কেউ যদি বলে, ‘আত্মপরিচয় জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য জরুরি।’ বলা যায়, এটা তো দাবি। এর পেছনে কি সায়েন্টিফিক দলিল বা যুক্তি আছে? কারণ, আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা না করেও অনেকে সভ্য মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করছে। অনেক নাস্তিক দাবি করছে, বিশেষ কোনো আত্মপরিচয়ের প্রয়োজন নেই। সময় পেলে উত্তর দিবেন।”

আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে পাঠক খান আফিফ ফারহানের সম্পূরক প্রশ্ন।

উত্তর:

আমি তো ফিলোসফির লোক। আর্টস ফ্যাকাল্টির একটা সাবজেক্ট ফিলোসফি। আমার কাছে সায়েন্টিফিক দলিল চাওয়া কেন?

যদ্দুর বুঝেছি, লোকেরা মনে করে সায়েন্স সার্টিফায়েড কোনো কিছু হলো সত্য ও নির্ভরযোগ্য। অথচ, সায়েন্স স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে ফিলোসফির ওপরে। সায়েন্স যেখান থেকে শুরু করে সেটা সায়েন্স নয়, লজিক তথা ফিলোসফি। সায়েন্স কাজ করে ইনডাক্টিভ লজিক বা আরোহমূলক যুক্তি পদ্ধতিতে। সায়েন্স বিশ্বাস করে অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্পিরিসিজমে। অথচ, জ্ঞানের উৎপত্তিমূলক মতবাদসমূহের মাত্র একটি হলো অভিজ্ঞতাবাদ। সায়েন্স বিশ্বাস করে বা সত্য বলে ধরে নেয় বাস্তববাদ বা রিয়েলিজমকে। অথচ, সত্তা সম্পর্কিত অনেকগুলো মতবাদ বা তত্ত্বের মধ্যে এটি একটিমাত্র বা অন্যতম। একমাত্র নয়।

সায়েন্স সত্য বলে ফর গ্রান্টেড ধরে নেয় প্রকৃতিবাদ বা ন্যাচারালিজমকে। যেটাকে আমরা বলি সায়েন্টিফিক ন্যাচারালিজম। এর বিকল্প তত্ত্ব হচ্ছে ফিলোসফিক্যাল ন্যাচারালিজম। আচরণবাদ বা বিহেভিয়েরিজমকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিয়ে সায়েন্স ডিসিপ্লিনে রিসার্চ করা হয়। অথচ, মনোদর্শনে আচরণবাদ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মত, ধারণা বা প্রস্তাবনাসমূহের একটিমাত্র বা অন্যতম একটি প্রস্তাবনা বা থিওরি।

সায়েন্স বা যে কোনো সাবজেক্ট যেখানে থেমে যায়, অন্য ডিসিপ্লিনের লোকদের গবেষণার দৌড় যেখানে সমাপ্ত হয়, ওই সাবজেক্ট সম্পর্কিত ফিলোসফিক্যাল স্টাডি সেখান হতে শুরু হয়।

আফসোস!!! লোকেরা ফিলোসফারের কাছে সায়েন্টিফিক দলীল খোঁজে।

বলা যায়, এটি জমানার দুর্ভাগ্য!!!

সায়েন্সিজমের যুগে সায়েন্টিজমই হলো বিজ্ঞানবাদী লোকদের কাছে একমাত্র একসেপ্ট্যাবল ‘স্ট্যান্ডার্ড’!!!

যারা কোরআন স্টাডি বা উলুমুল কোরআনকে ‘কোরআনিক সায়েন্স’ বানিয়ে নিয়েছেন তাদের কাছ হতে আর কীইবা আশা করা যায়!!!

প্রশ্নকর্তাকে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মনে করি। অপ্রিয় সত্য কথা বলার সুন্নত আদায় করতে গিয়ে এ কথাগুলো বললাম।

দ্বিতীয় শিরোনাম: আত্মপরিচয় অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে সভ্যতা গড়ে তুলেছে

এরপর আসেন আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে।

মানুষ প্রাকৃতিক জীবন ছেড়ে, প্রকৃতিকে মেনুপুলেইট করে, নিজের সুবিধা মোতাবেক কাজে লাগিয়ে মানুষ সভ্য হয়েছে। নচেৎ মানুষ অপরাপর প্রাণীদের মতো গুহায় বসবাস করতো। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম আবিষ্কার করতো না। সভ্যতা গড়ে তুলতো না।

এবার বলেন, কিংবা একটুখানি ভাবেন, মানুষ কেন সবকিছু জানতে চায়? অপরাপর প্রাণীর মতো সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তিনির্ভর জীবন যাপন না করে মানুষ কেন স্বীয় সহজাত প্রবৃত্তি বহির্ভূত ফিলোসফিক্যাল অন্ড রিলিজিয়াস বিষয়ে ভাবিত হয়? এনগেইজ হয়? শুধুমাত্র মানুষের অভাবনীয় ভাষাগত উন্নতির কারণ কী? অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রসঙ্গ আসে না কেন? মানুষ কেন স্বীয় ন্যাচারাল হেবিটেট বা প্রাকৃতিক আবাসস্থল ছেড়ে পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে? কেন সে মহাশূন্য জয় করতে চায়? মানুষের এই অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তার হেতু ও উদ্দেশ্য কী?

আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা শুধু নয়, আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে সমাধান না করে কেউ তো সভ্য হতে পারে না। যে স্ট্যান্ডার্ডেই হোক না কেন, সভ্যতা মানেই স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট আত্মপরিচয়। আত্মপরিচয়ের ঠেলুনি ও জীবনবোধের গুতানি না থাকলে মানুষ মানুষ হয়ে উঠতো না।

হ্যাঁ, হতে পারে, এই আত্মপরিচয়কে মানুষ অবচেতনে সঠিকভাবে বুঝে নিলেও এক শ্রেণীর মানুষ সচেতনভাবে সেটাকে স্বীকার করে না, বা করতে চায় না। খেয়াল করলে দেখবেন, নাস্তিক-অজ্ঞেয়বাদীদেরও নিজস্ব জীবনবোধ ও জীবনদর্শন আছে। নিজেদের মতো করে তাদেরও আছে নৈতিকতা ও মানবিকতা।

আত্মপরিচয় ছাড়া নৈতিকতা ও মানবিকতা হয় কী করে?

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *