১৯৬৩ সাল। বাবুনগর গ্রামের মাস্টার বাড়ি। হালদা নদীর ভাংগনে তখন উঠানে বন্যার পানি। যে কোনো সময়ে ভেংগে পড়তে পারে মাটির ঘর। চট্টগ্রামের ভাষায় গুদাম ঘর। ভদ্রমহিলার স্বামী চাকুরীস্থলে। তিন মেয়ে আর ছোট এক ছেলেকে নিয়ে এমনি এক ক্রান্তিকালে উনার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। উনার এক চাচী-শাশুড়ি একটা পুরনো ব্লেড পাটার উপরে একটুখানি ঘষে নিয়ে সেটা দিয়ে বাচ্চার নাড়ি কেটে কিছু একটা দিয়ে বেঁধে দিলেন। তৎকালে ‘ডলু’ (বাঁশের ধারালো পিঠ) দিয়ে নাড়ি কাটার রেওয়াজ ছিলো। যৌথ পরিবারে বড় ছেলের বউ হিসাবে সাধ্যমতো সবার দেখাশোনা করলেও শাশুড়িদের কাছে তিনি ছিলেন ‘দেমাগী’। কেননা, তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। বুঝতেই পারছেন, সময়ে সময়ে তিনি অবহেলা আর নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

অল্প সময় পরেই বাচ্চাটার নাড়ির বাঁধন খুলে যায়। নাড়ি দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। এমনকি ঘরের মাটিতে রক্ত পড়ে সেখানে চাক হিসাবে জমাট বেঁধে যায়। নতুন বাচ্চা হওয়ার এই পরিবেশে উনার বড় মেয়েদের পক্ষে মা কিংবা বাচ্চার কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। প্রসূতি মায়ের কাছ হতে সাময়িকভাবে বাচ্চাটাকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। উনাদের কাচারি ঘরে আশ্রিত হিসাবে থাকতেন বাচ্চাটার এক জ্ঞাতি-চাচা। থম দিয়ে থাকা সেই রক্ত তিনি একটা কোদাল দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন।

বাচ্চার নাড়ি দিয়ে এভাবে রক্ত প্রবাহিত হতে দেখে চিৎকারে করে উঠে বিপন্ন সেই মা বলেছিলেন, ‘আমার এই বাচ্চা বাঁচবে না…!’ হ্যাঁ, উনার সেই বাচ্চাটা বাঁচে নাই। জন্মের সাত দিনের মাথায় ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। চারিদিকে পানি। পরিবারের পুরুষ মানুষ বড় কেউ বাড়িতে নাই। আশপাশের লোকেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। জানি না সেই বন্যায় বাচ্চাটাকে কীভাবে কোথায় দাফন করা হয়েছিল।

মুরুব্বী শ্রেণীর এক বেপরোয়া স্বভাবের প্রতিহিংসাপরায়ণ মহিলার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাচ্চা হারিয়েছিলেন এই মা। পর পর তিনটা মেয়ে হওয়ার ‘অপরাধে’ চাচী-শাশুড়িরা উনাদের ছেলেকে আবার বিয়ে করাতে চেয়েছিলো। যাতে করে ছেলের ঘরে নাতি হয়। আল্লাহর হুকুম, প্রথম তিন মেয়ের পরে একটা ছেলে সন্তান হওয়ার তিন বছরের মাথায় জন্ম হলো এই দ্বিতীয় ছেলে সন্তানের। দুর্ভাগ্য, ভুল পরিচর্যার কারণে বাচ্চাটার অকাল মৃত্যু হলো।

এর বছর তিনেক পরে সেই মায়ের আরও একটা ছেলে সন্তান হলো। জন্মের পর হতে ছয় মাস পর্যন্ত এই তৃতীয় ছেলে সন্তানের মাথার চুল কামানো হয় নাই। উনার ভয় ছিলো, মাথার চুল ফেলে দিলে বাচ্চা মারা যেতে পারে। দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের সপ্তম দিনে মাথা মুণ্ডানো হয়। সেদিনই বাচ্চাটা মারা যায়। শুনেছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাচ্চাটার কান্না ছিল বিরামহীন।

সন্তান রা সেই মায়ের অনুরূপ অবিরত অঝোর কান্না আর আর্তনাদ যেন আমার কানে ভাসছে। দুঃসহ এই ঘটনা সম্পর্কে ভাবলে ভেতর থেকে কলিজাটা যেন ছিঁড়ে আসে। অকালপ্রয়াত সেই বাচ্চাটা ছিলো আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য পরিবারের ছোটরা আমাকে সেজো সম্বোধনে ডাকে। আমার মা, রত্নগর্ভা মহিয়সী সেই নারী, দশ সন্তানের জননী, আজ নাই হয়ে আছে বেঁচে আছেন আমাদের স্মৃতিতে, অস্তিত্বে, আর উনার যাবতীয় সদগুণ আর অবদানের মাঝে ।

ক’দিন আগে বলেছিলাম, আবেগই মানুষের শুদ্ধ পরিচয়। সব মানবিক অর্জনের উৎস হলো শুদ্ধ আবেগ। প্রিয় পাঠক, বলুন তো, কেন সেই অসহায় নারীর কষ্ট এখনো তাঁর সন্তানদের আলোড়িত করে? অপার্থিব এই আবেগের উৎস কী?

আমরা একটা কিছুকে চেনা জানা অন্য কোনোটার সাথে মিলিয়ে বুঝাতে চাই বা বুঝতে চেষ্টা করি। সব কিছুর তুলনা চলে। শুধুমাত্র দুটো জিনিস ছাড়া– আবেগ ও জীবন। আবেগের তুলনা আবেগ। জীবনের তুলনা জীবন। আবেগের বহিঃপ্রকাশ জীবনে। জীবনের প্রমাণ হলো আবেগ। হৃৎস্পন্দন ইত্যাদি শরীরবৃত্তীয় সংবেদন প্রাণ থাকার প্রমাণ হতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রমাণ প্রাণের চেয়ে বেশি কিছু। এই ‘বেশি কিছু’টাই হচ্ছে আবেগ।

আবেগকে তাই কোনো উদারহণ বা তুলনার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বিবেক যা-ই বলুন না কেন, আবেগ হলো মূল চালিকা শক্তি।

আবেগ আমাদের কাঁদায়। আবেগ আমাদের দেয় তুষ্টি। আবেগের অবিরত চাপের মুখে মানুষ বিশ্বকে জয় করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। নিছক খেয়ে পরে বেঁচে থাকার ছককে পিছনে ফেলে মহৎ লোকেরা যুগে যুগে ধর্ম, নীতি, আদর্শ ও নৈতিকতা গড়ে তুলেছে। ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, জগৎকে অতিক্রম করার, জগতের অতিবর্তী কিছু আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার, এ ধরনের নৈর্ব্যক্তিক বিষয় নিয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়ার দৃশ্যমান যে মানবিক প্রবণতা, তার উৎস কী? আবেগ।

আবেগ নিয়ে আগের দুইটা লেখায় যারা কনভিন্স হতে পারেন নাই, আশা করি, আমার মেজো ভাইয়ের এই কাহিনী শুনে বুঝতে পারবেন, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে এ ধরনের বৈষয়িক লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে কিছু কষ্ট আছে। যার যার মতো করে তা আমরা অনুভব করি।

আমাদের সব মহৎ কাজের অন্তরালে ভাবাবেগ কাজ করে। সত্যি কথা হলো, আবেগ আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। বেঁচে থাকার যে অদম্য প্রেরণা, তা এক ধরনের মৌলিক ও শুদ্ধ আবেগ ছাড়া আর কিছু নয়। এ জন্য দেখবেন, আবেগের এই ফল্গুধারা যার মধ্যে যত গভীর ও খরস্রোতা, সে ব‍্যক্তি তত বেশি গতিশীল মননের অধিকারী। আর মানবিক আবেগের জায়গায় যে ব্যক্তি যত সংকীর্ণ ও বঞ্চিত, দেখবেন, সেই ব্যক্তি তত বেশি নিষ্প্রাণ ও আচারনিষ্ঠ। এ ধরনের ফর্মাল লোকেরা নৈতিকতার চেয়ে আইন, উদ্দেশ্যের চেয়ে নিয়ম বা প্রথার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করে।

যেমন করে পর্যাপ্ত পরিমাণে ও নির্ভেজাল ইঞ্জিন অয়েল ছাড়া কোনো মেশিন ফাংশানিং থাকা অসম্ভব, আমাদের জীবনে আবেগের ভূমিকা তেমনই। আবেগহীন বিবেক, অকার্যকর ও অসম্ভব। বিবেক আবেগকে কাজে লাগায়। যেমন করে নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে জলযান আমাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছতে সহায়তা করে। আমাদের সৃজনশীল হওয়ার ক্ষেত্রে, নৈতিক হওয়ার ক্ষেত্রে, আদর্শবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে, সর্বোপরি মানবিক হওয়ার ক্ষেত্রে আবেগই হলো অনুঘটক বা ট্রিগারিং ফ্যাক্টর।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *