটিকেল থিংকিং এর অভাব। একপাক্ষিক প্যাসিভ লার্নিং সিস্টেমে তারা পড়ায়। গুগলের এই যুগে মুখস্তবিদ্যার কোনো গুরুত্ব নাই। দিনশেষে তা বিশেষ কোনো উপকারে আসবে না। চ্যাগজিপিটি এসে তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
৩.
ক্রিয়েটিভিটি ছাড়া মানুষের জ্ঞান অর্থহীন। আমার ইচ্ছা করে bloom’s taxonomy এর বড় বড় পোষ্টার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোড়ে মোড়ে লাগিয়ে রাখি। বহু বছর আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব ক্লাসরুমের দরজায় লাগিয়ে দিয়েছিলাম। একপর্যায়ে কালার ফেইড হয়ে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ডিপার্টমেন্টে কখনো সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়নি।
পাশ্চাত্যপ্রভুরা ওয়ার্লড ব্যাংকের থ্রুতে HEQEP, OBE ইত্যাদির মাধ্যমে চাপ না দিলে কখনো এসব নিয়ে অন্তত আর্টস সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে আলোচনা হবে না, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। মাদ্রাসার কথা তো আরো পরে, অবাধজ্ঞান চর্চার কল্পিত স্বর্গরাজ্য এইসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা ধারনাতীত মাত্রায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছি।
৪.
যে কথা বলার জন্য এতকথা সেইটা হইলো, পানি ছাড়া যেমন খাবার গলাধকরণ ও হজম করা যায় না, তেমন করে ফিলসফি ছাড়া ক্রিটিকেল থিংকিং অচল। জানতে চান? ক্রিটিকেল থিংকিং লাগবে। ক্রিটিকেল থিংকিং রপ্ত করতে চান? ফিলসফি ছাড়া কোনো উপায় নাই।
বাই দ্যা ওয়ে, ক্রিটিকেল থিংকিং করতে গিয়ে অনেকে সফিস্ট্রি (sophistry) করা শুরু করেন। ক্রিটিকেল থিংকিংএর সাথে সফিস্ট্রিকে তারা গুলিয়ে ফেলেন। সক্রেটিসের যুগে একধরনের লোকেরা অর্থের বিনিময়ে জ্ঞানদান করতো। সহজ সরল কথাগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তারা ঘুরাইয়া প্যাঁচাইয়া অনর্থক জটিলত তৈরী করে মিথ্যাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করতো। এই ধরনের লক্ষ্যহীন বুদ্ধিজীবীতা হলো সফিস্টগিরি করা।
সে যাই হোক, ক্রিটিকেল থিংকিংয়ের সারকথা হলো কোনোকিছুকে সার্বিক দৃষ্টিকোণ হতে তথা হলিস্টিকেলি দেখার চেষ্টা করা, উন্মোচিত সত্যকে অকপটে গ্রহণ করে নেয়া এবং মিথ্যাকে বর্জন করা, যা আমি সত্য মনে করি তা নিজে অনুসরণ করা এবং জ্ঞাত মিথ্যাকে সাধ্যঅনুসারে মোকাবিলা করা।
৫.
খুব কম কলিগের সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ভাল-মন্দ নিয়ে কথা বলতে পারি। অধিকাংশ কলিগ নিছক চাকুরীজীবী। তো, যে ক’জনের সাথে কথা বলা যায় তেমন একজনকে সেদিন বলেছি, ‘দেখো, আমরা প্রাকটিকেল এথিক্সের নানা ব্রান্চ নিয়ে বাইরের লোকদের সাথে এনগেইজ হই। অথচ ফিলসফির সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেয়ার মতো জিনিস হইলো ক্রিটিকেল থিংকিং।’
আমার সব আলোচনাতে তাই আমি ক্রিটিকেল থিংকিংএর ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকি। এই ভিডিওতেও সেইটার রিফ্লেকশান পাবেন।
অনেকসময়ে লোকেরা ‘টপকা টপকা প্রশ্ন’ করে কেটে পড়ে। কোনো একটা ইস্যুকে ডিল করার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে সিরিয়াসনেস এবং কনসিস্টেনসির যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। জ্ঞান অর্জনের আদি ও অকৃত্রিম পথে অগ্রসর না হয়ে, ফেইসবুক ইউটিউব করে আপনি জ্ঞানী হতে পারবেন না।
হ্যাঁ, আমি প্রকৃত জ্ঞানী হওয়ার কথা বুঝাচ্ছি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আপনি সার্টিফিকেটধারী কিনা তা আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। সব নন-টেকনিকাল সাব্জেক্টের জন্য এটি প্রযোজ্য। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জ্ঞানী হওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞানতার পরিচায়ক। ডেইলিস্টারের প্রাক্তন কলামিস্ট মরহুম বদরুল আহসান বলেছেন, (formal) education is certified ignorance।
প্রসংগত উল্লেখ্য, কোনেকিছু সম্পর্কে জানতে হলে (১) উপযুক্ত পাঠ্য খুঁজে পেতে হবে, (২) অতঃপর সেইটা গলাধঃকরণ করতে হবে, (৩) এরপরে পঠিত/শ্রুত কন্টেন্ট নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে হবে। সবশেষে (৪) আলোচ্য বিষয়কে লিখিতভাবে অথবা/এবং মৌখিকভাবে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
এই চারটার কোনো একটাও যদি বাদ পড়ে যায়, তাহলে ওই বিষয়ে আপনার প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হয় নাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার যত ফ্যান-ফলোয়ার থাকুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না।
এই ভিডিওতে আমি কী বলেছি, তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত আমি একটা কথাও বলি নাই। এতক্ষণ যা বললাম তা এই ভিডিওর আলোচ্য বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা।
হ্যাপি লিসেনিং।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Tahmid Tajwar: স্যার লজিকের ওপর বেস করে চললে গাইবের ওপর ইয়াকিন কিভাবে সম্ভব? দুনিয়াকে আল্লাহ্ তৈরি করছেন দুনিয়ার নেজাম অনুযায়ীই চলবার জন্য। এই নেজামে চলতে চলতে ব্যতিক্রম হবে কিছু। আল্লাহ্ সে ব্যতিক্রমের ক্ষমতা রাখেন। আর এটাই আল্লাহর সুন্নাহ্।
মুসা আঃ এর তাঁর কওমকে নিয়ে সাগর পাড়ি দেবার ক্ষেত্রে সাগরের পানি সড়ে যাবাকে অনেকে যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করে “জোয়ার-ভাটার” কারণ হিসেবে। ফেরাউন ডুবলো জোয়ারের কারণে। আর মুসা আঃ পার হলেন নাকি ভাটার কারণে!
তারপর শেষ যামানায় ঈসা আঃ যখন দামেস্কের মসজিদে আসবেন…বর্ণনা অনুযায়ী উনি ফেরেশতার পাখায় ভর দিয়ে মসজিদের ছাদে আসবেন। লোকে দেখবে। তিনি বলবেন মই দেবার কথা। যুক্তি অনুযায়ী প্রশ্ন আসতে পারে ঈসা আঃ আসমান থেকে এতটা আসতে পারলেন…আর ছাদ থেকে নামতে পারবেন না? দুনিয়াকে আল্লাহ্ দুনিয়ার নিয়মেই চালাবেন। এটা আল্লাহর সুন্নাহ্ পাশপাশি ওয়াদাও আছে ঈমান ও আমালের সাথে।সেগুলা গায়েবের সাথে সম্পর্কিত। ঘটনাকে যদি যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করা হয় তবে তা অনেকটা বস্তুবাদীতায় রূপ নেয় বেশিরভাগ থেকে। অথচ ঈমান তো গাইবের জিনিস।
ইমানদারদের সফলতার ঘোষণা রয়েছে বারবার। তারা যখন সফল হয়, তখন সফলতার কারণ হিসেবে যা দাঁড় করানো হয় তা হচ্ছে দুনিয়ার নেজামে চলা আনুষঙ্গিক ঘটনা থেকে। অথচ কার্যসম্পাদনের পূর্বেই সফলতার যে ঘোষনা আসলো তার ব্যাখ্যা কিন্তু যুক্তি দিয়ে বের করা যাচ্ছে না আর তা সম্ভবও না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কার্য সম্পাদনের আগে তিনি ফলাফল ঘোষণা করতে পারেন যিনি কার্য সম্পাদনের পরে ঘটনাটা কী দাঁড়াবে সেটা আগে থেকেই জানেন।
Tahmid Tajwar: জ্বি স্যার, তাতো “সফলতার ঘোষনা এবং সফল হবার দ্বারা” বললামই। তবে সফলতা আসবার ক্ষেত্রে যেসব অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়…কিংবা যে উপায়ে সফলতা আসে… যুক্তির ক্ষেত্র সেখানে বস্তুজগতের আসবাবকে ফোকাস করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অথচ যে সফলতার ঘোষণা এলো সম্পূর্ণ গায়েবের ওপর বিশ্বাস রেখে যে স্পৃহা অর্জন হলো অদেখা শক্তির ওপর ভরসা করে… লজিক কিন্তু তার ব্যাখ্যা দিতে পারছে না যে সে কেমন করে তা প্রেডিক্ট করলো!
তৎকালীন বিশ্বশক্তি “রুমের” সেনাপতিকে যখন জিজ্ঞাস করা হলো মুসলিমদের সাথে তোমাদের পরাজয়ের কারণ কি? জবাবে ও বেচারা উত্তর দিলো, ” মুসলিমরা খেয়ানত করে না, রাত জেগে তাদের রবের ইবাদাত করে, দিনে রোজা রাখে, জুলুম করেনা।” এ ছিলো উত্তর। অথচ ময়দানে জয় পাবার সাথে এ কারণগুলোর কি রিলেশান? যুক্তি দিয়ে একুরেট এন্সার বের করা সম্ভব?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: You misunderstood logic and ‘gayeb’. If you are interested enough contact with me next week. I am busy right now. and I shall be talking with you.
Hasibul Haque: In our lifetime we can only think about 3 dimensions where time is not constant or cannot be used as a static argument.
I believe on our final day we will not have that limitation I mean only 3 dimensions. At that stage, we can view entire stuff at a glance and from that point of view we know everything past, present, and future. I think in that way Allah knows everything.
Naeem Hasan: পুরো বিশ্ব জগত সৃষ্টির কারণ আমরা জানি না বটে তবে মানুষ সৃষ্টির কারণ কোরআনে যেভাবে এসেছে তার সারমর্ম মনে হয় এ’রকম –
স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন সৃষ্টি কল্যানকর কি না এই নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে আল্লাহর আলোচনায় ফেরেশতারা বলেছিল যে এ’রকম সৃষ্টি পৃথিবীতে কেবলমাত্র বিপর্যয় তৈরী করবে। তখন আল্লাহ বলেছিলেন ‘তিনি যা জানেন ফেরেশতারা তা জানে না’। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষে এমন স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন সৃষ্টিও সম্ভব যা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না – আর এটা প্রমান করার জন্য মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে – আল্লাহ যখন ভবিষ্যত জানেন, কলম যখন সবকিছু লিখেই রেখেছে তখন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর প্রয়োজন কী ছিল।
উত্তর হচ্ছে : আল্লাহ ভবিষ্যত জানেন, কিন্তু ফেরেশতারা কি জানে? আল্লাহতো ন্যায় বিচারক – আর ন্যায় বিচারের শর্ত হল ‘ঘটনা ঘটার পর স্বাক্ষ প্রমানের ভিত্তিতে বিচার করা’।
কোন বিচারক যদি কোন মামলার বাদি বিবাদী বা স্বাক্ষি হন তাহলে তিনি সেই মামলার বিচার করতে পারেন না – সেটা অন্য বিচারকের এজলাসে পাঠাতে হয়। সুতরাং আল্লাহ যদি তার ভবিষ্যত জানার ভিত্তিতেই রায় দিয়ে দিতেন তাহলে সেটা ন্যায় বিচার হত না। ন্যায় বিচারের স্বার্থেই দুনিয়ায় মানুষকে পাঠাতে হয়েছে যাতে শেষ বিচারের দিন ফেরেশতাদের সামনে পর্যাপ্ত স্বাক্ষী সহ প্রমান করা যায় যে আল্লাহই সঠিক – স্বাধীন ইচ্ছা সম্পন্ন সৃষ্টি বিপর্যয়কারী নয়।
এটা যদি গ্রহনযোগ্য যুক্তি হয় তাহলে – মানুষের উপর একটা দ্বায়িত্ব এসে যায় ফেরেশতাদের মতামত ভুল প্রমান করা – স্বাধীন ইচ্ছা সম্পন্ন হয়েও বিপর্যয়কারী না হওয়া। যে মানুষ সেটা পারবে আল্লাহ তাদের পুরোষ্কৃত করবেন – যে পারবে না সে শাস্তি পাবে।