হেগেলের তিনটি সূত্র আছে যেগুলো সাধারণভাবে তাঁর অন্যতম ছাত্র মার্ক্সের নামে প্রচারিত। এগুলোর মধ্যে পরিমাণের গুণে রূপান্তর হলো দ্বিতীয় সূত্র।

বস্তুর ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ ঘটলে নতুন গুণের আগমন ঘটে। যেমন– একটি ঘড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলোকে ‘নির্দিষ্ট’ভাবে একত্রিত (সংযোজন অর্থে) করলে নতুন একটা কিছু পাওয়া যায়– সময়।

এই দৃষ্টিতে গুণ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে বটে তবে তা বস্তু-অতিরিক্ত, কিন্তু বস্তু-নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। গুণ বস্তুর অংশও নয়। ঘড়ির যন্ত্রাংশের মধ্যে ‘সময়’ বলে কোনো পার্টস নাই।

বস্তু থেকে গুণ আলাদা কিনা– এই নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে।

মার্ক্সিস্টরা মনে করেন, মন হলো মস্তিষ্কের উপজাত বা বাই-প্রডাক্ট। মন দেহকে প্রভাবিত করতে পারে না। দেহই মনকে গঠন করে। এই তত্ত্বের বিপক্ষে অনেক আলোচনা আছে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মার্ক্সের মতানুসারে, মনের স্ট্যাটাস বস্তুর গুণের সমতুল্য।

মন নিয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারায় ব্যাপক ভেরিয়েশন আছে। মন ও আত্মাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজিতে mind, soul, spirit ইত্যাদি আলাদা শব্দ থাকলেও তত্ত্বীয় আলোচনায় সবকিছুকে মাইন্ড বা মন হিসাবে ট্রিট করা হয়।

গুণকে যদি বস্তুনির্ভর কিন্তু বস্তুর অতিরিক্ত (যেমন– ঘড়ি ও সময়ের ধারণা) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ‘প্রাণ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও আত্মার ধারণা নাকচ হয়ে যাবে না। কারণ, আত্মা দেহকে ভর করে থাকে, অথচ তা দেহাতীত।

আত্মার আর একটি বড় প্রমাণ হলো– মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও দেহ ইনট্যাক্ট থাকে। তাহলে পরিবর্তনটা কী, যাকে আমরা মৃত্যু বলছি? সেটি হলো আত্মার অনুপস্থিতি।

আত্মাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু পরবর্তী কোনো জীবন আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপরে আমি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিলাম তাতে মন বা আত্মার উপস্থিতি অনিবার্য।

এখানে মার্ক্সিস্টরা বলতে পারেন– দেহের অপরিহার্য (বস্তুগত) ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলেই ‘মৃত্য’ ঘটেছে। অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তাই নতুন সিন্থেসিস হয়েছে। যেটিকে বলা হয় নিগেশন অব নিগেশন। এখানে মনের বা আত্মার কোনো প্রসঙ্গ অবান্তর।

প্রশ্ন হলো– এই ‘বিপরীতের ঐক্য’ কেন নষ্ট হলো? যদি অন্য কোথাও কোনো ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে এখানে এফেক্ট পড়েছে বলা হয়, তাহলে ‘বেগিং দ্যা কোয়েশ্চন’ হতে বাঁচার জন্য প্রশ্ন করতে হবে– সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন? এভাবে আপনাকে ‘কেন’ প্রশ্নের অন্তহীন পরম্পরাতে গিয়ে এক পর্যায়ে ‘অসীম’ নামের এক ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করতে হবে (অবচেতনে এটলিস্ট); অথবা স্বীকার করতে হবে, এই বস্তু তথা দেহে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য এটি ফাংশনিং ছিল। যেটির অনুপস্থিতিতে বস্তু তথা দেহটি সজীব থাকা সত্ত্বেও ফল করেছে। যে ঘটনাকে আমরা মৃত্যু বলছি।

দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ বা সামগ্রিকভাবে দেহ অচল হওয়ার কারণে মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যু ঘটার কারণে দেহের অঙ্গ-প্রত্যংগসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তাহলে কী সেই ব্যাপার, যা বিয়োজিত হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেহ আর কাজ করে না, ধীরে অথবা দ্রুত অচল হয়ে পড়ে?

