শায়ান। ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। বয়স ১০ বছর। আমার পাশের বাসায় থাকে। প্রতিদিন বিকাল হলেই এলাকার বাচ্চাদের সাথে আমাদের বাসার লনে খেলতে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে বানানো অতিপুরনো এই ধরনের ৩৪টা বাসার মধ্যে একটা ছাড়া সব বাসার ভেতরের লনে সবজি ও ফুলের বাগান দেখা যায়। খেলার জায়গা নাই। ২৮নং বাসা এর ব্যতিক্রম। এখানে বাচ্চাদের আকর্ষণের মধ্যে আছে একটা বড় দোলনা, অনেকগুলো এংগোরা জাতের সাদা খরখোশ, ফুটবল, ব্যাট ইত্যাদি খেলার সরঞ্জাম, বাসার সামনে-পিছনে অবাধে ছোটাছুটি করার স্বাধীনতা, বাচ্চাদের প্রিয় রাহনুমা আপু এবং ততোধিক প্রিয় মোজাম্মেল চাচা।
চাচা তাদেরকে প্রজেক্টর লাগিয়ে মাঝে মধ্যে ভিডিও ছবি দেখান। কখনো উনার অনেক বড় মনিটরে রেড-সায়ান চশমা লাগিয়ে একসাথে ৫-৬জনকে থ্রি-ডি ভিডিও দেখার সুযোগ করে দেন। তাদের সাইকেলে পাম্প চলে যাওয়া, খেলতে খেলতে পানির তৃষ্ণা লাগা, নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান ও ঝগড়া-বিবাদ হওয়া, বলা যায়, সব ঝামেলাতেই মোজাম্মেল চাচা হলেন তাদের আরবিট্রেটর বা ‘মুশকিল আসান’।
পাখির কিচির মিচিরের মতো তাদের অদ্ভূত সব খেলাধূলা আসরের পর হতে শুরু হয়ে মাগরিবের আজান পর্যন্ত চলে। চাচার ‘একমাত্র বড় মেয়ে’ মাহজুবাহ আপুর পরীক্ষার সময় বেশি শব্দ করা মানা। তাই, পরষ্পরকে তখন ঠোঁটে আংগুল লাগিয়ে তারা ইশারা করে, ‘ইস্… শব্দ করো না।’ মোজাম্মেল চাচা একটা ইউটিউব চ্যানেলে (mohammad mozammel hoque) তাদের আবৃত্তি/বক্তব্য, নানা রকমের খেলাধূলা, শারীরিক কসরত ও দোলনা বেয়ে উঠানামার ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেন। cu kids লিখে সার্চ দিলে সেগুলো পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে তাদের পারফরমেন্স দেখা যায়, সে জন্য তারা বেজায় খুশি।
এরচেয়েও তাদের বড় খুশি হলো মোজাম্মেল চাচার সাদা রংয়ের স্কুটিতে গাদাগাগি করে বসে হৈ চৈ করে মাঝে মাঝে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করা। তারা একেক ব্যাচে ৪/৫ জন করে উঠে। ছেলে বাচ্চাদের একটা ব্যাচ। মেয়ে বাচ্চাদের আলাদা ব্যাচ। কোনো পক্ষকে আবার কিছুটা কম ঘোরালেও হবে না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে চলে রেষারেষি। ইদানীং তাদের কাউকে কাউকে বাইক চালানো শিখাচ্ছি। বিশেষ করে যারা ভালো সাইকেল চালাতে জানে তারা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমার সামনে বসে কিছুটা চালাতে পেরে তাদের ভাবখানা এমন যেন তারা বিমান চালনা শিখে ফেলছে।
আজ আমার ‘একমাত্র ছোট মেয়ে’ রাহনুমাকে (৮ম শ্রেণী, এবং typical teeny…) প্রাইভেট টিউটরের বাসা হতে আগায়া আনতে গিয়ে দেখি তাদের আগেই ছুটি হয়ে গেছে। ১৫ নম্বরের সামনের রাস্তায় ‘রাহনুমা আপু’ বায়না ধরলো, ওর এক বান্ধবীকে পিছনে চড়িয়ে বাইক চালাবে। আমিও কী মনে করে যেন রাজি হয়ে গেলাম। বাইক হতে নেমে বললাম, ‘প্রীতিলতা হলের কর্ণার হতে ঘুরে আসবা। সাবধানে চালাবা।’
ওমা, আর দেখা নাই ওদের। কী ব্যাপার? কোথায় গেল? ক্যাম্পাসের রোমিওরা যে হারে ভোঁ-ভাঁ করে মোটা চাকার মোটর সাইকেল চালায়, তাদের কারো সাথে অলরেডি ঢুশ লাগায়া দিলো নাকি…? খুব টেনশান ফিল করছি। এদিকে শায়ানের গ্রুপও বায়না ধরেছে, তারা বাইকে উঠবে এবং চালানোর প্র্যাকটিস করবে। বৃষ্টিস্নাত রৌদ্র-সমুজ্জ্বল রমজানের অনির্বচনীয় এক বিকেলে, সুন্দর এই ক্যাম্পাসের সবুজ বনানীর মাঝে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ‘রাহনুমা আপু’র সন্ধানে লেডিস হলের মোড় পর্যন্ত গেলাম। নাহ, সাদা ওয়েগো স্কুটিটার দেখা নাই। কোনো রিকশাও পাচ্ছি না যে ওকে ফলো করবো…।
কিছুক্ষণ পরে দেখি, নবীন বাইক-ওমেন তার বান্ধবীকে পিছনে বসিয়ে পুরো দক্ষিণ ক্যাম্পাস এক চক্কর দিয়ে আমাদেরকে ক্রস করছেন। থামার জন্য আমাদের চিৎকারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দিক-বিজয়ীর মতো আরো এক চক্কর দেয়ার জন্য সাহসে যতটুকু কুলায় ততটুকু জোরে তারা বাইক হাঁকিয়ে ছুটছেন। সাথে শুল্কমুক্ত হাসি আর আনন্দ হর্ষধ্বনি। মনে পড়লো, ছোটবেলায় আমরা সাইকেল চালানোর জন্য কতো উন্মুখ হয়ে থাকতাম…! কারো পিছনে মোটর সাইকেলে উঠার সুযোগ পেলে মনে করতাম যেন রকেটে চেপে বসেছি। গতি আর ছুটে চলার এ আনন্দ যেন মানুষের মজ্জাগত।
এই পর্যায়ে, ‘রাহনুমা আপু’র আশা বাদ দিয়ে শায়ান ও তার বন্ধুদের নিয়ে বাসার দিকে ফিরতি পথে আসার সময় গোল পুকুরের কাছে এসে খেয়াল করলাম, তারা পুকুর থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাস্তার ওপাশ ঘেঁষে হাঁটছে। কেন ভয় পাচ্ছে জিজ্ঞাসা করার পরে বললো, ওরা শুনেছে, ‘এই পুকুরে একটা জ্বীন আছে। গার্ড-চাচাদের কেউ দেখেছে, গভীর রাতে পুকুরের মাঝখান হতে ওই জ্বীন উঠে আসে।’ আমি তাদের সাহস দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের সামনেই একদিন আমি সাঁতরিয়ে এ পাশ হতে ওই পাশে পার হবো।’
তাদের বদ্ধমূল ধারণা, আমি মাঝখানে ডুবে যাবো। অবশ্য তাতে তাদের, অন্তত শায়ানের, তেমন দুঃখ নাই। ও বললো, ‘আপনি পুকুরে ডুবে গেলে আমি আন্টিকে গিয়ে বলবো, মোজাম্মেল চাচা পুকুরে ডুবে গেছে। ওনার স্কুটিটা আমাকে দিয়ে দেন।’ আমি তো হাসতে হাসতে শেষ।
ওর এক বন্ধু আহবাবের মাথার উপর হাত রেখে বললাম, ‘তোমরা যখন বড় হবা তখন আমি অনেক বুড়া হয়ে যাবো।’ শায়ান এটা শুনেই বলে উঠলো, ‘তখন তো আপনি লাঠি ধরে হাঁটবেন। আর মোটরসাইকেল চালাতে পারবেন না। তখন আন্টিকে বলে আপনার স্কুটিটা আমি নিয়ে নিবো।’ দেখেন, বাচ্চাদের লজিক। কেমন অদ্ভূত রকমের সরল…!
২.
কত সুন্দর, কত নির্মম আর অমোঘ এই জীবনচক্র। এক সময় আমাদের বড় চাওয়া ছিলো একটা ফুটবল আর একটা সাইকেলের মালিক হওয়া। ছোটবেলায় আমার একটা রিকশা সাইকেল ছিলো। তা নিয়ে আমি গ্রামের সব বাচ্চাদের মধ্যে সর্দারি করতাম, এক ধরনের আভিজাত্য ফলাতাম। এরা ছোট। বড়দের শত শঠতার একটাও ওরা বুঝে না। কতো অল্পতেই এরা তুষ্ট…! তুচ্ছ কিছুতেও নির্মল আনন্দ খুঁজে পায়।
ওরা একদিন বড় হবে। তখন, এখনকার বড়, এই আমরা আর থাকবো না। আগামীর সেই দিনে, অনাগত সব বড়দের কেউ কেউ তখন, তখনকার ছোটদেরকে এভাবে স্নেহ করবে। ভালোবাসবে। স্বপ্ন দেখবে। আমাদের মতোই। ভাববে, যেন তারা বরাবরই ছিলো। মনে করবে, অবচেতনে, যেন তারা চিরদিনই রয়ে যাবে। কিন্তু না, সবাইকে যেতে হয় অতঃপর পরপারে। হোক সেটা অস্তিত্বহীন শূন্যতায় কিংবা নিরন্তর অস্তিত্বের এক অন্তহীনতায়। এ জগতে, আসাটা অনিশ্চিত। যাওয়াটাই বরং ব্যতিক্রমহীন, নিয়ম। আমাদের পরে যারা আসবে, জীবনের পরিণতি ভুলে, তারাও এভাবে অনিরুদ্ধ আবেগে জীবনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হবে। মোহগ্রস্ত হবে নানা মাত্রায়। জীবনধারা আর মানব সভ্যতা এভাবেই এগিয়েছে। এগিয়ে যাবে।
জীবনের এই কাফেলা বড় অদ্ভূত। একই সাথে এ যেন জীবন-মরণ যাত্রা। জীবনের পরিণতি জানি অনিবার্য। তবুও স্বপ্ন, তবুও স্মৃতি, তবুও বিস্মৃতি, বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। জীবনের আবেশে আমরা কমবেশি মুগ্ধ…। জ্বী না, এই মুগ্ধতাকে আমি মোটেও খারাপ কিছু মনে করি না। সত্যিই, অনেক অনেক সুন্দর এই জীবন, তাৎপর্যপূর্ণ এই পৃথিবী।
এক একটা শিশু যেন এক একটা জীবন-সমুদ্র, এক একটা আশ্চর্য সম্ভাবনা, যেন এক একজন ফেরেশতা, সাক্ষাৎ দেবদূত।
ভালো লাগে সব নিষ্পাপ মানবশিশুদের। নষ্ট এই সমাজের আত্মপ্রতারক সব ভণ্ড বড় বড় পণ্ডিতদের ইদানীং ‘সসম্মানে’ এড়িয়ে চলি। প্রিয় হিন্দি সিনেমা Prahar-এর নায়ক নানা পাটেকারের মতো নিষ্পাপ শিশু ও স্বপ্ন-সুখী তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলতে চাই এক দুর্জেয় কনটিনজেন্ট। এক সত্য সারথির দল। যে মানব-শক্তি-গুচ্ছের প্রত্যেকে হবে অকপট, অকৃত্রিম। ‘কমান্ডো’ পিটারের মতো। অদম্য। সত্য আর ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন। পরিণতির ভয়শূন্য। আপদমস্তক জীবনবাদী। গল্পের সেই শিশুটির মতো নির্ভীক। যে কিনা নগ্ন রাজাকে দেখা মাত্রই বলে উঠবে, “রাজা মশাই, তুমি তো ন্যাংটু। তোমাকে খুব বিশ্রী লাগছে। ঘরে ফিরে যাও। মা’কে বলো, তোমাকে পোশাক পরিয়ে দিতে…