একজন প্রশ্ন করেছেন: “তোমাকে পেয়েছি ইউসুফের রূপে, নূহের কিশতিতে”– এই পংক্তি নিয়ে আপনার মতামত আশা করছি। ইউসুফ (আ) শারীরিক রূপ-লাবণ্য ও আকৃতিতে আল্লাহকে পাওয়া কতটা যৌক্তিক? সেক্ষেত্রে হিন্দি ঐ গানটিকেও বিবেচনা করতে বলবো– “তুঝ মে রাব দেখতা হ্যায় ইয়ারা ম্যায় কিয়া কারু, সাজদে সার ঝুকতা হ্যায় ইয়ারা ম্যায় কিয়া কারু” (অর্থাৎ তোমার মাঝেই আমি রবকে দেখি, বন্ধু আমি কী করব, সিজদায় মাথা অবনত হয়ে যায়, বন্ধু আমি কী করব?)

আমি বলেছি: “তোমাকে পেয়েছি ইউসুফের রূপে, নূহের কিশতিতে”– কাব্য বা গীতবাণী হিসেবে এগুলো ঠিকই আছে বলে আমার মনে হয়। ‘তোমাকে পেয়েছি ইউসুফের রূপে’– এর একটা মানে হতে পারে, ইউসুফের রূপের মধ্যে আল্লাহকে কল্পনা করা। অবতারবাদ বলতে আমরা যেটা বুঝি। হিন্দু ধর্মে যেটা কৃষ্ণের ক্ষেত্রে বলা হয়। তারা মনে করে, কৃষ্ণ হচ্ছে বিষ্ণুর অবতার বা মানবীয় রূপ। এই অর্থে ‘তোমাকে পেয়েছি ইউসুফের রূপে’ কথাটা ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য, বাতিল এবং শির্ক।

আবার, ‘তোমাকে পেয়েছি ইউসুফের রূপে’ কথাটার আরেকটা তাৎপর্য হতে পারে, ইউসুফের রূপ যিনি সৃষ্টি করেছেন, ইউসুফ রূপের মধ্যে তাঁকেই আমি খুঁজে পাই, দেখতে পাই বা পেয়েছি।

কথাটাকে যদি পরবর্তী অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তো কোনো সমস্যা নাই। এটি বরং, এক অর্থে, স্বয়ং কোরআনেরই অ্যাপ্রোচ। সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা one-to-one অর্থ গ্রহণ না করে দূরবর্তী অর্থ গ্রহণই সাধারণত মিন করা হয়। রূপক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা বলতে যা বোঝানো হয়। ওয়ান-টু-ওয়ান বা আক্ষরিক অর্থে কোনো কিছু গ্রহণ করা হলো আইনী ভাষার বৈশিষ্ট্য।

তদুপরি, কোনো কথাকে বক্তা বা লেখক যেই অর্থে বুঝিয়েছেন সেই অর্থেই তা গ্রহণ করা উচিত। মানি বা না মানি, সমর্থন করি অথবা বিরোধিতা করি, সঠিক মনে করি কিংবা ভুল মনে করি, সেটা ভিন্ন বিষয়। লেখক বা বক্তা যা আদৌ বোঝাতে চাননি, তারই ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যের বুৎপত্তিগত বা অপ্রচলিত অর্থকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নিয়ে সেটাকে লেখকের বক্তব্য হিসেবে দাবি করা, এরপর সেটাকে নাকচ বা খণ্ডন করা– এটি এক ধরনের স্ট্র-ম্যান ফ্যালাসি। স্ট্র-ম্যান ফ্যালাসি হলো, আসল ব্যক্তিকে মোকাবেলা না করে খড়কুটা দিয়ে প্রতিপক্ষের একটা মূর্তি বানিয়ে সেটাকে কুপোকাত করা। এরপর দাবি করা, আমি তো আমার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছি।

ভাষা একটি বিবর্তনশীল মানবিক বিষয়। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত অর্থের ‘বিকৃত’ চর্চার মাধ্যমে নতুন ভাষা বা অপর ভাষায় নতুন শব্দ গড়ে উঠে। এমনকি একই ভাষার মধ্যেই এটি ঘটে। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যে এটি ফ্রিকোয়েন্টলি ঘটে। সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে ক্রিয়েটিভ লোকেরা একেকটি শব্দকে সেটির অরিজিনাল অর্থ হতে খানিকটা বা অনেকখানি বিচ্যুত করে নিজেদের সুবিধামত নতুন অর্থে সেটাকে ব্যবহার করে। এতে প্রচলিত শব্দের অর্থের ক্ষেত্রে নতুন দ্যোতনা সৃষ্টি হয়। অন্য ভাষা হতে নেয়া শব্দসমূহের ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘অর্থ-বিচ্যুতির’ মাত্রা হয় অনেক বেশি।

এমনও হতে পারে, কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধকে লেখক ব্যবহার করেছেন প্রচলিত অর্থে, আর পণ্ডিতি করে সমালোচকরা সেটাকে ধরে নিচ্ছেন উৎপত্তিগত অর্থে। এটি স্ট্রম্যান ফ্যালাসির সাথে সাথে অনুরূপ আরেকটি ফ্যালাসিকে ইনভলভ করে। সেটা হলো জেনেটিক ফ্যালাসি। কোনো কিছুর উৎপত্তিগত অর্থ ও বৈশিষ্ট্যকেই সেটির একমাত্র ও মূল অর্থ বা বৈশিষ্ট্য মনে করাটাকে বলে জেনেটিক ফেলাসি। উপরেই বলেছি, ভাষার প্রাণময়তার দাবি হলো, প্রচলিত অর্থ হতে শব্দ বা ফ্রেইজের কমবেশি বিচ্যুতির মাধ্যমে নতুন টার্ম তইর হওয়ার সুযোগ থাকা। তত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত টার্মের বুৎপত্তিগত তাৎপর্য অনুসন্ধান যতটা জরুরি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা ততটাই ড্যামেইজিং।

যারা সংস্কৃতির অনুরাগী নয়, তারা এই ধরনের মিনিং শিফটিংয়ের আকামটা বেশি করে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত– এসবকে যারা বেহুদা, বাহুল্য বিষয়, অর্থহীন ও বেদরকারি বলে মনে করে, আমার দৃষ্টিতে, তাদের জীবনটাই ব্যর্থ। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তারা বোঝা। দিনশেষে তারা হয় সুবিধাবাদী, ভোগবাদী ও বস্তুবাদী চরিত্রের। ভালো করে তাদের জীবনধারাকে যদি আপনি লক্ষ করেন তাহলে তাদেরকে পাবেন আচারবাদী, অক্ষরবাদী ও কট্টরপন্থী হিসেবে। তারা সামাজিক জীবন যাপন করে। কিন্তু, প্রকৃত জীবনবোধ থেকে বঞ্চিত। এরাই দেখবেন বিশেষ কোনো ধর্ম কিংবা আদর্শ বা জাতীয় চেতনাকে নির্যাতন ও শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে।

তেমন পরিস্থিতিতে এক ধরনের দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে এরা স্বৈরশাসকদের দোসর হিসেবে কাজ করে। মানবিক অনুভূতিশূন্য এসব সাহিত্য-মূর্খের হাতে মানুষের জীবন, আবেগ, অনুভূতি ও মানবিক মর্যাদা মোটেও নিরাপদ নয়। বরাবরই এরা ক্ষমতাপন্থী। নিজেরা ক্ষমতা পেলে এরা হয়ে উঠে সর্বাত্মকবাদী। কারণ, মানুষের মন জয় করা এবং মানুষের কাছে আদর্শ প্রচার করার জন্য যে ধরনের মননশীলতা ও সুকুমারবৃত্তি থাকা চাই, সেটা তাদের মধ্যে ততটা থাকে না। তাই, স্বৈরাচারী হয়ে উঠা ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না।

সবকিছুকে যারা আইনী কাঠামোর ভিতর থেকে দেখে, মানুষ সম্পর্কে তারা ভুল করে। কেননা, একটি ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আইনী কাঠামো যতটা গুরুত্বপূর্ণ, আইন প্রয়োগের পূর্বশর্ত হিসাবে সংশ্লিষ্ট আইন বা আইনী কাঠামোর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও এর ভিত্তি ইত্যাদিও ততধিক গুরুত্বপূর্ণ। আইনের সারনির্যাস বুঝার জন্য সংবেদনশীল মনন থাকা চাই। সংবেদনশীল মননের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে মানুষের কল্পনা শক্তির মাধ্যমে। সাহিত্য মানুষের কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটায়। মানুষকে যুক্তিবুদ্ধি চর্চায় উৎসাহিত করে। কল্পনা শক্তির কারণেই মানুষ সৃষ্টিশীল হয়ে উঠে। সৃজনশীলতা না থাকলে ‘মানুষ’ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠে না।

তাই, সমাজের যত উপরের লেভেলেই প্রতিষ্ঠিত থাকুন না কেন, যারা সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুরক্ত নন, তারা অন্তর্গতভাবে দাস-মনোভাবাপন্ন। মুক্তবুদ্ধি চর্চার অভাবে তারা হয়ে পড়ে সমাজ ও সামাজিকতার দাস। সেটা হতে পারে আদর্শবাদ বা ধর্মের অজুহাতে। স্বাধীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই হবে কল্পণাপ্রবণ, আবেগপ্রবণ, সৃজনশীল ও অনুসন্ধানী চরিত্রের। যা আছে তাকে গ্রহণ করেই তারা জীবন কাটিয়ে দেয় না। আদর্শকে যারা আবেগের দৃষ্টিতে না দেখে আইনের দৃষ্টিতে দেখে, তারা হতে পারে না কিছুটা বোকা। হ্যাঁ, খানিকটা বেকুব, বোকা ও অবুঝ হওয়াটাই কিন্তু আদর্শের দাবি, ঈমানের দাবি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তাদেরকে (মানে মুনাফিকদেরকে) যখন (প্রপারলি) ঈমান আনতে বলা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা কি ওইসব বোকাদের মতো করে ঈমান আনবো?’ আল্লাহ তায়ালা এরপরে বলেছেন, ‘আসলে, এরাই তো বোকা। যদিও তারা তা বুঝে না।’

প্রসঙ্গ সূত্রে এ কথাগুলো বললাম। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশেষ করে গীতকাব্যের মধ্যে গণহারে শির্ক খোঁজার যে প্রবণতা এক শ্রেণীর লোকদের মধ্যে দেখা যায়, এই ব্যাখ্যার আলোকে পুরো বিষয়টাকে বুঝার চেষ্টা করলে আশা করি এ ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা অনেকখানি কমে আসবে। এর মানে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে শির্ক-বেদাত অনুসন্ধান করা যাবে না– এমনটি আমি বুঝাচ্ছি না। মানুষের প্রত্যেক জ্ঞানকাণ্ডই হতে পারে সত্য দ্বারা উদ্ভাসিত। হতে পারে মিথ্যা দ্বারা কলুষিত। এমনকি বিজ্ঞানও এ ধরনের নরম্যাটিভ ফেনোমেনা হতে মুক্ত নয়।

তাই, মনে রাখতে হবে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত বিষয়ক কোনো কিছুতে মতাদর্শগত সমস্যা থাকা হলো এক জিনিস; আর সে বিষয়টার শিল্প বা সাহিত্যমান ভিন্ন জিনিস। আদর্শ বা নৈতিকতার দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট কথাটা ভালো হলেই যে তা শিল্প ও সাহিত্যমানের দিক থেকেও ভালো হবে, এমন কোনো কথা নাই। এর বিপরীতে, উচ্চমানের শিল্প ও সাহিত্যমানসম্পন্ন কোনো কিছুও হতে পারে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের। সাহিত্যমানকে বাদ দিয়ে শুধু সত্যমানের কথা দিয়ে ভালো মানুষ তৈরির সালাফী প্রবণতার উদাহরণ হলো, তরল খাবার বাদ দিয়ে কেবল পুষ্টিকর শুকনো খেতে দিয়ে কাউকে সুস্থ্ ও সবল হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা। বুঝতেই পারছেন! বেশি কিছু আর না বললাম।

সে যাই হোক, ‘তোমাকে দেখেছি ইউসুফের রূপে’ বাক্যটির কাব্যিক অর্থ বুঝতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে না, সংশ্লিষ্ট লেখক বা বক্তা কথাটাকে প্রথমে উল্লেখিত আক্ষরিক অর্থে বুঝিয়েছেন।

এ বিষয়ে সালাফী ধারার অনুসারী তথা লিটারালিস্ট ঘরানার লোকদের ভুল বুঝার আশংকা ও এতদ্বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো– এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ও মননশীলতার বিরোধী এই ধর্মবাদী গোষ্ঠীর অপরিশীলিত চিন্তাভাবনা ও অনুচিত দাবির কাছে আত্মসমর্পণ না করে তাদেরকে এভয়েড করা। অথবা, তাদেরকে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মননশীলতার প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যাপকভাবে চর্চিত সাধারণ অ্যাপ্রোচ ও প্যাটার্নের বিষয়ে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত ও শিক্ষিত করে তোলা।

আমাদের আজকের এই আলোচ্য বিষয়টি সামগ্রিকভাবে বুঝার কাজে নিম্নে উদ্ধৃত দুটি হাদীস অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ।

১। আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার ওলীর সাথে শত্রুতা করে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। আমার বান্দার প্রতি যা ফরজ করেছি, তা দ্বারাই সে আমার অধিক নৈকট্য লাভ করে। আমার বান্দা নফল কাজের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে। অবশেষে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি।

যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে; তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে; তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে; এবং তা পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলাফেরা করে।

সে আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা দেই। সে যদি আমার নিকট আশ্রয় কামনা করে, তাহলে আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যা করার ইচ্ছা করি, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি না, কেবল মুমিনের আত্মার ব্যাপার ছাড়া। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে। আর আমি তার মন্দকে অপছন্দ করি। (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিক্বাক, হাদীস নং– ৬৫০২। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনূদিত সহীহ বুখারী, ১০ম খণ্ড, হাদীস নং– ৬০৫৮)

২। আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তায়ালা (কোনো এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে) বলবেন– হে আদম সন্তান! আমি রোগাক্রান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। সে বলবে– হে আমার প্রতিপালক! তুমি তো বিশ্বজগতের প্রভু, আমি কী করে তোমার সেবা করতে পারি? আল্লাহ তায়ালা বলবেন– তোমার কি মনে নেই যে, আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত হয়েছিলো? তখন তুমি তার খোঁজ-খবর নাওনি। যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে আমাকে সেখানে পেতে।

অতঃপর অপর এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা বলবেন– হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খেতে দাওনি। সে বলবে– হে প্রতিপালক! তুমি তো সারা জাহানের মালিক, আমি কীভাবে তোমাকে খাওয়াতে পারি? আল্লাহ তায়ালা বলবেন– তোমার কি স্মরণ নেই যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলো? কিন্তু তুমি তাকে খেতে দাওনি। তোমার কি এ কথা জানা ছিলো না যে, তুমি তাকে খেতে দিলে আমার কাছে এর সওয়াব পাবে?

অতঃপর তিনি (অপর একজনকে) বলবেন– হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পান করাওনি। সে বলবে– হে প্রভু! আমি তোমাকে কীভাবে পান করাতে পারি? তুমি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক! আল্লাহ তায়ালা বলবেন– আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিলো, তুমি তাকে পানি দাওনি। যদি তখন তুমি তাকে পানি পান করাতে তাহলে এখন তা আমার কাছে পেতে। (হাদীসে কুদসী সমগ্র, ১৭৯/৪৮, তাওহীদ পাবলিকেশন, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ২১৪, ঢাকা, বাংলাদেশ)

ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Ahsan Habib: মাশাআল্লাহ্! ভালো পর্যবেক্ষণ। শব্দালঙ্কার, উপমা, উৎপ্রেক্ষার মিশেলে সৃজনশীল চিন্তা ও কর্ম, শিল্পচর্চা, সাহিত্য ইত্যাদ বুঝতে না পেরে অথবা ভুল বুঝে বয়কট করে চললে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়বে। এতে মানবিকতার পরাজয় হবে শুধু। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না! কৃষি ঘরানার বাঙ্গালী-বাংলাদেশী উৎসব-মেলা এসবে কী হয়– এ নিয়ে নাক সিটকে নিজের ঘরে ছিটকিনি মেরে বসে রইলাম! একদিন আমাদের প্রজন্ম থাকবে না, কী এমন আদর্শের বীজ বুনছি, ব্যবধান বাড়তে বাড়তে কী হবে, কেন এতো ব্যবধান! আমার পরিমিত লবণ আর মরিচ না হলে চলে না। তাই জেনে বুঝে টেবিলে লঙ্কার গুড়ো আর লবণদানী দেয়া থাকে। সেটুকু আমরা নিজেরাই নিয়ে নিতে পারি। কিন্তু ‘নিয়ে খাবো না’ বলে খালি পেটে বেরিয়ে আসলাম। কিন্তু আমাদের প্রিয় সন্তানরা উপোষ করে থাকবে কতদিন? একদিন ওরাই বাইরে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লে কী করবো?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অসাধারণ মন্তব্য। ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় আহসান হাবিব ভাই

Amim Mohammad: রূপক অর্থ ব্যক্তির দর্শন ও বিশ্বাস অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।

একজন মুসলিম কবি বা সুফির দৃষ্টিতে সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহকে দেখা বা খুঁজে পাওয়া বা পাওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর সৌন্দর্য, রহমত, সাহায্য, কুদরত, আয়াত‌ (নিদর্শন) ইত্যাদি দেখা, খুঁজে পাওয়া বা পাওয়া বুঝাবে। আর একজন সর্বেশ্বরবাদী দেখবে স্বয়ং প্রভু সৃষ্টিরূপে হাজির হয়েছে বা স্বয়ং প্রভু সৃষ্টির ভিতরে বিদ্যমান বা সৃষ্টিই স্বয়ং প্রভুর অংশ। তারা সৃষ্টি থেকে স্রষ্টাকে আলাদা করে বুঝতে পারে না।

অন্যদিকে, বর্তমানে মুসলিমদের একটি বড় অংশ অতি সালাফী প্রভাবের কারণে এইসব রূপক শব্দগুলোকে শিরকী কালাম বলে বিশ্বাস করে। অপরদিকে, এই রূপক শব্দগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাজার সংস্কৃতিতে বেশি ব্যবহৃত হয়। যার কারণে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সুফি কবিতা ও গান চর্চা ইসলামপন্থীরা করে না। তাই এইসব নিয়ে সমাজে ফেতনা সৃষ্টি হচ্ছে। বুঝে না বুঝে কোনো কিছুকে শির্ক বলে ফতোয়া জারি করা হচ্ছে।

Umme Salma: ঠিক এই জন্যই আমি রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ নিয়ে প্রচিলত আক্ষরিক ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারি না। এই কবিতাটাকে আমার শেলির ‘Ode to the West Wind’ কবিতাটির সমগোত্রীয় বলে মনে হয়। এখানে বৈশাখ বা West wind মানে কোনো কিছুর শুরু বা সূচনা বোঝায়। আর তার মানে পুরানো সব অপছন্দের হাত হতে মুক্তি প্রত্যাশা করা। এই কবিতাগুলোতে তাই সময়টা personified এবং তারা মেটাফোরিক্যাল অর্থ বহন করে। আর একজন কবির সবসময় একটা পজিশন থাকে। রবীন্দ্রনাথ বা শেলি কি তাদের ধর্ম বা সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে লিখবে? আমাদের সাহিত্যজ্ঞান আজ এমন যে আমরা সবকিছুতে ইসলাম-অনৈসলাম আনি। আর হয় তাকে নিয়ে শোরগোল করি, না-হয় তাকে জায়েজ করার চেষ্টা করি। এই জায়েজীপনাকে আবার আমরা ইসলামাইজেশন নাম দিয়েছি। আর তার প্রয়োগ চলছে ইংরেজি সাহিত্যে!!! আমার কাছে ব্যাপারটা বড় হাস্যকর লাগে। যে সাহিত্য আদতে এবং প্রকৃতিগতভাবে Christian faith (and non-faith) and English nature-culture কেন্দ্রিক, তারে আমরা কীভাবে ইসলামাইজ করবো? একটু আধটু কম্পারেটিভ স্টাডিজ আমাদের কি জ্ঞান সৃষ্টিতে কাজে লাগবে? এটা কি একটা চটকদার কিন্তু মূল্যহীন প্রচেষ্টা নয়? সাহিত্য নিয়ে আমাদের দৈন্যতার প্রকাশ নয়? এটাকে আমার বিকিনির পরিবর্তে বুরকিনি প্রতিস্থাপনের মতোই মনে হয়।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সাহিত্যের কোনো বিষয়কে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা হলো নিতান্তই না-হক ও বোকামিপূর্ণ কাজ। এ ধরনের মনোভাব হলো সাহিত্যবিরোধী মনোভাব।

এক তরুণ ইসলামপন্থী তার বন্ধুকে বলেছে, সে কোনো সাহিত্য, গল্প বা উপন্যাস পড়ে না। কারণ, সেগুলোতে, তার ভাষায়, ‘মিথ্যা’ কথা বলা হয়। ‘বানানো কথা’ লেখা হয়। এই ধরনের ‘কাল্পনিক’ কোনো কিছু সে শুনতে ও পড়তে নারাজ। সে মনে করে, যেহেতু তার কাছে ওহীর জ্ঞান আছে তথা কোরআন-হাদীস আছে, তাই আর কোনো সাহিত্য পড়ার দরকার নাই।

অথচ, বিশেষ করে কোরআনকে দাবি করা হয়, আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য! কোরআনের অন্যতম অলৌকিকত্ব বা মুজিযা হিসেবে দাবি করা হয় এর সাহিত্য মানকে। কিন্তু, কোরআনে বর্ণিত এ ধরনের শব্দ ও বাক্যগুলোকে তারা রূপক অর্থে গ্রহণ করতে নারাজ। সবকিছুকে যেন আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা!

আক্কাস আলী: কোরআন শরীফে অনেক কিছুই রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: খুবই স্বাভাবিক। এটি যদি একটি উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য হয়ে থাকে, তাহলে সাহিত্যের যে অনুষঙ্গগুলো আছে সেগুলো এটার মধ্যে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কোরআনকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে দাবি করে এর উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকগুলোকে যারা অস্বীকার করতে চায়, তাদের ব্যাপারটা আমার ঠিক বুঝে আসে না।

আক্কাস আলী: যারা অস্বীকার করে তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় কোরআনের সবকিছু আক্ষরিক ধরে নেবার অবস্থানটা অনেকটা যৌক্তিক। কারণ, প্রায় ৯৯ শতাংশ মুসলমান কোরআনকে জীবনবিধান (Law of Life) হিসেবে ধরে নেয়। ইসলাম শিক্ষার বইতে তাই শিখানো হয়। এমতাবস্থায়, কোন আয়াত (মানে বিধান!) রূপক, আর কোন আয়াত রূপক নয় এবং কোন আয়াত প্রাসঙ্গিক, কোনটা নয়– সেসব বিতর্কে যাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। আমি অবশ্য এসব জীবনবিধান-টিবনবিধান মূলক ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক ধারণা থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছি।

Nur Hosain Majidi: সাহিত্য, বিশেষত কবিতা হচ্ছে ভাষা ও তার শব্দাবলীর তাৎপর্যের গভীরতা, সূক্ষ্মতা ও ব্যাপকতা ব্যবহার করে সমাজচিত্র এবং সাহিত্যিক বা কবির চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ ও অনুভূতির প্রতিফলন। সুতরাং, সাহিত্য ও কবিতায় সাহিত্যিক ও কবির অন্তঃকরণের চিত্রই প্রতিফলিত হয়; সে যদি নাস্তিক্যবাদী বা শিরকী আক্বীদা পোষণ করে তাহলে তার লেখায় তারই প্রতিফলন ঘটবে। আর সে যদি ইসলামে ‘প্রকৃত ঈমানের’ অধিকারী হয় তাহলে তার লেখায় তার ঈমানেরই প্রতিফলন ঘটবে। তবে কোনো সাহিত্যিক বা কবি তার লেখায় যা বুঝাতে চেয়েছেন, তা থেকে সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে এবং কেবল সাহিত্য বিশেষজ্ঞগণই সঠিকভাবে তার অর্থ গ্রহণ করতে পারেন। যেমন : অতীতের অনেক সুফী কবিই আল্লাহর প্রতি স্বীয় ভালোবাসা বুঝানোর জন্য তাঁকে স্বীয় ‘মা’শূক্ব’ (প্রেমাস্পদ) বলেছেন, ‘বোত’ও (মূর্তি) বলেছেন; খোদাপ্রেমকে ‘শরাব’ (মদিরা), মসজিদকে ‘বোতকাদেহ্’ (মূর্তিশালা), নবী করীমকে (সা.) ‘সাক্বী’ (যে পান করায়) বলেছেন। এসব কিছুকে এসব রূপক অর্থেই গ্রহণ করতে হবে, আভিধানিক অর্থে নয়।

কোরআন মজীদ নিজেকে বালাগ্বাত ও ফাছাহাতের (সংক্ষিপ্ততম, প্রাঞ্জলতম বক্তব্যে সূক্ষ্মতম, ব্যাপকতম ও গভীরতম তাৎপর্য প্রকাশের) মানদণ্ডে মু‘জিযা হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং এ মানদণ্ডে কোরআনের যে কোনো সূরার সমমানসম্পন্ন একটি সূরা রচনার জন্য সমগ্র মানব ও জিন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। সুতরাং, কোরআনের সঠিক তাৎপর্য জানতে হলে ক্ল্যাসিক্যাল আরবী ভাষা ও সেই সাথে নিজ নিজ মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। সে লক্ষ্যে সাহিত্য ও কবিতার সঠিক তাৎপর্য জানাও অপরিহার্য। অর্থাৎ নিজের জন্য কবি বা সাহিত্যিক হওয়া অপরিহার্য না হলেও এ অঙ্গনে বিশেষজ্ঞ বিচরণকারী হতে হবে।

তবে কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে দ্বীনী বিষয়াদিতে দলীল গ্রহণ করা যাবে না এবং তাদেরকে অনুসরণীয় গণ্য করা যাবে না। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لا يَفْعَلُونَ إِلا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا

“আর কেবল বিভ্রান্তরাই কবিদেরকে অনুসরণ করে। (হে রাসূল!) আপনি কি দেখেননি যে, তারা (কবিরা) প্রতিটি প্রান্তরেই উদভ্রান্ত হয়ে বিচরণ করে এবং এও (কি দেখেননি) যে, তারা বলে যা তারা করে না? অবশ্য (কবিদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে, যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে ও আল্লাহকে অনেক বেশি স্মরণ করেছে, তারা ব্যতীত।” (সূরা আশ্-শূ‘আরা: ২২৪-২২৭)

প্রকৃত ঈমানদার কবিরা ব্যতিক্রম এ অর্থে যে, তারা প্রতিটি প্রান্তরে উদভ্রান্তের মতো বিচরণ করেন না এবং এমন কথা বলেন না যা তাঁরা করেন না। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, একজন প্রকৃত ঈমানদার কবি অনুসরণীয় হবেন। কারণ, একজন প্রকৃত ঈমানদার কবি ‘ইলমী যোগ্যতার বিচারে অনুসরণীয় নাও হতে পারেন। কিন্তু অনেককে এ ধরনের কবিদেরকে অনুসরণীয় হিসেবে গণ্য করতেও দেখা যায়।

তাছাড়া ঈমানেরও স্তরভেদ আছে এবং সর্বোচ্চ ‘ইলমী যোগ্যতা ব্যতীত ঈমানের সর্বোচ্চ স্তরের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয় (যদিও সর্বোচ্চ ‘ইলমী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি হয়তো সর্বোচ্চ স্তরের ঈমানের অধিকারী নাও হতে পারে বা কাফেরও হতে পারে)।

এমনকি ‘ঈমানদার’ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও এমন অনেকে আছেন, যারা কবি হিসেবে সর্বোচ্চ স্তরের ও কালোত্তীর্ণ, কিন্তু তাদের আক্বীদায় গলদ আছে এবং তারা তাদের লেখায় রূপক অর্থে নয়, আক্ষরিক অর্থেই গলদ আক্বীদা প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের কবিদের লেখা থেকে ভাষা-সাহিত্য ও প্রকাশক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নেয়া যাবে, কিন্তু আবেগে আপ্লুত হয়ে তাদের কথাকে দ্বীনী বিষয়ে দলীল হিসেবে গ্রহণ করলে গোমরাহ হতে হবে।

যুক্তিবিজ্ঞানে কোনো কিছু প্রমাণকারী বক্তব্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় এবং সে সবের মধ্য থেকে কেবল বুরহান ও জিদাল গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিগণিত এবং খিত্বাব (আবেগময়ী বক্তৃতা), শের (কবিতা) ও মুগ্বালাত্বাহ (অপযুক্তি) প্রমাণ হিসেবে প্রত্যাখ্যাত বিবেচিত হয়েছে।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *