প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহ স্যার ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিউন।
তিনি চবি ইতিহাস বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ৮ দিন আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হাটহাজারী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন পাহাড়িকা আবাসিক এলাকায় স্যারের একটি বাড়ি আছে। সেখানে ইলেকট্রিসিটির ভোল্টেজ খুব কম থাকার ব্যাপারে অভিযোগ করার জন্য তিনি হাটহাজারীতে অবস্থিত পল্লী বিদ্যুতের অফিসে যাচ্ছিলেন। বেপরোয়া গতির কারণে হাটহাজারীতে অবস্থিত শেরে বাংলার মাজারের আগে উনাকে বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাটি টার্ন নিতে গিয়ে রাস্তার উপর উল্টে যায়। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী বাস অত্যন্ত নিকট থেকে হার্ড ব্রেক চাপা সত্ত্বেও ট্যাক্সিটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ৮-১০ হাত টেনে নিয়ে যায়। টেক্সিতে আরোহী ছিল স্যারসহ দুইজন। অন্যদের আঘাত ততটা গুরুতর ছিল না। তাদের তেমন কিছু হয়নি।
এক্সিডেন্টের দুইদিন আগে আর্টস লাউঞ্জে স্যারকে দেখে আমি বললাম, “স্যার, আপনাকে তো হিংসা করা জায়েজ! আপনি রিটায়ারমেন্টে গেছেন। অথচ, দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখনো অনেক ইয়াং।” তিনি হাসলেন এবং আমাকে বললেন, “এদিকে আসো, তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
স্যার রিটায়ার করেছেন। আমিও শিক্ষক রাজনীতি ছেড়েছি প্রায় ১০ বছর। তাই সঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায়, রাজনীতি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কথা বলার জন্য তিনি আমাকে ডাকেন নাই। মুসলিম উম্মাহ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তিনি আমার সাথে কথা বলতেন। সিএসসিএস-এর ব্যানারে কোনো সেমিনার আয়োজন করলে সাধারণত অংশগ্রহণ করতেন। তাছাড়া লেখাপড়া সংক্রান্ত নানা বিষয়ে আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করতাম।
পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছে তিনি একজন লেখাপড়া জানা সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন জেএনইউ আর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে। যে কারো সাথে উনি মন খুলে কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সদালাপী। সিনিয়র শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকতে পারতেন না। দল, মত ও পদবী নির্বিশেষে সবার সাথে সৌজন্য বাক্য বিনিময় করতেন। মোহাম্মদ শাহ স্যার ছিলেন স্পষ্টভাষী মানুষ। যা সত্য, তা নির্দ্বিধায় বলে ফেলতেন। এ কারণে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে কখনো কখনো কারো কারো বিরাগভাজনও হয়েছিলেন। বেঙ্গল মুসলিম ন্যাশনালিজম ছিল উনার একাডেমিক গবেষণা ও ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়।
সে যা-ই হোক, স্যার যখন আমাকে উনার সাথে কথা বলার জন্য ডাকছিলেন তখন আমি কার সাথে যেন কী একটা বিষয়ে আলাপ করছিলাম। কিছুক্ষণ পরে উনি লাউঞ্জ থেকে বকুল স্যারের সাথে চলে যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে বললেন, “মোজাম্মেল, তুমি এগারোটার সময় আমার সাথে দেখা করো।” আমি বললাম, “আপনার রুমে?” তখন তিনি বললেন, “আমাদের তো এখন চাকরি নাই। আমাদের কি রুম আছে? চেয়ারম্যানের রুমে আসো।”
কিন্তু উনার সাথে সেদিন ১১টার সময় দেখা করার কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সাড়ে দশটা থেকে আমার ক্লাস ছিল। খুব সম্ভবত সে কারণে। রোববার যখন শুনলাম স্যার অ্যাকসিডেন্ট করেছেন, তখন স্যারের কাছে বৃহস্পতিবার ১১টায় আমার দেখা করার কথা ছিল, সেটা মনে পড়ল। আমার দুর্ভাগ্য, কী কথা তিনি আমাকে বলতে চেয়েছেন সেটা আর জানা হলো না।
স্যার ছিলেন আমার অসমাপ্ত পিএইচডির প্রথম সুপারভাইজার। থিসিসের টাইটেল চেঞ্জ করা নিয়ে স্যারের সাথে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমার আর পিএইচডি করা হয়ে ওঠেনি। সৎসত্ত্বেও স্যারের সাথে পরবর্তীতে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক অব্যাহত ছিল। বৃহস্পতিবারে স্যারের সাথে আমার উপরোক্ত কথাবার্তা থেকেও সেটা আপনারা আন্দাজ করতে পারেন।
হে আল্লাহ, পরওয়ারদিগার, সদা হাসিখুশি দিলখোলা এই পরোপকারী মানুষটিকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করো!