আমার কাছে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজতত্ত্ব বিভাগে যা পড়ানো হয় তারমধ্যে পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে সভ্যতার সংজ্ঞা নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে মৌলিক গলদ। আমি সমাজতত্ত্বের ছাত্র নই। কিন্তু সমাজতত্ত্ব বিভাগে পড়ছে অথবা পড়েছে এমন স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলে, তাদের বইপত্র দেখে আমার মনে হলো, তাদের একাডেমিক লেভেলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে সভ্যতার সংজ্ঞা, মাপকাঠি বা শর্তের সাথে একাকার করে ফেলা হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে সভ্যতার অন্যতম মৌলিক শর্ত বা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হলে এমনকি কয়েকশত বছর আগের লোকজনও বর্তমান সময়ের তুলনায় অসভ্য ছিল বলতে হয়। আগামী কয়েক শতকের মধ্যে, এমনকি আগামী শতাব্দীতেই পৃথিবীতে অভাবনীয় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যদি তা হয় তাহলে তখনকার অকল্পনীয় পর্যায়ের উন্নততর জীবনযাত্রার তুলনায় আমাদের জীবনযাত্রা সভ্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কম হওয়ার কারণে আমরা যদি আমাদের অতীত মানবগোষ্ঠীকে অসভ্য বা অর্ধসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করি তাহলে আমাদের পরবর্তী জেনারেশনও আমাদেরকে অর্ধসভ্য বা অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
অথচ আমরা জানি, সভ্যতা মানুষের ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। সভ্যতার মৌলিক উপাদানগুলোর পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে পরিপূর্ণতা দানকারী উপাদানগুলোর মধ্যে সভ্যতাভেদে তারতম্য হয়, হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে, বর্তমান মানব সমাজই একমাত্র সভ্যসমাজ, এমন তো নয়। এমনটা কেউ দাবিও করে না, আমরা জানি। কেননা সেটি counterintuitive।
প্রযুক্তিগত উন্নত জীবনমানকে সভ্যতার ক্রাইটেরিয়া বা স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনা করলে মনে হতে পারে, বর্তমান সমাজই একমাত্র বা পূর্ণ সভ্যসমাজ। অথচ পরবর্তীদের তুলনায় যে কোনো ‘বর্তমান সভ্যতা’ সবসময় অপূর্ণ। সভ্যতার বিবর্তন আছে। কিন্তু তারমানে এই নয়, অসভ্যতা থেকে মানুষ সভ্যতায় উন্নীত হয়েছে। আমার কথা হলো, মানুষ বরাবরই সভ্য ছিল। যে কোনো সমাজ, তা যদি মানুষের সমাজ হয়ে থাকে, হোক সেটা প্রাগৈতিহাসিক কিম্বা ঐতিহাসিক, মানবিক সমাজ মানে কোনো না কোনো মাত্রায় সভ্য সমাজ। মানুষের ন্যূনতম সভ্যতা সূচক গুণাবলী সবসময় সব সমাজেই বিদ্যমান ছিল। এই ধারণাটা ‘আদিম ও অসভ্যতার অবস্থা থেকে মানুষের ক্রমান্বয়ে সভ্য হওয়ার’ ধারণা থেকে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
আদিম সমাজ আসলে কেমন ছিল তা আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি না। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ থেকে আমরা বড়জোর তখনকার সমাজে জীবনযাত্রার মান কেমন ছিল তা জানতে পারি। জীবনযাত্রার মান সভ্যতার মানদণ্ড নয়।
সভ্যতার লক্ষণ বা মানদণ্ড হলো কিছু নৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানগত বিষয়ের উপস্থিতি। কথাটা পরিস্কার। প্রয়োজনে বাক্যটি আবার পড়ুন।
হিউম্যান সিভিলাইজেশন সম্বন্ধে স্টাডি করার ক্ষেত্রে যে কাউকে প্রথমে যা মেনে নিতে হবে তা হলো, সভ্যতা একটা মানবিক অনুষঙ্গ। শুধুমাত্র মানুষই পারে সভ্য হতে। মানব সমাজই পারে সভ্যতা বা সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে। গরু-ছাগল তথা ইতর প্রাণীদের সভ্য হওয়ার বা না হওয়ার কোনো ঝামেলা নাই। বস্তুজগৎ প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। তাই বস্তুনিচয়ের সভ্য হওয়ার অবকাশ নাই। মানুষ ছাড়া সব প্রাণী নিছক প্রজাতিগত সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। তাই তাদের সভ্য হওয়ার সুযোগও নাই, দরকারও নাই। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তারা সামাজিক জীবনযাপন করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খানিকটা বুদ্ধিসম্পন্নও হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা কখনোই সভ্যতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। কেন পারে না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।
এ পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষেরাই সভ্যতা গড়ে তুলেছে। এতোটুকু আমরা দেখতে পাই। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী তার natural habitat-এর বাইরে যায়নি, অথবা যেতে পারেনি, অথবা সম্ভব হয়নি।
আদিম মানব সমাজ নিয়ে মূলধারার সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বৈপরীত্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। একদিকে তারা মনে করেন আদিম মানব সমাজ ছিল অসভ্য। ক্রমে তারা সভ্য হয়েছে। অন্যদিকে আবার উনাদেরই একটা অংশ মনে করেন আদিম সমাজ ছিল সাম্যবাদী সমাজ (যে সাম্যবাদ কায়েম করার জন্য তারা দিনরাত স্বপ্ন দেখেন)। তাদের বর্ণনা মোতাবেক, প্রযুক্তিগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য সঞ্চয় বা দখলে নিয়ে পুঁজিবাদ তথা অসাম্যের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল।
প্রযুক্তি এসেছে বিজ্ঞান থেকে। বিজ্ঞান এসেছে দর্শন থেকে। দর্শন এসেছে মানুষের মানবিকবোধ তথা সভ্যতার চেতনা থেকে। ইতিহাস লিখিত হওয়ার আগেও যেমন ইতিহাস ছিল তেমনি বিজ্ঞানের ইতিহাস জানার আগেও বিজ্ঞান চর্চা বা চেতনা ছিল। দর্শনের ইতিহাস লেখা শুরু হওয়ার আগেও দর্শন চর্চা ছিল। ছিল বলেই তা আমরা জানতে পেরেছি। মার্কসের যেসব কথা আমার ভালো লাগে তারমধ্যে একটা হলো, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র আবিষ্কার হওয়ার আগেও জগত দ্বান্দ্বিক নিয়মে পরিচালিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কথাটা এভাবে বলা যায়, সভ্যতা আর সভ্যতার জ্ঞাত ইতিহাস, এক কথা নয়।
আগুন আবিষ্কার এবং খাদ্য রান্না করে খাওয়ার বিষয়টা মানুষের সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ। কিভাবে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখল এবং আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া শিখল সেটা দেখানোর জন্য একটা ভিডিও তৈরি করা হয়েছে দেখলাম। সেটাতে দেখালো, শুকনো কাঠ নিয়ে ঘষাঘষি করতে গিয়ে হঠাৎ আগুন উৎপন্ন হয়। সেই থেকে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখলো। একদিন আগুনের পাশে লোকেরা মাংস খাওয়ার সময় হাত থেকে একটা টুকরা গোস্ত আগুনে পড়ে যায়। কেউ একজন সেটা তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। দেখল, আগুনে পোড়া মাংসটা খেতে ভালোই লাগে এবং সেটা স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। এভাবে মানুষ রান্না করে খাওয়া শিখল।
গল্পটা চিত্তাকর্ষক ও বাস্তবসম্মত। যুক্তি আমাদের এটাই বলে। এভাবে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে মানুষ সবকিছু আবিষ্কার করেছে। কথাটা ঠিক। সমস্যা হলো, মানুষ এসব আবিস্কার কেন করতে গেল? নিছক বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য প্রাণী যা করে মানুষ ততটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না কেন? কেন মানুষ উন্নততর জীবনযাপন করতে চায়? কেন সে মহাকাশ ছাড়িয়ে যেতে চায়? কেন সে সাগরের তলে কী আছে সেটা দেখতে চায়? মানুষের অদম্য আবিষ্কারের নেশা কোত্থেকে এসেছে? এর কারণ কী? মানুষ কেন প্রশ্ন করে? মানুষ কেন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়? কী এমন বিষয় মানুষের মধ্যে সুপ্ত (potentiality) হিসেবে আছে যা তাকে সভ্যতা গড়ে তুলতে বাধ্য করেছে?
বস্তুবাদীদের কাছে এর কি কোনো সদুত্তর আছে? কীভাবে মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলেছে, এই প্রশ্নের উত্তরে দেয়া বর্ণনাগুলো ‘কেন মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলল?’ – এই প্রশ্নকে satisfy করেনা। ‘Why’ format questions cannot be satisfactorily answered by showing any ‘how’ procedure, we know.
মাঝখানে একটা কথা বলে নেই। আদিম সমাজ যদি সাম্যবাদী সমাজ হয়ে থাকে তাহলে তা সভ্য সমাজেরই উদাহরণ হওয়ার কথা। এবং তা যদি হয় তাহলে তো বলতে হয়, আদিম সমাজ ছিল সভ্য সমাজ। যেটা সভ্যতা সংক্রান্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দেখা যায়, মানব সমাজ মাত্রেরই থাকে কিছু নৈতিক চেতনা। যা তাদের আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আচার আচরণের জন্য কাউকে দায়ী মনে করার অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো নৈতিকতার অনুমোদন, উপস্থিতি ও এর প্রয়োগযোগ্যতা। একটা পশু অন্য একটা পশুকে বধ করলেও হত্যাকারী পশুটির কোনো অন্যায় হয় না। ন্যায়-অন্যায় কিংবা ভালো-মন্দের যে অনুভূতি বা বোধ, তা শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
মানুষ কর্তৃক পোশাকের ব্যবহার মানুষের সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। এমনকি নেংটু সমাজ বলতে যাদেরকে আমরা বুঝি তারাও কিছু না কিছু, কোনো না কোনো প্রস্থে পোশাক ব্যবহার করে। কেন করে? অন্য কোনো প্রাণী তো নিজের শারীরিক গঠনের বাইরে কৃত্রিম কোনো আবরণী বা পরিচ্ছদ ব্যবহার করে না।
সব প্রাণী নিজের মতো করে ভাষা ব্যবহার করে। এমনকি বস্তুজগতে জড় পদার্থও এক ধরনের ফিজিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বন্ধন গড়ে তুলে। পরস্পরের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। ভাষাকে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলে বস্তু জগতেও রয়েছে এক ধরনের বস্তুগত ভাষা বা ফিজিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ। ভাষার এ ধরনের সর্বজনীন সংজ্ঞা ভাষার connotation বা মর্মার্থ নষ্ট করে। সেজন্য ভাষা বলতে আমরা সাধারণত মানুষের ভাষাকেই বুঝে থাকি। মানুষের ভাষা বিশেষভাবে উন্নত। এই দৃষ্টিতে ভাষার সাথে রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অনস্বীকার্য সম্পর্ক। তাই বলা যায়, শুধুমাত্র মানুষ প্রজাতিই ভাষার যথার্থ ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে।
মানুষের রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনা। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, জগৎ সম্পর্কে ভাবার এই আকুলতা আর কোনো সত্তার মধ্যে দেখা যায় না। আধ্যাত্মিকতার চর্চা হিসেবে মানুষ যা করেছে তা হতে পারে অনেকখানি ভুল। তৎসত্ত্বেও মানুষের এসব ব্যতিক্রম উদ্যোগ প্রমান করে মানুষ একটা বিশেষ ধরনের প্রাণী। শুরু থেকেই যার ছিল সভ্যতা গড়ে তোলার যোগ্যতা। যার রয়েছে সভ্যতার এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।
এক কথায় মানুষের ইতিহাস হলো সভ্যতার ইতিহাস। বিবর্তনের মাধ্যমে বানর জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে – এমন ধারণা যদি আমরা মেনেও নেই তাতে করে মানুষের ‘মানুষ হিসেবে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে, অর্থাৎ শুরু থেকেই মানুষের সভ্য থাকার’ ধারণা নাকচ হয়ে যায় না। পাশবিক জীবন শেষে মানুষের পূর্বতন প্রজাতি যখন মানুষ হিসেবে এ পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয় তখন সে সভ্য হিসেবেই যাত্রা শুরু করে। সেই বিশেষ সত্তা বা প্রাণীর এই ধরনের ব্যতিক্রমী উন্নয়ন বা অগ্রযাত্রার কারণ হিসেবে আপনি প্রাকৃতিক ‘নির্বাচনে’ বিশ্বাস করুন কিংবা খোদার আদেশে আস্থা রাখুন সেটি আপনার নিজস্ব বিবেচনা বা বিশ্বাস।
মানুষ মানুষ হতে পেরেছে তার নৈতিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানগত, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কারণে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সুসংস্কার বা কুসংস্কার থাকার প্রাসঙ্গিকতা নাই। প্রত্যেক যুগেই মানুষ জগতের উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ জানার জন্য আগ্রহী হয়েছে। কখনো তারা আস্তিক হয়েছে, কখনো তারা নাস্তিক হয়েছে, কখনো তারা সংশয়বাদী থেকেছে। নিজের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা তথা দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রামের বাইরে কি অন্য কোনো প্রাণী এমন মৌলিক ধাঁচে জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত হয়েছে? আমরা তা জানি না।
আমরা শুধু এতোটুকু বলতে পারি, সভ্যতার ব্যাপারটা মানুষ নামক এই প্রাণীগোষ্ঠীর জন্য শুরু থেকেই ছিল একান্তভাবে নির্ধারিত বা এক্সক্লুসিভ। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মানুষের সভ্যতার উন্নয়নে অবদান রেখেছে। ব্যাপারটা স্রেফ এতটুকু। প্রযুক্তির ব্যবহারকে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করার প্রচলিত ভুল পদ্ধতিকে সংশোধন করে নিলে যুক্তিপ্রিয় কারো এ কথা মানতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়– history of human civilization is actually history of human race.
মানুষ প্রথমে অসভ্য ছিল, এরপরে ক্রমান্বয়ে সভ্য হয়েছে – এই তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত হাইপোথিসিস কোত্থেকে আসলো, তা জানতে চেয়েছিলাম সমাজবিজ্ঞান পড়ুয়া এক স্টুডেন্টের কাছে। সে আমাকে বলল, কিছু কিছু অসভ্য জনগোষ্ঠী দেখে নাকি বুঝা যায়, এরা হলো আদিম অসভ্য মানবগোষ্ঠী তথা আমাদের উত্তরসূরী। উত্তরটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং কন্ট্রাডিকটরি।
এই উত্তরের সমস্যা দুইটা–
(১) আদিম গোষ্ঠী হিসেবে যাদেরকে দেখানো হচ্ছে, যাদেরকে অসভ্য বা সভ্যতার স্পর্শ বঞ্চিত হিসাবে দাবি করা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উন্নত জীবনযাপনকে সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে নৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক এবং জ্ঞানগত মৌলিক বিষয়গুলোকে বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়া সেই মানবগোষ্ঠীসমূহ আসলে ন্যূনতম মানে হলেও সভ্য বটে।
(২) অতি নগণ্য ব্যতিক্রমকে কেন তারা স্ট্যান্ডার্ড মনে করছে? Deviant position-কে কেন তারা original position মনে করছে? সম্ভবত, যেহেতু সেটি তাদের মনমানসিকতা ও রুচির সাথে মিলে। আমরা জানি, প্রত্যেকে যার যার দৃষ্টিভঙ্গি বা worldview তথা paradigm অনুসারে সত্য বা ফ্যাক্টকে গ্রহণ করে।
মনে করি, একজন ব্যক্তি ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থলে উক্ত রক্তমাখা ছুরি হাতে একজন ব্যক্তিকে পাওয়া গেল। শুধু এতটুকু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আপনি সেই ব্যক্তিকে হত্যাকারীও মনে করতে পারেন কিংবা তাকে উদ্ধারকারীও মনে করতে পারেন। অর্থাৎ একই তথ্য হতে একেকজন ব্যক্তি একেক রকম জ্ঞান লাভ করতে পারে।
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো তথ্য-প্রমাণের দিক থেকে প্রতিসম বা counterbalanced। তাই এসব বিষয়ে একেক মানুষ একেক রকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির দৃশ্যমান ব্যাপক ভিন্নতাও তার সভ্যতাগত উন্নয়নের অন্যতম মাত্রা।
একটা ঘটনা ও পর্যবেক্ষণ স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিম্বা প্রত্যেক পর্যবেক্ষণ তৎপরবর্তী পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে– এমন মনে করার সমস্যা হলো আমাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাদের গঠনগত সীমাবদ্ধতা দ্বারা সীমিত (delimited)। তাই কোনো কিছু সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের সাথে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব বা বিশ্বাসকে মিলিয়ে জ্ঞান তৈরি করে থাকি।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে সভ্যতার অগ্রগতির সহায়ক হিসেবে যদি আমরা বিবেচনা না করি, অর্থাৎ, সভ্যতার শর্ত থেকে যদি প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে বাদ দেই, তাহলে সহজেই বুঝতে পারি, মানুষ প্রথম থেকেই সভ্য ছিল। সভ্যতা মানব সমাজের মূলধারা। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মানবসভ্যতার উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমানে যাদেরকে আমরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখতে পাই তারা হলো মানবসভ্যতার বিচ্যুত বা দুর্বল অবস্থার উদাহরণ। যুক্তি-বুদ্ধি অন্তত তাই বলে।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মূলধারার একাডেমিক চর্চায় মানবসভ্যতার ভুল ইতিহাসকে উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কেউ একে চ্যালেঞ্জ করেনি দেখে অবাক লাগছে। আমি এখানে যা কিছু বলেছি, তা আমাদের চেনাজানা উদাহরণ থেকে মূলত যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি। যারা দ্বিমত পোষণ করবেন তারা দয়া করে পাল্টা যুক্তি দিবেন। একগাদা বোগাস রেফারেন্সের বোঝা চাপিয়ে দিবেন না আশা করি।