মানব মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে আমি কথা বলেছি আমার বড় বোন প্রফেসর ডা. ফাতেমা খানমের সাথে। তিনি ঢাকাস্থ ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজে ফিজিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। উনার সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে আমার মেজ আপার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তানভির রায়হান। ও পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডে হেড অব মেইনটেইন্যান্স কন্ট্রোল পদে কর্মরত।
আলোচনা শুনলে বুঝতে পারবেন, আমাদের ব্রেইন খুলির ভেতরে একটা ফ্লুইডের ওপর ভাসতে থাকে। যার কারণে আমরা প্রায় দেড় কেজি ওজনের এই ব্রেইনের ওজন তেমন একটা অনুভব করি না। একইভাবে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত ৫০০ মেট্রিক টনের একটা গোলককে অতি সূক্ষ্ম একটা অয়েল ফ্লুইডের মধ্যে ভাসিয়ে মাত্র সাড়ে চার মেগাওয়াটের একটা মটর দিয়ে ঘুরানো হয়। অন্যথায় ৫০ মেগাওয়াট মটর দিয়েও এটাকে ঘুরানো সম্ভব হতো না।
বড় আপা মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে অতি সংক্ষেপে যা বললেন তার একটা হলো ট্রান্সডিউসার, যা সিগনাল পরিবহন করে। তানভিরের কথা হলো, এই ট্রান্সডিউসার সিস্টেমটাই তারা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করে। এই লাইনের সব কথার মূল কথা হলো, প্রাকৃতিকভাবে যা আছে তা কাজে লাগিয়ে মানুষ নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করছে। মূলগত দিকে থেকে নাথিং ইজ নিউ।
কিছুদিন আগে ‘প্রবলেম অব এভিল’ নিয়ে একটা প্রস্তুতিমূলক লেখায় একটা পয়েন্ট নোট করেছি। সেটা হলো, অন্তত এই ব্যাপারে আস্তিক-নাস্তিক উভয় পক্ষই একমত, জগত তৈরি হয়েছে বা শুরুই হয়েছে সব শক্তি, সম্ভাবনা এবং সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম দিয়ে। গড বা ন্যাচার, যেটাই এগুলো দিয়ে থাকুক না কেন। এখানে নতুন কোনো শক্তিও যেমন তৈরি হতে পারে না। তেমন করে নতুন কোনো সম্ভাবনা ও নিয়মও তৈরি হবে না। অজানা পুরনো বিষয় আমরা ‘যথাসময়ে’ জানতে পারি। মূলত বিদ্যমান নিয়ম সম্পর্কে অবগত হই।
তাই, প্রশ্ন হতে পারে, এগুলো কে দিলো? কেন এমন হলো? অন্যরকম হলো না কেন? না হলেই বা কী ক্ষতি হতো?
না, এ ধরনের অস্তিত্বগত মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে আমি উনাদের সাথে আলাপ করি নাই। বলেছি, এগুলো ফিলসফির বিষয়। আমি উনাদের থেকে জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের শরীর কি একটা যন্ত্র? তাদের মতে, আমাদের শরীর যান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে কাজ করে। কিন্তু এটি নিছক যন্ত্র নয়।
বড় আপা প্রফেসর ফাতেমা খানম ও ভাগিনা ইঞ্জিনিয়ার তানভিরের মতে, এমনকি তর্কের খাতিরে নাস্তিকদের দাবি অনুসারে আমরা যদি ধরেও নেই যে মানুষ নিজেও একটা যন্ত্র, তাহলেও তাদের দাবি স্ববিরোধী হয়ে পড়ে। কারণ, কোনো যন্ত্র কখনো স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠে না। এটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানোর জন্য একজন সূচনাকারী, নিয়ন্ত্রক ও সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলীর প্রয়োজন হয়।
বেড়াতে এসেছেন। এমন ইজি মুডে বড় আপা তো প্রথমে ইন্টারভিউ দিতেই রাজিই হচ্ছিলেন না। অবশেষে, দশ-পনের মিনিট কথা বলার জন্য কোনোমতে রাজি করাই। ব্যাপার হলো, নিজের সাবজেক্ট ও ফিল্ড অব ইন্টারেস্ট নিয়ে কথা বলতে প্রত্যেকেই পছন্দ করে। বড় আপার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটলো। বলতে বলতে তিনি অনেক কথাই বললেন। লাইফ সায়েন্স নিয়ে যারা পড়াশোন করেছেন তারা উনার কথাগুলো ভালো বুঝবেন। সময় করে নিয়ে যদি শোনেন, ভালো লাগবে, আশা করি।
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
M Hasan Mehedhi: স্যার, দর্শন আর যুক্তি কী এক জিনিস? না কোনো পার্থক্য আছে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার মনে হয়, যুক্তি নিয়ে কাজ করা হলো দর্শন। দর্শনের ভিত্তি হলো যুক্তি। আর যুক্তির চর্চা হলো দর্শন।
গোধূলি বেলায়: স্যার, আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে একটু বিস্তারিত জানতে চাই।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আবেগ ও অনুভূতি দুটোই ব্যক্তিনিষ্ঠ বা সাবজেক্টিভ। তবে, আবেগ হলো অধিকতর ব্যক্তিগত, অনুভূতির তুলনায়। সকল আবেগই এক ধরনের অনুভূতি। কিন্তু সকল অনুভূতি আবেগ নয়। অনুভূতি অনেকটা শারিরীক ফেনোমেনা বা বিষয়। পক্ষান্তরে, আবেগ অনেকটাই মনোগত বিষয়।
Kamrulhasan Rashed: আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহ সুবহান আপনাদেরকে নেক হায়াত দিন। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সময়ে বিশ্বাসের ভিতকে পোক্ত করায় আপনাদের এ ধরনের আলোচনা পাইলিংয়ের কাজ করে বৈকি। গত সন্ধ্যায় হঠাৎ এক দাওরায়ে হাদীস পাশ মুফতীর নাস্তিক (তার ভাষায় মুরতাদ) হবার অল্প করে কথোপকথন দেখছিলাম।
যে প্রশ্নটি মাথায় ঘুরছে, তাহলো কুরআন-হাদীস পড়ে তার এই ইউটার্নের সিক্রেট বা কার্যকরণ কি?
সংক্ষিপ্ত হলেও খানিক বলবেন, তৃপ্ত হবো।
ভালো থাকবেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মাদ্রাসাগুলোতে জীবনমুখী ও ইন্টারেক্টিভ শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে আনুগত্য ও মুখস্তবিদ্যার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। নাস্তিক হয়ে যাওয়া মুফতি মাসুদ ছোট বেলা হতে ‘আউট বই’ তথা সাহিত্যের বই-পুস্তক পড়তো। যখন কেউ এক ধরনের চিন্তাধারার বইপুস্তক পড়বে, অথচ সেগুলোর ব্যাপারে কোনো গঠনমূলক সমালোচনা আছে এমন মানসম্পন্ন বইপুস্তক সে পাবে না, বা সেগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে ও খোলামনে আলাপ আলোচনা করতে পারবে না; তখন সে স্বাভাবিকভাবেই মনে করবে, ওরা যারা ভিন্ন ধাঁচের বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলছে, তারাই খুব সম্ভবত সঠিক।
মানুষ যখন একবার মনের দরজা কোনো দিকে বা কারো জন্য খুলে দেয় তখন সে অনেক কিছুকে এক ধরনের আস্থার ভিত্তিতে গ্রহণ করে নেয়। যে কোনো পক্ষভুক্ত লোকের জন্য এটি সমভাবে সঠিক ও সমভাবে প্রযোজ্য।
প্যাসিভ লার্নিং সিস্টেমে পড়ালেখা করে কেউ আসলে সত্যিকারের জ্ঞানী হতে পারে না। সমস্যা হলো, মাদ্রাসাওয়ালারা জ্ঞান আর তথ্য-স্তুপীকরণ বা information retrieval-এর মধ্যে যে পার্থক্য, সেটাই বুঝতে পারেন না। তথ্য দেয়া-নেয়াই যদি জ্ঞান হতো, তাহলে ‘আল্লামা গুগল’ই হতো দুনিয়ার সেরা জ্ঞানী!
কী মনে করে জানি, কিছু কথা খোলামেলাভাবে বললাম। মুফতি-শায়খেরা না জানি আবার আমাকে মুরতাদ ঘোষণা করে!
Kamrulhasan Rashed: জাযাকাল্লাহ। এ ব্যাপারে আমার মরহুম আব্বার একটি উক্তি শেয়ার করছি। আব্বা জেলা শিক্ষা অফিসার থাকার পরও তাঁর বৈষয়িক জৌলুস না থাকায় আমরা তাকে বলতাম, অমুক মাওলানা তো দালানকোঠা করছেন, আপনি করছেন না কেন? তিনি জবাব দিলেন, “ওরা ইসলাম মুখস্ত করেছে, আন্ডারস্ট্যান্ড করেনি।” সত্যিই মুখস্তবিদ্যা আর আত্মস্থ জ্ঞানে বিস্তর ব্যবধান। শুকরিয়া সময় দেবার জন্য।