প্রায় বছর দেড়েক সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগার পর গতকাল দুপুরে চবি গণিত বিভাগের প্রফেসর, চবি বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন ড. মো: আবুল কালাম আজাদ স্যার স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন। তখন বাসায় কেউ ছিলো না। আমার ধারণায় এটি সুইসাইড।
দুই-তিন দিন ঔষধ বন্ধ রাখলে তেমন কী আর হবে, এমন ধারণা করে উনার পরিবারের লোকেরা ভুল করেছেন। তদুপরি ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও উনাকে বাসায় একা রেখে যাওয়াও ঠিক হয় নাই। স্যারের মধ্যে বেশ কিছু দিন হতে ডিপ ডিপ্রেশান লক্ষ করছিলাম। সালাম দিলে কোনোমতে উত্তর দিতেন। কখনো দিতেনও না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়তেন। শারীরিকভাবেও স্যার নানা রকমের রোগে ভুগছিলেন।
Centre for Social & Cultural Studies (CSCS) তথা সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র যাদের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিলো ড. আজাদ স্যার ছিলেন তাদের একজন। প্রফেসর আবদুন নূর, প্রফেসর ড. এম এ আজাদী, প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ, প্রফেসর ড. আ ক ম আবদুল কাদের, কেমিস্ট্রির শামসুদ্দীন ভাই আর আমি ছিলাম প্রবাদতুল্য শিক্ষক ড. এম এ সালেহ স্যারের কনসেপ্টচুয়্যাল-একাডেমিক গ্রুপের সদস্য।
কালাম স্যার জেএন ইসলাম স্যারের অধীনে পিএইচডি করেছেন। পিএইচডির ভাইভাতে স্যার কোনো কাগজপত্র সাথে নেন নাই। শ’খানেক পৃষ্ঠায় লেখা উনার নিজের থিসিসটাও নেন নাই। কারণ, সবকিছু ছিলো স্যারের নখদর্পণে। সারা দেশের মধ্যে গণিত বিষয়ে উনার মতো এতো পড়ুয়া ও মেধাবী শিক্ষক খুব কমই আছে। আমার বাসাতে লেখালেখি করার জন্য যে হোয়াইট বোর্ড লাগানো আছে তা কালাম স্যার হতে দেখে শিখেছি।
ড. আবুল কালাম আজাদ স্যার ছিলেন নামকরা মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পরিচিত জামায়াতপন্থী শিক্ষক। সারা জীবন, বিশেষ করে তরুণ বয়সে শিক্ষক হিসাবে বিএনপি-জামায়াত জোট ‘সাদা দলের’ জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমাদের শিক্ষাগুরু বা মেন্টর আবু সালেহ স্যারও ছিলেন ‘লাল মুক্তি বার্তা’ভুক্ত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু জামায়াতপন্থী। সালেহ স্যার ও আজাদ স্যার উভয়েই জামায়াতের নেতাদের ওপর নানা কারণে ততটা আস্থাশীল ছিলেন না। উনারা ছিলেন ইসলামী আদর্শ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অনুসরণীয় সৎ ব্যক্তি।
চবি দক্ষিণ ক্যাম্পাস মসজিদের সামনে একটু আগে স্যারের জানাজা পড়ে আসলাম।
সিএসসিএস-এর উদ্যোগে আয়োজিত প্রত্যেকটা সেমিনারে স্যার পুরোটা সময়জুড়ে উপস্থিত থাকতেন। ২০০১ সালে তোড়জোড় করে শুরু করলেও পরবর্তীতে আমার তখনকার সাংগঠনিক ব্যস্ততার কারণে সিএসসিএস-এর কাজে কিছুটা ভাটা পড়ে। স্যারের অভিযোগ ছিলো, কোনো কারণে জামায়াত আমাকে নিষেধ করেছে বলে আমি নতুন নতুন প্রোগ্রামের উদ্যোগ নিচ্ছি না। এ জন্য স্যার আমার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। আমাকে দায়ী করতেন।
স্যারের এই ভুল ধারণার অবশ্য কারণও ছিলো। সিএসসিএস গঠনের পাশাপাশি ওই সময়ে স্যারের ওয়াইফ রসায়নবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. শাহানারা ম্যাডামকে সভাপতি করে ‘বাংলাদেশ জাতীয় নারী সমাজ’ নামে একটা সংগঠনের ব্যানারে ছাত্রী ও মহিলাদের মধ্যে নতুন ধারায় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ শুরু হয়েছিলো। প্রফেসর ড. মোঃ লোকমান স্যারের ওয়াইফ অধ্যাপিকা শামীমা আফরোজ পুরো বিষয়টাকে তত্ত্বাবধান করছিলেন।
উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কয়েকটা প্রোগ্রাম করার পরে প্রধানত মহিলা জামায়াতের শহর শাখার দায়িত্বশীলাগণের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে এই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। শাহানা ম্যাডাম এ জন্য যাদেরকে দায়ী মনে করতেন এবং যাদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন, খুব সম্ভবত, আমিও ছিলাম তাদের একজন। সে সময় স্যার ও ম্যাডাম উভয়ের সাথে আমার মতাদর্শগত যে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, এক পর্যায়ে নানা কারণে তা আর বজায় থাকেনি।
যাহোক, সেসব আজ অতীত। কিন্তু এসব স্মৃতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ‘বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম: বিশ্বতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট’ বিষয়ের উপর আমার কাছে থাকা স্যারের কয়েকটি ভিডিও বক্তব্যের লিংক দিচ্ছি।
মে, ২০০১ ।। দর্শন বিভাগ, চবি
১ম অংশ (০৪:১০ মিনিট হতে) || ২য় অংশ
নভেম্বর, ২০০১ ।। বনবিদ্যা ইনস্টিটিউট, চবি
আমরা জানি, শরীয়ত ও দেশের আইন অনুযায়ী দুরারোগ্য মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে রোগের প্রবল প্রকোপকালীন কৃত কোনো ‘অপরাধ’কে অপরাধ হিসাবে গন্য করা হয় না।
আসুন, আমরা আজাদ স্যারের জন্য দোয়া করি।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য–প্রতিমন্তব্য
হিমু বড়ুয়া: সিজোফ্রেনিয়া এটা কী ধরণের রোগ?
Mohammad Mozammel Hoque: মানসিক রোগের সর্বশেষ ধাপ।
MoMin: Schizophrenia and Suicide (https://www.webmd.com/schizophrenia/schizophrenia-and-suicide)
Mohammad Mozammel Hoque: চিকিৎসা না করালে রোগ বাড়তে বাড়তে এ পর্যায়ে এসে ঠেকে। বছর খানেকের হসপিটালাইজড চিকিৎসার পরে বাসায় সার্বক্ষণিক কেয়ারে রাখলে রোগের প্রকোপ কমে। একপর্যায়ে রোগী তার এই রোগ থাকার বিষয়টাকে মেনে নেয়, এবং এর সাথে মানিয়ে নিয়ে জীবন চলতে পারে। John Nash, who has given the game theory, was suffering from schizophrenia. “A Beautiful Mind” cinema is made on this theme.
Adhar Rater Musafir: ভাই অনেক লেখাই তো লিখেন। লিখছেন এবং লিখবেন। লিখে যাবেন এ প্রত্যাশাই করব। কিন্তু সবকিছুতেই একটা শব্দের বা নামের আধিক্য, আপনাকে ভাইরাস জ্বরাক্রান্ত বিবেচিত করবে না তো?
Mohammad Mozammel Hoque: কোন শব্দটার? একটু খোলাসা করে বলবেন, প্লিজ!
Siddik: উনি সম্ভবত জামায়াত এর কথা বলছেন স্যার।
Mohammad Mozammel Hoque: এটা বলতে উনার হেসিটেইট করার কী আছে? আমার জীবন, বিশেষ করে কারো সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গেলে শিবির ও জামায়াতের কথা আসবেই। কারণ জীবনের ২৭ বছর এই ধারাটার সাথে একাত্ম হয়ে আমি কাজ করেছি। আমি ও আমার কর্মতৎপরতা, এই সময়কার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত ঘটনাপ্রবাহের এই দিকটার, অনস্বীকার্য অংশ। কেউ, এমনকি আমি নিজে চাইলেও তা মুছা বা অস্বীকার করা অসম্ভব।
কেউ আমার কোনো কথা সম্পর্কে ভাবতেই পারে, এটি এভাবে বলা উনার উচিত হয় নাই। সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব মূল্যায়ন। আমি অসত্য বলেছি কি না, তা শুধু আমার দেখার ব্যাপার। (১) কোনো সমালোচনা নয়, শুধু নিজের কথাটা বলা, (২) শুধু সমালোচনা করা, খুঁত ধরা – এই দুইটাকেই আমি ভুল মনে করি। আমার মতে নতুন কিছু করতে হলে প্রচলিত ধারা হতে নিজের অবস্থান কীভাবে স্বতন্ত্র তা ক্লিয়ার করার জন্য নেতিবাচক ও ইতিবাচক, উভয় ধরনের বক্তব্য থাকতে হয়। অংকের নিয়মের মতো এটি সত্য।
Osman Mas’ud: আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আংকেল এ কাজ করতে পারে? অন্য কিছু উড়িয়ে দেয়া যায় না। যে কন্ডিশন দেখা গেছে ঝুলে থাকা অবস্থায় তা কিন্তু বেশ সন্দেহজনক।
Mohammad Mozammel Hoque: পা বিছানার উপর থাকলেও ভর দেয়া ছিল না। ঘাড়ে ফাঁসের টান লাগার সাথে সাথেই মানুষ ঘাড় ভেংগে মারা যায়।
Osman Mas’ud: তাহলে স্যার, বলেন তো উনি তো ক্লাশ নিতে যেতে চেয়েছিল। ড্রাইভারকে গ্যাস আনতেও পাঠিয়েছিলেন। কিভাবে বুঝবো এটা স্বাভাবিকভাবে হয়েছে! আর এমন মানুষের ক্ষেত্রে চিন্তাই আসে না।
Mohammad Mozammel Hoque: ক্লাস নিতে উনি যান নাই। ম্যাডাম উনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। ছুটা বুয়াকে উনি দশটার দিকে চলে যেতে বলেছেন। গ্যাস নিয়ে আসার পর উনি ড্রাইভারকে ফোনে বাসায় না আসার জন্য বলেছিলেন। ১১টার পরে ম্যাডামের সাথে কথা বলেছিলেন। এরপরে কারো সাথে কোনো যোগাযোগ হয় নাই।
Osman Mas’ud: স্যার, এর মাঝেও কি কোন কিছু হাইড থেকে যাচ্ছে না!! আত্মসম্মানের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই তো না বলা থেকে যায়!! ইতিহাস অন্তত তাই বলে। এমন মাপের মানুষ যদি সত্যি সত্যি হত্যার শিকার হয় (আল্লাহ্ ভাল জানেন) তখন তো অনেক রাঘব-বোয়াল জড়িত থাকে…. তেমন কিছু নয়তো?
মোহাম্মদ সংকেত: স্যার! একজন সুস্থ্য মানুষের আত্মহত্যা করা আর একজন সিজোফ্রিনিয়া রোগীর আত্মহত্যা কি সমান অপরাধ? কিংবা এই রোগীদের এধরনের ক্রিয়াকর্ম কি আদৌই আত্মহত্যা বলে গন্য হবে ? ওরা যেখন এটা করে, অনেক সময় ওরা নিজেরাও বুঝতে পারে না, ওরা আসলে কি করতে চলেছে। আমার কিশোর বয়সে এমন একজন রোগীর মৃত্যু দেখেছি, যে কিনা হাসতে হাসতে নিজের পেটে নিজেই চাকু চালিয়ে দিয়েছিলো, এরপর ২ ঘন্টাপর সে মারা যায়।রোগীর এসব মৃত্যু কি অপরাধ-আত্মহত্যার মধ্যে গন্য হবে??
Mohammad Mozammel Hoque: definitely not.
হাসান রিয়াদ: স্যার, ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত ছবির কন্ডিশন দেখে মনে হয় না এটা আত্মহত্যা। নিশ্চয় আল্লাহ ভাল জানে। আর আপনাদের আরো সাবধান হওয়া উচিত। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়
Mohammad Mozammel Hoque: আমার কাছে এইটা আত্মহত্যা মনে হইছে।