কমসে কম আজ থেকে পনের বছর আগের কথা। খুব ভোরে শুনলাম বদরুল আমীন ভূঁইয়া স্যারের বাসার ওদিকে একটা ছাত্রের লাশ পড়ে আছে। তখন শীতকাল শেষের দিকে। স্পষ্ট মনে পড়ে শীতের কাপড় গায়ে না দিয়ে আমি পাতলা জামা পরে পাহাড়িকা আবাসিকের দিকে ছুটলাম। তখন আমি ২৮ নং বাসায় থাকি।

কাছাকাছি যেতে দেখলাম জুলজির গফুর খান স্যার একজন ছাত্রকে এম্বুলেন্সে তুলছেন। সাথে হাবীব স্যারও ছিলেন। আরো শিক্ষকরা ছিলেন। তখন আমি সাইকেল চালাতাম। এম্বুলেন্সের পিছু পিছু মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে জানলাম, ছাত্রটি বেঁচে আছে। গুরুতর আহত। প্রাণিবিদ্যার ছাত্র। থাকে আমানত হলে। তাকে তখনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।

শোনা কথা। ওর প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্ররা কোনো অজুহাতে ওকে পলিটিকেলি কালার করে হলের মধ্যে আচ্ছামতো মেরেছে। এরপর সোহরাওয়ার্দী হলের লেবু বাগানে নিয়ে আরেক দফা মেরেছে। মৃত মনে করে ভোরের দিকে ওকে স্টেশনের পাশে ধান ক্ষেতে ফেলে দিয়ে গেছে। ওদিকটায় তখন এত বাড়িঘর ছিল না।

তখনকার সময়ে ক্যাম্পাসে শোনা কথা, ওকে মারার মোটিভ ছিল, ও খুব মেধাবী ছাত্র। যাতে টিচার হতে না পারে সেজন্য তাকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে মারা হয়েছে।

সেই ছেলে ঠিকই টিচার হলো। ওর বউও ওদের ডিপার্টমেন্টের টিচার। ওর শ্বশুর আর আমার সেজ দুলাভাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ফার্স্ট-কাজিন। আফতাব আমার এক ঘনিষ্ঠ স্কুল বন্ধুর ভাইয়ের বা বোনের ছেলে। এ মুহূর্তে আমি কনফিউজ করছি। ও নিজেই এইসব পরিচয় আমাকে দিয়েছে।

প্রগতিশীল ধ্যানধারণার অধিকারী হলেও ব্যক্তিজীবনে ওকে দেখেছি খুবই পাঙ্কচুয়াল প্রাকটিসিং মুসলিম হিসেবে। স্বভাবতই ধর্মের নামে প্রচলিত বাড়াবাড়ি ও ভণ্ডামিকে সে খুব ঘৃণা করতো। ইসলাম নিয়ে খুব পড়াশোনা করতো।

কোরআন, হাদীস ও সীরাতের ওপরে ও যতো টেক্সট পড়েছে তা আমি তো নই-ই, খুব কম লোকেরা পড়েছে। অনেক স্কলারের ভিডিও বক্তব্য সে নিয়মিত শুনতো। সেসব নিয়ে আমার সাথে প্রায়শ সে আলাপ-আলোচনা করতো।

আমার সাথে ওর খুব সাবলীল সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল ওর আগ্রহের কারণে। আমার সাথে ওর অনেক মিল। আমার মতো আফতাবও হাঁসমুরগী পালতো। কবুতর পালতো। ছাদ বাগান করতো। সাইকেল চালাতো। ইদানীং সে একটা স্কুটিবাইক চালাতো। ওকে একদিন বললাম, তুমি দিনের বেলায় বাইকের হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখো কেন? ও বলছিল, এখন নাকি এরকম নিয়ম করেছে। হেলমেট ছাড়া ওকে কখনো বাইক চালাতে দেখি নাই।

গত মধ্যরাতে চবি ১নং রাস্তার মাথায় মূল রাস্তায় উঠার সময়ে বিপরীত দিক থেকে আসা একটা মাইক্রোবাসের সাথে ওর স্কুটির সংঘর্ষ হয়। স্পট ডেড। কীভাবে কী হলো তা আমার বুঝে আসছে না।

দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেন, সত্য হলো একজন প্রতিশ্রুতিশীল জীববিজ্ঞানী, একজন সমাজসচেতন সাহসী ব্যক্তি, একজন নিখাদ বিশ্বাসী মানুষকে আমরা হারালাম।

ইসমত (ওর স্ত্রী) আর তার সন্তান কীভাবে এই আঘাত কাটিয়ে উঠবে তা আমার বুঝে আসছে না। তাদেরকে সান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা আমার জানা নাই।

শুধু জানি, জন্মের চেয়ে বড় বিস্ময় আর মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য পৃথিবীতে নাই। একদিন যেতে হবে। একে একে সবাইকে। যাওয়াটাই এখানে নিয়ম। পৃথিবীর এই আজন্ম নিয়মের নেই কোনো ব্যতিক্রম।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে অন্যায়ভাবে যাকে প্রহার করে মৃত মনে করে ফেলে দেয়া হয়েছিল ধান ক্ষেতে আইলের উপরে, এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু বর্ণাঢ্য জীবনের মেয়াদান্তে আজ সত্যিই সে মৃতের নগরীতে স্থায়ী বাসিন্দা হলো।

হে আল্লাহ, তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করো সদ্য ইন্তেকাল করা তোমার এই সত্যনিষ্ঠ বান্দাকে। আ-মীন!

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *