জন্মের চেয়ে বড় বিস্ময় আর মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য, পৃথিবীতে নাই!
জাফর ভাই যখন মাস্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে। ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের খুব সম্ভবত প্রথম ভালোছাত্র-দায়িত্বশীল সদস্য, যিনি সরাসরি শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। আমরা যখন জয়েন করি তখন হতে অব্যবহিত পরবর্তী প্রায় দশ বছর তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল। তখনও অবিবাহিত ছিলেন। বহুবার উনার নালাপাড়ার বাসায় গেছি। মেরিন সায়েন্সে তখন নিয়মিত যেতাম। উনার রুম ছিল নানা রকমের গবেষণা উপাদানে ভর্তি। কোনো রকমে বসা যেত। ক্লাশ পারফর্মেন্স, গবেষণা নির্দেশনা ও দলীয়-আদর্শিক কাজ– এই তিন ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন ঈর্ষনীয় সুনামের অধিকারী।
শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. জাফর ভাইয়ের মৃত্যুর এই দিনে স্মরণ করছি মরহুম লোকমান স্যার, সালেহ স্যার, বদিউল আলম স্যার ও (ইসলামের ইতিহাসের) শামুসদ্দীন স্যারকে। তাাঁরা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আন্দোলনের এক একটি পিলার।
বদিউল আলম স্যারের লাশের গাড়ি যখন ফটিকছড়ির উদ্দেশ্যে ১নং গেইট অতিক্রম করছিল তখন ভাবছিলাম– স্যার কখন প্রথম এই গেইট অতিক্রম করে ভিতরে গিয়েছেন, জানি না। তবে এটুকু নিশ্চিত জানি, আজকের পর তিনি আর কখনো প্রিয় এই ক্যাম্পাসে আর ফিরবেন না। উনাকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করার জন্য ছন্দা আপা বলেছিলেন। কিন্তু উনার কাজিন নুরুল ইসলাম ভাই এতে প্রবল আপত্তি তুলে বলেছিলেন, বদ্দা এখানে চাকরি করতে এসেছিলেন। এখন সব শেষ [অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়-পর্ব এখানেই শেষ]। উনি থাকবেন উনার মা-বাবার পাশে।
একদিন আমারও ‘চাকরি শেষ’ হবে। বাড়ি-ঘরের মতো হয়ে যাওয়া এই ক্যাম্পাস হতেই হয়তোবা আমাকেও নিয়ে যাওয়া হবে ফটিকছড়ির বাবুনগর গ্রামে আমার বাবার কবর সংলগ্ন পশ্চিমের একটুখানি ফাঁকা রয়ে যাওয়া জায়গাতে দাফন করার জন্য। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে চবি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রথম এসেছিলাম এই সুন্দর ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের উত্তরে অবস্থিত কলেজ হতে মধ্য-ক্যাম্পাসে সাড়ে সাত বছরের হল জীবনের পরে বিগত প্রায় কুড়ি বছর হতে দক্ষিণ ক্যাম্পাসে থাকছি। এর দক্ষিণে আর কোনো ক্যাম্পাস নাই। এরপরে আছে শুধু একদিন লাশ হয়ে বের হয়ে যাওয়া…!
সদ্য-মৃত জাফর ভাই ও ১৯৯১ সাল হতে পঙ্গুত্ববরণকারী ‘জীবন্মৃত’ সহযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন কাজল ভাইকে এই হৃদয়-নিংড়ানো লেখাটি উৎসর্গ করছি। ফর্মাল-স্মার্ট প্রফেসর/ডক্টরদের ও শ্রদ্ধাবনত ছাত্রদের মাঝে নিজের অযাচিত অসহায় আবেগ প্রকাশের বিড়ম্বনা হতে বাঁচার জন্য বেলায়েত হোসেন কাজল ভাইয়ের প্রসংগকে আমি সবসময়ে এড়িয়ে চলি। জাফর ভাইয়ের ‘অকাল মৃত্যু’র কথা জানিয়ে দেয়া স্ট্যাটাসে কাজল ভাইয়ের মন্তব্য দেখে নিজের অবাধ্য অশ্রুকে সংবরণ করতে পারিনি। আমি জানতাম না উনি আমার ‘বন্ধু তালিকায়’ আছেন!
হযরত আবু হুরাইরা (রা) একদিন দামি রুমাল দিয়ে নাক ঝাড়তে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। সাথে থাকা লোকজন এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমার মনে পড়ে গেল সে সময়ে কথা যখন মসজিদে নববীর সামনে ক্ষুধার চোটে আমি অজ্ঞানপ্রায় হয়ে পড়ে থাকতাম। লোকেরা মৃগী রোগী মনে করে জ্ঞান ফেরানোর জন্য তাদের পায়ের চামড়ার জুতা দিয়ে আমাকে মাড়িয়ে যেত! এ প্রসংগে তিনি মাসআব ইবনে উমায়েরের (রা) কাহিনী বললেন, যিনি ছিলেন মক্কার সবচেয়ে সুদর্শন ও সৌখিন যুবক। ধনাঢ্য মায়ের একমাত্র পিতৃহীন সন্তান। হিজরতের পরে তিনি একবার আল্লাহর রাসূলের (সা) পাশ দিয়ে সালাম বিনিময়ের পরে চলে গেলে তাঁর জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) কেঁদে দিলেন। উপস্থিত সাহাবারাও কাঁদলেন। উহুদ যুদ্ধের পরে উনার লাশ দাফন করতে গিয়ে দেখা গেল উনার পরনের কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায়, আর পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) পরামর্শ চাওয়া হলে তিনি বললেন, কাপড় দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকো। আর ইযখির (এক প্রকার লম্বা ঘাস) দিয়ে পায়ের দিকে ঢেকে দাও!
হযরত আবু হুরাইরা (রা) বললেন, তাঁরা তাঁদের পূর্ণ প্রতিদান, আশা করি, আখিরাতে পাবেন। আর আমরা যারা দুনিয়াতে অনেক কিছু পেয়ে গেছি (তখন তিনি একটা প্রদেশের প্রশাসক), জানি না, এরপরে আমরা কিছু পাবো কিনা…!
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Mohammad Main Uddin: চরম সত্য কথা লিখেছেন মুযাম্মিল ভাই। ৮৬ সালে আমরা ফার্স্ট ইয়ারে। জাফর ভাই মাস্টার্স পরীক্ষাথী। আলাওল হলের দায়িত্বশীল। বড় দায়িত্বশীল হবার পরও উনার রেজাল্ট ভালো। ঊনাকে ব্যালান্সড লাইফের উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হতো। শিক্ষক হিসেবে ঊনার যোগদান ছিল আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কত কম সময়েই জাফর ভাই চলে গেলেন! আপনি অতি প্রাঞ্জল লিখেছেন। একদা আমাদেরও চলে যতে হবে। কত ক্ষণস্থায়ী এক দুনিয়াতে আমরা বাস করছি!
Md. Saiful Islam: I worked with Zafar sir for two years in Abdur Rab hall. I was house tutor and he was Provost. One of the nice man I met in my life. O Allah! give him Jannah.
Nhm Abu Bakar: I just came to know by your heart-breaking status that Prof. Jafar is no more. Innalillahe….rajeun. He was very close to me like many other near and dear ones. Very recently he updated me about his physical conditions. But I never thought that almighty God will call him so soon. I deeply feel sorry for his unexpected demise. He was a very respectable teacher to his students and friendly to his colleagues. He always tried tell anything without breaking formal decorum of any meeting. My condolences to his family members and friends. May God bless him the right place in heaven.
Khandoker Zakaria Ahmed: ড. জাফর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর আমাকে ভীষণভাবে বেদনার্ত করেছে। পুরাতন বিশাল স্মৃতিভাণ্ডারকে উস্কে দিয়েছে। সকলেই কীভাবে চলে যাচ্ছেন– ড. লোকমান স্যার, ড. বদিউল আলম স্যার, ড. সালেহ স্যার, শামসুদ্দিন স্যার, ড. ইউসুফ শরীফ স্যার চলে গেছেন। তারমানে আমাদেরকেও চলে যেতে হবে খুবশীঘ্রই। ভয় হয়, আসলে কি যাওয়ার জন্য কোনো প্রস্তুতি নিতে পেরেছি? জাফর ভাই ছিলেন নিরহংকার ও কাজপাগল মানুষ। আমি তার অনেক ভালো কাজের সাক্ষী। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাবাসী করুন। আমীন।
Hamid H Azad: I am speechless. Only prayer, O Allah accept my brother as your valued guest and put him in the best place of Jannah, Ameen.