আমাদের প্রগতিশীল বিজ্ঞানবাদী বন্ধুরা স্বীকার করতে না চাইলেও জীবনের জন্য অপরিহার্য এই ‘একটা কিছু’ হলো আত্মা, যার সঠিক পরিচয় অজানা। যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ফলাফলকে দেখা যায়। যেটি না থাকলে জীবনের সব শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সংক্ষেপে আত্মা হলো জীবনীশক্তি। আত্মাকে যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে দেহে অবস্থিত কিন্তু দেহ-অতিরিক্ত, কখনো কখনো দেহকে নিয়ন্ত্রণকারী মনকে অস্বীকার করার কোনো কারণ নাই। কথাটি বিপরীতক্রমেও সমসত্য।

আমাদের সুশীল বন্ধুদের একটা অংশ আত্মাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাদের ভয় আত্মা বা মনের জানালা দিয়ে না আবার ধর্মের ‘দূষিত’ বাতাস ঢুকে পড়ে! না জানি এতে ইহজাগতিকতার ‘অতি পবিত্রতা’ ক্ষুণ্ন হয়ে পড়ে!

এভাবে ভাবুন: বস্তু → শক্তি → গুণ → মন → আত্মা।

সুধীবৃন্দ, অতি বিশ্বাসীরা অদেখা আত্মাকে যেমন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও চতুর্পাশ্বস্থ বস্তুনিচয়ের চেয়েও বেশি দেখা মনে করেন, তেমনি আপনারা যারা প্রগতিশীলতার (নিশ্চয়ই মননে) দাবি করেন, আপনারা যুক্তির বাহিরে গিয়ে আত্মা বা মনকে অস্বীকার ও বস্তুকে আত্মার সকল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে ‘বস্তু’ নামে জপ করা হতে বিরত থাকবেন। অনুরোধ। দেহাতিরিক্ত কিছু যদি থেকে থাকে, তাকে স্বীকার করে নেয়া ভালো। সেজন্য ঈশ্বরবাদী হতে হবে এমন কোনো কথা নাই। ধর্মের (আসলে ধর্মবাদীদের) পক্ষে চলে যেতে পারে– এই আশংকায় আত্মা বা মনকে যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করা ধর্মবাদীদের অজ্ঞতা ও অসহিষ্ণুতার মতোই একটা অগ্রহণযোগ্য ও অনভিপ্রেত চরমপন্থা; বলা যায় এক ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা।

টীকা: ‘বিজ্ঞানবাদী’ পরিভাষাটি আমার দেয়া। এর সঠিক ইংরেজি কী হবে বুঝতে পারছি না। তবে ধারণাটা এ রকম: বিজ্ঞানবাদী হচ্ছেন তারা, যারা বিশ্বাস করেন– বিজ্ঞান আমাদেরকে একটি পূর্ণ জীবনাদর্শ দিতে পারে। বিজ্ঞান আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তরদানে সক্ষম। যা পাওয়া যায় নাই তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞানই হলো একমাত্র পন্থা।

আসলে বিজ্ঞান আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তি আমাদের কাজে লাগে। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানসংশ্লিষ্টতা হলো প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রাপ্তি। এর বাইরে বিজ্ঞানের যত তত্ত্ব সবই ফিলোসফিক্যাল, নট ফিলোসফি ইটসেলফ; বাট দিস ট্রেন্ড ইজ ফিলোসফিক্যাল। আমার এক সহকর্মী সায়েন্টিফিক রিয়্যালিজমের উপরে কাজ করে ডক্টর হয়েছেন। তিনি জোরেশোরে বলেন, বিজ্ঞানকে যতটা অবজেক্টিভ দাবি করা (বিজ্ঞানবাদীরা) হয়, বিজ্ঞান ততটা অবজেক্টিভ নয়। শুধুমাত্র পরীক্ষণলব্ধ ফলাফলই (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞান নয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব নির্মাণই লক্ষ্য, যাতে অদেখা থাকে অনেকটুকু। এ প্রসঙ্গে পপার, কুন, ফিয়ারাব্যান্ড প্রমুখের লেখা পড়ে দেখা যেতে পারে।

নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

কিরিটি রায়: ধন্যবাদ। প্রিয়তে রাখলাম।

বিজ্ঞান আমাদের স্থিত বস্তু সমূহের ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টে করে মাত্র। বিজ্ঞান নিজে কিছু সৃষ্টি করে না। বরং সৃষ্ট বস্তুসমূহের বহুমাত্রিক ব্যবহার করে মাত্র।

সকল কিছু সৃষ্ট। তার বিশ্লেষণই হলো বিজ্ঞান। তবে আত্মার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত জ্ঞান কেন বিজ্ঞান হবে না?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কারণ, আত্মা বা মন নিয়ে ল্যাব-টেস্ট হয় না। অবশ্য সমাজবিজ্ঞান যে অর্থে বিজ্ঞান, সে অর্থে আপনার ‘আত্মার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত জ্ঞান’কেও বিজ্ঞান বলা যেতে পারে।

অবশ্য ‘আত্মার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত জ্ঞান’ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন, বুঝি নাই।

আত্মা বা মন সম্পর্কে আলোচনা বিভিন্ন সাবজেক্টে করে: মনোবিজ্ঞান, মনোদর্শন, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি।

অত্যল্প মন্তব্যের মধ্যে সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

যদি ‘বাজারী বিষয়ের’ পোস্ট হতো তাহলে হয়তোবা এতক্ষণে প্রশংসা ও নিন্দার বাণীতে সয়লাব হয়ে যেতো।

চ্যাংরামী করা ব্লগারদের এড়িয়ে কীভাবে মননশীল ব্লগারদের কাছে পৌছা যায়, ভাবছি। কারণ, পোস্ট তো আর বেশিক্ষণ ফ্রন্ট পেইজে থাকে না। আর আমার টার্গেট রিডাররাও ব্লগ খুলে ২৪ ঘণ্টা বসে থাকে না।

ব্লগে আমি নতুন, তাই কোনো পরামর্শ থাকলে বলবেন।  আবারো ধন্যবাদ।

উদাসী স্বপ্ন: হেগেল তথা মার্ক্সের তিনটি সূত্র পড়লাম, বড়ই অদ্ভূত ধরনের। কোয়ান্টিটিভলি প্র্যাক্টিক্যাল এনালাইসিস না করে সবকিছুর উপর ওয়েল জেনারেলাইজড সূত্র মনে হলো। তবে মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। অনেকটা এরকম– সবকিছুর প্রতিসম বা ভারসাম্য রক্ষাই কেন হবে? তাহলে তো এটাকে শক্তির নিত্যতা ধরে নিলেই হয়ে যায়। তাহলে প্রায়োগিক দিক থেকে ঘাড় ঘুরাবার জন্য কেনই বা এরকম থিওরেটিক্যাল হাইপো দিয়ে কেনো এতো আলোচনা?

যাই হোক, যদি আত্মার ব্যাপারটা আমি দু নম্বর সূত্র অনুসারে বিচার করি, তাহলে আমার মনে হয় প্রথমটাকে একটু এড়িয়ে যাচ্ছি অথবা একটা ক্লিঞ্চ অনুভব করছি। কারণ, আত্মাকে আমরা কীভাবে ডিফাইন করবো– কনা তত্ত্ব নাকি তড়ঙ্গ তত্ত্ব? তবে এটা শিওর, এটা হয়তোবা কোনো শক্তির সন্নিবেশ অথবা হাইয়ার অর্ডার ডাইমেনশনাল কোনো প্রোপার্টি। তাহলে দেখা যাচ্ছে তাকে আমরা কীভাবে নালিফিকেশনে (পজিটিভ অথবা নেগেটিভ যাই বলেন না কেন) টানবো, অথবা বস্তু ছাড়া গুণ হিসাবেই বা কীভাবে ডিটেকশনে আনবো?

আপনাকে একটা কথা বলি, জ্ঞান এবং বয়সে আপনি আমার বড়। অনেক বড় বড় মনীষী ছিলেন যারা কথা বললে মানুষের কানে যেতো না, এমন অনেক কবি আছেন যাদের লেখা তাদের জীবদ্দশায় পড়তো দূরে থাক তার নামই জানতো না। কিন্তু মানুষ করে গেছে তার কাছে যা সত্য এবং উচিত মনে হয়। আপনি লিখেছেন আপনার মতোন, কেউ পড়ুক বা না পড়ুক সেটা দেখার বিষয় নয়, আপনি যে আপনার ভিউটা প্রকাশ করেছেন সেটাই অনেক বড়। আপনি লিখুন, লিখতে থাকুন এটাই চাওয়া!

পোস্টটির সামহোয়্যারইন লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *