বিগত পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছে ৯ হাজারের বেশি, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছে ৫ হাজারের বেশি আর জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছে ৪ হাজারের বেশি ভোট। এ হিসাবে জামায়াতের প্রার্থী পেয়েছে প্রায় এক পঞ্চমাংশ ভোট।
এই রেজাল্ট ছিল প্রত্যাশিত। জামায়াতের কোনো কোনো দায়িত্বশীল চেয়েছিলেন, জামায়াত এবারে পৌরসভার নির্বাচন না করে বিএনপিকে ছেড়ে দিক। কারণ, জেতার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেন নাই? যেখানে জামায়াতের এমপি গতবার এবং এবার নির্বাচিত হয়েছেন?
সংসদ নির্বাচনে মহানগরী জামায়াতের সভাপতি মাওলানা শামসুল ইসলাম জয়লাভের পর পরই মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করে। সাতকানিয়া সদরে জামায়াতের সংগঠন খুবই দুর্বল। মাত্র ৩ জন কর্মী নিয়ে একটি সক্রিয় ইউনিট হতে পারে। সাতকানিয়া প্রপারে ১টিও সক্রিয় ইউনিট নাই! সাতকানিয়া সদরে ৩টি পাড়া– সতী পাড়া, চর পাড়া ও বোয়ালিয়া পাড়া। বোয়ালিয়া পাড়া জামায়াত-শিবির হিসাবে পরিচিত হলেও ওখানে মিশ্রিত অবস্থা। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের লোক সেখানে থাকেন। জনগণ আদর্শিকভাবে প্রভাবিত নয়। সতী পাড়া শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী এলাকা হিসাবে পরিচিত। এরা মূলত আওয়ামী লীগ করে। সন্ত্রাসী টাইপের লোকজন। চর পড়া (প্রকাশ চোর পাড়া) হলো সাতকানিয়া কলেজ সংলগ্ন এলাকা। সেখানকার লোকজন পাঁচমিশালী ধরনের। এরা মূলত বিএনপি সাপোর্টার। সাতকানিয়া পৌরসভার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা ও লোক আদতে ইসলামপন্থী নয়।
বিভিন্ন কারণে সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তি ছিলো আশাতীত। সে হিসাবে পৌরসভায় প্রাপ্ত ভোটে জামায়াত তখন মেজরিটি ছিলো। সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ছাড়া অপর দুই প্রার্থী ছিলেন ‘বহিরাগত’। কর্নেল অলি আহমদ চন্দনাইশের মানুষ আর আওয়ামী লীগের এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম লোহাগাড়া শেষ প্রান্ত বড় হাইত্যা এলাকার। জামায়াত প্রার্থী মাওলানা শামসুল ইসলাম হলেন তুলনামূলকভাবে লোকাল। আওয়ামী পাড়া হিসাবে পরিচিত সতী (স্থানীয় উচ্চারণে হতি পাড়া) হলো মাওলানা শামসুল ইসলামের নানার বাড়ির এলাকা। তাঁর কিছু মামা ইত্যাদি আত্মীয়-স্বজন সেখানে এখনো আছেন যারা স্বভাবতই তাঁর পক্ষে ছিলেন। তাঁর বোন বিয়ে দিয়েছেন লোহাগাড়া আওয়ামী লীগের পুরনো এক নেতার কাছে, যিনি ছিলেন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি মারা গেছেন।
সাতকানিয়া পৌরসভা ‘এনেছেন’ শাহজাহান চৌধুরী এমপি। তখন যদি জেলা সভাপতি জাফর সাদেককে দিয়ে ইলেকশন করা হতো, হয়তোবা গণজোয়ারের ধাক্কায় তিনি পাশ করে যেতেন। কিন্তু জামায়াত সে সময়ে প্রার্থী দেয় একজন সমর্থককে। যেটি এমনকি জামায়াতের স্ট্যান্ডিং পলিসির ব্যতিক্রম। সে সময়ে নাকি উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি। অথচ তখনোও জনাব জাফর সাদেক জামায়াতের নেতা ছিলেন। হয়তোবা তখন তিনি পৌরসভা নির্বাচনকে ছোট মনে করেছেন!?
উপজেলার আওতায় ১৭টি ইউনিয়ন। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া হয় একটা ইউনিয়নের জামায়াত সভাপতি জনাব নুরুল হককে। সেখানেও যদি জাফর সাদেক ইলেকশন করতেন তাহলেও একটা ইমেজ গড়ে উঠতো, হয়তোবা।
সাতকানিয়া সদরে যারা রুকন আছেন, ৫/৭ জন, তাঁরা কেউই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। মানুষ তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জামায়াতকে সমর্থন করার কোনো কারণ নাই। অন্যদের জন্য সর্বোচ্চ মান (আযিমত) ও নিজেদের জন্য জায়েযের সর্বনিম্ন সীমা (রুখসত) হলো তাঁদের মুয়ামালাতের প্যাটার্ন। জামায়াতের নেতারা সাধারণত যা করে থাকেন।
পৌরসভা বিএনপির কনস্টিটিউয়েন্সি। মাহমুদুর রহমান গতবারও বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সংসদ জামায়াতের। এভাবেই সেট ঠিক করা। সেক্ষেত্রে জামায়াতের কাজটি ক্লেইম করা কৌশল ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিপরীত হয়েছে। গতবার যদি জামায়াত পৌরসভায় নির্বাচন না করে ছেড়ে দিতো তাহলে হয়তোবা এবার বিএনপির সাথে একটা দরকষাকষি করতে পারতো। এমনও স্ট্র্যাটেজি হতে পারতো যে, লোকটি যেহেতু বোনাফাইড বিএনপি নন, তাহলে তাঁকে সমর্থন দিয়ে অবলাইজড করা ও ক্রমান্বয়ে তাঁকে জামায়াত বানানোর চেষ্টা করা। এর কোনোটাই না করাতে অসম্ভব নয় যে মাহমুদুর রহমানকে দিয়ে আগামীতে বিএনপি সাতকানিয়াতে সংসদ নির্বাচন করতে চাইবে!?
বিএনপির পৌরসভা মেয়র মানুষকে যে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তা অভূতপূর্ব। টাকার হিসাবে তা বহু কোটি টাকা। এমন কোনো কাজ নাই যেটিতে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নাই। অপরদিকে জামায়াত প্রার্থী সংগঠনের বড় নেতা। কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক, জনবিচ্ছিন্ন ও উচ্চাকাংখী। মেয়র জামায়াতের হলে এমপির জন্য সহায়ক হবে ইত্যাদি যুক্তির কথা বলা হলেও তিনি জেতার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী ছিলেন। কিসের ভিত্তিতে তা তিনি মনে করেছেন, সেটি স্পষ্ট নয়। জেলা আমীর স্বয়ং জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী থাকায় কেন্দ্রও তাঁর সাথে একমত হয়ে অনুমতি দিয়েছেন। কেন্দ্রের উচিত ছিলো নিরপেক্ষ জরিপ রিপোর্ট নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া।
যেখানে এমপি জামায়াতের সেখানে নির্বাচন না করা বা কোনো জামায়াত প্রার্থী হেরে যাওয়া যদি দু’আনা পরিমাণে ক্ষতির বিষয় হয়, তাহলে দীর্ঘদিনের জেলা আমীর স্বয়ং নির্বাচন করে এক-পঞ্চমাংশ ভোট পাওয়া কত আনার ক্ষতি? জনগণ ভেবেছে, মেয়র বিরোধী দলের হলেও ব্যক্তিগতভাবে যা করেছেন তা তো অনেক বেশি। জামায়াত নেতারা জনগণের মনকে বুঝতে সক্ষম হয় নাই। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞজনের অভিমত হচ্ছে, ‘শরয়ী ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে আমাদের অধিকতর পরিপক্কতা দরকার’।
সাতকানিয়াকে আমরা জামায়াতের গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার নমুনা হিসাবে দেখতে পারি বটে। সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বশীলেরা যেভাবে এক এক জনে কয়েকটা করে ভোট দিয়েছেন এবং টাকা বিলিয়েছেন তা জামায়াতের ইসলামী রাজনীতির কলংক। এক একটা ভোটে গড়ে ৫০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। একটা কেন্দ্রে ১ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। অতি উৎসাহী কেউ বলতে পারেন, আপনি কীভাবে জানেন? রেফারেন্স কী? ইত্যাদি। আসলে আমি নিজেই রেফারেন্স, ধরে নিন। আমরা তো একটা ছোট্ট জগতে বাস করি। তাই না? কাবার ভেতরে কেবলা নাই। লাগে না। কী বলেন?
এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
সব জানা শমসের: মোটেই অবাক হইনি। কারণ, সিলেট সিটি কপোরশন নির্বাচনে জামায়াত নমিনি আজিজুল হক মানিককে জিতাতে নির্লজ্জ ভোটচুরি করতে দেখেছি! ইসলামকে বিজয়ী করতে কী কসরত!!!
পরদেশী: আপনি মনে হয় সাতকানিয়ার লোক। আপনি যখন ভোটের এত হিসেব-নিকেশ জানেন, তাহলে আপনি ভোটে প্রতিদ্বন্দিতা করলেন না কেন? যেহেতু আপনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন এবং লেখাজোখা করেন, সাথে আছে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। দল আপনাকে নমিনেশন না দিলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নিজস্ব ভোটের কারিশমা দেখাতে পারতেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অপ্রাসঙ্গিত ও ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক কিছু না বলাই ভালো।
দেখুন, কীভাবে আপনার মন্দ কথার উত্তরে সুন্দর কথা বলে মোকাবিলা করলাম! আগে জানতাম, বাম-নাস্তিকরা অসহিষ্ণু। এখন দেখছি, ইসলামী লোকেরাও কম যান না! লোকেরা দেখুক, আপনার মন্তব্য ও আমার উত্তর।
আবু আফরা: ওখানে মাঝে মাঝে যেতাম চিটাগাং থাকা ওবস্থায়। ওখানে গেলে আমারও ঐরকম মনে হতো। তবে ওটা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের যে ঘাঁটি, তা আমার সব সময় মনে হয়েছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনাকে দেখে খুশি লাগছে। ভাবছি, আপনাকে প্রিয়তে রাখবো।
জাতীয়তাবাদীদের ঘাঁটি হতে পারে বটে, ইসলামেরও হতে পারে। তবে ওখানে জামায়াতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শংকিত।
এম এন হাসান: “সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বশীলেরা যেভাবে এক এক জনে কয়েকটা করে ভোট দিয়েছেন এবং টাকা বিলিয়েছেন তা জামায়াতের ইসলামী রাজনীতির কলংক।”
আচ্ছা, উপরোক্ত ঘটনার যেহেতু আপনি নিজেই সাক্ষী, তাই আরেকটা বিষয় জানতে চাচ্ছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কিছু পত্রিকায় খবর এসেছিল, সিরাজগঞ্জে নাকি কুরআন শরীফে হাত রেখে শপথ করানো হতো ভোট নিশ্চিত করার জন্য? এই ঘটনা কি আদৌ সঠিক? সিরাজগঞ্জবাসী বা ঐ অঞ্চলের কেউ যদি জানেন, তাহলে জানাবেন প্লিজ।
এগুলো যে ভোটের রাজনীতিতে বাধ্য হয়ে করতে হয়, সেটা বুঝার জন্যই জানা দরকার। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞজনের অভিমত হচ্ছে, ‘শরয়ী ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে আমাদের অধিকতর পরিপক্কতা দরকার’। অভিজ্ঞজনের সাথে একমত।
খুবই ভালো লিখেছেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ। পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। ইসলাম ও গণতন্ত্র নিয়ে কিছু মন্তব্য দিয়েছি। কোনো এক কমেন্টে সাতকানিয়ার উদাহরণ দিয়ে লিখবো, এমনটা লিখেছিলাম। নিছক ওয়াদা রক্ষার জন্য লেখা। দুয়েকদিনের মধ্যে মন্তব্য করবো, ইনশাআল্লাহ।
আমি ভাই চিটাগাংয়ের লোক। সিরাজগঞ্জ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। আমি এসব বাদ-প্রতিবাদে, সত্যি কথা বলতে, কিছুটা বিরক্ত। তবে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। আপনি লেগে থাকেন। আমি আপনাদের সাথে আছি।
বুলেন: আমি চট্টগ্রামের নই। তবে চট্টগ্রামে পড়াশোনার সুবাদে চট্টগ্রামের রাজনীতির খোঁজখবর নিতাম। এবারের সাতকানিয়ার পৌরসভা নির্বাচনের আগের নির্বাচনের দুইদিন আগে আমি একজন শিবিরের ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কে জিতবে?” উনি মনে হয় রেডি করা উত্তর দিলেন, “অবশ্যই বিএনপির প্রার্থী।” অথচ অনেকেই বলছিল জামায়াত জিতবে। নির্বাচনে বিএনপি জেতার পর আমি বুঝতে পারলাম, ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়। আপনার কথায় ওই শিবির নেতার মতো অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ দেখতে পেলাম। প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জামায়াত যদি আদর্শ মেনে না চলে, ভবিষ্যতে জামায়াতের জন্য কঠিন সময় আসতেছে, শুধু সাতকানিয়ায় নয়, পুরো বাংলাদেশে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ।