Ø জামায়াত-শিবিরের পক্ষে কি ৮৩ সালে ফেরত যাওয়া সম্ভব? বর্তমান আন্দোলনকে পপুলার মুভমেন্টে রূপান্তর করা কি সম্ভব?

জামায়াতের হাই কমান্ড এটা মনে করে কিনা যে, something is problem there? এটা হলো বুনিয়াদী ব্যাপার। যদি তারা মনে করে যে- কোনো প্রবলেম নাই, তাহলে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে জামায়াত কেন ১০ শতাংশের বেশি জনপ্রিয়তা পায় না?

Ø এক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনাল জামায়াত লিডারশীপ হয়তো বলবে, problem is within the concept of people about Islam.

আসলে ব্যাপারটা ঠিক নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে একেবারে সাধারণ থেকে শুরু করে শিক্ষিত মানুষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী যখন ইসলামের কথা বলে তখন তারা এর সাথে থাকে না, বরং দূরত্ব বজায় রাখে। আসলে পাবলিক সাপোর্টের দিক থেকে জামায়াত এক ধরনের legitimacy crisis-এ ভুগছে। এই বৃত্ত থেকে জামায়াত গত ৩৮ বছরে বেরুতে পারেনি এবং যদি major reform না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও পারবে না। opinion maker হলো সাধারণ মানুষ এবং সুশীল সমাজ, elite person. এই দুই শ্রেণীর মানুষের কাছে জামায়াতের একটা legitimacy crisis আছে।

Ø এই ব্যাপারটা কেমন?

এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চেয়েও legitimacy থাকাটা ভিন্ন একটা ব্যাপার। জামায়াতে ইসলামীকে socio-political বাস্তবতা বুঝতে হবে। এজন্য জামায়াতের soul-searching থাকা উচিত।

বাংলাদেশে নাস্তিকদের সংখ্যা যদি ৫ শতাংশও হয়, তাহলে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে তারা হলো ৮০ লক্ষ। যদিও ৮০ লক্ষ একটা বড় সংখ্যা কিন্তু ৯৫ শতাংশ মানুষ তো আস্তিক। তাহলে কেন জামায়াতে ইসলামী legitimacy crisis-এ ভুগছে? আসলে এটা শুধুমাত্র ৭১ ইস্যু নয়। ৭১ সালে জামায়াতের মতো অন্য যারা একই ভূমিকা পালন করেছে, তারা তো এ ধরনের সংকটে নাই।

বিভিন্ন দিক থেকেই জামায়াতের legitimacy crisis রয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকেও জামায়াতের এক ধরনের legitimacy crisis রয়েছে। জামায়াত প্যান ইসলামিজমের কথা বলে। অথচ পাকিস্তানকে একটা আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টার যে মডেল, সেটা একটা টেরিটোরিয়াল ব্যাপার। এটা প্যান ইসলামিজমের সাথে মিলে না।

জামায়াতের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের একটা উদাহরণ হলো জামায়াত পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময় এর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানকেই আবার একটা মডেল রাষ্ট্র হিসেবে গঠনের চেষ্টা করছে। এমনকি পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টাও করেছে। মূলত ইসলামিক সেন্স থেকে জামায়াত ৭১ সালে ওই ধরনের ভূমিকা পালন করে। যদি এটাই হয়, তাহলে তো এক ধরনের কন্ট্রাডিকশন রয়েছেই।

Ø এক্ষেত্রে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হতে পারে, যেহেতু জামায়াত একটা পজিশনে এসেছে, তাই সবাই জামায়াতের নাম নিচ্ছে এবং অন্যরা যেহেতু পজিশনে নাই, তাই তাদের নাম কেউ নিচ্ছে না।

স্বাধীনতার আগে-পরে কমিউস্টদের ভূমিকা, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এ ক্ষেত্রে প্রাসংগিক। স্বাধীনতার পর জামায়াতের পুনর্গঠনের ইতিহাস দেখেন। সবশেষে ৭১ ইস্যুতে কমিউনিস্ট দলগুলোর সাথে জামায়াতের তুলনা করেন। ১৯৬৮/৬৯ সালের দিকে ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিংহ) এবং ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (আব্দুল হক – তোয়াহা) নামে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে সিরাজ শিকদার গঠন করেন পূর্ব-বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। এভাবে অনেকগুলো গ্রুপ গড়ে উঠে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে সিরাজ শিকদারের গ্রুপটা স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে। মোটাদাগে যারা তরুন ছিল, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে।

চীনপন্থী কমিউনিস্টদের বিভিন্ন গ্রুপ জামায়াতের মতো বা জামায়াতের চেয়েও বেশি করে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। এদের গুরু ছিলেন মাওলানা ভাসানী। এমনকি মোহাম্মদ তোয়াহা গ্রুপ ১৯৭৮/৮০ সাল পর্যন্ত নিজেদেরকে পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য তালুকদার মনিরুজ্জামানের Radical Politics in the Emergenceof Bangladesh নামের বইটিকে পড়া দরকার। কমিউনিস্টরা মূলত ইন্ডিয়া-চায়না কনফ্লিক্টে চীনের পক্ষে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এটা করতে গিয়ে তারা প্রচুর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধারাও তাদেরকে হত্যা করেছে।

স্বাধীনতা-উত্তর জামায়াতের পুনর্গঠনের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান ছিল রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের জন্য বেনিফেক্টর, আর জামায়াত বেনিফিশিয়ারি। কারা কারা রাজনৈতিক দল করতে পারবে কিংবা পারবে না, তা অনুমোদনের জন্য জিয়া Political Parties Regulation (PPR) ঘোষণা করেন। ওই সময় জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ বিরোধী সবাইকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ দিয়েছিলেন। এই PPR-এর অধীনে জামায়াত নিজ নামে রাজনৈতিক দল পুনারায় চালু করার অনুমতি চেয়ে তিনবার দরখাস্ত করেছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামী নামে দল পুনর্গঠনের অনুমোদন দেননি। সে জন্য পরে আইডিএল (Islamic Democratic L eague) গঠন করা হয়। IDL থেকে বেরিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে জামায়াত যখন নিজ নামে চালু হলো, তাতে জিয়ার সমর্থন ছিল না। এ জন্য জিয়া তার মৃত্যুর আগে জামায়াতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ছিলেন আইডিএলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কিছুদিন পর জামায়াতের কিছু লোক উদ্যোগ নিয়ে compelling situation-এ আইডিএলের মধ্যে রিকুইজিশন মিটিং ডেকে এক ধরনের ক্যু করেন। ওই মিটিংয়ে সিদ্দিক আহমদকে বাদ দিয়ে জামায়াতের মাওলানা আব্দুর রহীমকে আইডিএলের সভাপতি করা হয়। অথচ, মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর শেখ মুজিবের সাথে তাঁর এক ধরনের জেন্টলম্যান্ট এগ্রিমেন্ট হয়েছিল যে, তিনি রাজনীতি করবেন না। কিন্তু জামায়াত রাজনীতিতে আসার জন্য মাওলানা আব্দুর রহীমকে ব্যবহার করে আইডিএল-এ ভাঙ্গন ধরায়। এই ভাঙ্গনের ফলে মাওলানা সিদ্দিক আহমদ আইডিএল-এর এক অংশের নেতা হন, আর মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব হলেন আরেক অংশের নেতা।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের শুরুর দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে দেশব্যাপী জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়, জামায়াতের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করা হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ছিল সরাসরি সরকার নিয়ন্ত্রিত। পদাধিকার বলে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা। এরশাদ সাহেব তখন এ পদে ছিলেন।

একই সময়ে জামায়াত মাওলানা আব্দুর রহীমকে আইডিএল থেকে পদত্যাগে রাজী করাতে না পেরে ‌‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নামে দল ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সমর্থন ছিল না। কাজী নুরুজ্জামান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান তাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন এবং জামায়াতকে তিনি দমন করবেন। কিছু দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার ফলে এটা তিনি করে যেতে পারেননি।

Ø অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নাগরিকত্ব লাভের পর বাইতুল মোকাররম গেটে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্যে ৭১ ইস্যুতে এপোলজি করার ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এটা চ্যালেঞ্জ করেন।

অধ্যাপক গোলাম আযম এমনটা বলেননি। বরং ৯২ সালে দৈনিক ইনকিলাবে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে গোলাম আযম ৭১ ইস্যুতে জামায়াতের ভূমিকাকে লেজিটিমেট করার চেষ্টা করেছেন। একটা অন্যায়কে সোজা স্বীকার করা একটা ব্যাপার। কিন্তু অন্যায়ের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো এবং সে যুক্তিকেই হাইলাইট করা তো আসলে কনফেশন না। যেসব পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন থেকে শুরু করে সবাই, তারা প্রকাশ্য জনসভায় ওই বিষয়টা ফোকাস করে জনগণকে বলেছে যে, তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল এবং সে জন্য তারা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এই কাজটা জামায়াত ছাড়া সবাই করেছে । অথচ সবাই চাচ্ছিল জামায়াত এটা করুক।

জামায়াত-শিবিরের অভ্যন্তরীণ একটা বিষয়ের তথ্য হলো, ৮০’র দশকের শুরুতে মাওলানা আবু তাহের শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ৭১ ইস্যু নিয়ে একটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করা হয়। পরবর্তীতে উনার পরে যখন আব্দুল কাদের বাচ্চু কেন্দ্রীয় সভাপতি হন, তখন তিনি ওই কমিটির কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন শিবির নেতাদের মধ্যে যে তিনজন এতে বাধা দেয়, তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের শাহজাহান চৌধুরীও ছিলেন। তারা এ কমিটিকে কাজ করতে দেয়নি। যে ইস্যুগুলো তখন সমস্যা হিসেবে ছিল, সেগুলো এখনও রয়ে গেছে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে যে, আহমদ আব্দুল কাদের বাচ্চুই ছিলেন সঠিক।

তিনি জামায়াতর উত্থান থেমে যাওয়ার কারণ নিয়ে কিছু বলতে চাই। আব্বাস আলী খান ‘একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ’ শীর্ষক একটা বই লিখেছেন। সে হিসেবে জামায়াতের উত্থান থেমে যাওয়াকে যদি আমরা পতন হিসেবে ধরি, তাহলে এর মূল কারণ হলো, জামায়াতের সাংগঠনিক অহংবোধ এবং দম্ভ। জামায়াতে ইসলামী হলো বিএনপির বেনিফিশিয়ারি। কিন্তু বিএনপির সাথে যখন জামায়াতের দ্বন্দ্ব শুরু হলো তখন বিএনপি, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জামায়াতের দায়িত্বশীল পর্যায়ের শিক্ষিত-ভদ্রলোকেরা যত আক্রমণাত্মক কথা বলেছেন, সেগুলো এতোটাই অশালীন ও অসুন্দর ছিল যে শেখ হাসিনাও বর্তমানে এই ভাষায় কথা বলেন না। ওই সময়ের সাপ্তাহিক সোনার বাংলা ও দৈনিক সংগ্রামে এর উদাহরণ রয়েছে।

জামায়াতের আদর্শের তাত্ত্বিক ত্রুটি এবং একই সাথে তত্ত্বের সাথে বাস্তবের বৈপরিত্ব হলো জামায়াত যে ধরনের পিউরিটানিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটা আসলে কখনোই এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ, বাংলাদেশ একমাত্র মুসলিম দেশ, যার সব আশপাশে কোনো মুসলিম দেশ নাই। এই বিষয়টি জামায়াতের বিবেচনায় থাকতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিও বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতকে কাজ করতে হবে।

পিউরিটানিক ফর্মে জামায়াত টিকে থাকবে এবং সাংগঠনিকভাবেও শক্তিশালী হবে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে না। সেটা করতে হলে জামায়াতকে অ্যাডাপ্ট করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের এথনিক আইডেন্টিটিকে soul searching করে অ্যাডাপ্টেশনের মাধ্যমে যদি জামায়াত নিজেকে সংস্কার করে, তাহলে হয়তো তাদের দিয়ে হবে। কিন্তু dilemma হলো, জামায়াতে ইসলামী পিউরিটানিক ইসলামের কথা বললেও নিজেরা কিন্তু তার মধ্যে নেই।

True Islamicspirit-এর আওতায় থেকে যদি কোনো কিছু করতে হয়, তাহলে মদীনা সনদকেই সামনে রাখতে হবে। মদীনা সনদের গুরুত্ব এতো বেশি যে, যদি ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ না হতো, তাহলে হয়তোবা মদীনা সনদকে কোরআনের আওতাভুক্ত করা হতো। ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সাম্য। ‘প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে ইবাদত কবুল হবে না’- এ ধরনের হাদীসগুলোতে তো প্রতিবেশী মুসলিম নাকি অমুসলিম, তা বলা হয়নি। ইসলামের এই সাম্যবাদী চেতনার বিপরীতে পিউরিটানিক ইসলামপন্থী জামায়াতের নেতাদের সামাজিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, মূলত তারা একটা ভোগবাদী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তাদের চরিত্রের মধ্যে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায় না, যেগুলো তারা বলে বেড়ায়।

এক ধরনের সরলিকরণ করা যায় যে, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (সা) যে ধরনের আহ্বান জানিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্যই মার্কস বা মার্কসিস্টরা কাজ করছে। সাম্য এবং ন্যায়বিচারের পথ থেকে সরে আসার কারণে জামায়াতে ইসলামী নিজেই আভ্যন্তরীণভাবে সমাজের মধ্যে এক ধরনের legitimacy crisis-এ ভুগছে। ৮০’র দশকে জামায়াত বাইরে থেকে ফান্ড এনে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপ করার বিষয়টাকে এজন্যই প্রাধান্য দিয়েছিল যে, মনে করা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিপ্লবীরা বের হবে। কিন্তু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের সাথে সমানতালে স্পিরিট বা মননশীলতা ডেভেলপ না হওয়ার কারণে ইনফ্রাস্ট্রাকচারগুলো সে ধরনের বিপ্লবী সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং এসব ইনফ্রাস্ট্রাকচার ভাগ-বাটোয়ারা করে নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন সুবিধা অর্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Ø জামায়াতের ভবিষ্যত

জামায়াতের ভেতরে একটা প্যাসিমিস্ট অ্যাপ্রোচ আছে। জামায়াতের ১৫/১৬ জন নেতার ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরেও জামায়াত যদি কোনো সহিংস পথে না গিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে হয়তো জামায়াতে ইসলামী একটা সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। আসলে এটা হওয়ার নয় যে, কোনো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে যখন একটা অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে, তখন অবশ্যই সে দলের লোকেরা বসে থাকবে। তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবেই। এই প্রতিক্রিয়া দেখানো এতোটাই বেশি হতে পারে যে, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন যে ধরনের গন্ডোগল হচ্ছে, বাংলাদেশও সে ধরনের পরিস্থিতিতে পরে যেতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, আমেরিকা কখনোই চায় না, বাংলাদেশ পুরোপুরি ইন্ডিয়ার বলয়ে চলে যাক।

জামায়াতকে এভাবে ক্র্যাশ করার পরে জামায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে- ইন্ডিয়ার এ রকম একটা ভুল রিডিং আছে। একইভাবে এই ভুল রিডিং আছে দেশের কিছু থিংক ট্যাংক এবং শাহবাগ আয়োজকদের। তাদের এই আইডিয়াটা সঠিক নয়। কারন, জামায়াত সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে যদিও ইসলামী আন্দোলন হিসেবে সামাজিকভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে দুর্বল হবে।

পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই শেখ হাসিনার উচিত হয়নি। এর ফলে রাজনীতির যে মিডল সেন্টার, যে ইকুইলিব্রিয়াম, তা অলমোষ্ট নষ্ট হয়ে গেছে। বিএনপির মধ্যে মেজরিটি হলো ডানপন্থী মানসিকতার লোকজন যারা আদতে র‍্যাডিক্যালিস্ট না। আওয়ামী লীগের মধ্যে মেজরিটি প্রগতিশীল ধারার হলেও তারাও কিন্তু র‍্যাডিক্যালিস্ট না। radical right হিসাবে যখন জামায়াতকে আঘাত করা হলো, তখন আওয়ামী লীগের উচিত ছিল মিডলে যারা আছে, তাদেরকে আশ্বস্ত রাখা। তা না করে যখন মিডলের লোকদেরকেও আঘাত করা হয়েছে, তখন পাশের র‍্যাডিক্যালরা মিডল পয়েন্টের কমান্ড নিয়ে নিয়েছে।

আসলে মিডলে যারা আছে (বিএনপি), তাদের চাওয়াটা কি? তাদের চাওয়া হলো ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। দেশের মধ্যে স্বাভাবিক পরিবেশ থাকলে র‍্যাডিক্যালরা পাশে থাকবে। আর যারা মডারেট তারা দেশ পরিচালনা করবে, আওয়ামীলীগ বা বিএনপি- যে কোনো একটা দলের তরফ থেকে। কিন্তু এখানে একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং এই শূন্যস্থান র‍্যাডিক্যালদের দিয়ে পূরণ হওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে চারটা শীর্ষ এনজিও’র সম্মিলিত একটা অনুষ্ঠানে রাশেদ খান মেনন অভিযোগের সুরে বলেছেন, ‘সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়েও জাতীয় নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছে।’ অথচ এটাই হলো বাস্তবতা। সুশীল সমাজ চাচ্ছে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে দেশের চলমান অস্থিতিশীলতা আরো গড়াক। তারা চাচ্ছে, একটা নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটা স্বাভাবিক হোক।

জামায়াতকে একটা পক্ষে চলে আসা উচিত- হয় একটা কনস্টিটিউশনাল পার্টি, নয়তো একটা রেভ্যুলশনারি পার্টি। যদি তারা স্বাভাবিক রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তাদের আর দশটা পার্টির মতো কনস্টিটিউশনাল পার্টি হওয়া উচিত। তাদের তাত্ত্বিক অস্বচ্ছতা দূর করা উচিত। বাঙ্গালিত্ব এবং মুসলমানিত্বের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত খুব খারাপ কিছু না। কিন্তু আদর্শিক জায়গা থেকে যদি দেখা হয় বা ইসলামের জায়গা থেকে যদি দেখা হয়, তাহলে জামায়াতের মধ্যে মেজর প্রবলেম আছে।

ফেসবুকে প্রথম প্রকাশিত

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *